#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
কেটে গিয়েছে আরও তিনটি দিবারাত্র। আজকের সকালটা ভীষণই কদাকার। অম্বরে দেখা মিলেছে ধূসর রঙা মেঘের গুটলি। এমন দিবস মোটেও পছন্দ নয় ভূমির। আকাশ হতে হবে নীল দরিয়া তুল্য। ধূসর মেঘের গুটলির বদলে— ঢেউয়ের শুভ্র ফেনা উড়ে বেড়াবে অখণ্ড অন্তরিক্ষে। ভূমির পায়ের বেন্ডেজ কপালে বেন্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। ঘা শুকিয়ে আসছে পুরোপুরি ভাবে৷ বারান্দায় কাপড় মেলতে এসে আবারও বিরস মুখে আশেপাশে তাকাল। বাড়ির পুরুষেরা যে যার কাজে গিয়েছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা নিজেদের ঘরে পড়ছে। নতুন টিউটর রেখে দিয়েছেন মোর্শেদ শিকদার। সাড়ে এগারোটার দিকে হয়তো পড়াতে আসবেন৷ বোর্ড পরীক্ষার তো খুব বেশি সময় বাকি নেই৷ পূর্ণতা পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও পুষ্পিতা ঠিক তার বিপরীত। মেয়েটার মাঝে গম্ভীরতার বড্ড অভাব৷ উল্টো পূর্ণতা‚ সারাক্ষণ চুপচাপ বইয়ের মাঝে মুখ গুজে রাখে৷
বারান্দা থেকেই উপলব্ধি করল একটা মহিলা অনেকক্ষণ যাবৎ ভূমির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুবই অস্বস্তি হলো তার৷ তাড়াতাড়ি করে টিশার্ট আর ট্রাউজার গুলো মেলে দিল৷ এমনিতে বারান্দায় বেশ রোদ থাকে। জামাকাপড় ছাদে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে আজ সকাল থেকে মেঘে রোদে লুকোচুরি খেলছে৷ রোদকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না৷ এরই মাঝে ঘর থেকে মাধুরীর গলার আওয়াজ ভেসে এলো৷ ঘরের বাহির থেকেই তিনি ডাকছেন৷
“তুমি কী ঘরে আছ ভূমি?”
“জি মা কিছু বলবেন?”
বারান্দা থেকেই জবাব দিল ভূমি। ঘরে প্রবেশ করলেন মাধুরী। বালতি হাতে নিয়ে বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল ভুমি। বোরকা পড়ে তৈরি হয়ে এসেছেন মাধুরী। ঘরে এসে ভূমি আবারও বলল‚
“কিছু বলবেন মা?”
“হ্যাঁ! আমি আর তোমার চাচি মা একটু শপিং এ যাচ্ছি৷ কিছুক্ষণ পরেই তো পূর্ণ পুষ্পর টিউটর চলে আসবেন৷ সাবিনাকে বোলো নাস্তা আর শরবত বানিয়ে দিতে।”
মাধুরী কথা গুলো বলে থামতেই ভূমি ঘাড় কাত করে সায় জানাল। মাধুরী এবার জিজ্ঞেস করলেন‚
“তোমার কী কিছু লাগবে?”
দু পাশে মাথা ঝাকিয়ে ভূমি বলল‚ “আমার কিছু লাগবে না মা!”
“আচ্ছা। আমরা তাহলে বের হচ্ছি৷ কোনো সমস্যা হলে আমদেরকে কল করবে।”
যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন মাধুরী৷ উনার এই মিষ্টি কথায় মোটেও অবাক হলো না ভূমি। বরঞ্চ খুশি হলো৷ তিনদিন ধরেই তার সাথে ভালো ব্যবহার করছেন মাধুরী। এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ ভূমিকে বড্ড স্নেহ করে।
❑
“একটা ফুল নেন স্যার। সকাল থাইকা একটাও বিক্রি হয় নাই।”
জানালার বাহিরে তাকাতেই প্রলয় দেখতে পেল ছোটো ছেলেটার হাতে অনেকগুলো ফুল। ফুলগুলো দেখে ভূমির কথা মনে পড়ল প্রলয়ের৷ ছেলেটার হাত থেকে সবগুলো ফুল নিয়ে নিল৷ লাল‚ হলুদ আর সাদা গোলাপ। পনেরোটা গোলাপ তো হবেই। সেই সঙ্গে তিনটা রজনীগন্ধার মালা আর একটা বেলীফুলের গাজরা। ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে দিল ছেলেটার দিকে। ছেলেতা অসহায় মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে প্রলয়ের দিকে৷ বুঝতে পেরেও প্রলয় শুধাল‚
“এভাবে তাকিয়ে রয়েছ কেন?”
