#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
কোন কিছুর আওয়াজ পেয়ে মুখর আরবাজ সহ সবাই মেহবিনের কেবিনে গেল। ওখানে যেতেই ওরা দেখল টুলটা উল্টে পরে আছে। মেহবিনের দিকে তাকাতেই দেখল মেহবিন চোখ খুলে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কেমন যেন হাঁসফাঁস করছে বোধহয় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখর তাড়াতাড়ি করে ডক্টর ডাকলো ডক্টর এসেই মেহবিনকে দেখে একটা ইনজেকশন দিল। মেহবিন আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে চোখ বুঝলো। ডাক্তার জানালো আউট অফ ডেন্জার মেহবিন চিন্তার কোন কারন নেই। কথাটা শুনে সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। তবে আরবাজ খুশি হওয়ার সাথে এটাও বুঝতে পারলো টুলটা মেহবিনের হাত লেগে পরেনি কেউ এসেছিল এখানে। অতঃপর অ্যাম্বুলেন্স আসতেই মেহবিন কে সেখানে উঠানো হলো। গন্তব্য কোন এক ভালো হাসপাতালে । এদিকে মেহবিন জানতেও পারলো না কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে সে আর কাদের পেছনে ফেলে যাচ্ছে সে।
______________
সকাল আটটায় তাজেল আসলো নওশিকে নিয়ে মেহবিন কে দেখতে। এখানে এসে জানতে পারলো মেহবিন এখানে নেই রাতেই ওকে ট্রিটমেন্ট এর জন্য ওর হাজবেন্ড অন্য হাসপাতালে নিয়ে গেছে কিন্তু কোথায় গেছে তারা জানে না। সব শুনে তাজেল একদম চুপ হয়ে গেল। তখন নওশি বলল,,
“চল তাজেল আমরা বাড়ি যাই এখন।”
তাজেল কিছু বললো না ও হাঁটা ধরলো বাড়ির দিকে। হেঁটেই বাড়ি যাবে সে। নওশি বুঝতে পারলো তাজেলের খুব খারাপ লাগছে সাথে রাগ ও লাগছে। তাই নওশি তাজেলের কাছে গিয়ে বলল,,
“ডাক্তার আপার জামাইয়ের ওপর রাগ করিস না তাজেল। ডাক্তার আপার ভালোর লাইগাই তো ডাক্তার আপারে নিয়া গেছে অন্য জায়গায়।”
তাজেল এবার ও কিছু বললো না। সে হাঁটতেই লাগলো।
___________
“কিরে আরবাজ তুই আসলি কখন? তোর না হাসপাতালে থাকার কথা।”
সকালের খাবার খাওয়ার জন্য নিচে আসতেই উক্ত প্রশ্নটি শেখ আমজাদ করলেন। শুক্রবার সে বাড়ি ফিরেছে আজ যাবে আবার। আরবাজ চেয়ারে বসতে বসতে বলল,,
“কাল রাতেই ফিরেছি সবাই ঘুমিয়েছিল তাই কাউকেই জাগাইনি।”
“কেন? চলে এলি কেন?”
“ডক্টর মেহবিন এর হাজবেন্ড ওনাকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেছে তাই ।”
“কোথায় নিয়ে গেছে?”
“তা জানি না উনি বলেন নি।”
“ওহ আচ্ছা।”
তখন রাইফা বলল,,
“আরবাজ ভাইয়া ডক্টর মেহবিন এখন কেমন আছে?”
“কালকে রাতেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল বলে ডক্টর বলেছে আউট অফ ডেন্জার চিন্তার কোন কারন নেই। তিনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। তা সবাই তো এসে পরেছে বাবা আর মিশু কোথায়?”
