রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৫| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
805

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

শহরের অলিগলির হরিদ্রাভ সোডিয়াম বাতির দেখা কী আর গ্রামের মেঠোপথে মিলবে? এটা যে ভারী দুর্লভ। সন্ধ্যে হবার সঙ্গে সঙ্গে তমসাচ্ছন্ন ঘুটঘুটে রূপ ধারণ করে মেদিনী। দূরাকাশে চাঁদের দেখা না মিললেও টিমটিমে তারার দেখা মিলেছে সংখ্যাল্প। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটে ধোঁয়া ফুঁকছে প্রলয়। কাজ ছেড়ে এখানে এসেছে শুধুমাত্র অর্পণের কথায়৷ মন বসছে না এখানে৷ ঢাকা ফিরে যেতে পারলেই বাঁচে৷ তিনদিন থাকার জন্য এসেছে অর্পণ। কেন যে ছেলেটার কথা শুনতে গেল! মনে মনে আফসোস করছে প্রলয়৷ হুট করে চলেও যেতে পারবে না৷ অনিন্দ্যনগর গ্রামটা দেখতে সুন্দর তবে তার কাছে ঝোঁপ ঝাড়ই বেশি মনে হয়েছে৷ কেমন জঙ্গলের মতো অনুভূত হয়৷ চারিপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। বড়ো বড়ো গাছগাছালি। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ‚ গ্রামে ঢোকার মুখে এক ফালি ছোট্টো নদী। অনিন্দ্যনগর গ্রামটা আসলেই অনিন্দ্যসুন্দর।

বিশাল কামরার লাগোয়া বারান্দা থেকে চলে এলো প্রলয়। বিছানার কাছে এসেই উপলব্ধি করল তার ফোনে কেউ কল করছে৷ দ্রুত পায়ে মুঠোফোনের কাছে এগিয়ে গেল। বিছানার পাশে টিমটিমে দোদুল্যমান শিখায় হারিকেন জ্বলছে৷ জানালার পর্দা ভেদ করে মৃদুমন্দ সমীরণ উঁকি দিচ্ছে৷ কল রিসিভ করল প্রলয়।

“হ্যাঁ বল!”

ফোনটা কানে নিতেই কিছু কথা কর্ণগোচর হলো। প্রত্যুত্তরে প্রলয় বলল‚

“আমি একটু শহরের বাহিরে এসেছি। তোরা একটু সামলে নে বাকি কাজ আমি ফিরে এসে করব।”

ওপাশ থেকে কিছুই শোনা গেল না৷ প্রলয় আবারও বলল‚

“এক্ষেত্রে কী করা উচিত তুই তো জানিস রবিন। তাহলে এত কথা কীসের?”

কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে রবিনের কথা শুনল সে৷ এরপর আবারও বলল‚

“শিহাবকে বলিস মাথা গরম না করতে।”

কল কে’টে দিয়ে ফোনটাকে পকেটে রেখে দিল প্রলয়৷ শহর থেকে দূরে এসেও নিস্তার নেই৷ যেদিকটায় দেখবে না সেদিকটাতেই গণ্ডগোল বেঁধে যাবে। ভাই এসেছে শুনে বিকেলেই চলে এসেছে ইরা৷ সকাল সকাল নানু বাড়িতে গিয়েছিল৷ আজ আর থাকা হলো না তার। অন্য কোনো দিন গিয়ে থেকে আসা যাবে৷ সন্ধ্যে থেকে বিদ্যুৎ নেই৷ হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে৷ দোতলার করিডর দিয়ে যাচ্ছিল অর্পণ। এদিকে হাতে হারিকেন নিয়ে ভাইয়ের ঘরের দিকে যাচ্ছে ইরা। আঁধারিয়ায় আচ্ছন্ন করিডরে হুট করেই দুজন দুজনের সঙ্গে ধাক্কা খেল৷ অর্পণ হারিকেনটাকে বাঁচাতে পারলেও শেষ রক্ষা হলো না৷ মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠল ইরা৷

“ও মা গো।”

“এখানে তো আন্টি নেই।”

ভেংচি কে’টে সেখানেই বসে রইল ইরা৷ কোমড়ে খানিকটা ব্যথা পেয়েছে৷ মনে মনে অর্পণকে বেশ কয়েকটা গালমন্দও করেছে৷ সব দোষ এই লোকের৷ তার জন্যই তো সে এভাবে মেঝেতে পড়ে গেল৷ হারিকেন বাঁচাল— কই তাকে তো বাঁচাল না? ইরার মুখের সামনে হারিকেন ধরে অর্পণ বলল‚

“সারা রাত কী এখানেই বসে থাকার ইচ্ছে আছে নাকি?”

