#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
পূর্ণতা পুষ্পিতা তখন ভূমির সামনে বসে ছিল। দুপাশে বসেছে ইরা আর লামিয়া। দুজনে এতক্ষণ মেহেন্দি লাগিয়ে দিয়েছে। এ ঘরে মহুয়া আসতেই পূর্ণতা পুষ্পিতা সরে গেল। মহুয়াকে জায়গা করে দিল বসার জন্য। এ ঘরে এখন প্রলয়-ভূমি‚ অর্পণ-ইরা‚ পূর্ণতা পুষ্পিতা‚ লাম‚ লামিয়া এবং রাফি উপস্থিত রয়েছে। মহুয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মেয়ের মুখপানে। দুহাত ভরতি মেহেন্দি৷ হলুদ পাড়ের জলপাই রঙা শাড়ি পড়েছে ভূমি। ঘন দীঘল কেশগুচ্ছ বিনুনি গেঁথে ফুলের মালা পেঁচিয়ে রাখা। মহুয়া খুব মনোযোগ দিয়ে মেয়েকে দেখতে লাগলেন। মুখ তুলে একটিবারও তাকাল না ভূমি৷ কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! মহুয়া চেষ্টা করলেন মেয়ের সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু সবার সামনে কিছুই বলতে পারছেন না তিনি। তখনকার ব্যাপারটা নিয়েই মনমরা ভূমি। প্রলয় বুঝল মা মেয়েতে মিলে কিছুক্ষণ কথা বলা প্রয়োজন কিন্তু এখন তা সম্ভব হবে না। ছোটোদের এত শখ করে আয়োজন করা নষ্ট হয়ে যাবে। এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতা বলে উঠল‚
“চল ভাবিমণি আমরা সবাই একটা গ্রুপ সেলফি তুলব।”
ওদের সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও সায় জানাল। মহুয়ার আর সুযোগ হয়ে উঠল না মেয়ের সঙ্গে কথা বলার। ভাবলেন পরে এক সময় কথা বলে দিবেন। মেহরাব শিকদারের সম্পর্কে আরো কিছু সত্যি বলার রয়েছে উনার। মেহরাব শিকদারকে মোটেও ঠিক মনে হচ্ছে না। যেকোনো সময় কিছু একটা করে ফেলতে পারেন তিনি। লোকটা নিজের স্বার্থে সবকিছু করতে পারেন। এ সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই অবগত। তাইতো সময় থাকতেই উনিশ বছর আগেই সরে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তা হতে দিল না। রাফি নিজের ক্যামেরা দিয়ে সকলের ছবি তুলতে শুরু করল। ভূমি তার মায়ের সঙ্গে কখনো ছবি তোলেনি। সকলের সঙ্গে আজ ছবি তুলিয়ে দিয়েছে রাফি। এত মানুষের মাঝে মুখটা তবুও ভার হয়ে আছে ভূমি। মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললেন‚
“তোমরা আড্ডা দাও৷”
মহুয়াকে হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে ইরা বলল‚ “তুমি কোথায় যাবে আন্টি?”
