প্রিয়_রাগান্বিতা🩷 #লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷 পর্ব-৩০

0
279

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩০
________________
সময়ের স্রোতে ভাসমান প্রকৃতি। দিনগুলো যেন কেমন কাটছে বিষণ্ণতায়। চারপাশ কেমন আবছা আবছা। দিনরাত বুঝি অন্ধকারে ডুবে থাকে এমন। রাগান্বিতা প্রায়শই খেয়াল করছে কোনো এক বিষয় নিয়ে ইমতিয়াজ চিন্তিত থাকে। আগের চেয়ে কথাও কম বলে। কেমন যেন এড়িয়ে এড়িয়ে চলে তাকে। প্রথম প্রথম বিষয়টা রাগান্বিতার নজরের না আসলেও ইদানীং আসছে। মানুষটার কি হয়েছে জানার জন্য রাগান্বিতার প্রতিদিনই অস্থিরতা কাজ করে। রাগান্বিতা প্রায় সময়ই দেখে ইমতিয়াজ গভীর রাতে না ঘুমিয়ে পালঙ্কের পাশে নিচে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন বিষণ্ণমাখা চাহনী! মনে হয় হাজার বছর যেন তাকে দেখেনি ইমতিয়াজ। অথচ তারা রোজই একেঅপরের মুখোমুখি হয়। এই তো দু’দিন আগে। রজনীর শেষ প্রহর চলছিল। আচমকাই রাগান্বিতার ঘুম ভেঙে যায় সে চোখ খুলেই দেখতে পায় ইমতিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা দেখেই চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে রাগান্বিতা দ্রুত নিচে নেমে আসে। ইমতিয়াজ নীরব, চুপচাপ। কোনো ভাবাক্রান্ত নেই। সে পালঙ্কের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রয় চুপচাপ। কেমন নির্বিকার, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাকে। রাগান্বিতা পালঙ্ক থেকে নেমেই পাশে বসে ইমতিয়াজের খানিকটা নিস্তব্ধ স্বরেই বলে,
“আপনার কি কিছু হয়েছে?”

ইমতিয়াজ নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,
“কি হবে!”
“আপনাকে প্রায় দেখি আপনি গভীর রাতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।”
“তোমার কি অসস্থি লাগে? তাহলে কাল থেকে আর তাকাবো না।”

রাগান্বিতা হতাশ হলো সে ওইভাবে কথাটা বলতে চায় নি। রাগান্বিতা হতাশ হয়েই ইমতিয়াজের হাতটা নিজের হাতের মুঠোতে নিলো। নরম কণ্ঠে বলে,
“আপনার কি হয়েছে বলুন আমায়? ইদানীং আপনায় খুব চিন্তিত দেখায়।”
“আমার কিছু ভালে লাগে না বউ।”
“কেন?”

ইমতিয়াজ চুপ। রাগান্বিতা আবার প্রশ্ন করে,
“ব্যবসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হয়েছিল অনেকদিন আগে একজনের পণ্য মানে শাড়ি আমার এক সহকারী ভুল করে আরেকজনকে দিয়ে দেয়। যা এখন ঠিক হয়ে গেছে।”
“তাহলে এখনও চিন্তিত কেন থাকেন?”

কেমন একটা হয়ে যায় ইমতিয়াজ। সে নিস্তব্ধ হয়ে ঠলে পড়ে রাগান্বিতার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতা প্রথমে একটু ঘাবড়ালেও সামলে নেয় নিজেকে। ইমতিয়াজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নীরব সুরে শুধালো,
“আপনার কি হয়েছে বলুন না আমায়?”

ইমতিয়াজ কেমন একটু করে যেন বললো,“আমার যন্ত্রণা হয় বউ। চারপাশ ছারখার হয়। আমি কেমন বিষের জ্বালায় জ্বলছি। দাউদাউ করে অন্তর পুড়ছে প্রতিনিয়ত।”

রাগান্বিতা থমকে যায় ইমতিয়াজের এমন কোথায়! কান্না আসতে চায় ভিতর থেকে। মানুষটা এত কি নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতেই বলে,
“এমনটা কেন হচ্ছে বলুন আমায়?”