“ঐ তো আসছে দুজন।”
মিশু প্রতিদিনের তুলনায় আজ অনেকটা শান্ত সে চুপচাপ এসে তার বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে পড়লো। শেখ শাহনাওয়াজ ও বসলেন। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
“আরবাজ ডাক্তারের কি খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবা। ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
তখন মিশু বলল,,
“আমি ফুলকে দেখতে যাবো বাবা।”
তখন আরবাজ বলল,,
“তোমার ফুল এখানে নেই। তোমার ফুলের জামাই তাকে নিয়ে গেছে অন্য জায়গায়।”
“ফুলের জামাই ও আছে বাজপাখি?”
“হুম আছে।”
“কই এতোদিন তো দেখলাম না।”
“কাল হাসপাতালে এসেছিল।”
তখন আরিফা জামান বললেন,,
“মেয়েটা যে বিবাহিত বুঝতেই পারি নি। কখনো বলেও নি আমাদের।”
তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
“এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার সে কিভাবে কতটা নিজের জীবনবৃত্তান্ত অন্যদের জানাবে। এখন সবাই কথা বন্ধ করে খাবার খাওয়া শুরু করো।”
________________
মেহবিনের এক্সিডেন্টের বিশ দিন পার হয়ে গেছে আজ মাহফুজ শাহরিয়ার এর ওপর বড় একটা হামলা হয়। তিনি কোথাও থেকে অফিসে ফেরার পথে উক্ত ঘটনা ঘটে। এখন তিনি অপারেশন থিয়েটারের ভেতর রয়েছেন অবস্থা খুবই খারাপ তিনটে গুলি লেগেছে ওনার। পুরো শাহরিয়ার পরিবার থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি মুখর নিজেও পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস মাহমুজ সেই কখন থেকে কাঁদছেন মিসেস আছলাম তাকে সামলাচ্ছেন। নাফিয়াকে নিসা সামলাচ্ছে। আছলাম শাহরিয়ার তার মাকে অর্থাৎ আছিয়া খাতুন কে। আলভি ওষুধ পত্র রক্তের সবকিছু ব্যবস্থা করছে। এই সময় মুখরের পাশে কেউ নেই সে একা দেয়ালের সাথে চেপে দাড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিশন কান্না পাচ্ছে তার কিন্তু সে কাঁদলে তার মা আর বোনসহ পুরো পরিবার আরো ভেঙে পরবে তাই শক্ত হয়ে রয়েছে। মিসেস আছলাম , আছলাম শাহরিয়ার এর কাছে এসে বললেন,,
“এখানে মেহবিনের থাকা উচিৎ নয় কি। পরিবারের এই অবস্থা তারওপর যে হাসপাতালে সে সম্পর্কে তার শ্বশুর তার ওপর কি মেহবিনের কোন দায়িত্ব নেই। মানলাম ও আমাদের বাড়ি থাকে না ওকে উঠিয়ে আনা হয়নি। কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নি। মা ওর ওপর কিছু শর্তারোপ করেছেন।তাই বলে কি খারাপ সময়েও সব ছেড়ে দেবে। পরিবারের পাশে থাকবে না।
কথাটা ওখানে থাকা সবাই শুনলো। মুখর ওর মা ওর বোনের কানেও গেল। মুখর পুরোটা শুনে আরো পাথর হয়ে গেছে। সব শুনে আছলাম শাহরিয়ার মুখরের কাছে গিয়ে বলল,,
“মেহবিন কিছু জানে? ও যদি,,
হুট করেই আছিয়া খাতুন আছলাম শাহরিয়ার কে না বলতে দিয়ে মুখরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,,
“সারা শহর জানে হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিক পুলিশগো অভাব নাই। আর ও জানবো না।তোমার বউ কই মুখর। বাড়ির বউ হে পরিবারের ওপর এতোবড় একটা ঝড় যাইতেছে সে কই? নাকি আসবো না। সে কি তার শ্বশুরের মরার জন্য অপেক্ষা করতেছে নাকি এখন আসবার পারতেছে না। সারা শহর জানে মাহফুজ এর এই অবস্থা তোমার বউকি শুনে নাই কিছু। আবার বড় বড় ডায়লগ দেয় সে সবাইরে আপন ভাবে সে মাহফুজ রে নিজের বাবা মনে করে। বাপের এইরকম খবর শুইনা কোন মেয়ে কি বইসা থাকতে পারে। নাকি সে কোন ঝামেলায় পরবো না দেইহা আসতেছে না। তার কি কোন দায়িত্ব নাই। এহন তো মনে হইতেছে তার সাথে তোমার বিয়া দেওয়ায় ভুল হইছে। যদিও আমার আগেই মনেই হইছিল একটা পরিবারহীন মাইয়া কখনো পরিবারের মূল্য বুঝবো না। ও বুঝতে পারবো না সম্পর্ক কেমন হয় সম্পর্ক এর গুরুত্ব ও,,
