#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
যামিনীর নাম করে নিশীথনিবিড় আঁধার নেমেছে মেদিনীর বুকে৷ অম্বরে ঘোর অমাবস্যা। কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথি চলছে বোধহয়। নীরবতায় বিরাজমান কামরায় ঘড়ির কা’টা তখন খটখট শব্দ তুলছে৷ সময় বলছে‚ সে থেমে থাকবে না৷ সবে ঘরে প্রবেশ করল প্রলয়৷ এতটা সময় ধরে ছাদে পায়চারি করছিল৷ ঘরের ঘুম বাতি জ্বলছে৷ সেই আবছা আলোয় উপলব্ধি করল‚ বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে শুয়েছে ভূমি। ঘরের বাতি জ্বালাল না। দরজা আটকে সোজা চলে গেল খোলা অলিন্দের দিকে৷ প্রলয়ের হিমশীতল বাতাবরণ ভীষণ পছন্দের৷ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল৷ ঘুম আসছে না কিছুতেই৷ মস্তিষ্কে চিন্তার পাহাড় জমেছে৷ হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ জানা নেই তার। তর্জনী ও মধ্যমাঙ্গুলি ফাঁকে আটকে রাখা সিগারেট টান দিতেই নাক মুখ দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বের হয়ে গেল৷ চোখ বন্ধ করে নিল প্রলয়। মৃদুমন্দ সমীরণ গা ছুঁয়ে দিচ্ছে৷
সমস্ত চিন্তাকে ধোঁয়ায় উড়িয়ে আঁধারিয়া কামরায় ফিরে এলো প্রলয়। বন্ধ ঘরের ভেতরে দুটো মানুষ আটকা পড়েছে৷ একজন ক্লান্তি আর দুর্বলতার কারণে ঘুমচ্ছে। আরেকজন শত ক্লান্তির পরও দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না। প্রলয় ঘরের লাইট জ্বালাল৷ বিছানার ডান পাশে নিষুপ্তিতে আচ্ছাদিত মেয়েটা দুহাত ভাজ করে মাথার নিচে রেখে একপাশ হয়ে শুয়েছে৷ গায়ে পাতলা চাদর গলা অবধি জড়িয়ে দেওয়া। ঘুমোনোর আগ অবধি শীত করছিল তাই গায়ে চাদর জড়িয়ে নিয়েছিল ভূমি। অবুজ মেয়েটা বুঝতেও পারল না— ঘরে এসি চালিয়ে রাখা ছিল। এসির পাওয়ার খানিকটা কমিয়ে বিছানার কাছে গেল। ভূমির দিকে কিছুটা ঝুঁকে চুলে হাত বুলিয়ে নিজে নিজেই কয়েকটা কথা আওড়াল‚
“প্রত্যেকটা আকস্মিক পরিস্থিতির কোনো না কোনো কারণ থাকে৷ কিছু কারণ অজানাই থাকুক। এখন থেকে আপনার সকল দায়িত্ব আমার৷ আমি চেষ্টা করব অহর্ণিশ আপনার পাশে থাকার। সবকিছু থেকে আপনাকে রক্ষা করার।”
পুনরায় ফিরে গিয়ে ঘরের লাইট বন্ধ করে দিল প্রলয়৷ এরপর ভূমির অপরপাশে শুয়ে পড়ল৷ মনে কিছুটা অস্বস্তি‚ অশান্তি নিয়ে নিদ্রাকে আমন্ত্রণ জানাল।
রাতের তখন শেষ প্রহর…
“তুমি চাইলেই আমাকে নিজের কাছে আটকে রাখতে পারতে আম্মা৷ কিন্তু তুমি তা করোনি। আমাকে নিজের থেকে বহুদূরে ছুড়ে ফেলেছ৷ আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না আম্মা।”
চোখের সামনে মেয়েটা আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ চেয়েও কিছু করতে পারছেন না মহুয়া৷ ঘুমের ঘোরেই “ভূমি…!” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি৷
উনার কাতর চিৎকারে ধড়ফড় করে উঠে বসল ইরা৷ বহু কষ্টে একটু ঘুমিয়ে ছিলেন। ভূমির শূন্যতা পূরণ করতে মহুয়াকে নিজের ঘরে রেখেছিল ইরা৷ ঘরের বাতি জ্বলতেই দেখতে পেল‚ অপর পাশে বসে সমানে কেঁদে যাচ্ছেন মহুয়া৷ উনাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ইরা অবাক হলো বৈকি! মহুয়ার হাতের পিঠে হাত স্পর্শ করে শুধাল‚
“কী হয়েছে আন্টি? খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছ?”
“ভূমি আমার থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে।”
এই বলে পুনশ্চ কাঁদতে শুরু করলেন। ইরা স্বান্তনা দিয়ে বলল‚
“ভূমি যদি জানে তুমি এভাবে খাওয়া‚ ঘুম ছেড়ে সারাক্ষণ কাঁদছ তাহলে কী ও ভালো থাকবে?”