ইমতিয়াজ বলে না। তবে মনে মনে ঠিকই আওড়ায়,“আমার যন্ত্রণার কথা যদি তোমায় বলা যেত তবে বোধহয় আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হতো না। আমি বিতৃষ্ণায় আবদ্ধ বউ।”

সেদিন ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। রাগান্বিতাও আর প্রশ্ন করে না। তবে রজনীর শেষ হওয়ার পুরোটা সময় ইমতিয়াজ জড়িয়ে ধরে থাকে রাগান্বিতাকে। যেন ছেড়ে দিলেই রাগান্বিতা বুঝি পালিয়ে যাবে।

সেদিনের পর টানা দু’দিন ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার তেমন সংস্পর্শে আসি নি। এমন কি তাদের দেখাও হতো কম। ইমতিয়াজ গত দু’দিন খুব বেশি দেরি করে বাড়িতে আসতো। রাগান্বিতা অপেক্ষা করতো কিন্তু ইমতিয়াজ আসতো না। ইমতিয়াজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাগান্বিতা ঘুমিয়ে যেত। সকালে উঠেও রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে দেখতো না তবে ইমতিয়াজ যে রাতে তার পাশে এসে শুতো এটা বেশ বুঝতো কারণ ইমতিয়াজ প্রতিদিন তার পরিধিত পোশাক পালঙ্কের কর্নারে রেখে চলে যেত। ইমতিয়াজের দু’দিনের অবহেলাতেই রাগান্বিতা খুব কষ্ট পাচ্ছে। তবে রাগান্বিতা জানে ইমতিয়াজও তার মতো কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু দিনে দিনে এমন অবহেলা কেন করছে এইটুকুই বুঝচ্ছে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে পড়াশোনার কথা বলেছিল অনেকদিন আগে। কিন্তু রাগান্বিতা বলেছে সে আর পড়াশোনা করতে চায় না। ইমতিয়াজও জোর করে নি আর। তবে পড়াশোনা যে একেবারে বাদ দিয়েছে এটা বললেও ভুল হবে। ইমতিয়াজ অনেকগুলো বই এনেছিল রাগান্বিতার জন্য। সেগুলো প্রায়শই পড়ে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের টেবিলেও অসংখ্য বই আছে। ইমতিয়াজ উপন্যাস পড়তে খুব পছন্দ করে। রাগান্বিতা আগে এসব পড়তো না কিন্তু এখন পড়ে বেশ লাগে তার। তবে দিন শেষে ইমতিয়াজের অবহেলা বেশ পোড়ায় তাকে।

জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজের গত কয়েকমাসের দিনগুলোর কথা ভাবলো রাগান্বিতা। আচমকা ইমতিয়াজের অবহেলায় সে যেন তিলে তিলে শেষ হচ্ছে। হঠাৎই সাইকেলের বেল বাজার আওয়াজ আসলো। রাগান্বিতা বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু তাও তাকালো না। আবারও শব্দ হলো রাগান্বিতা তাকালো না এরপর বেশ কয়েকবারই আওয়াজ আসলো এবার বিরক্ত নিয়ে তাকাতেই সামনে ইমতিয়াজকে দেখে বিস্মিত হলো রাগান্বিতা। এইসময় ইমতিয়াজ এখানে। ইমতিয়াজ হাতের ইশারায় রাগান্বিতাকে নিচে নামতে বললো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের একটুখানি ইশারাতেই বুঝি প্রাণ ফিরে পেল। সে দৌড়ে ছুটে গেল নিচে। রবিন তখন ঘরের ভিতর কাজ করছিল। রবিনের বউয়ের ছেলে হয়েছে। সে এখন দ্রুত দ্রুতই কাজ সেরে বাড়ি চলে যায়।’

রাগান্বিতা ছুট্টে এসে সামনে দাঁড়ালো ইমতিয়াজের। ইমতিয়াজ তখন তাকিয়ে থাকে রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতাও তাকায়। দুজনেই চুপচাপ। কথা দুজনেই বলতে চাচ্ছে কিন্তু দু’দিনের অধিক দুরত্বেই কোথায় যেন সংকোচতা কাজ করছে। কিছু সময় পার হওয়ার পরও যখন ইমতিয়াজ কিছু বলছিল না ধীরে ধীরে রাগান্বিতার ঠোঁটে জড়ানো হাসিটা মিলিয়ে গেল। সে মন খারাপের দৌলতেই প্রশ্ন করলো,
“কিছু কি বলবেন আমায়?”