“আমি একটু ঘরে যাব মা। তোমরা আড্ডা দাও।”
মহুয়া একবার ভূমির দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখমুখ এখনো ফুলে রয়েছে। তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন উনার পদ্মিনী খুব কান্না করেছে। আজ সত্যিটা বলা মোটেও ঠিক হয়নি উনার। কাল বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান। কোনো সমস্যা হবে না তো? ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে এলো উনার। এমনিতেই জীবনের সমস্যার কোনো শেষ নেই। ভূমিকে একপলক দেখে ক্ষীণ হাসলেন মহুয়া। এরপর এই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার পথেই দেখা হয়ে গেল মেহরাব শিকদারের সঙ্গে। উনার সঙ্গে ফিরোজা রয়েছেন। লোকটা মহুয়াকে দেখে ক্ষিপ্ত হলেন। দেখে মনে হচ্ছে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। দিনকে দিন কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে! ফিরোজার সামনে কোন কথা বলতে চাইছেন না মহুয়া। নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান নিতে চাইলে মেহরাব শিকদার বলে উঠলেন‚
“মেহমান আছে মেহমানের মতোই থাকবেন। এদিক সেদিক ঘুরঘুর করা বন্ধ করুন।”
মেহরাব শিকদারের এহেন ব্যবহারে ভীষণই অবাক ফিরোজা৷ তবে ব্যাপারটা মোটেও অবাক করলেন না মহুয়াকে৷ তিনি জানেন মেহরাব শিকদারের এমন ব্যবহার করার কারণ। বড্ড আতঙ্কে রয়েছেন মেহরাব শিকদার। না জানি কখন কোন সত্যিটা সামনে চলে আসে৷ মহুয়া কিছুই বললেন না৷ মেহরাব শিকদার পুনশ্চ বললেন‚
“কী হলো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এক্ষুনি নিজের ঘরে যান।”
এবার উনাকে থামিয়ে ফিরোজা বললেন‚ “কাকে কী বলছ? উনি শধু মেহমানই না— এ বাড়ির কুটুম।”
ফিরোজার কথা কিছুই বুঝলেন না মেহরাব শিকদার। বরঞ্চ অবাক হলেন। একবার ফিরোজা তো আরেকবার মহুয়া৷ দুজনের দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚
“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?”
কিছুটা ভয় পাচ্ছেন মহুয়া। সত্যিটা আজ মেহরাব শিকদারও জেনে যাবেন। সত্যিটা তো একদিন জানারই ছিল৷ ফিরোজাকে পর্যবেক্ষণ করছেন মহুয়া৷ মেহরাব শিকদার শুকনো ঢোক গিলছেন বারবার। মনে উঁকি দেওয়া প্রশ্নের উত্তরটা যেন কিছুতেই সত্যি না হয় সেই প্রার্থনাই করছেন তিনি। ফিরোজা বললেন‚
“উনিই তো আমাদের ভূমির আম্মা। কেন— তুমি কী জানো না?”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না মেহরাব শিকদার। গলা শুকিয়ে আসছে উনার৷ যতই অতীতকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন ততই অতীত যেন জেঁকে বসছে। কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছেন না তিনি। মহুয়া তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলেন। গম্ভীর হয়ে উঠল মেহরাব শিকদারের মুখখানা। কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলেন‚
“কী বললে— আবার বল!”
“বললাম‚ মহুয়া হচ্ছে ভূমির আম্মা। কেন তুমি জানো না?”
নিটোল পা দুটো কেঁপে উঠল। তারমানে ভূমি উনার সন্তান। যাকে কিনা উনিশ বছর আগে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলেন। মহুয়া আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না। বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গেলেন। মেহরাব শিকদারের মনে হানা দিল আতঙ্ক। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি! এবার যদি ভূমি নিজের অধিকারের জন্য মুখ খুলে? না! ভূমির মুখ খুলতে দেওয়া যাবে না। যে করেই হোক‚ যা করার উনাকেই করতে হবে। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে উঠলেন তিনি। ঝোঁকের বশে চেঁচিয়ে উঠলেন ফিরোজার উপরে। স্বামীর এমন পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারলেন না তিনি। হুট করে কী হলো লোকটার? গ্রাম থেকে ফেরার পর থেকেই এমন অচেনা মানুষের মতো আচরণ করছেন। প্রেসার ফল করল না তো? ফিরোজা একবার ভাবলেন অর্পনকে সবটা বলবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ছুটে অর্পনের কাছে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু খুলে বললেন। অর্পণ তার মাকে আশ্বাস জানাল যে‚ সে সবটা দেখবে। এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন ফিরোজা। ছেলের উপর খুবই ভরসা উনার।
রাতে…
চুল থেকে ফুলের মালা খুলে রাখছে ভূমি৷ ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখায় খুব চুলকচ্ছে। চুলে টান লাগায় ব্যথাও করছে খানিকটা। রাতের খাবার প্রলয় নিজের হাতেই খাইয়ে দিয়েছে৷ ভূমির হাত এখনো পুরোপুরি ভাবে শুকয়নি। এদিকে খুবই ঘুম পাচ্ছে তার৷ দুপুরে এক দফা ঘুমিয়েছিল কিন্তু তবুও ঘুম হয়নি তার৷ বসে বসেই ঝিমচ্ছে সে। প্রলয় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল ভূমি ঝিমচ্ছে। তখনই মনে পড়ল দুপুরে কান্না করার কথাটা। সে ভূমির কাছে গিয়ে বসল। হাতের মেহেন্দি তুলতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“তখন এভাবে কাঁদছিলে কেন? কেউ তোমাকে কিছু বলেছিল?”