উনি আর কিছু বলতে পারলো না কারণ মুখর এক দৃষ্টিতে কড়িডোরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখরের থমকানো চেহারা দেখে তিনি মুখরের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। আর তাকিয়েই থমকে গেল। কেউ একজন আসছে এক হাতে স্কাউচে ভর দিয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ ওরনা এমনিতেই মাথায় দিয়ে রেখেছে তার ওপর কালো ক্যাপ মুখে মাস্ক। থ্রি কোয়ার্টার হাতার গোল জামায় হাতের ব্যান্ডেজ ও স্পষ্ট। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার পেছনে একজন ছেলে আর আর একজন মেয়ে। তা দেখে মুখর বলল,,
“কাব্যের বিহঙ্গিনী তার দায়িত্ব কখনো ভুলে না। আর সম্পর্কের কথা বললেন না দাদিজান তার থেকে ভালো সম্পর্কের মানে এবং সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝতে আমি আর কাউকে বুঝতে দেখিনি।
বলেই সে দৌড়ে মেয়েটার সামনে গেল। আর তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে তার হাত ধরে বলল,,
“তোমাকে এই অবস্থায় এখানে আসতে কে বলেছে বিহঙ্গিনী?”
মেহবিন মুখরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আমার দায়িত্ব আর আমার এই পরিবারের থেকে পাওয়া স্নেহ ভালোবাসা।”
মুখর কিছু বললো না ওকে আস্তে আস্তে করে ধরে আনতে লাগল । পেছনে মিহির আর মাইশা। এদিকে মেহবিন কে এই অবস্থায় দেখে সকলে চমকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহবিন সোজা এসে মুখরের মায়ের পাশে বসে তার হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলল,,
“ভরসা রাখুন আল্লাহর ওপর মা। ইনশাআল্লাহ আল্লাহর রহমতে বাবার কিছু হবে না। ইনশাআল্লাহ বাবা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। বাবার জন্য দোয়া করুন।আর আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের মন থেকে খুব করে চাওয়া জিনিসটা থেকে কখনো নিরাশ করেন না।”
মেহবিন কে দেখেই ওনার কান্না থেমে অবাকতা ফুটে উঠেছে। তিনি সেসব বাদ দিয়ে বলল,,
“তোমার এই অবস্থা কেন মেহু?”
“তেমন কিছু না যাস্ট ছোট একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমার কথা ছাড়ুন তো আমি এখন ঠিক আছি।”
মেহবিনের কথা শুনে মুখর অবাক হয় না। কারন সে ভালোমতোই চেনে তার বিহঙ্গিনীকে। মেহবিন একবার মুখরের দিকে তাকালো ঐ চোখে কতটা অসহায়ত্ব তা ও টের পেল। সে যে কতটা কষ্টে নিজের কান্না চেপে রেখেছে সেটা ও ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো। মেহবিন মুখরের মাকে কিছুক্ষণ শান্তনা দিয়ে আছিয়া খাতুনের কাছে গিয়ে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। আছিয়া খাতুন মেহবিন কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। মেহবিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
“কাঁদবেন না দাদিজান ইনশাআল্লাহ বাবার কিছুই হবে না। উনি খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন বাবার জন্য যাতে তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে।”
কথাটা শুনে আছিয়া খাতুন আরো বেশি করে কান্না জুড়ে দিল। মেহবিন কোন রকমে তাকে শান্ত করলো। এরপর মুখরের হাত ধরে ওকে নিয়ে একটু দূরের বেঞ্চে বসলো। মেহবিন বলল,,
“আমার কাঁধে মাথা রাখুন কাব্য!”