উত্তরে ইমতিয়াজ বলে,“বলতে তো অনেক কিছুই চাই তোমায় কিন্তু সংকোচতার জ্বালায় বলতে আর পারছি কই।”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় ইমতিয়াজের দিকে। একটু কাছে এগিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,“আমি তো আপনার কাছের মানুষ আমাতে কথা বলতেও আপনার এত সংকোচতা কেন প্রিয়।”

ইমতিয়াজ কিছু বলতে পারে না। সে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে,“সাইকেলে বসবে বউ, চলো একটু কাছাকাছি হয়ে আশপাশটা ঘুরি।”

রাগান্বিতা বিনা সংকোচে সাইকেলের সামনে বসে। মনে মনে খুব খুশি হয়। ইমতিয়াজও খুশি হয়। সে সাইকেল চালিয়ে তাদের পুরো বাংলো বাড়িটির চারপাশটা ঘোরে। বাড়ি চারপাশটায় বনজঙ্গল আর গাছপালা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। তবে বাড়ির পিছনের দেয়ালের একটা অংশে অনেকগুলো জমানো গাছের ডালপালা দেখছিল রাগান্বিতা। এদিকটায় তেমন একটা আসে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ বলে ছিল বাড়ির বাহিরে খুব একটা না যেতে। একই তো সুন্দরী বউ তারওপর বনজঙ্গল কখন কি ঘটে বলা যায়। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের কথায় সেদিন খুব হেঁসেছিল। তবে কথা রেখেছিল ইমতিয়াজের। সে বার হয় নি খুব একটা বাহিরে।

সারাবিকালটা দু’জনে কাছাকাছি থাকলেও কোথাও যেন দূরত্বতা, ছিল কথা না বলতে পারার সংকোচতা। এমনটা কেন হচ্ছিল বুঝচ্ছিল না রাগান্বিতা। সে তো কথা বলতে চায় কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন আটকাচ্ছিল খুব। ইমতিয়াজেরও বুঝি এমনই হচ্ছিল।
—-
সময় চললো বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। পুরো প্রকৃতি হচ্ছিল লালচে। ইমতিয়াজ বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে সাইকেল থামালো। রাগান্বিতা নামলো, গিয়ে বসলো বাড়ির সদর দরজার সামনে থাকা ছোট ছোট সিঁড়িগুলোর ওপর। তার যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে বোঝানো যাবে না। ইমতিয়াজ বুঝলো রাগান্বিতার বিষয়টা সে সাইকেলটাকে এক কর্নারে রেখে বসলো রাগান্বিতার পাশ দিয়ে একটু দূরত্ব নিয়ে। এবার তার সংকোচতা বুঝি কমলো। সে প্রশ্ন করলো,
“মন খারাপ হচ্ছে?”

রাগান্বিতা চুপ। ইমতিয়াজ বলে,
“অভিমান করেছো খুব তাই না।”

রাগান্বিতা এবারও চুপ। ইমতিয়াজ খানিকটা অস্থিরতা নিয়ে বলে,
“আমার সাথে কথা বলবে না বউ?”

রাগান্বিতা এবার ঘুরে থাকালো ইমতিয়াজের দিকে। আচমকাই কেঁদে উঠলো। ইমতিয়াজ বুঝলো। মাথা নিচু করে বললো,
“এভাবে কেঁদো না গো বউ,তোমার কান্নায় যে আমার অন্তর পুঁড়ে ছারখার হয়ে যায়।”

তাও থামে না রাগান্বিতা। কিছুটা সময় পার হওয়ার পর রাগান্বিতা বলে,
“আমার ভুলটা কোথায় বলুন না আমায় এমন অবহেলা কেন করছেন?”

বলতে বলতে আবার কাঁদলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ এবার গা ঘেঁষে বসলো রাগান্বিতার৷ নিজের হাতের মুঠোতে রাগান্বিতার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,“তোমার কোনো ভুল নেই, সব ভুল আমার।”

ছলছল আঁখিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো রাগান্বিতা। বললো,“কেন করছেন এমনটা?”

উত্তর দেয় না ইমতিয়াজ। অন্যদিকে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রবিন ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার বিষয়টা লক্ষ্য করলো সে বোধহয় খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে পারলো ইমতিয়াজের বিষয়টা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাগান্বিতা মেয়েটা খুবই ভালো মনের একটা মেয়ে। যেমন রূপ তেমনই মিষ্টি স্বভাবের অধিকারি। এমন মেয়েকে যেকোনো পুরুষই হৃদয় দিতে বাধ্য। ইমতিয়াজও দিয়ে ফেলেছে। যেটা তাকে ক্ষণে ক্ষণে দুঃখ দিচ্ছে। রবিন চলে গেল। ইমতিয়াজ হঠাৎই বললো,
“কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে বউ?”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here