“দেখতেই তো পাচ্ছেন পড়ে গিয়েছি৷ একা উঠতে পারব না৷”

“আপনাকে কী কোলে তুলে উঠাতে হবে?”

“তা হবে বৈকি!”

মেঝেতে হারিকেন রেখে ইরাকে তুলতে নিলেই‚ “থামুন থামুন!”

“আবার কী হলো?”

“কী করছিলেন আপনি?”

“আপনাকে কোলে তুলছিলাম।”

“থাক কোলে তুলতে হবে না৷ হাত দিন আমিই ধরে উঠছি।”

অর্পণ হাত এগিয়ে দিল৷ ইরা তার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। কোমড়ে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে৷ মেঝে থেকে হারিকেন তুলে ইরার দিকে এগিয়ে দিল অর্পণ। এরপর ঘরের দিকে চলে গেল৷ প্রলয় অপেক্ষা করছে তার জন্য। এইতো কিছুক্ষণ আগে কল করে ঘরে ডেকেছিল৷

সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। নাজমা সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। খেতে বসার আগে ইরা সবাইকে একবার ভালো ভাবে অবলোকন করল। খাবার টেবিলের আরও চারজনের বসার জায়গা রয়েছে৷ বিশাল বড়ো খাবার টেবিল৷ শাহাদাৎ মোড়লের ভাই আর ভাইয়ের বউ আপাতত ঢাকা রয়েছেন। উনার স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন। গ্রামে খুব একটা ভালো ডাক্তার নেই৷ ডাক্তার দেখাতে হলেও সদরে যেতে হয়৷ শুধুমাত্র গ্রামের মানুষের কথা ভেবে শাহাদাৎ মোড়ল অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে ডাক্তার বানিয়েছেন। গ্রামে বড়ো একটা হাসপাতাল বানিয়েছেন৷ ঢাকা থেকে চিকিৎসা করার যাবতীয় সবকিছু বন্দবস্ত করেছেন। সবটাই নিজের একা পুঁজিতে। যাতে গ্রামের মানুষ চিকিৎসাহীনতায় না ভোগে।

সবাই চুপচাপ খেতে বসেছে। খাওয়ার মাঝে আরশ তার মাকে জিজ্ঞেস করল‚

“মহুয়া আন্টি কী চলে গেছেন?”

“হ্যাঁ! ওর মেয়েটা তো বাড়িতে একা৷ তাই ও সন্ধ্যে হবার আগেই চলে যায়।”

আবারও খাওয়ায় মনোযোগী হলো আরশ। ইরা টিপ্পনী কে’টে জিজ্ঞেস করল‚

“উনাকে দিয়ে তোর কী কাজ?”

“আজ বিকেলে দেখলাম উনাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ওই পুষ্করিণী পাড়ে‚ একটা মেয়েকে বিরক্ত করছিল এক লোক।”

ইরা অবাক হবার ভান ধরে আবারও জিজ্ঞেস করল‚ “তারপর কী হলো?”

“তারপর আর কী? প্রলয় ভাইয়া নিজের রিভলবার বের করলেন আর লোকটা নিজের লুঙ্গি খিঁচে ভোঁ-দৌড়ে পালিয়েছে।”

“মেয়েটা কেমন দেখতে ছিল রে ভাইয়া?”

পাশেই বসে থাকা ইরার মাথায় টোকা মে’রে আরশ বলল‚ “গাধি! আমি কী এত কিছু খেয়াল করেছি নাকি?”

