#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
আজ কলেজে প্রথম দিন পূর্ণতা পুষ্পিতার। কলেজের প্রথম দিন নিয়ে দুজনের মাঝে বেশ উচ্ছাস। সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগেছে দুজন। উচ্ছ্বসিত হয়ে খুব তাড়াতাড়িই তৈরি হয়ে নিয়েছিল দুজনে। ফিরোজার জ্বর অনেকটাই কমে এসেছে। সকাল থেকে জ্বর নেই বললেই চলে। তবুও উনাকে বিছানা ছাড়তে বারণ করেছেন মাধুরী। সবে জ্বর থেকে উঠছেন। দু একদিন বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। সকালের নাস্তা মাধুরী নিজের হাতেই করেছেন। ভূমি আজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে সেই সকাল থেকেই। প্রলয় আজ কিছুটা ব্যস্ত থাকবে। আজ তার সংসদ সভায় যাওয়ার কথা। সেও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। উঠেই গোসল করে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে নিয়েছে। তার উপর কালো কটি। ভেজা চুলগুলো তাড়াতাড়ি করে শুকিয়ে নিয়ে স্যাট করেছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার কলেজ সকাল আটটা পনেরো থেকে শুরু। প্রলয় নিজেই ওদের দুজনকে কলেজের সামনে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এরপর আবার বের হবে সকাল দশটার দিকে। ভূমি রান্নাঘরে এসে যখন দেখল মাধুরী সকালের নাস্তা সব বানিয়ে রেখেছেন‚ তখন কিছুটা কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল তার৷ না জানি শাশুড়ী মা কখন কী বলে উঠেন! তিনি যে এখনো তাকে মেনে নিতে পারেননি সেটা ভূমি খুব ভালো করে বুঝতে পারে। অন্যদের ক্ষেত্রে ভালোবাসা মিললেও তার প্রতি অবহেলায় জুটেছে৷ এ বাড়িতে দুজন মানুষ হয়তো তাকে কখনোই মেনে নিতে পারবেন না৷ এক হলো মাধুরী। আরেকজন হলো তার জন্মদাতা পিতা। যিনি কি-না তাকে জন্মের আগেই মে’রে ফেলতে চেয়েছিলেন৷ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যান নিজের পথের কা’টা কীভাবে সরাবেন! ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভূমি।
মাধুরী টেবিলে খাবার রাখছেন৷ ভূমিকে বললেন ফিরোজাসহ বাকিদেরকে ডেকে নিয়ে আসতে। ভূমিও উনার কথানুযায়ী সবাইকে ডাকতে চলে গেল। প্রথমে পূর্ণতা পুষ্পিতা‚ প্রলয় আর অর্পণকে ডেকে ভূমি নিচে নেমে এলো। এরপর মোর্শেদ শিকদারকে ডেকে ভূমি গেল মেহরাব শিকদারের ঘরের দিকে। তখনই দেখা হয়ে গেল মোরশেদ শিকদারের সঙ্গে। তিনি সবে ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন। ভূমিকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এই সময় ভূমিকে আশা করেননি তিনি। আজকের দিনটার কথা ভাবতেই উনার খুব আনন্দ লাগছে। এবার খুব বড়োসড়ো পরিকল্পনা করেছেন তিনি। ভূমিকে কিছুটা বাজিয়ে দেখার জন্য মেহরাব শিকদার বললেন‚
“ডক্টর মেহরাব শিকদারের মুখোশ কীভাবে উন্মোচন করবে‚ কিছু ভেবেছ?”
ভূমি চকিত দৃষ্টিতে তাকাল মেহরাব শিকদারের দিকে। লোকটার চোখমুখে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। দুদিনের মাঝে কী এমন হলো যে‚ নিজের মাঝে এতটা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেলেন তিনি? সেদিন তো ভূমির কথার প্রত্যুত্তরে কোনো উত্তরই দিতে পারছিলেন না৷ এত পরিবর্তনের কোনো উত্তর খুঁজে পেল না ভূমি। মেহরাব শিকদার আবারও বললেন‚
“আমার সঙ্গে লাগতে এসো না মেয়ে৷ দুনিয়াটা তুমি এখনো দেখনি।”
“আপনার এই ভালো মানুষের মুখোশ সবার সামনে উন্মোচন করতে দুনিয়াটা ঠিক কতখানি দেখা উচিত?”
চরম বিরক্ত মেহরাব শিকদার। চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না উনার। চোখ দিয়েই অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। মেহরাব শিকদার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন‚
“আচ্ছা ঢাঁট আর ধুরন্ধর মেয়ে তো তুমি!”
ভূমি তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল‚ “একই র’ক্ত কি-না!”
