প্রিয়_রাগান্বিতা🩷 #লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷 পর্ব-৩৮

0
278

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৮
________________
নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে সবেমাত্র ঢাকার বাড়িতে পা রাখলো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। সদর দুয়ারের সামনেই দাড়ানো ছিল রবিন আর ওর বউ। রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে হেঁটে আসলো তাদের সামনে। সদর দুয়ারের কাছে এসেই বলো ইমতিয়াজ,
“কেমন আছো চাচা?”
“ভালা। তুমি?”
“ভালোই। চাচিও সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে যে কেমন আছেন চাচি?”

চাচি মিষ্টি হাসলেন। ইমতিয়াজের গালে আলতো স্পর্শ করে বললো,“ভালাই আছি। তুমরা কেমন আছো?”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে জবাব দিলো,“ আমরাও ভালো।”
এরপর রাগান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো ইমতিয়াজ,“ইনি রবিন চাচার বউ রাগান্বিতা।”

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো। নিকাবের আড়ালে মিষ্টি গলায় বললো,“আসসালামু আলাইকুম চাচি ভালো আছেন?”

চাচি মৃদুস্বরে বললেন,“হ ভালোই আহো ঘরে আহো।”

রাগান্বিতাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল চাচি। আর ইমতিয়াজ রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ব্যবসার অবস্থা কেমন চাচা?”
“ভালাই। তুমি কি এহন যাইবা দ্যাখতে?”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“দেখি।”

ভিতরে ঢুকলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা তখন সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষে যাচ্ছিল। তখনই পিছন থেকে ইমতিয়াজ বলে উঠল,
“বউ শুনো,

রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। দ্রুত কয়েককদম নিচে নেমে এসে বললো,“জি বলুন।”

ইমতিয়াজও এগিয়ে আসলো খানিকটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললো,“আমার একটা কাজ আছে কাজটা সেরেই আমি আসছি। তুমি চিম্তা করো না আমার আসতে একটু দেরি হবে।”

রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরে বললো,“কোথায় যাবেন? মাত্রই তো এলেন এখনই যাবেন। কাজটা কি খুব জরুরি?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়িয়ে বললো,“হুম।”
রাগান্বিতা আর বারণ করলো না। বললো,“ঠিক আছে সাবধানে যাবেন কাজ সেরে দ্রুত চলে আসবেন কেমন।”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বললো,“ঠিক আছে।”
ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো তারপর চট করেই রাগান্বিতার কপালে চুমু কেটে বললো,“ভালোবাসি বউ, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।”

কথাটা বলেই ঝড়ের গতিতে চলে গেল ইমতিয়াজ। আর রাগান্বিতা লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। পরক্ষণেই মৃদু হেসে অগ্রসর হলো নিজ কক্ষে যাওয়ার জন্য।

সময় গড়ালো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। তাও ইমতিয়াজের খবর নেই। যদিও ইমতিয়াজ বলেছিল তার ফিরতে দেরি হবে তবুও বিকেল গড়িয়ে কত সময় চলে যাচ্ছে। মানুষটা রাস্তায় কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। সেই সকালবেলা চা নাস্তা করেছিল মাত্র এরপর আর কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। রাগান্বিতার খুব চিন্তা হচ্ছে। রাগান্বিতা বার বার বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। চাচি বিষয়টা লক্ষ্য করলেন মুচকি হেসে বললেন,“চিন্তা কইরো না ইমতিয়াজ আইয়া পড়বো নে।”

বিনিময়ে রাগান্বিতা আমতা আমতা করে বললো,
“চিন্তা করছি না চাচি।”

চাচি মিষ্টি হেঁসে বললেন,
“এগুলান চেহারা দেখলে বোঝন যায়।”

বলেই নিজের শয়নকক্ষে চলে গেল চাচি। তার বাচ্চাটা কাঁদছে, বোধহয় ঘুম থেকে উঠে গেছে। রাগান্বিতা খানিকটা লজ্জা পেল চাচির কথা শুনে।
——
গ্রামের নাম আনন্দপুর। ঢাকা থেকে বেশ দূরে তার অবস্থান। সেই গ্রামেরই সবচেয়ে বড় জমিদার বাড়িটির নাম সিকদার মঞ্জিল। এককালে বিপুল প্রাচুর্যে ঘেরা ছিল এই বাড়ি। অথচ আজ সেই বাড়ি পরিত্যাক্ত কেউ ভুলেও এই বাড়ির ত্রিসীমায় আসে না। বাচ্চাদের ছোট থেকেই এখানে আসতে নিষেধ করেন তাদের বাবা মা। তাদের ধারণা এ বাড়িতে ভূত প্রেত আছে। বহুবছর আগে এ বাড়ির জমিদার মতিন সিকদার আর তার দ্বিতীয় বউ যমুনা বেগম খুন হন। সেই থেকেই এ বাড়ি পরিত্যাক্ত! বাড়িতে যত মানুষ ছিল তারাও সেই মৃত্যুর পর আতঙ্কে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকেই অযত্ন আর অবহেলার কারণে বনজঙ্গলে ভরে ভুতুড়ে ভুতুড়ে হয়ে গেছে চারপাশ।

