রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৪| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
664

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বাঁধাই করা ঘাটে বসে জুতো জোড়া ধুয়ে নিচ্ছে ভূমি। আজ গোসল করতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে৷ যোহরের আগে একটু শুয়েছিল। কখন যে চোখ লেগেছিল জানা নেই। যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় শেষ দুপুর৷ উঠে তাড়াহুড়ো করে ঘর উঠোন ঝাড়ু দিল। এরপর সকালের জমিয়ে রাখা এঁটো বাসনগুলোকে ধুয়ে‚ পুষ্করিণী পাড়ে গোসল করতে এসেছে। আশেপাশে কেউই নেই৷ ঘাটের ওপাশে ঝোপ ঝাড় গুলো বেড়েছে৷ কাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পুষ্করিণীর পানি কিছুটা ঘোলাটে লাগছে। ভূমি তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে নিল৷ আম্মা হয়তো একটু পরেই চলে আসবেন৷ দূর থেকে কেউ একজন লোভাতুর দৃষ্টিতে পুষ্করিণীর ঘাটে তাকিয়ে রয়েছে।

ভেজা শরীরে ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে নিল ভূমি৷ এবার বাড়িতে যাবে৷ ভেজা জামাকাপড় বাড়িতে গিয়ে পাল্টাবে। কয়েক কদম সামনে এগোতেই মকবুল এগিয়ে এলেন৷ জামাল কাকাদের পাশের বাড়িটাই উনাদের। লোকটাকে এভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসতে দেখে যারপরনাই বিরক্ত আর ক্রুদ্ধ হলো ভূমি। স্পষ্ট স্বরে বলল‚

“সামনে থেকে সরে দাঁড়ান কাকা।”

“হোপ মাইয়া কী যে কও তুমি! আমার বয়স কী অত বেশি নি?”

মকবুলের হাবভাব ভালো ঠেকছে না৷ কীভাবে যেন তাকিয়ে আছে। গায়ের ওড়নাটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল ভূমি। সেখান থেকে প্রস্থান নিতে চাইলে মকবুল তার পথরোধ করে দাঁড়াল৷ ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে রয়েছে ভূমি৷ আড়ষ্টতা ক্রমশ কাবু করছে তাকে৷ এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হয়নি তাকে। ক্ষীণ কম্পিত স্বরে ভূমি বলল‚

“কাকা আমাকে যেতে দিন দয়া করে।”

“অত তাড়া ক্যা? আমার লগেও একটু সময় কাটাইয়া যাও মাইয়া৷”

“এসব আপনি কী বলছেন?”

“আমার কথা বুঝি ভালা লাগে নাই?”

মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করল ভূমি৷ কিছুটা রুক্ষ স্বরে বলল‚ “রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান।”

“বাপ রে কথার দেহি বহুত তেজ। তেজি মাইয়া আমার মেলা ভালা লাগে।”

মকবুল কিছুটা এগোলো। ভূমি ভীতু চোখে আশেপাশে লক্ষ করল৷ পুষ্করিণী পাড়ে কেউ-ই নেই। সে চিৎকার করলেও কেউ হয়তো শুনবে না। তখনই দৌঁড়ে পালানোর কথা মাথায় এলো। গায়ে জড়িয়ে রাখা ওড়না শক্ত করে ধরেই দৌঁড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিল ভূমি। মকবুল সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা ধরে ফেলল। ভয়ে কান্না করে দিল ভূমি।

“দয়ে করে হাত ছাড়ুন কাকা নয়তো আমি চেঁচাব।”

“তোমার চিল্লানি কেউ শুনব না মাইয়া।”

