রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৭| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
610

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

প্রকাণ্ড সূর্যটা প্রায় নিভন্ত। বুকে দুহাত গুজে বিছানায় বসে রয়েছে প্রলয়৷ আড়চোখে ভূমিকেও দেখছে সে। সর্দি খুব ভালোভাবেই লেগেছে। হাঁচি দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করছে ভূমির। মেঝেতে টিস্যু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। নাক মুছতে মুছতে বেহাল দশা৷ টমেটোর মতো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। জ্বালা করছে ভীষণ। তারউপর হাড় জ্বালাতে জ্বালাময়ী ভাব নিয়ে প্রলয় বলল‚

“সত্যি হলো তো আমার কথা?”

“বেশি কথা না বলে আমার মাথাটা একটু টিপে দিন। খুব ব্যথা করছে।”

“আমার বয়েই গেছে৷ আরও খাও আইসক্রিম। আমি অর্পণকে বলছি তোমার জন্য আরও কয়েক বক্স আইসক্রিম এনে দিতে।”

কথা বলতে বলতেই বিছানা ছেড়ে নামল প্রলয়৷ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই অর্পণকে ডাক দিল। তার ঘরের পাশের ঘরটাই অর্পণের। প্রলয়ের ডাক শুনেই ঘর থেকে ছুটে এলো অর্পণ। এতক্ষণ ইরার সঙ্গে কথা বলছিল। ইরা আজ গ্রামে গিয়েছে। মহুয়া আর আরশের সঙ্গেই গিয়েছে৷ অনেকদিন বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হয় না তার৷ এদিকে আজ সারাদিনে একটিবারের জন্যও ইরার সঙ্গে কথা হয়নি অর্পণের। সবে পাঁচ মিনিট হয়েছিল ইরাকে কল করায়। অর্পণ আসা মাত্রই দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল প্রলয়। অর্পণ ঘরে এসে দেখল ভূমি এক হাতে টিস্যু আরেক হাতে মাথা চেপে ধরেছে৷ কোমরে হাত গুজে ধরমের স্বরে অর্পণ বলল‚

“সঙ্গে সঙ্গে সর্দি লাগিয়ে ফেললি? সবটা আইসক্রিম খেতে কে বলেছিল? আমি ঔষধ নিয়ে আসছি। চুপচাপ খেয়ে নিবি।”

অর্পণ চট করে ভূমির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে প্রলয় হা করে তাকিয়ে রয়েছে। অর্পণ ঝড়ের বেগে এলো আবার ঝড়ের বেগে চলেও গেল। সে যে ঘরে রয়েছে‚ তাকে একটিবার গুরুত্বও পর্যন্ত দিল না। ভূমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে। অর্পণের ধমক বাচ্চাদের মতো মাথা নিচু করে শুনছিল। ভাইয়ের বকা খেতে বেশ ভালো লাগছিল তার। এরই মাঝে অর্পণ আবারও চলে এলো। হাতে করে সর্দির ঔষধ নিয়ে এসেছে। ভূমিকে ঔষধটা এগিয়ে দিয়ে এক গ্লাস পানিও দিল। সবাটাই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে প্রলয়। ভূমি ঔষধটা খেয়ে নিল। প্রলয় হাতে তালি দিয়ে বলল‚

“বাহ্! কী দরদ!”

“আমার বোন! দরদ তো থাকবেই।”

হাঁটে হাড়ি ভাঙার ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো হলো ভূমির। প্রলয় কিছুই বলল না। সবই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ কালে কালে এমপি মশাইয়ের কী দুর্দশা নেমে এলো। প্রলয় আগের ভঙ্গিতেই চেয়ে রইল অর্পণ আর ভূমির দিকে৷ তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিক করে হেসে উঠল ভূমি। তার সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে অর্পণও হাসছে। এবার প্রলয় বলল‚

“তোর বোনকে বলিস আজ বারান্দায় আর নয়তো ওয়াশরুমে থাকতে।”

“ও কেন থাকবে? যেহেতু ওর সর্দি লেগেছে তাই সে বিশ্রাম নেবে। তুমিই গিয়ে বারান্দায় আর নয়তো ওয়াশরুমে গিয়ে থাকবে।”

“ওয়াশরুম আমার‚ বারান্দা আমার‚ ঘর আমার‚ বিছানা আমার এমনকি বউটাও আমার। সেই তোরা আমাকে আমার বউয়ের কাছ থেকে আলাদা করে দিলি!”