“স্যার আমার কাছে তো খুচরা নাই।”
“খুচরা লাগবে না টাকাটা তুমি রেখে দাও৷”
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা ছেলেটার। হয়তো একটু বেশিই খুশি হয়েছে৷ ছেলেটা চলে গেল৷ গাড়ি জ্যামে আটকে ছিল মিনিট দশেক ধরে। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে আছে প্রলয়ের৷ শাহবাগ থানার দিকে যাচ্ছিল। ব্যক্তিগত একটা কাজ ছিল সেখানকার পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। ফুলগুলোকে পাশের সিটে রেখেছে সে৷ জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটা গাড়ি চলেও গিয়েছে। প্রলয় দেখতে পেল‚ রাস্তার অপরপ্রান্তে একটা গাড়ি। পেছন সিটের জানালা খোলা৷ দুটো মহিলা বসে রয়েছে৷ একজন ব্যথায় ক্রমশ তড়পাচ্ছে৷ আর আরেকজন সেই পীড়িত মহিলাকে সামলাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামল প্রলয়৷ ট্রাফিক পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলল‚
“স্টপ!”
ট্রাফিক পুলিশ পেছনে তাকিয়ে দেখল প্রলয়কে৷ দেখেই সালাম জানাল। তাকে তো ঢাকা শহরের সবাই চেনে৷ এমপিকে কে না চিনবে? এভাবে দাঁড় করানোর মানে বুঝল না ট্রাফিক পুলিশ ছেলেটা৷ প্রলয় দৌঁড়ে একটা গাড়ির সামনে গেল৷ ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটাকে ইশারায় চলে যাওয়া নির্দেশ দিচ্ছে। পেছনে একটা মহিলা ক্রমশ ব্যথা কাতরাচ্ছে৷ দেখে মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্ট। বেশ অনেকটা সময় ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল গাড়িটা৷ যাওয়ার আগে লোকটা প্রলয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল৷ বিনিময়ে মৃদু হাসল প্রলয়। চলে গেল নিজের গাড়ির দিকে।
দুপুর তিনটে…
মাধুরী আর ফিরোজা এখনো শপিং করে ফেরেননি। ভূমি নিজে আজ রান্না করছে৷ আম্মা কম বেশি অনেক ধরনের রান্নাই শিখিয়েছেন৷ রুই মাছ রান্না করবে ভূমি। সাবিনাকে দিয়ে মাছ কাটাচ্ছে৷ সবজি রান্না বসিয়েছে৷ ভাত রান্না হয়ে গিয়েছে৷ দুপুরের কারো খাওয়া হয়নি। আজ অনিয়ম করেছে পূর্ণতা পুষ্পিতা। বিশেষ করে পুষ্পিতা। ইউটিউব দেখে কী হাবিজাবি রান্না করে খেয়েছে। সেই সঙ্গে পূর্ণতা আর তাকেও খাইয়েছে৷ এরই মাঝে বাড়ি ফিরেছেন মাধুরী আর ফিরোজা। সাবিনা গিয়ে সদর দরজা খুলতে ব্যস্ত হলো। চুলোর আঁচ কমিয়ে শরবত বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভূমি। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে রাখল।
মাধুরী আর ফিরোজার হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ৷ মায়ের গলার আওয়াজ পেয়েই ঘর থেকে ছুটে এসেছে পূর্ণতা আর পুষ্পিতা। এসেই সোফায় বসে থাকা মাধুরী গলা জাপ্টে ধরেছে দুটোতে। পুষ্পিতা আদুরে স্বরে তার মাকে জিজ্ঞেস করল‚
“আমাদের জন্য কিছু আনোনি মা?”
“তোদের জন্য কিছু না আনলে উপায় আছে? এক্ষুনি তো চেঁচিয়ে মাথা খাবি।”
পূর্ণতা এসে এবার তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল‚ “দেখি না মা কী এনেছ?”
পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্য আনা শপিং ব্যাগ দুটো এগিয়ে দিলেন মাধুরী৷ নিজেদের জিনিস পেয়ে ঘরে চলে গেল দুটোতে৷ রান্নাঘরে শরবত বানাচ্ছে ভূমি। সাবিনা পেঁয়াজ কাটছে৷ বৈঠকখানা থেকেই ভূমিকে ডাকলেন মাধুরী। উনার এক ডাকেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো ভূমি। এসে দাঁড়াল মাধুরীর সামনে। সোফায় বসে মুখ টিপে হাসছেন ফিরোজা। মাধুরী তিনটে শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলেন ভূমির দিকে।
“এগুলো তোমার জন্য। পড়ে দেখ— ফিটিংস ঠিকটাক হয় কি-না!”
আম্মা আর প্রলয়কে ছাড়া আর কখনো কেউ তার জন্য ভাবেনি। আজ নিজে থেকে মাধুরী তার জন্য ভাবছেন। ভূমি আবেগাপ্লুত হলো। নেত্র যুগল সিক্ত হলো মুহূর্তেই। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল মাধুরীর মুখ পানে।
“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছ? যা বলেছি সেটাই কর। যাও এগুলো নিয়ে ঘরে যাও।”
“এগুলো পরেও দেখা যাবে৷ আপনাদের জন্য শরবত নিয়ে আসি মা?”
ফিরোজা মাঝখান দিয়ে বললেন‚ “সাবিনা দেবে৷ তুমি যাও।”
ব্যাগগুলো নিয়ে উপরে চলে গেল ভূমি। রান্নাঘর থেকে দুটো গ্লাসে করে ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত দিয়ে গেল সাবিনা৷ বাকি রান্নাবান্না সাবিনা নিজেই সেরে ফেলল৷ কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে মাধুরী আর ফিরোজা নিজেদের ঘরে চলে গেলেন।
রাতে…
সেই দুপুরে ফুলগুলো কেনা হয়েছিল। এতক্ষণে হয়তো মূর্ছা গিয়েছে৷ একটা ব্যাগের ভেতরে করে ফুলগুলো নিয়ে এসেছে প্রলয়। বৈঠকখানায় সাবিনাকে ছাড়া আর কেউ নেই৷ বসে বসে টিভি দেখছিল মেয়েটা। সদর দরজা ওই-ই খুলে দিয়েছে৷ ফুলের ব্যাগটা নিয়ে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরের দিকে গেল প্রলয়। দুটোতে মিলে পড়তে বসেছে। ব্যাগ থেকে দুটো লাল গোলাপ আর দুটো রজনীগন্ধার মালা পূর্ণতা পুষ্পিতাকে দিল প্রলয়৷ ফুল অএয়ে খুশি হয়ে গেল দুটোতে৷ ক্ষীণ হেসে প্রলয় নিজের ঘরের দিকে চলে গেল৷ ঘরের দরজা চাপিয়ে রাখা। আলগোছে খুলে ভেতরে ঢুকল প্রলয়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বিনুনি গাঁথছে ভূমি। লম্বা চুলে একা বিনুনি গাঁথতে গিয়েও হিমসিম খেয়ে হয় খানিকটা। প্রলয় ঘরে প্রবেশ করল অথচ ভূমি চেরই পেল না। যখন আয়নায় প্রলয়ের প্রতিবিম্বের দেখা মিলতেই ভূমি উঠে দাঁড়াল। ওড়না ঠিক করে মাথায় টেনে নিল৷ প্রলয় ত্রস্ত স্বরে বলল‚
“মাথায় ওড়না জড়াতে হবে না।”
ভূমি শুনল না তার কথা। তপ্ত নিশ্বাস ফেলল প্রলয়। ড্রেসিং টেবিলের উপর গোলাপ ফুলগুলো একটা একটা করে বের করে রাখল। উঠে দাঁড়িয়ে ভূমির মাথার উপর থেকে ওড়না সরিয়ে দিল। পেছনে দাঁড়িয়ে চুলে বেলীফুলের গাজরা লাগিয়ে দিল প্রলয়। বাঁ হাতে রজনীগন্ধার মালাও পড়িয়ে দিল৷ সবকিছুই চুপচাপ দেখে যাচ্ছে ভূমি। মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না সে৷ নীরবতা ঘুচিয়ে প্রলয় বলল‚
“ফুলের সাথে ফুলকেই ভালো মানায়৷ তবে অকৃত্রিম এই ফুলে থেকে আমার ফুলটা বেশি জীবন্ত৷”
চলবে?…..