#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সারা সন্ধ্যা পেরিয়ে রজনি নেমেছে ধরিত্রীর বুকে। বেলা কী অবলীলায় অতিবাহিত হচ্ছে! পুরো একটা দিন ভূমির কোনো খোঁজ নেই। বিকেলে প্রলয়ে বেরিয়েছিল‚ কারো সঙ্গে দেখা করতে। এরপর ভর সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরেছে। এসেই একঘণ্টা লাগিয়ে গোসল করেছে৷ বিকেল থেকেই তার মাথা ব্যথা৷ কড়া করে একবার কফি খেয়েছিল কিন্তু মাথা ব্যথা কমা তো দূর উল্টো বেড়ে গিয়েছে। অন্য সময় হলে ভূমি তার মাথাটা টিপে দিত। তবে আজ তার ঘর ফাঁকা৷ শূন্য ঘরটায় থাকতে ইচ্ছে করে না। ভূমির স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে৷ ভেতরটা হাহাকারে নিমজ্জিত। বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষে তারার মেলা। একফালি রূপালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। ভেজা চুল নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়৷ একদৃষ্টে জোছনায় আচ্ছাদিত অম্বরে তাকিয়ে রয়েছে সে৷ বারবার ভূমির বলা কথা গুলো মনে পড়ছে। প্রলয় যখনই ভেজা চুল না মুছে বসে থাকত তখনই ভূমি বলত‚ “আপনাকে কতবার বলেছি— অসময়ে গোসল করবেন না।” ভূমির কথাগুলো মনে পড়তেই একা একা হাসতে লাগল প্রলয়৷ একা একাই বলল‚
“কেন তুমি আমার পাশে নেই ভূমি কন্যা? আমার যে তোমাকে ছাড়া একমুহূর্ত সহ্য হয় না। তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী যে বেরঙিন। নিজের একাকীত্ব আমি বেশ ভালো উপলব্ধি করতে পারছি। প্লিজ তুমি আমার কাছে ফিরে এসো!”
❑
বিছানায় বসে রয়েছে ভূমি। কিছুক্ষণ আগেই এশারের নামায আদায় করে বিছানায় এসে বসেছে৷ ঘরে সে একাই রয়েছে। দরজা বাহির থেকে আটকে দেওয়া। পুরো ঘরটা জানালাবিহীন। এ ঘরে থাকতে দমবন্ধ লাগে ভূমির। তিথি কোথাও নেই৷ হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত৷ যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল ঘর থেকে বের না হতে৷ তিথি নিজেই বাহির থেকে দরজা আটকে দিয়ে গিয়েছে। বাহিরে এখন বেগানা মানুষের চলাচল শুরু হয়ে যাবে। ভূমিকে দেখলে যে কেউই আকর্ষণ অনুভব করতে পারে। সভ্য সমাজের মুখোশধারী পুরুষদের হাত থেকে বাঁচাতে তিথি ঘরের দরজাটা বাহির থেকে আটকে দিয়ে গিয়েছে। এঘরে অ্যাটাচড ওয়াশরুম রয়েছে তাই আর কোনো অসুবিধে হবে না ভূমির। এরই মাঝে ঘরের দরজা খোলার শব্দ হয়। ভূমি ভেবে নেয় হয়তো তিথি এসেছে৷ তাই সে সেভাবেই বসে থাকে। তবে হুট করে এ ঘরে মেহরাব শিকদারকে দেখে অবাকের চরম শীর্ষে ভূমি৷ ঠিকঠাক হয়ে বসতেই মেহরাব শিকদার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। সুযোগ বুঝে হসপিটাল থেকে ফেরার পথে এখানে এসেছেন৷ সন্ধ্যেবেলা ফিরোজাকে কল করে বলেছেন আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে উনার৷ উনাকে এখানে দেখে চকিত কণ্ঠে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚
“আপনি এখানে?”
“কেন আমাকে এখানে আশা করোনি বুঝি?”
আজ আর নিজেকে দূর্বল ভাববে না ভূমি। এখন থেকে প্রত্যেককেই যোগ্য জবাব দিতে হবে৷ তাই ভূমি কিছুটা তেজি স্বরে বলল‚
“ভেবেছিলাম আপনিই সবকিছুর মূলে রয়েছেন। তবে আমার ভাবনাই যে সঠিক তা ভাবতেই পারিনি। একটু বেশিই অবাক হয়েছি৷ একটা মানুষ এতটা নরপি’শাচ কী করে হতে পারে?”