প্রলয়ের এহেন কথায় সব সময়কার মতো আজও ভড়কে গেল অর্পণ। এভাবেই প্রলয় তাকে সবসময় বোকা বানায়। বিদ্রোহ করে এবার অর্পণ বলল‚ “তুমি নিজেই তো আমার বোনকে আলাদা করে দিচ্ছিলে।”

দুহাত জোড় করে প্রলয় বলল‚ “ঘাট হয়েছে আমার৷ আমার বোঝা উচিত ছিল— এখানে আমার পক্ষে কেউ নেই।”

এবার শব্দ করে হেসে উঠল অর্পণ আর ভূমি। ছোটো বাচ্চাদের মতো করে গাল ফোলাল প্রলয়। অর্পণ তার ঘরে চলে গেল। এত হাসাহাসির মাঝে ভূমি বেমালুম ভুলে গেল‚ তার মাথা ব্যথা করার ব্যাপারটা। হাঁচি দেওয়া আপাতত কমেছে৷ প্রলয় দরজা চাপিয়ে এসে ভূমির পাশে বসল। ভূমির মাথাটা নিজের বুকের উপর রেখে আলতো হাতে চুল টেনে দিল। মাঝে মাঝে মাথাটাও টিপে দিল৷ চোখে বন্ধ করে রয়েছে ভূমি। হয়তো এখন কিছুটা ভালো লাগছে। প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“আরাম লাগছে জান?”

ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে ভূমি বলল‚ “হুম!” প্রলয় বুঝল সর্দির ঔষধ খেয়ে ভূমির ঘুম পাচ্ছে। তাই আর বেশি কথা বাড়াল না৷ কিন্তু এই সন্ধ্যে বেলায় ঘুমলে রাতে ঘুম হবে না। সারাদিনের রুটিন এলোমেলো হয়ে যাবে৷ পরক্ষণেই ভাবল‚ হলে হবে। এই ভেবে ভূমির চুলে আবারও হাত বুলিয়ে দিল প্রলয়৷

অন্যদিকে…

বারান্দায় দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন মেহরাব শিকদার। ফিরোজাকে চা করে আনার বাহানায় ঘর থেকে বের করেছেন তিনি। একটা বড়ো বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেহরাব শিকদার। সেটা তো যে করেই হোক বাস্তবায়ন করতেই হবে৷ ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটার সঙ্গে এতক্ষণ কুশল বিনিময় করলে এবার মোদ্দা কথায় এলেন তিনি।

“তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে৷”

“……”

“শেকড় নড়াতে পারলে গাছ এমনিতেই নড়ে যাবে।”

“……”

“আপাতত এই কাজটা করে দাও। আর হ্যাঁ এর জন্য মোটা টাকা পাবে তুমি। এরপর আমার পথের কা’টা আরেকজনকে সরাতে হবে।”

“……”

“এই জন্যই তো তুমি আমার এতটা বিশ্বস্ত। তোমাকে ভরসা করি বলেই তো সব কথাই তোমাকে বললাম। তা তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?”

“……”

“সময় পেলে আমি নিজেই গিয়ে তোমাকে সব ডিটেইলস দিয়ে আসব। এরজন্য পুরষ্কার হিসেবে টাকা আর মেয়ে দুটোই পাবে।”

“কার সঙ্গে কথা বলছ? আর পুরষ্কার আর মেয়ে এসবের মানে কী?”

হুট করেই ফিরোজার গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। কী করে ব্যাপারটা সামাল দেবেন সেটাই ভাবছেন তিনি! এভাবে হুট করে কথার মাঝেই যে ফিরোজা চলে আসবেন এমনটা তিনি ভাবতেই পারেননি। বড্ড ভুল হয়ে গেল যে! তিনি বললেন‚

“ও কিছু না। আমার একজন কলিগ তার ছেলের জন্য পুত্রবধূ খুঁজছে। আমাকে বলছে পুত্রবধূ খুঁজে দিতে পারলে নাকি পুরষ্কার দেবে।”

জগাখিচুড়ি যা তা বলেই ব্যাপারটা ধামাচাপা দিলেন মেহরাব শিকদার। আপাতত এই ঝামেলা থেকে বাঁচুক তারপর বাকি সব হবে। বোকা ফিরোজাও স্বামীকে বিশ্বাস করে নিলেন অল্পতেই। আর অবিশ্বাস করার মতো তো কোনো কারণ নেই উনার কাছে।

প্লেটে করে ভূমির জন্য খাবার নিয়ে এসেছে প্রলয়। সবে ঘুম থেকে উঠেছে ভূমি। লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিল। এখনো মাথাটা ঝিমচ্ছে। প্রলয় জোড় করেই ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। একবার ঘুম যেহেতু ভেঙেছে‚ এখন আর সারা রাতে ঘুম আসতে চাইবে না৷ বিছানায় থম মে’রে বসে রয়েছে সে। আর প্রলয় তাকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। এই তিনমাসে আগের থেকে কিছুটা মোটা হয়েছে ভূমি৷ নতুন বউ থেকে এখন পুরোনো বউয়ের তকমা লেগেছে। আগে যে-ই বাড়িতে আসত সে-ই বলত‚ ‘কী গো নতুন বউ কেমন আছ?’ আর এখন বলে‚ ‘কী গো প্রলয়ের বউ কেমন আছ? অথবা ভূমি কেমন আছ?’ যাক এই তিনমাসে সম্বোধনের দিক থেকে পরিবর্তন এসেছে৷ বসে বসে হাই তুলছে ভূমি। প্রলয় এসে তার সামনে বসল। হাত ধুয়ে খাবার মেখে মুখের সামনে ধরে ইশারায় ‘হা’ করতে বলল ভূমিকে৷ ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গেই খাবার খেতে শুরু করল ভূমি। ক্ষিধে পেয়েছিল তার৷ সেই দুপুরে খেয়েছিল। এরপর আইসক্রিম ছাড়া আর কিচ্ছুটি খায়নি সে। ঘুমের জন্য আলসেমি ধরছিল বিধায় খেতে ইচ্ছে করছিল না। ওইযে আলসেমি ধরছিল খুব।