মুখর বাধ্য ছেলের মতো রাখলো। মেহবিন নিজের মাথার ক্যাপ খুলে মুখরের মাথায় পরিয়ে দিয়ে এমনভাবে নিচু করে দিল যাতে মুখরের মুখ না দেখা যায়।সব শেষে মেহবিন বলল,,
“এবার আর আপনার দূর্বলতা কেউ দেখবে না কাব্য।”
মুখরের চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি পরতে লাগলো। মুখর বলল,,
“তুমি এখানে কেন এলে বিহঙ্গিনী?”
“আমি কাউকে বলেছিলাম তার জীবনের সাথে আমি যেমনভাবেই জড়িয়ে যাই না কেন? তার সুখে দুঃখে আমি তার সাথে থাকবো। আর কেউ একজন কথা দিয়েছিল আমার সব সুখে দুঃখে সে আমার সাথে থাকবে। কয়েকদিন আগেও সে তার কথা রেখেছে তাহলে আমি কেন নয়। ইনশাআল্লাহ বাবার কিছু হবে না আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।”
“তুমি জানো আমার এতোক্ষণ কতটা অসহায় লাগছিল। আমার পরিবার জানে আমি একজন কঠোর ব্যক্তিত্বের মানুষ আমার কারো সঙ্গ প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার কি করতে ইচ্ছে করছিল জানো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। আমার বাবা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আজ সেই অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল বিহঙ্গিনী। দেখো না সবার জন্য কেউ না কেউ শান্তনার জন্য ছিল। মায়ের জন্য কাকিমনি, নাফির জন্য নিসা,দাদির জন্য কাকাই কিন্তু কেউ আমার কাছে আসে নি বিহঙ্গিনী। এই সময়টায় আমারও একটা কাঁধ প্রয়োজন এটা কেউ ভাবে নি। আমার ভিশন দমবন্ধ লাগছিল চোখের অশ্রু গুলো বার বার চিৎকার করছিল বাইরে বের হবার কিন্তু আমি দিই নি মায়ের আর বোনের দিকে তাকিয়ে। আমার মতো কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পূর্ন মানুষ যদি কাঁদে তাহলে তারা আরো ভেঙে পরবে।কারন আমাকে তারা কোন পরিস্থিতিতে ভেঙে পরতে দেখেনি। আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসি বিহঙ্গিনী। আমার বাবার এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বিহঙ্গিনী। কারন ঐ একজন মানুষ সবসময় আমার ওপর বটগাছের মতো ছিল। আমার আইডল আমার শক্তি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বিহঙ্গিনী।
“বাবার কিছু হবে না প্লিজ নিজেকে শান্ত করুন। আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে এটা একটা পরীক্ষা মাত্র। আল্লাহর ওপর ভরসা করুন তাকে ডাকুন বাবার জন্য দোয়া করুন ইনশাআল্লাহ বাবা ভালো হয়ে যাবে।”
মুখরের কান্নায় মেহবিনের জামার হাতা ভিজে যাচ্ছে তবুও সে নিশ্চুপ। মুখর বলতে লাগলো,,
