#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৬
________________
থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে রাগান্বিতা। মুখে কথা নেই। নির্জীব চুপচাপ পরিবেশ। রাতের আকাশটাও বুঝি গেল থমকে। রাগান্বিতার পানে তাকালো দাদিমা। অশ্রুভেজা চোখ নিয়েই বললেন তিনি,
“রাগান্বিতা,
রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো দাদিমার পানে। চোখদুটোতে কেমন পানি টলমল করছে। দাদিমা বললেন,
“কাইন্দো না রাগান্বিতা।”
রাগান্বিতা আরো অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। কিছু ভেবে প্রশ্ন করলো,
“আপার কার সাথে সম্পর্ক ছিল?”
“জানি না।”
“আপারে তো কখনো সেইভাবে কোনো মানুষের সাথে কথা বলতে দেখি নি। আপা তো ঘর থেকেই বের হতো না। গ্রামের অনেক মানুষই তো আপারে ঠিকভাবে চিনতো না। তাহলে?”
“এগুলান কিছু জানি না।”
রাগান্বিতা আবার চুপ হয়ে গেল। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। রাগান্বিতা নিজের চোখ মুছলো। শান্ত গলায় বললো,
“এগুলো সব মিথ্যে আমার আপা পবিত্র ছিল। তুমি মিথ্যে কথা বলছো।”
“মিথ্যে কইলেই সব সত্য মিথ্যে হইয়া যায় না রাগান্বিতা।”
রাগান্বিতা দমে গেল সত্য এত কঠিন কেন। রাগান্বিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলো,
“আর শাপলার সাজ।”
এবার যেন থমকে গেলেন দাদিমা এই কথা কি রাগান্বিতাকে বলা ঠিক হবে। মোতালেব তো বারণ করেছিল।’
“কি হলো কথা বলছো না কেন?”
“হাপলার লগে কুনো কতা আছিল না।”
“তুমি ভয় কেন পেয়েছিলে সত্যি করে বলো?”
“তুমারে কইছিলাম তো ওসবে পোকামাকড় সাপকোপ থাহে।”
রাগান্বিতার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হলো। সে জোরালো গলায় বললো,“মিথ্যে বলো না দাদিমা।”
দাদিমা তাও চুপ করে রইলেন। ভিতরে ভিতরে কি যেন ভাবছেন। রাগান্বিতা দাদিমার হাবভাব প্রখর করলো। বললো,
“তুমি আজও ভয় পাচ্ছো কি লুকাচ্ছো আমার থেকে বলো দাদিমা, আপার সাথে জড়িত নয় তো।”
এবার যেন আরো ঘাবড়ে গেলেন দাদিমা। এবার কি বলবেন তিনি। রাগান্বিতা দাদিমার হাত ধরে বসলো। নিজেকে ধাতস্থ করে প্রশ্ন করলো,
“আমি জানি বাবাও কোনো এক ভয়ের কারণে আমায় দ্রুত বিয়ে দিতে চেয়েছিল বাবার সেদিনকার থাপ্পড় দেয়াটা আমায় নিশ্চিত করেছে তা। আমি জানি তুমি সব জানো আমায় বলো দাদিমা।”
দাদিমা ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠলেন,“তুমার আব্বায় না করছে।”
রাগান্বিতা এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো তার মানে এদের মাঝে সত্যি কোনো কথা লুকানো আছে। রাগান্বিতা বললো,“তার মানে আমি যা ভেবেছিলাম তাই সত্যি তোমরা আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো।”
দাদিমা নিজের কথার জালে যেন নিজেই ফেঁসে গেলেন। আজ বোধহয় কোনো কথাই আর লুকানো যাবে না। রাগান্বিতা আবারও প্রশ্ন করলো,“আমায় সবটা খুলে বলো দাদিমা, আমি বাবাকে কিছু বললো না।”
দাদিমা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,“একদিন কু..
আর কিছু বলার আগেই সদর দরজার সামনে দিয়ে এক বিকট শব্দ আসলো দাদিমা রাগান্বিতা দুজনেই যেন চমকে উঠলো। দাদিমা বললেন,“এত জোরে শব্দ আইলো কিসের কেউ পইড়া গেল নাকি।”
রাগান্বিতা দাদিমা দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। দরজার সামনেই ইমতিয়াজকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে দুজনেই থমকে গেলেন। রাগান্বিতা তো স্তব্ধ হয়ে ছুট্টে গেল সামনে ইমতিয়াজের মাথাটা নিজের কোলে রেখে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“এসব কি করে হলো?”