বেশ কিছুক্ষণ সময় পর ভূমিকে খাবার খাইয়ে এঁটো প্লেট রান্নাঘরে রেখে এলো প্রলয়। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল ভূমি অলস ভঙ্গিতে বিছানাতেই বসে রয়েছে। মাঝে মাঝে ফোলা ফোলা চোখ কচলে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে হাই তুলছে। চুলগুলো এলোমেলো বিনুনি গাঁথা। ভূমির গাল দুটোতে শব্দ করে চুমু খেতে ইচ্ছে করল প্রলয়ের। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে খুবই অভিলাষিণী লাগছে। প্রলয় গিয়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে দিল। এরপর সোজা বিছানায় চলে এলো। এসির পাওয়ার কমিয়ে দেওয়া। ভূমিকে টান দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। প্রলয়ের এহেন কাজে ভড়কে গেল ভূমি। তবুও কিছু বলল না৷ প্রলয় কখন কী করে বুঝে আসে না তার। এমপি মশায়ের এই বাচ্চামো স্বভাবটা হয়তো কখনো যাবার নয়। এসব ভাবনার মাঝেই ভূমির বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে প্রলয়। একহাতে এমপি মশাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ভূমি। আর এদিকে প্রলয় তার ভূমির কন্যার আরেক হাতের উল্টো পিঠে বেশ কয়েক বার চুমুও এঁকে দিচ্ছে। ঘরে নীলচে ঘুম বাতি জ্বলছে। ভূমির বুকের উপর থেকে মাথা তুলে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“আজ একটু আদর করি বউ?”

“ঘুমান। আমারও ঘুম পাচ্ছে।”

“কিন্তু আমার তো বাসর রাতের ফিলিংস হচ্ছে।”

“বাসর রাত তিনমাস আগেই শেষ। তাই আপনিও ঘুমান আর আমাকেও ঘুমতে দিন।”

“বউ যদি কাছে থাকে তাহলে প্রতিটা রাতই বাসর রাত।”

“আপনি আবারও বাজে বকা শুরু করলেন?”

“বাজে কথা কোথায় বললাম? সত্যি কথাই তো বললাম৷ এটা শুধু আমার কথা না— সমগ্র পুরুষজাতির মনের কথা।”

“আপনি তো সর্বজ্ঞ!”

“অবশ্যই। আমি হচ্ছি এ শহরের এমপি। পুরুষজাতির মনের কথা জানাটা আমার দায়িত্ব।”

শুরু হয়ে গেল প্রলয়ের অযৌক্তিক কথাবার্তা। একে তো সন্ধ্যে বেলা ঘুমনোর কারণে এখন তার মোটেও ঘুম পাচ্ছে না তারউপর এই রাতবিরেতে প্রলয়ের এই সমস্ত কথাবার্তা হজম করতে হচ্ছে তাকে৷ ভূমি প্রত্যুত্তর করছে না দেখে প্রলয় নিজে থেকেই আবার বলল‚

“তুমি একটা জিনিস খেয়াল করেছ? আমাদের এখনো মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া হয়নি।”

“তাতে কী? আর গিয়েই বা কী হবে?”

“আমাদের ভালোবাসায় মিষ্টত্ব বাড়বে।”

“কেন এখনের ভালোবাসা বুঝি তেঁতো হয়ে গেছে?”

“তেঁতো হবে কেন? আমার বউ এবং তার ভালোবাসা তো মিষ্টির থেকে অধিক মিষ্টি৷ তবে আমার এই অধিক মিষ্টির চাইতেও অধিক মিষ্টি চাই৷ ইউ নো না— তোমার এমপি মশাই একটু বেশিই রোমান্টিক?”

“এত লাগাম ছাড়া হবেন না এমপি মশাই।”

“বউয়ের সামনেই তো লাগাম ছাড়া হতে হয়। তা না হলে কী এত আদর করতে পারতাম নাকি?”

ভেংচি কাটল ভূমি। অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। রাত তো কম হচ্ছে না। এদিকে ঘুমও আসছে না। কেমন প্যাঁচার মতো করে জেগে রয়েছে। প্রলয় ভূমিকে নিজের দিকে ফেরাল। সে থাকতে কেন তার বউ অন্যপাশ ফিরে ঘুমবে? বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জাপ্টে ধরে না ঘুমবে! তাহলেই তো ঘুমটা গভীর হবে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here