“বয়স কম তো তাই র’ক্ত গরম। অন্যের চরকায় তেল না দিয়ে নিজের চরকায় তেল দাও।”
“সেটাই দিচ্ছি।”
কথাটা বলেই ভূমি ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। মেহরাব শিকদার বৈঠকখানার দিকে চলে গেলেন। ঘরে ফিরোজা বিছানা গোছাচ্ছেন। ভূমি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি গাল এলিয়ে হাসলেন। উনার হাত থেকে বিছানা ঝাঁট দেওয়ার ঝাঁটাটা নিজের হাতে নিয়ে বলল‚
“আমি করে দিচ্ছি চাচি মা৷ তুমি এখন কেমন আছ?”
“আমি ঠিক আছি ভূমি। তুমি এত ব্যস্ত হইয়ো না।”
ভূমিকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন ফিরোজা। ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মেহরাব শিকদার। চেয়ারে বসে রয়েছে অর্পণ। দুজনের দৃষ্টিই ফিরোজা আর ভূমির দিকে। দুজনেই জানেন ভূমির আসল পরিচয়। অর্পণ ক্ষীণ হাসল ওনাদের ভূমি আর ফিরোজাকে দেখে৷ দুজন কী সুন্দর মা মেয়ের মতো একসঙ্গে হেঁটে এলো৷ অর্পণের খুবই ভালো লাগল। এদিকে মেহরাব শিকদারও এদিকেই তাকিয়ে অথচ উনার চিন্তাভঙ্গিই আলাদা। তিনি ভাবছেন কী করে ভূমিকে সরানো যায়!
দুপুরে…
আজ দুপুর থেকে মনটা ভালো না ভূমি। ভেতরটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগতে শুরু করেছে! কোনো কাজে মন বসাতেই পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই। এইতো দুপুরেও রান্না করতে গিয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। তারপর আর কী? পুরোটা তরকারি পুরে কয়লা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভূমির ওড়নায় আগুন লেগেছিল। তখন রান্নাঘরে মাধুরী ছিলেন৷ তিনিই তাড়াহুড়ো করে চুলো নিভিয়েছেন। ভূমির ওড়না থেকে আগুন নিভিয়েছেন। তবে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন‚ “মন কোথায় থাকে? কী এত ভাবছ? রান্নাতে মনোযোগ দাও। আমি না থাকলে কী হত ভাবতে পারছ?” ঠিকই তো বলেছেন তিনি। যদি ওড়নায় পুরোপুরি ভাবে আগুন লেগে যেত? কী অঘটনটাই না ঘটত! ভাবতে শিউরে উঠল ভূমি৷ মাধুরী তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। বাকি কাজটা তিনি আর ফিরোজা সামলে নিতে পারবেন৷ ঘরে এসে আবারও অন্যমনস্ক হয়ে গেল ভূমি। সে কী ভাবছে নিজেও বুঝতে পারছে না! সময় অতিবাহিত হতে লাগল। ভূমি একটিবার ভাবল হয়তো গোসল করলে শরীরটা হয়তো একটু ভালো লাগবে তাই সে নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
❑
সন্ধ্যেবেলা পূর্ণতা পুষ্পিতার নতুন টিউটর এসেছিলেন। শুরু থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে ওরা। মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে খুবই স্ট্রিক্ট মোর্শেদ শিকদার। যা-ই হয়ে যাক না কেন পড়াশোনা সময় মতো হওয়া চা-ই চাই! ছোটো থেকেই ওদের জন্য বাসায় টিউটর রাখা হয়৷ স্কুল‚ কলেজ ছাড়া বাহিরে যাওয়া হয় না ওদের। যা দরকার হয় তা বড়ো ভাইয়া আর নয়তো ছোটো ভাইয়া কিনে এনে দেয়। আর নয়তো মাকে জানায়। এদিকে টানা দেড় ঘণ্টা পড়াশোনা করে খুবই ক্লান্ত পূর্ণতা পুষ্পিতা। ভাবল একটিবার তাদের ভাবিমণির সঙ্গে দেখা করে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ৷ দুবোনই চলে গেল তাদের ভাবির কাছে। ভূমি তখন হাতে থাকা কাপড়চোপড় গুলো বিছানার উপর রাখছিল। এগুলো সবেই বারান্দা থেকে এনেছে। পূর্ণতা পুষ্পিতা এবার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ভূমি এবার তাদের দুজনকে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমাদের কলেজের প্রথম দিন কেমন কাটল?”
দাঁড়িয়ে থেকে আড়মোড়া ভেঙে পূর্ণতা বলল‚ “খুবই ভালো কেটেছে ভাবিমণি।”
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে পুষ্পিতা বলে উঠল‚ “তুমি জানো ভাবিমণি আমাদের অনেকগুলো নতুন বন্ধু হয়েছে৷ মেয়েগুলো খুব ভালো আর মিশুক।”
“ওদের মিশুক মনে হয়েছে কারণ আমার রায়বাঘিনী ননদিনীরা যে এত এত ভালো আর মিশুক!”