শব্দ করে কেঁদে দিল ভূমি। মকবুল বিকৃত করে হাসল৷ ভয়ে শরীর কাঁপছে ভূমির৷ এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত জানা নেই তার! এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত মায়ের কাছ থেকে তো জানা হলো না৷ সিক্ত কম্পিত আঁখিপল্লব। গৌর কপোল জুড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা। এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে নিষ্পত্তি মিলবে জানা নেই৷ ঢেউ খেলানো ঘন দীঘল কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ হতে টপ টপ করে পানি ঝরছে। হঠাৎ গম্ভীর পুরুষালি ভরাট কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো৷ চকিত দৃষ্টিতে তাকাল ভূমি। অশ্রুপ্লাবিত ঝাপসা চোখে সাদা পাঞ্জাবির উপর কালো কটি পরিহিত এক লোককে দেখতে পেল সে৷ লম্বা দীর্ঘ আঁটসাঁট দেহাবয়ব। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। শ্যাম রঙা কপোল জুড়ে উঁকি দিচ্ছে সংখ্যাল্প খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। লোকটা আবারও বলল‚

“একা একটা মেয়েকে পেয়ে বিরক্ত করছেন?”

মকবুল বিরক্ত হয়ে বলল‚ “ডিস্টাব কর ক্যারে? নিজের কামে যাও।”

লোকটা তার পকেট থেকে রিভলবার বের করে বলল‚ “এই জিনিসটা নিশ্চয়ই চেনেন?”

রিভলবার দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল মকবুলের। চট করে ভূমির হাতটা ছেড়ে দিল৷ এবার নিজেই হয়তো পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। লুঙ্গিটাকে শক্ত করে ধরেই ভোঁ-দৌড়ে পালাল। সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি দুজন শব্দ করে হেসে উঠল৷ লোকটা তাদের দুজনের দিকে একবার তাকাতেই হাসি উবে গেল। এরপর ভূমিকে উদ্দেশ্য করে বলল‚

“আর ইউ ওকে?”

স্কুলের মেডামের কাছ থেকে একটু আধটু ইংরেজি শিখেছিল ভূমি। পড়াশোনা আর নাচের প্রতি ভারী ঝোঁক তার৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কথা একটু হলেও বুঝতে পেরেছে সে। মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে কম্পিত মোলায়ের স্বরে বলল‚ “জি!”

“ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। আপনি যেতে পারেন। ভেজা শরীরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

এতক্ষণ বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ভূমি৷ এবার ভারী লজ্জা অনুভূত হলো তার। এভাবে কোনো পুরুষের সামনে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেও ভালো কাজ নয়। লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে তার৷ অস্ফুটে গলায় ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে ছুটে পালাল সে৷ সেদিকে তাকিয়ে কালো ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করল লোকটা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের একজন বলল‚

“বাড়ি ফেরা যাক?”

অন্যদিকে…

আবারও রান্না বসিয়েছেন মহুয়া৷ এখন রাতের খাবার রান্না হবে৷ আজ খুব চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এমনিতে সকাল আর দুপুরের রান্না করতে হয়। কিন্তু আজ তিনবার রান্নার কাজ করতে হচ্ছে৷ বিকেলও গড়িয়ে আসছে৷ রাতের জন্য ভাত‚ সবজি রান্না করলেন আর কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল৷ ব্যাস এটুকুই! এত এত এঁটো বাসন জমেছে৷ সেগুলোও ধুয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে৷ খাবার টেবিল আর বৈঠকখানাও ঝাড়ু দিতে হবে৷ ময়লা জমেছে৷ আজ এটুকু কাজেই ক্লান্ত মহুয়া।