“একটু আগে সবাই তোমার ব্যাপারে কতোকিছু বলছিল। তখন আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল আর বলতে ইচ্ছে করছিল আজ বাবা যে অবস্থায় ভেতরে রয়েছে তুমিও বিশদিন আগে সেরকম অবস্থায়ই ছিলে। কিন্তু আমি বলতে পারিনি বিহঙ্গিনী আমি ওদের কথার জবাব দিতে পারি নি। ওরা বলছে তোমার দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে আমি তখনও মুখ ফুটে বলতে পারি নি তোমার দায়িত্ব পালনের গভীরতা কতটা। তারা দূর থেকে টেনশন করবে বলে তুমি সবাইকে মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন খবর না জানানোর জন্য ওয়াদা করিয়ে রেখেছো। এরা তো তোমার কোন দুঃখে তোমার পাশে থাকে নি তাহলে তারা কেন আজ তোমার,,
মেহবিন মুখরকে না বলতে দিয়ে বলল,,
‘আমার কথা ছাড়ুন মুখর আমার কারো প্রতি কোন প্রত্যাশা নেই এটা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। প্লিজ শান্ত হন আপনি।”
মুখর আর কিছু বললো না চুপচাপ মেহবিনের কাঁধে মাথা রেখে নিজের অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। মেহবিন মুখর কে নিয়ে বসলে সবাই সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। মেহবিন মুখরের মুখটা ক্যাপ দিয়ে ঢেকে দিলে ওরা বুঝতে পেরেছিল মুখর কিছু বলছে কিন্তু কি বলছে বা ও কাঁদছে কিনা এটা কেউ দেখেনি। মুখর সোজা হয়ে বসলো কিছুক্ষণ পর এখন অনেকটাই শান্ত সে। তখন মুখরের মামার বাড়ির লোকজন এলো। আরো কিছু লোকজন এলো। কয়েকজন পুলিশ ও আগে থেকেই ছিল। মেহবিন আজ কিছুই করলো না মাস্ক আছে তো। তাছাড়া মাইশারাও তো আছে। অতঃপর আধ ঘন্টা পর ডক্টর বের হলো সবাই এগিয়ে গেল। ডাক্তার জানালেন আউট অফ ডেন্জার চিন্তার কোন কারন নেই তবে দুই মাস ফুল বেড রেস্ট এ থাকতে বললো। সকলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। মিহির আর মাইশা যেহেতু আছে মুখর বলল মেহবিন কে মাস্ক খুলে ফেলতে। কারন মাস্কে ওর নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে অসুস্থ দেখে। মেহবিন মাস্ক খুলে ফেলল। মাহফুজ শাহরিয়ার কে কেবিনে দেওয়া হলে সকলে একবার করে মাহফুজ শাহরিয়ার কে দেখে এলো। মুখরের মামার বাড়ির সকলে চলে গেল । মাইশারা অনেকক্ষন রইল এখন বের হবে কারন রাত হয়েছে অনেক এখন দুই জনের বেশি অ্যালাও না। মেহবিন অসুস্থ দেখে মুখর বলল তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে। মেহবিন চলে গেল এখন মুখরের মা আর মুখর বাদে সবাই বাড়ি যাবে। তখন তিনজন নার্স মেহবিনের নামে আর ওদের নামে কিছু বলাবলি করছিল তা দেখে নাফিয়া বলল,,
‘এই আপনারা আমাদের সম্পর্কে কি কথা বলছেন?”