তখনই দাদিমা দেখলেন ইমতিয়াজের কপাল চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। দাদিমা ঘাবড়ে গেলেন। বললেন,
“এহনো রক্ত পড়তাছে রাগান্বিতা হয়ালে কবিরাজ গো ডাহা লাগবো তুমি নাতজামাইরে নিয়া কক্ষে যাও আমি এখনই মোতালেবরে ডাকতাছি।”
দাদিমা থরথর করে বেরিয়ে গেলেন। আর রাগান্বিতার শরীর কাঁপছে। বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। ইমতিয়াজের এমন অবস্থা হলো কি করে? কে মারলো তাকে।”
——
রাত জুড়ে বিষণ্ণতা। পালঙ্কে শুয়ে আছে ইমতিয়াজ তার পাশেই কবিরাজ হাকিব বসা। ইমতিয়াজের কপালের অংশটায় বেশ খানিকটা জায়গায় জখম হয়েছে কেউ ভাড়ি কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করেছে। কবিরাজ তার হাতে বানানো কিছু জড়িবুটি দিয়ে মাথায় পট্টি বেঁধে দিল ইমতিয়াজের। সাথে ঔষধ দিলেন কিছু। ক্ষত স্থানে পানি লাগাতে বারণ করেছেন। ইমতিয়াজের পাশেই মোতালেব তালুকদার, কাশেম আর দাদিমা বসা। রাগান্বিতা কিছুটা দূরে আর দুয়ারের কাছ দিয়ে রেজওয়ান দাঁড়ানো তাদের কারো মাথাতেই আসছে না ইমতিয়াজের এমন অবস্থা হলো কি করে! কবিরাজ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
“কপাল দিয়া অনেকখানি রক্ত পড়ছে। ফাইট্টাও গেছে অনেকখানি শহরে নিলে মনে হয় বেশি ভালো হইতো। আমার যা দেওয়ার দিলাম আজ রাতে এমনই থাকুক পারলে কাইলগো শহরে নিয়া দেখাইয়েন।”
কবিরাজের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে গেলেন সবাই। মোতালেব কাশেমরে ইশারায় কবিরাজকে বাহিরে নিয়ে যেতে বললো। কাশেমও তাই করলো। ওনারা যেতেই মোতালেব প্রশ্ন করলো,
“এসব কি করে হলো জামাই?”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো মেয়েটার চোখ ছলছল করছে। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরালো মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি জানি না কে করলো। কিছুক্ষণ আগে আমি বাড়ির দিকেই ফিরছিলাম রাস্তায় হঠাৎই কে জেনো সামনে এসে ভাড়ি কিছু দিয়ে কপালে আঘাত করলো। আমি বুঝে ওঠার আগেই পালিয়ে গেল রাস্তায় অন্ধকার থাকায় আমি তার মুখ দেখতে পায় নি। তবে মনে হয় গায়ে চাদর জড়ানো ছিল।”
এবার যেন রেজওয়ানের খটকা লাগলো তার সাথেও তো এমন ঘটনা ঘটেছিল। তবে কি সেই চাদর পড়া ব্যাক্তিটি ইমতিয়াজকেও আঘাত করলো। কিন্তু কেন! যদিও তাকে আঘাত করার কারণটাও আজও জানে নি রেজওয়ান।’
ইমতিয়াজের কথা শুনে চিন্তিত হলেন রাগান্বিতার বাবা। এর আগে রেজওয়ানের সাথেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। কে যে পিছন থেকে আঘাত করছে কে জানে। রাগান্বিতার বাবা ভাবছেন মেয়ে জামাইকে এখানে বেশিদিন রাখাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং কালই এরা চলে যাক। রাগান্বিতার বাবা কিছু বলবেন তার আগেই রাগান্বিতা বললো,
“বাবা তুমি অনুমতি দিলে আমরা কালই চলে যাই। কবিরাজ দাদু তো বললেন ওনাকে শহরের ডাক্তার দেখালে ভালো হবে।”
রাগান্বিতার বাবা বুঝলেন। নির্বিকার হয়ে বললেন,
“হুম তাই করো। সাবধানে থেকো।”
শেষের কথাটা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললেন মোতালেব তালুকদার। অতঃপর রাগান্বিতার বাবা উঠে দাঁড়ালেন কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে রেজওয়ানও তার পিছু পিছু গেল। একটু এগিয়েই বাবার মুখোমুখি হয়ে বললো,
“বাবা এবার আমাদের বিষয়টা খুঁটিয়ে দেখা উচিত। আমার মনে হচ্ছে আমায় আর ইমতিয়াজকে আঘাত করা ব্যক্তিটি একজনই।”
রাগান্বিতার বাবা ছেলের কথার গুরুত্ব দিলেন কাঁধে হাত দিয়ে আশ্বাস দিয়ে বললেন,“দেখছি।
—–
কক্ষে দাদিমা ইমতিয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,“চিন্তা কইরো না সব ঠিক হইয়া যাইবো।”
উত্তরে শুধু শুঁকনো হাসলো ইমতিয়াজ। দাদিমা বেরিয়ে গেলেন ইশারায় রাগান্বিতাকে বুঝালাম নাতজামাইর খেয়াল রাখতে। সবাই চলে যাওয়ার পরও রাগান্বিতা বেশ কিছুক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইমতিয়াজ দৃষ্টি রাখলো রাগান্বিতার দিকে। শীতল সুরে বললো,
“বউ,
রাগান্বিতা জবাব দিলো না সে এগিয়ে গিয়ে নিজেদের কক্ষের দুয়ার দিলো। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলো ইমতিয়াজের দিকে। পুরোটা সময় রাগান্বিতার দিকেই তাকিয়ে ছিল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের কাছ দিয়ে বসলো। কপালে হাত ছুঁয়ে বললো,
“খুব জ্বলছে তাই না।”
“একটু।”
“আপনি এতো রাতে বাহিরে কেন গিয়েছিলেন?”