ভূমির কথাতে রাগ হলেও আজ নিজের রাগ সংবরণ করলেন মেহরাব শিকদার। ভূমিকে কথা বলার সুযোগ দিলেন তিনি। মুখে বললেন‚ “আজ সুযোগ আছে যা ইচ্ছে বলতে পারো।”
“একটা সত্যি কথা বলুন তো!”
মেহরাব শিকদারের চোখমুখ বলে দিচ্ছে তিনি ভূমির উপর চরম বিরক্ত। সেই বিরক্তিমাখা কুঁচকানো চোখে ভূমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “কী?”
“আমার আম্মার মৃ’ত্যুর পেছনে আপনার হাত আছে তাইনা?”
“খুবই বুদ্ধিমতী তুমি৷ এত তাড়াতাড়ি বুঝে যাবে ভাবতেই পারিনি।”
“কেন মে’রেছেন আমার আম্মাকে?”
“কেন আবার! তোমার আম্মা আমাকে হুমকি দিয়েছিল‚ সব সত্যিটা ফিরোজা আর সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবে৷ আমি তা কী করে হতে দিই? তাইতো সময় থাকতেই একটা পথের কা’টা দূর করেছি৷”
“তাহলে আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন? আমিও তো আপনার পথের কা’টা!”
“কেন জানি— তোমাকে আমার মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করল না। র’ক্তের টানও বলতে পারো।”
তাচ্ছিল্য করে হেসে ভূমি বলল‚ “র’ক্তের টান? বাহ্!”
“তবে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তো নরপি’শাচ! তোমাকে পিংকির হাতে তুলে দিয়েছি তার একটাই কারণ— তোমাকে সারাজীবন তড়পাব বলে।”
একটু থেমে মেহরাব শিকদার আবারও বললেন‚ “মৃ’ত্যুর আগে তোমার আম্মা খুব তড়পেছে৷ ভিডিও কলে তো সবটাই দেখছিলাম।”
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ভূমির। সবকিছু ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে করল৷ তুমুল ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে শুরু করল‚
“যেভাবে আপনি আমার আম্মাকে খু’ন করেছেন— তার থেকে কঠিন মৃ’ত্যু আমি আপনাকে দেব৷ বাঁচতে কে না চায়? আপনিও বাঁচার জন্য একটু একটু করে তড়পাবেন। কিন্তু আমি আপনাকে এমন মৃ’ত্যু দেব যে‚ আপনার ❝কাঁটামুকুট❞ এর প্রত্যেকটা কামরা কেঁপে উঠবে৷ সেখানেই আপনার মৃ’ত্যু শিরোধার্য। আপনার ধ্বংসোন্মুখ ক্রমশ এগিয়ে আসছে৷ যতদিন ইচ্ছে হয় নিজের পাপ আরও বাড়িয়ে নিন। আমি যদি বেঁচে থাকি তবে মেহরাব শিকদারের মতো পাপকৃৎ-কে একদিন না একদিন এই আমার হাতেই ম’রতে হবে। আপনার ধ্বংসেই আমি হব রণরঙ্গিণী।”
এদিকে রাগের পাশাপাশি “কাঁটামুকুট” এর নাম শুনে ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। এই কথা তো ভূমির জানার কথা না৷ তাহলে কী মহুয়া সব সত্যিই ভূমিকে জানিয়ে দিয়েছিল? মেহরাব শিকদার ভয় পেতে শুরু করলেন৷ তবে ভূমির সামনে তা প্রকাশ করলেন না৷ মেহরাব শিকদারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ দমিত হয়েছেন। আড়ালেই ভূমি হাসল৷ মেহরাব শিকদারকে বলল‚
“ভয় পেলেন নাকি?”
কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই মেহরাব শিকদার বললেন‚ “কাঁটামুকুটের কথা তুমি কী করে জানলে?”