খাওয়ার সময় কথা বলা একদমই পছন্দ করে না প্রলয়। এদের এত কথা বলায় যারপরনাই বিরক্ত হলো সে৷ এক ঢোক পানি খেয়ে বলল‚

“খাওয়ার সময় কথা বলা ব্যাড হ্যাবিটস।”

কথাতা বলেই খাওয়ায় মনোযোগী হলো প্রলয়। ভুরু কুঁচকে এলো ইরার। লোকটা একটু বেশিই গম্ভীর নয় কী? এমপি মানুষরা কী এমনই গম্ভীর ধাঁচের হয়? দুটো বিপরীতমুখী চরিত্রের দেখা পেল ইরা। সামনে বসে থাকা গম্ভীর ধাঁচের ব্যক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী ব্যক্তিটি হচ্ছে অর্পণ।

মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে রাখা৷ ভূমির ধোয়া এলোমেলো চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন মহুয়া৷ লম্বা চুলে নিজে তেল লাগাতে গেলে জট পাকিয়ে যায় তাইতো নিয়ম করে সপ্তাহ খানেক পর পর তেল লাগিয়ে দেন মহুয়া৷ ভূমির ভারী ফর্সা মুখশ্রী পানে চিন্তার ভাজ৷ পুষ্করিণী পাড়ের ঘটনা এখনো মাথা থেকে যাচ্ছে না৷ আম্মাকেও কথাটা বলতে পারছে না৷ এমনিতেই সারাদিন খাটাখাটুনি করে৷ রাতে একটু বিশ্রামের সুযোগ পান। অহেতুক আম্মাকে চিন্তা দিতে ইচ্ছে করছে না তার৷ দেখা গেল কাজে গিয়েও মেয়ের জন্য চিন্তায় মশগুল হয়ে থাকবেন মহুয়া। লোকের বাড়ি কাজ করে খেতে হয়। একটু ভুলচুকও তারা মানবে না। এটাই স্বাভাবিক। মেয়েকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে মহুয়া জিজ্ঞেস করলেন‚

“চুপ কেন— কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”

নিজের মনের অবস্থা বুঝতে দিল না ভূমি। মুখে হাসির রেখা প্রসারিত করে বলল‚

“আমাকে কেউ কিছু বলেনি আম্মা। তুমি অহেতুক আমার জন্য চিন্তা কর।”

“চিন্তা কী আর সাধে করি রে? মায়ের মন থেকে সন্তানের জন্য চিন্তা করা বাদ পড়ে? সারাক্ষণ মনটা চিন্তায় বিভোর থাকে। তোকে আমি সবসময় বলি‚ লোকের কথায় কান দিবি না৷ তারা শুধু তোকে কষ্ট দেবে৷ কষ্ট দিয়ে ভেতর থেকে ভেঙে দিতে চাইবে। কিন্তু তুই কখনো ভেঙে পড়বি না। মনে রাখিস তুই হচ্ছিস তোর আম্মার শক্তি।”

“তুমি অহেতুক আমার জন্য চিন্তা কোরো না আম্মা৷ আমি তোমার সাহসী মেয়ে— আমিই তোমার শক্তি।”

মহুয়া মেয়ের চুল আলতো হাতে টেনে দিতে লাগলেন। এভাবে টেনে দিলে আরাম পায় ভূমি। এমনটা তিনি সবসময়ই করেন। কাঁকই দিয়ে লম্বা চুল গুলোতে দুটো বিনুনি গেঁথে দিলেন। তেল আর কাঁকই জায়গা মতো রেখে এসে ভূমি তার মায়ের সামনে গিয়ে বসল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল‚

“আম্মা আজকের খাবার গুলো খুব সুস্বাদু ছিল। কত দিন পর বাড়িতে এত ভালো ভালো খাবার এলো! খাবারের গন্ধে পুরো বাড়ি ম-ম করছিল।”

মেয়ের চোখমুখের তৃপ্তির আভাস পেলেন মহুয়া। একদিকে আনন্দ দিচ্ছে আরেকদিকে নিজের অপারগতায় সুপ্ত মনস্তাপ অনুভূত হচ্ছে। মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলেন তিনি। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। তবে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। ঠিক যেভাবে উনিশ বছর আগে মহুয়া নামক তরুণীর নিষ্পাপ কোমল হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হবার পরও‚ অনাগত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কঠোর তৈরি করেছিলেন।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here