পূর্ণতা এসে ভূমিকে জড়িয়ে ধরে বলল‚ “আমাদের ভাবিমণিও যে খুব খুব খুব ভালো আর মিশুক। এইযে কত তাড়াতাড়ি আমাদের সবার সঙ্গে সহজ হয়ে গিয়েছ৷ আমাদের পরিবারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছ। মায়ের সমস্ত কটু কথা নীরবে সহ্য করেছ।”
“হয়েছে— হয়েছে!”
এবার পুষ্পিতা এসে ভূমির গাল দুটো টেনে দিয়ে বলল‚ “অ্যাই পূর্ণ! তুই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”
পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল‚ “কী?”
“আমাদের ভাবিমণি আগে থেকে গোলুমোলু হয়ে গিয়েছে৷ এখন তাকে দেখতে আরও বেশি সুন্দরী লাগে।”
পূর্ণতা পুষ্পিতার গাল দুটো টিপে দিয়ে এবার ভূমি বলল‚ “তোমাদের বেশি বেশি ভালোবাসায় আমি মোটু হয়ে গিয়েছি।”
এরপর তিনজনই খিলখিল করে হেসে উঠল৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা গিয়ে বিছানায় আয়েশ করে বসল। এদিকে ভূমি শুকনো কাপড়চোপড় গুলোকে গোছাতে শুরু করল৷ দুপুরে ধুয়ে দিয়েছিল। সবগুলোই প্রলয়ের জামাকাপড়। বিছানায় আধশোয়া হয়ে নিজেদের মাঝেই কথায় মশগুল পূর্ণতা পুষ্পিতা। এরই মাঝে হতভম্ব হয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল প্রলয়। তাকে দেখা মাত্রই পূর্ণতা পুষ্পিতা নিজেদের ঘরে চলে গেল৷ বড়ো ভাইয়া সবে বাহির থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজন তাই তারা তার ভাই ভাবিকে কিছুটা স্পেস দেওয়ার জন্যই মূলত চলে গিয়েছে। বিছানার উপর গুছিয়ে রাখা কাপড়চোপড় গুলোকে ওয়ারড্রব রেখে দিল৷ এদিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে প্রলয়। সে যে গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পারল ভূমি৷ সে গিয়ে প্রলয়ের সামনে দাঁড়াল৷ কাঁধে হাত রাখতেই প্রলয় মুখ তুলে তাকাল। লোকটার চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে৷ লোকটা কী কোনো কারণে রেগে আছে? বুঝতে পারল না ভূমি। হুট করে প্রলয় তাকে জড়িয়ে ধরল৷ প্রলয়ের শরীরটা কিছুটা গরম রয়েছে। জ্বর টর এলো না তো? ভূমি তার কপালে হাত রাখল। কপালও কিছুটা গরম। প্রলয় তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতেও অসুবিধে হচ্ছে ভূমি। এভাবেই কিছুটা সময় কে’টে গেল৷ ভূমিও কিছু বলল না। কিছু হলে তো নিজে থেকেই বলবে! এমন কোনো কথা নেই যা এমপি মশাই তার থেকে লুকিয়ে রাখে৷ অথচ সে তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্যিটাই লুকিয়েছে প্রলয়ের কাছ থেকে। হয়তো কোনো একদিন সব সত্যিই উদঘাটন হবে অথবা হবে না! সময় অতিবাহিত হতে থাকল। প্রলয় মুখ তুলে ভূমিকে তাড়া দিয়ে বলল‚
“আমাদের আজ অনিন্দ্যনগর যেতে হবে।”
অনিন্দ্যনগরের নাম শুনে সহসাই অবাক হলো ভূমি। সেই সঙ্গে চিন্তার ভাজ পড়ল গৌর সুশ্রীতে। ভূমি জিজ্ঞেস করল‚
“কিন্তু কেন? হঠাৎ করে গ্রামে কেন যাব? আপনি আগে তো বলেননি যে‚ আজ আমরা গ্রামে যাব?”
এই মুহূর্তে কোনো কিছুই ভালো লাগছে না প্রলয়ের৷ তারউপর ভূমির ক্রমাগত প্রশ্নে চরম বিরক্ত সে। তাই কিছুটা ধমকে বলল‚
“এত প্রশ্ন ভালো লাগছে না। তুমি রেডি হবে?”
হুট করে প্রলয়ের এমন ব্যবহার খুবই অবাক করল ভূমিকে৷ সেই সঙ্গে কিছুটা খারাপও লেগেছে৷ কই এই তিনমাসে তো ভুল করে খারাপ ব্যবহার করেনি লোকটা। তাহলে আজ কী হলো? অনিন্দ্যনগরের নাম শুনে হুট করেই ভূমির মনটা কু গাইছে। ভেতরটা ধক করে উঠল ভূমি। অসাড় হাত-পা কেঁপে উঠল৷ মনের ভেতর তো অনেক কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে! প্রলয়কে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। ভূমি শুকনো ঢোক গিলে বলল‚
“এমপি মশাই! আমার আম্মা ঠিক আছে তো?”
চলবে?…..