কান্না থেমে গেল মহুয়ার। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ইরার মুখ পানে৷ ইরা আবারও বলল‚
“মেয়েকে সুখী দেখতে চাও— এটাই তো তোমার একমাত্র চাওয়া তাই না আন্টি?”
অশ্রুসিক্ত নেত্রে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন মহুয়া৷ মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে ইরার করার উত্তর দিলেন‚ “হু!”
“তাহলে তোমাকে আগে ভালো থাকতে হবে৷ এখন ঘুমিয়ে পড়! কাল আমি ভিডিও কলে ভূমির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। ভূমিকে দেখতে পারবে তুমি।”
তৎক্ষনাৎ রাজি হয়ে গেলেন মহুয়া। ইরার কথা মতো শুয়ে পড়লেন৷ আর কাঁদবেন না তিনি। ইরা তো বলেছে কাল ভূমির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবে। ছুঁতে না পাড়ুক মেয়েটা তো চোখের দেখতে দেখতে পারবেন। ঘরের বাতি বন্ধ করে দিল ইরা৷ এসে শুয়ে পড়ল মহুয়ার পাশে৷ চোখ বন্ধ করে রেখেছেন মহুয়া। ইরা উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মনে মনে ভাবল‚ প্রত্যেকটা মেয়েকেই একদিন স্বামীর ঘরে যেতে হয়! এভাবেই প্রত্যেকটা মায়ের বুকে হাহাকার নামে। সেই মেয়েটিকে অন্যের ঘর-সংসার আঁকড়ে ধরতে হয়। সেই অন্যের সংসারটাই একদিন নিজের হয়ে ওঠে। বড্ড শখের— বড্ড ভালোবাসার!
❑
উৎকণ্ঠিত অহোরাত্র কে’টে গিয়েছে৷ নবোদিত সূর্যের কিরণ সর্বত্র আচ্ছাদিত। তেজস্বী সোনালি রোদ উঁকি দিচ্ছে জানালার দুয়ার ভেদ করে। মৃদুমন্দ সমীরণে সফেদ রঙা পর্দা শূন্যে বিচরণ করছে৷ ঘুম হালকা হয়ে এসেছে ভূমির। আধবোজা চোখে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল বিছানাতেই৷ পুরো ঘরময় চোখ বুলাল। সবকিছুই অচেনা মনে হলো। পরক্ষণেই মনে পড়ল‚ সে তো আর গ্রামে নেই। চলে এসেছে বহুদূরে। বিষণ্ণমনা হয়ে বিছানা ছেড়ে নামল। পুরো ঘর জুড়ে নীরবতা বিরাজ করছে৷ কাল বিকেল থেকে একই শাড়িতে এখন বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। শাড়িতে অভ্যস্ত নয় সে। গা কেমন কুটকুট করছে। সোফার কাছে প্রলয়ের লাগেজ রাখা৷ ভূমি সেদিকটাতেই গেল। চেইন খুলে নিজের জন্য জামাকাপড় বের করল। ইরা কাল সঙ্গে করে জামাকাপড় পাঠিয়ে দিয়েছিল। বেছে বেছে লাল রঙা থ্রিপিসই বের করল সে৷ খুঁড়িয়ে ওয়াশরুমের কাছে গেল। পায়ে ব্যথা এখনো অল্পস্বল্প রয়েছে। তবে সমস্ত দুর্বলতা কে’টে গিয়েছে। অতিরিক্ত ঘুমের কারণে ফজরের নামাযটাও আদায় করা হয়নি৷
ওয়াশরুম থেকে গোসল করে বেরিয়েছে ভূমি। তোয়ালে দিয়ে মাথা পেচিয়ে রাখা। হাতে থাকা ভেজা কাপড় ঘরের সংলগ্নে থাকা বারান্দায় গিয়ে মেলে দিয়ে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে‚ তোয়ালে খুলে ভেজা চুল মুছতে শুরু করল। এরই মাঝে প্রবেশ করল পূর্ণতা‚ পুষ্পিতা আর ফিরোজা৷ ভূমিকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন ফিরোজা। স্নিগ্ধস্বরে শুধালেন‚
“উঠে পড়েছ?”
আঁখিপল্লব ঝাপ্টাল ভূমি। তিনজনেই এগিয়ে গেল। পূর্ণতা পুষ্পিতা ইতিমধ্যেই বিছানায় বসে পড়েছে। ফিরোজা বললেন‚
“আমি হচ্ছি প্রলয়ের চাচি মা। আজ থেকে তোমারও চাচি মা। আর ওরা হচ্ছে পূর্ণতা আর পুষ্পিতা। যমজ বোন। তোমার রায়বাঘিনী ননদিনী।”
শেষোক্তটি মজার ছলেই বললেন ফিরোজা৷ ভূমি মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুজনের মুখশ্রীতে অমিল রয়েছে অল্পস্বল্প। তবে বেশিরভাগই মিল।
“চাচি মা তুমি যাও আমরা ভাবিমণির সঙ্গে আছি।”
ফিরোজা চলে যেতেই পুষ্পিতা গিয়ে বিছানায় সোজা হয়ে বসেই বলল‚ “আমার তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে৷ মা শুধু শুধু রেগে আছে।”
পূর্ণতা বলল‚ “তুমি চিন্তা কোরো না। মা এমনই। বড়ো ভাইয়াকে খুব ভালোবাসেন। কাউকে না জানিয়ে হুট করে বিয়েটা হয়ে গেল তো তাই রাগ করে আছে।”
ভূমি খুব মনোযোগ দিয়ে পূর্ণতার কথা শুনল। এবার পুষ্পিতা বলল‚ “তবে মা খুব বেশিদিন রাগ চেপে রাখতে পারেন না। তুমি দেখ— তোমাকেও ভীষণ ভালোবাসবে।”
পূর্ণতা দৌঁড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে এলো। ভূমির ভেজা কেশগুচ্ছ হতে টপটপ করে পানি ঝরছে। পুষ্পিতা হা করে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন‚ কখনো ঘন দীঘল কেশ কখনো দেখেনি সে। পুষ্পিতার মাথায় চাঁটি মে’রে বসল পূর্ণতা৷ কিছুটা ব্যথা পেল বৈকি৷ ঝাঁঝাল স্বরে ধমকে উঠল। দুটোর কাণ্ডকারখানায় হাসি পেলেও প্রকাশ করল না ভূমি। পূর্ণতা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভেজা চুল শুকিয়ে যেতেই বিনুনিও গেঁথে দিল। এরপর ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে ভূমিকে নিয়ে নিচে গেল। সকলের প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে সবেই স্বামীর পাশে বসেছেন মাধুরী৷ পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে ভূমিকে আসতে দেখেই তিনি বললেন‚
“এই মেয়েটা এখানে কী করছে? এই মেয়েটা কী এখন এখানে বসে খাবে নাকি? ফিরোজা তুই ওর খাবার ঘরে দিয়ে আসতে পারলি না?”
“বারবার এই মেয়েটা এই মেয়েটা করছ কেন মা? ওর একটা সুন্দর নাম আছে। ওকে ওর নামেই ডাকবে।”
“এই মেয়ে এখানে বসে খেলে আমি খাব না।”
“তাহলে আমি স্ত্রী নিয়ে আমি বাহির থেকে খেয়ে আসতে বাধ্য হব। শুধু স্ত্রীর কথা ভাবলেই তো চলবে না। মায়ের অসুবিধেও তো আমাকেই দেখতে হবে তাই না?”
এতক্ষণ সবটাই পর্যবেক্ষণ করলেন মোর্শেদ শিকদার। বাবা হিসেবে তিনি যদি সবটা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে পারেন তাহলে মা হিসেবে মাধুরী কেন পারবেন না? মাধুরীর রাগ করে এভাবে কথা বলার যথার্থ কারণ রয়েছে তবুও অযৌক্তিক মনে হলো উনার। মোর্শেদ শিকদার বললেন‚
“সত্যিটা মেনে নেওয়া চেষ্টা কর মাধুরী৷ যা হবার হয়ে গিয়েছে। সবই শুনেছি আমি। বিচার বুদ্ধি আমারও আছে। বাহিরে তোমার ছেলে দেশে মানুষের সেবা করছে আর তুমিই কি-না বাড়িতে কারো উপর অবিচার করছ।”
স্বামীর কথায় মুখটা থমথমে হয়ে গেল মাধুরীর৷ উচিত কথা সহ্য হলো না যেন। আঁধার নেমে এসেছে পুরো মুখে। চুপ করে বসে রইলেন স্বামীর পাশে। আর একটা কথা বলার সাহস পেলেন না তিনি। মুখ টিপে হাসল পূর্ণতা পুষ্পিতা। বড়ো বড়ো চোখের শাসানো দৃষ্টিতে তাকালেন দুটোর দিকে। মায়ের চোখ রাঙানো দেখে হাসি বন্ধ হয়ে গেল পূর্ণতা পুষ্পিতার। দুজনেই খাওয়ায় মনোযোগী হলো। প্রলয় উঠে দাঁড়াল। নিজের পাশের চেয়ারটা কিছুটা সরিয়ে বসার জন্য ইশারা করল। প্রলয়ের ইশারা বুঝতে পেরে ভূমি বসল৷ প্লেটে করে দুটো স্যান্ডউইচ‚ একটা ডিম আর একগ্লাস দুধ এগিয়ে দিল ভূমির দিকে। মোবাইলে সময় দেখে প্রলয় বলল‚
“লেটস্ ফিনিশ!”
মুখে কিছু বলল না ভূমি। প্রলয় আবারও বলল‚ “সবগুলো খাবার খাবে।”
প্রলয়ের মুখে তুমি সম্বোধন শুনে অন্তঃকরণ কেঁপে উঠল। অজানা অনুভূতিতে ব্যাকুল হয়ে উঠল হৃদয়৷ চুপটি করে খেতে শুরু করল ভূমি।
চলবে?…..