“মোকলেসের সাথে কথা বলতে।”
“এই রাতের বেলা।”
“ও ডেকেছিল।”
“কেন?”
“বললে তুমি রাগ করবে।”
“করবো না বলুন।”
“তুমি রাগ করবেই।”
“বললাম তো করবো না বলুন,
“তাস খেলা দেখতে।”
সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা রেগে উঠলো। উচ্চস্বরে বললো,
“আপনি এই রাতের বেলা তাস খেলতে গেছিলেন।”
“উম না খেলতে নয় শুধু দেখতে আমি ওসব খেলি না।”
রাগান্বিতা রাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আয়নার কাছে যেতে যেতে বললো,
“আপনি কি পাগল এই রাতের বেলা তাস খেলা দেখতে গেছিলেন।”
“তুমি বলেছিলে রাগ করবে না তাও করছো।”
রাগান্বিতা একে একে তার গায়ের অলংকার খুলতে লাগলো। তীক্ষ্ণ স্বরে সুধালো,
“আপনি বলুন এটা কি রেগে যাওয়ার মতো কথা নয়।”
ইমতিয়াজ মাথা নিচু করলো অপরাধী সুরে বললো,
“ভুল হয়ে গেছে, এমনটা আর হবে না। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কখনো ওসব দেখতে যাবো না।”
রাগান্বিতা মনে মনে খুশি হলো নিজের খোঁপা করা লম্বা চুলগুলো খুলে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে বেনুনী করলো। ইমতিয়াজ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখলো তা। কেমন যেন নেশালো গলায় শুধালো,“তুমি এত সুন্দর কেন বউ?”
ইমতিয়াজের নেশা লাগানো কথাটা কানে বাজতেই কেমন এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল রাগান্বিতার মাঝ দিয়ে। সে এগিয়ে আসলো পালঙ্কে বসলো। ইমতিয়াজের চোখে চোখ রেখে আদুরে গলায় বললো,
“আপনার চোখ দুটো সুন্দর তাই সুন্দর লাগে।”
ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“তোমাকে দেখতে দেখতেই কবে যেন আমি পাগল হয়ে যাই।”
“উম! মিষ্টি মিষ্টি কথাতে রাগান্বিতা কিন্তু ভুলবে আজ আপনি অন্যায় করেছেন আমায় না বলে তাস খেলা দেখতে গেছেন।”
“তুমি ঘরে ছিলে না তার জন্যই তো।”
“আমায় ডাকা যেত না।”
“ডাকলে আমায় যেতে দিতে বুঝি।”
“অন্যায় করে মুখে মুখে তর্ক করা ঠিক না।”
“আমায় কি ক্ষমা করা যায় না?”
“ঠিক আছে করে দিলাম তবে আর যেন এই ভুল না হয়। এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। মাথা ব্যাথা করছে নিশ্চয়ই।”
“তুমি আমার পাশে থাকলে এসব ব্যাথা আমার অনুভব হয় না বউ।”
আচমকা কেঁদে ফেললো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল এতে। বললো,
“আরে আরে তুমি কাঁদছো কেন?”
“আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম জানেন,
“কি ভেবে ছিলে মরে…
কথাটা শেষ করতে পারলো না ইমতিয়াজ তার আগেই ইমতিয়াজের মুখ চেপে ধরলো রাগান্বিতা। বললো,
“এভাবে বলবেন না। আপনি কেনো বুঝেন না আপনার এসব কথায় আমার বড্ড আঘাত লাগে, যন্ত্রণা হয়।”
ইমতিয়াজ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু রাগান্বিতার চোখের দিকে। মেয়েটা দিনে দিনে তার প্রতি বড্ড আবেগী হয়ে যাচ্ছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে! ইমতিয়াজ মনে মনে আওড়ালো,“আমায় এতো ভালোবেসো না বউ, কখনো বড় আঘাত দিলে সইবে কেমন করে।”
#চলবে…
[ভুল-ক্রটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️