“কাঁটামুকুটের কথা শুনেই ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার? আপনার কী মনে হয়েছিল— আমি কিছুই জানি না? তাহলে আপনি ভুল। আপনার সব অপকর্মের সাক্ষী যেমন আমার আম্মা ছিল। তেমনই আমিও সব সত্যি জানি। এমন আরেকজন আছেন‚ যিনি আপনার অপকর্ম সম্পর্কে অবগত।”
একটু থেমে ভূমি আবার বলল‚ “আপনি আম্মাকে আর আমাকে মে’রে ফেলতে পারলেও‚ তাকে কখনো ছুঁতেও পারবেন না৷ তাকে মে’রে ফেলার কথা ভাবলেও আপনার বুক কেঁপে উঠবে।”
ভূমির কথাগুলো শুনে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালেন না মেহরাব শিকদার। বড়ো বড়ো পা ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান নিলেন। উনাকে ভয় পেতে দেখে ভূমি হাসল। শব্দ করেই হাসল সে। মেহরাব শিকদারকে ভয় পেতে দেখে আনন্দ লাগছে ভীষণ। ধ্বংসলীলা সবে তো শুরু। এখনো অনেক কিছুই দেখার বাকি আছে। মহুয়াকে কষ্ট দেওয়া‚ খুন করার শাস্তি তো মেহরাব শিকদার অবশ্যই পাবেন৷ একদিন পরে হোক বা এক বছর পরে— শাস্তিও উনাকে পেতেই হবে।
রাত সাড়ে এগারোটা…
সবাই এতক্ষণে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ শুধু ঘুম নেই প্রলয়ের চোখে৷ বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ভূমির চিন্তা তাকে একমুহূর্তের জন্য ঘুমতে দেয় না। মেয়েটা কী অবস্থায় আছে তা জানা নেই তার৷ আদতে সুস্থ আছে তো? না! এমন কথা সে কিছুতেই ভাববে না৷ অবশ্যই তার ভূমি কন্যা ঠিক আছে— সুস্থ আছে৷ প্রলয় তার ফোনটা বের করে রবিনের নাম্বারে কল লাগাল। কল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রবিন রিসিভ করল। প্রলয় নিজে থেকেই বলল‚
“রবিন তোকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কালকের মধ্যেই আমার সব ডিটেইলস চাই।”
“……”
“চব্বিশ ঘণ্টা চোখে চোখে রাখবি৷ কোথায় যাচ্ছে— কী করছে! সব খবর আমার চা-ই চাই।”
“……”
“ওকে তো আমি হাতেনাতে ধরতে চাই৷ যদি আমার সন্দেহ সঠিক হয় তাহলে ওকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব৷ আর সেহরিশ আরশান প্রলয়ের পক্ষ থেকে শাস্তিটা হবে ভয়ঙ্কর। কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।”
“……”
“নিজের কাজে লেগে পড় ভাই৷ কাল আমি একবার দেখা করে আসব। রাখছি এখন।”
কল কে’টে দিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল৷ বিছানার অয়াশের টেবিলের উপর সিগারেটের প্যাকেট রাখা। কিন্তু প্রলয় তা ছুঁয়েও দেখল না৷ ভূমিকে বলেছিল সিগারেট ছোঁবে না৷ পরপরই তাচ্ছিল্য করে হাসল৷ আজ সিগারেটের ধোঁয়াও তাকে মানসিক প্রশান্তি দেবে না৷ মানসিক প্রশান্তি তো একমাত্র তার ভূমি কন্যার বক্ষঃস্থলেই মেলে।
গভীর রাত…
দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না ভূমি। আম্মা তার জীবন থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত বিপদ এসে হানা দিয়েছে৷ প্রিয় মানুষগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে৷ দুটো মানুষই তো তার জীবনের একটিমাত্র অবলম্বন। প্রলয়কে খুব মনে পড়ছে না৷ সে কেন তাকে উদ্ধার করতে আসছে না? আদতেও কী প্রলয়ের সঙ্গে তার দেখা হবে আর? নাকি এভাবেই দুজনের পথ চিরতরে আলাদা হয়ে গেল? অক্ষিকোটর হতে উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। একদিকে মায়ের শূন্যতা অন্যদিকে প্রিয়র কাছ থেকে এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া মানতে পারছে না ভূমি৷ গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ জীবনটা কেন সহজ সরল হলো না? জীবনে এত জটিলতা তো সে কখনোই চায়নি। ডুকরে কেঁদে উঠল ভূমি৷ ভেতরে তীব্র হাহাকার। রাতের এই নিস্তব্ধতার গুমোট অনুভূতি জেঁকে বসেছে৷ একা ভয় লাগতে শুরু করল৷ পরক্ষণেই মনে পড়ল সে তো আর একা নেই। তারই মাঝে আরেকটি অস্তিত্ব একটু একটু করে বেড়ে উঠছে৷ নিমিষেই সমস্ত মন খারাপেরা পালিয়ে গেল৷ বাঁচার আশা খুঁজে পেল ভূমি। এখান থেকে যে করেই হোক সে পালাবেই৷ বাহিরে কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। একেরও অধিক হতে পারে৷ ভূমি তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে নামল। এরপর গিয়ে দরজাটা ভালো করে আটকে দিল৷ যাতে করে কেউ এ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে৷ তিথির কথা মনে পড়তে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখানে বন্দী পড়ে কতই না কষ্ট সহ্য করছে৷
চলবে?…..