“অনেকদিন পরে আম্মাকে কাছে পেয়ে খুবই আনন্দ হয়েছিল। আবেগাপ্লুত হয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তাই আরকি!”
প্রলয় বুঝতে পারল ভূমি তার থেকে কিছু একটা লুকতে চাইছে। তাই বিষয়টাকে নিয়ে খুব বেশি ঘাটল না সে। মন ভালো হলে নিজে থেকেই সবটা বলবে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে দুহাতের মেহেন্দি তুলে দিল প্রলয়। কমলাটে রং হয়েছে। ইরা বলেছিল‚ সারারাত থেকে রং ফুটবে। তারজন্য সময়ের প্রয়োজন। ভূমির হাতের মুঠোয় অধর ছোঁয়াল প্রলয়। দুহাতের তালুতে নিজের নাম দেখে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে সে৷ পরক্ষণেই মনে পড়ল‚ কাল তাদেরও একটা পারফরম্যান্স দেওয়ার কথা আছে৷ কিন্তু রিহার্সালই তো করা হয়নি এখনো। ভূমিকে বিছানা ছেড়ে নামিয়ে প্রলয় বলল‚
“তাহলে চলো নাচের রিহার্সালটা করে ফেলি। ওরা তো বেশ সুন্দর নাচ শিখছে। কাল নাকি নাচবে। আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। আমি নাকি ভালো নাচতে পারিনা অথচ ওরা তো জানেই না আমার ঘরে নাচের টিচারই রয়েছে।”
সমস্ত মন খারাপ দূরে ঠেলে ভূমি আতকে উঠল। এখন কী সকলের সামনে নাচতে হবে নাকি? ভারী বিপাকে পড়েছে। সে তো অতটাও ভালো নাচতে পারে না। মায়ের কাছ থেকে একটু আধটু শিখেছিল। আর সকলের সামনে নাচতে গেলে তো লজ্জায় ম’রি ম’রি অবস্থা হবে। প্রলয় এগিয়ে গিয়ে ভূমির দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল।
আকাশ গুড়গুড় করছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে। ঝড়ো হাওয়া আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। বাতাসে চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে৷ শীতল হাওয়ায় গা ভাসাতে বেশ লাগছে ইরার৷ ছাদের এককোণায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে৷ রাত হয়েছে তবে ঘুম আসছে না তার৷ রাতে ছাদে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করার অভ্যেস আছে তার৷ বাড়িতে থাকাকালীন এমন রাত বিরেতে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটাহাঁটি করে সময় কা’টাত। এদিকে ঘুমের ঘোরে পানি খেতে উঠেছে অর্পণ। কিন্তু জগে একফোঁটা পানি অবধি অবশিষ্ট নেই৷ অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়েছে সে৷ ইরাদের ঘরের দরজাটা খোলা৷ ঘরের ভেতর থেকে ঘুম বাতির আবছা আলো বাহির অবধি আসছে। এ ঘরে তো ইরা আর লামিয়া থাকছে৷ কে জেগে রয়েছে? আর দরজাই বা খোলা কেন? বিষয়টাকে খুব একটা তোয়াক্কা না করে নিচে চলে গেল অর্পণ। কিছুক্ষণ পর জগে করে পানি নিয়ে ইরাদের ঘরের সামনে এসেস দাঁড়াল। না এখনো দরজা খোলা। অর্পণ এদিকসেদিক একবার তাকাল৷ ছাদের দরজাওয়াজ খোলা। তার এখনো মনে আছে‚ বিকেলে নাচ রিহার্সালের পর তো ছাদের দরজা আটকে আসা হয়েছিল। হাতে থাকা জগটা ঘরে রেখে এসে অর্পণ ছাদের দিকে অগ্রসর হলো৷ বাহিরে তীব্র নাতাস বইছে৷ সবকিছু যেন উড়িয়ে দিচ্ছে৷ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। আঁধারিয়া খোলা আকাশের নিচে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইরা। এই রাতের বেলায় মেয়েটাকে এভাবে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে কিছুটা আতকে উঠল অর্পণ। অত্যন্ত ধীর পায়ে সেই শীর্ণ দেহাবয়বের দিকে এগিয়ে গেল সে। হুট করে কারো উপস্থিত অনুভব করে পেছন তাকাল ইরা৷ অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“তা ম্যাডাম হঠাৎ এই রাতের বেলা ছাদে একা দাঁড়িয়ে কী করছেন?”
“আপনি বুঝি জানেন না বৃষ্টিময় আবহাওয়া আমার কতটা পছন্দের! তাইতো আবহাওয়া বিলাস করতে এলাম। বেশ ফুরফুরে লাগছে নিজেকে।”
“কিন্তু আমার একদমই পছন্দ নয়। আমার তো সেই আবহাওয়া বিলাসীকে পছন্দ।”
“রাতবিরেতে মজা করতে এসেছেন?”
“মজা কোথায় করলাম? আমি তো সত্যিটা বললাম।”
“তা আপনি এখানে কী করছেন ঘুমাননি কেন? কাল তোর সকাল সকাল উঠে সমস্ত আয়োজন করতে হবে। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।”
“শুধু আমার একার দায়িত্ব নয়। এ বাড়ির সকলের দ্বায়িত্বও বর্তায়।”
“বাকিরা তো মেহমান।”
“বাড়ির সহস্য হতে কতক্ষণ?”
চুপ রইল ইরা৷ আঁধারের মাঝেও তার মুচকি হাসি খুব করে উপলব্ধি করল অর্পণ। সে আবারও বলল‚
“আপনি কৃপা করিয়া নিজের কামরায় অবস্থান করুন। আমার ঘুম আপনা আপনিই চলিয়া আসিবে। আপনাকে ছাদে একা ফেলিয়া তো কোথাও যাওয়া হচ্ছে আমার।”
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নকল করা বন্ধ করুন। আমি এখন ঘরে যাব না। মনে হচ্ছে না বৃষ্টি আসবে বলে। এলে খুব ভালো হত। একটু ভিজতে পারতাম। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না!”
“ভালো হয়েছে মেঘ আসবে না৷ বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে। তখন তো ভাই আর ভূমির রিসেপশনে আনন্দ করতে পারবেন না। বিছানায় শুয়ে বসে সময় কা’টাতে হবে।”
“উফ আপনার ডাক্তারি আপনি আপনার কাছেই রাখুন তো৷ ভাইয়াও মাঝে মাঝে এমন জ্ঞান দেয়।”
“তোমার ভালোর জন্যই বলে— স্টুপিড!”
ভেংচি কাটল ইরা। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। আড়ালেই হাসল অর্পণ। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল। একটা কথা মাটিতে ফেলতে চায় না। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়ায় মেতে ওঠে মেয়েটা।
চলবে?…..