তখন একজন বলল,,
“না আপু আপনাদের নামে তেমন কিছু বলছিলাম না । ঐ যে ক্যাপ পড়া আপু এতক্ষণ ছিল না আপনাদের সাথে। ওনাকে দেখে ও বলছিল আপনারা সবাই কতো কাঁদলেন কিন্তু উনি সবাই কে শান্তনা দিলেন কিন্তু একটুও কাঁদলেন না। উনি কি দিয়ে তৈরি । তাই আমি বলছিলাম উনি সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। বছর খানেক আগে উনি এসেছিলেন একজন কে নিয়ে উনার অবস্থা আপনার বাবার থেকেও খারাপ ছিল উনার তো বাঁচার চান্সই ছিল না। পাঁচ দিন কি খারাপ অবস্থা ছিল। উনি এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলেন নি। এবং যা প্রয়োজন সব একাই করেছিলেন এমনকি ঐ পাঁচ দিন ঠিক মতো খাওয়া তো দূর তিনি ঘুমানওনি। ওনার পাশে কেউ ছিল না তবুও তিনি ভেঙে পরেন নি। আল্লাহর রহমতে পাঁচ দিন পর ওনার পেশেন্ট আউট অফ ডেন্জার হয় । আমি জিজ্ঞেস ও করেছিলাম ওনাকে আপনার কি একটুও কান্না পায় নি উনি বলেছিল ‘কান্না করলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কান্না করে ভেঙে পরলে কি পেশেন্ট সুস্থ হয়ে যাবে। আর কান্না করলে সে অসুস্থ হলে তার দৌড়াদৌড়ি কি আমি করে দেব নাকি। আর এটাও বলেছিল আবেগে ভেসে দায়িত্ব ভুলে যেতে নেই। আবেগ কান্না মানুষ কে দূর্বল করে দেয়। আর সে দূর্বল নয়।” এটা শুনে আমি তো ওনাকে সিমেন্ট আপু বলে আখ্যা দিয়ে ছিলাম। প্রথমে চিনতে পারি নি কিন্তু যখন মাস্ক খুললো তখন ওনাকে দেখেই চিনেছি আমি আর সারাজীবন মনেও রাখবো আমি।”
সব শুনে পুরো শাহরিয়ার পরিবার থ হয়ে গেলেন পরে আলভি বলল,,
“হয়তো তার চেনা কেউ ছিল না তাই কাঁদেনি?”
তখন নার্সটা বলল,,
“আরে কি বলেন উনি তো আপুর বাবা ছিলেন।”
কথাটা শুনে যেন শাহরিয়ার পরিবারের ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। আছলাম শাহরিয়ার বললেন,,
“আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে তার বাবা আসবে কোথা থেকে? ”
‘না স্যার কোন ভুল হচ্ছে না। তার বাবাই ছিল এমনকি তাদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে দুজনের একই রকম।”
‘আপনারা পেশেন্ট এর নাম ঠিকানা দিতে পারবেন।”
‘সরি স্যার এ বিষয়ে আমি আপনাকে কিছু বলতে পারছি না আসছি।”
বলেই নার্সগুলো চলে গেল সকলে মুখরের দিকে তাকালো। ও বলল,,
‘সবাই বাড়ি চলে যাও অনেক রাত হয়েছে।”
“তুই কিছু জানিস মুখর?”
“না! তোমরা বাড়ি যাও।”
মুখর সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল কেউ কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু মেহবিন কে নিয়ে সবার কৌতুহল দিনকে দিন বেড়েই চললো। সবথেকে বেশি আছিয়া খাতুন এর।
************
দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরো একমাস দশ দিন। এখন কেউ মেহবিনের উঠানে খেলে না। সেদিনের পর তাজেলকে খেলতে দেখা যায় না, না দেখা যায় তার মুখের হাঁসি। সে যেন সব ছেড়ে দিয়েছে তার ডাক্তারের জন্য। সকাল বেলা উঠে নিজেই পড়াশোনা করে স্কুলে যায় আবার ফিরে এসে ঘরেই থাকে বিকেল হলে ডাক্তারের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এটাই তার সেদিনের পর দুই মাসের রুটিন। একটা বাচ্চা মেয়ের মেহবিনের প্রতি এতটা ভালোবাসা দেখে সবাই অবাক হয় বয়সই বা কতো এই ছোট্ট মেয়েটার ডাক্তারের অবর্তমানে যেন তাকে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সেদিন যাওয়ার দুদিন পর মুখর এসেছিল মেহবিনের বাড়িতে সে এসে তাজেলকে তার ডাক্তারের খবর দিয়ে গেছে। এই দুই মাসে মুখর চারবার এসেছিল তাজেলের কাছে মেহবিনের অবস্থা জানিয়ে গেছে। দুইবার মেহবিনের মতো ঘুরতে নিয়ে গেছিল। কিন্তু মুখর সেই আগের তাজেলকে পায় নি। তবে একটা ব্যাপার হলো মুখর ওকে বলেছে ফোনে কথা বলবে কি না ও সাফ না করে দিয়েছে বলেছে তার ডাক্তারকে সামনাসামনি দেখেই সে তার সাথে কথা বলবে। মুখর অবাক হয়েছিল মেহবিন আর তাজেলের বন্ডিং দেখে। মেহবিন যখন চোখ খুলেছিল নিজেকে অন্য জায়গায় আবিষ্কার করে তখন ও বলেছিল তাজেলকে বলে এসেছে কি না যে ওকে নিয়ে আসা হয়েছে। ও না জানাতেই ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিল তাজেলের কাছে তার খবর জানাতে। এরপর মেহবিনের কথা মতোই ও আসতো তাজেলের কাছে।
প্রতিদিনের মতো আজ ও বিকেলবেলা তাজেল মেহবিনের বাড়ির সামনে বসে আঁকিবুঁকি করছে মাটিতে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ বলল,,
“শেখ তাজেল এখানে বসে কি করছেন?”