পুষ্করিণী পাড় থেকে বাড়ি ফিরে আসরের নামাযের সঙ্গে যোহরের কাযা আদায় করে নিল ভূমি। দুপুরের খাবার এখনো খাওয়া হয়নি। ক্ষিধেও পেয়েছে ভীষণ। তার আম্মা আসতে এখনো অনেকটা সময় দেরি৷ ভাতের পাতিল থেকে নিজের জন্য ভাত বেড়ে নিল সে। সকালের ডিম ভাজা ছিল। এখন সেটা দিয়েই খাবে৷ সঙ্গে করে একটু শুকনো মরিচ ভর্তা মেখে নিল ভূমি। আম্মা এলে তারপর রান্না হবে৷ খাওয়া শেষ হতেই উঠোনে গিয়ে মুরগী গুলোকে ‘তিতি’ বলে ডাকতে শুরু করল। ভূমির ডাকে সবগুলো মুরগী যেখানেই ছিল ছুটে চলে এলো। কয়েকটা খুদ উঠোন জুড়ে ছিটিয়ে দিল৷ সবগুলো তাড়াহুড়ো করে খেতে শুরু করল৷ দুটো বাচ্চা ওয়ালা মুরগীকে আলাদা আলাদা খেতে দিল সে।

মাগরিবের আযান পরেছে৷ মুরগী গুলোকে অনেক আগেই খুপরিতে তুলে রেখেছিল। ঘরে এখনো আলো জ্বালায়নি৷ চুলোতে লাকড়ি জ্বালিয়ে রেখেছে সে৷ সন্ধ্যে বেলা ঘর আঁধার রাখতে নেই৷ বাহিরে এখনো আবছা আলো অবশিষ্ট রয়েছে। এই সুযোগে গোসলঘর থেকে ওযু করে এলো ভূমি। চুলোয় আগুন জ্বলতে জ্বলতে নামায আদায় করা হয়ে যাবে৷ আম্মার জন্যও চিন্তা হচ্ছে তার৷ সচরাচর এত দেরি হয় না আম্মার। আজ কেন দেরি হচ্ছে?

এইতো সবে মহুয়া বাড়ি ফিরেছে৷ সঙ্গে ছিল তিনটে পলিথিন আর একটা বোতল। ঘরে ফিরেই সবগুলো জিনিস ভূমির হাতে এগিয়ে দিলেন তিনি। জিনিসগুলো নিজের হাতে নিয়ে ভূমি বলল‚

“আজ এত দেরি হলো কেন আম্মা?”

“আজ অনেক কাজ ছিল রে মা৷ মোড়ল বাড়িতে মেহমান এসেছে ঢাকা থেকে৷”

“তুমি গোসল করে বিশ্রাম নাও। আমি রান্না বসাচ্ছি।”

“রান্না বসাতে হবে না।”

“তাহলে রাতে খাব কী আম্মা? আর পিলিথিনে এগুলো কী?”

“মোড়ল বাড়ির ভাবি আজ অনেক খাবার পাঠিয়েছেন।”

“অনেক কিছুই রান্না হয়েছিল নাকি আম্মা?”

“হ্যাঁ! দেশি মুরগী‚ গোরুর গোশত ভুনা‚ রুই মাছ ভাজা‚ পোলাও আর জর্দা।”

“এত এত খাবার হয়েছে আজ৷”

“হ্যাঁ রে৷ সবই বড়োলোকদের এলাহি কারবার। তুই খাবার গুলো গরম করে নে। সেই দুপুরে রান্না হয়েছিলে এগুলো। আমি গোসল করে আসি৷”

“আচ্ছা।”

মায়ের কথা মতো খাবার গুলো গরম করে নিল ভূমি। কী সুন্দর সুবাস ছড়াচ্ছে৷ পুরো ঘর ম-ম করছে৷ সুবাস নিতেই পেটে চোঁ চোঁ করছে৷ আসার সময় মহুয়া কেরোসিন তেল কিনে নিয়ে এসেছিলেন৷ কুপি জ্বালিয়ে নিয়েছে ভূমি৷ টিমটিমে দোদুল্যমান শিখায় ঘর আলোকিত৷ গ্রামে গোধূলি লগ্নের পরপরই রজনি নেমে আসে৷ সময় পিছুটান রাখে না৷ নিজ গতিতেই এগিয়ে যায়৷ চলার পথে পিছুটান থাকতে নেই তাহলে জীবন থমকে দাঁড়ায়।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here