তাজেল তার দিকে না তাকিয়েই আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল,,
‘হাডুডু খেলছি এখানে বসে। তুই খেলবি?”
এ কথা শুনে পেছনের মানুষ টা হাসলো। সে বলল,,
” না খেলবো না। আরে বাহ! একা একা হাডুডু খেলেন আপনি। তা খেলছেন কিভাবে? আমি তো দেখছি মাটিতে বসে আঁকিবুঁকি করছেন।”
‘দেখতেছোস আঁকিবুঁকি করতেছি তাইলে আবার জিগাস করোস কেন?”
বলতে বলতেই সে পেছনে ঘুরলো পেছনে ঘুরে কাঙ্খিত মানুষ টাকে দেখে তাজেল হেঁসে চিৎকার করে বলল,,
‘ডাক্তার!”
বলেই ঝাঁপিয়ে পরলো মেহবিনের ওপরে মেহবিন টাল সামলাতে না পেরে মাটিতেই পরে গেল। মেহবিন তাজেলকে আর তাজেল মেহবিনকে খুব শক্ত করে আকড়ে ধরলো। মেহবিন আর তাজেলের মুখে তৃপ্তির হাঁসি। এই হাঁসি তাজেলের মুখে এই দুই মাসে কেউ দেখেনি। এসব দেখে পেছনের মানুষ গুলো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শুধু একজন বাদে সে হলো মুখর। তাজেলের চিৎকার শুনে নওশিদের ওখানের প্রায় সবাই বেরিয়ে এসেছে। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
‘নেত্রী তুমি আসতে না আসতেই আমাকে ফেলে দিলে।”
তাজেল হেঁসে বলল,,
‘তোমার সাতে আমিও পরলাম হেইডা দেখলা না।”
তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো তখন মুখর এসে তাজেলকে কোলে করে উঠালো তারপর মেহবিন কে উঠালো। মুখর তাজেলকে বলল,,
‘নেত্রী তোমার ডাক্তার এখন সম্পূর্ণ সুস্থ বুঝলে তবুও,,
মুখর কে আর না বলতে দিয়ে মেহবিন বলল,,
‘আমি ঠিক আছি। কিছুই হয় নি আমার।”
তখন তাজেল বলল,,
“কিমুন আছাও ডাক্তার?”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
‘আমার নেত্রীকে দেখে এখন ভিশন ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
‘তুমারে দেইখা মেলা ভালো আছি।”
তখন নওশি বলল,,
‘ডাক্তার আপা আপনার এক্সিডেন্টের পর আজ প্রথম তাজেল এভাবে হাসলো। আপনি যাওয়ার পর ওর হাসির বাত্তি বন্ধ হইয়া গেছিল আপনি আসতেই তা আবার জ্বলে উঠলো।”
মেহবিন হাঁটু গেড়ে বসে তাজেলকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
“আমায় এতো কেন ভালোবাসো নেত্রী?”
‘তুমি আমারে ভালোবাসো তাই।”
~চলবে,,
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। আজ অনেকবড় করে একটা পর্ব দিছি। তাই অনেক বড় বড় করে আপনারা মন্তব্য করবেন আজকে পর্বটা আর গল্প সম্পর্কে।