জং ধরা গেটের শিঁকল খুলে সিকদার মঞ্জিলে পা রাখলো ইমতিয়াজ। ক্যাচ ক্যাচ করে আওয়াজ হলো কেমন। দু’একজন দূর থেকে দেখলো। ইমতিয়াজ বেশি না ভেবেই তার চটি(জুতা) খুলে আস্তে করে চলে গেল ভিতরে। বাড়ির ডানদিকে একটা সরু রাস্তা আছে ইমতিয়াজ সেই পথ ধরেই হেঁটে গেল। হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিললো একটা সুন্দর পরিপাটি বেড়া দেয়া কবরস্থান। এই বাড়ির বাকি সব স্থান অগোছালো থাকলেও এই জায়গাটা পরিষ্কার। ইমতিয়াজ বেড়ার একপাশ খুলে কবরের দোয়া পাঠ করে ভিতরে ঢুকলো। তারপর বসলো সোজা মৃত ব্যক্তিটির পায়ের কাছ দিয়ে। আলতো করে পায়ের দিকের ওপরের মাটি স্পর্শ করে বললো,
“আম্মা, আমার প্রাণের আম্মা। আমি এসেছি আম্মা। তোমার ছেলে ইমতিয়াজ এসেছে, তুমি কি আমার লগে কথা কইবা না আম্মা। এইবার আমি আইতে খুব দেরি করছি তুমি খুব রাগ করছো তাই না। জানো আম্মা তোমারে দেহার জন্য আমার মনডা ছটফট করে। এমনে কেন চইল্যা গেলা আম্মা। আইজ তুমি বাইচ্যা থাকলে আমার জীবনডা এমন বিষণ্ণমাখা হইতো তুমি কও। আমি প্রতিহিংসায় জ্বলছি আম্মা।”

এমন নানা কিছু বলতে লাগলো ইমতিয়াজ। চারপাশে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না। পুরো নিরিবিলি পরিবেশ। ইমতিয়াজের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে এতক্ষণে ভয়েই কেঁপে যেত। অথচ ইমতিয়াজ একদম স্বাভাবিক। যেন মনে হচ্ছে মায়ের পাশে বসে সে গল্প করছে। আর তার মা আদুরে হাতে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নীরবে সেই গল্প শুনছে। অথচ বাস্তবে তেমন কিছুই হচ্ছে না এ ভয়ার্ত পরিবেশে একাই বক বক করছে ইমতিয়াজ। কতকিছুই যে বলছে সে ছাড়া আর কেউই শুনছে না।

অনেক সময় পার হলো। বিকেল শেষে সন্ধ্যা নামার সময় আসলো। ইমতিয়াজ তখনও বসা তার আম্মার কবরের পাশে। কারো আওয়াজ শোনা গেল। এক বৃদ্ধলোক বললো,
“তুমি কেডা এই সন্ধ্যাহালে এহানে কি করো?”

ইমতিয়াজের হুস ফিরলো। সে ঘুরে তাকালো। সামনে দেখলো কিছু মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটা লোক বললো,
“এই জায়গাডা ভালা না। তুমি এহিনে ঢুকছো হেই কহন, আর আহোনা দ্যাইখা আমরা সবাই মিল্লা খুঁজতে আইছি। তুমি কেডা কও তো তোমারে এর আগেও দেখছি এহানে আইয়া কান্দো। কি হইছে তুমার?”

মাগরিবের আজানের শব্দ শোনা গেল। সবাই কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে বললো,
“আর বইয়া থাইকো না লও আমগো লগে।”

ইমতিয়াজ শুনলো আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বেড়াভেদ করে বাহিরে এসে আবার বেড়া আঁটকে দিলো। মৃদু আওয়াজে বললো,“আমি তাইলে যাই আম্মা। আবার সময় করে দেখতে আসবো কেমন। এবার আর দেরি হবে না।”

বলেই চলে আসলো ইমতিয়াজ। লোকগুলাও সঙ্গে সঙ্গে বের হইলো তার। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো ইমতিয়াজকে,“তুমি কেডা কও তো এই বাড়ির কেউ লাগো।”

ইমতিয়াজ বাড়ির বাহিরেই সেই জং ধরা শিকলটা পুনরায় আটকে গম্ভীর এক আওয়াজে বললো,“আমি ইমতিয়াজ সিকদার।”

কথাটা বলেই চটি পড়ে চলে যায় ইমতিয়াজ। বাকিরা নিজেদের মধ্যে বলতে থাকে, ইমতিয়াজ সিকদার আবার কেডা?”

তখনই সেই বৃদ্ধ লোকটি বলে,“ইমতিয়াজ সিকদার হইলো মতিন সিকদারের প্রথম বউয়ের পোলা। যে কবরডার পাশে বইসা পোলাডা কানছিল ওইডা এই পোলার আম্মার কবর।”

সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকে সবাই ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে। বলে,“এই সেই ইমতিয়াজ সিকদার যে কি না হেই ছোডোহালে বাপের অত্যাচারে ঘরদুয়ার ছাইড়া চইল্লা গেছিল।”

বৃদ্ধ লোকটি বললো,“হয়। একখান কতা কি জানো এই ইমতিয়াজ জায়োনের তিনদিন পরই খুন হয় মতিন সিকদার আর হের দুই নাম্বার বউ যমুনা বেগম।”

একলোক বললো,“হুনছিলাম মতিন মিয়ার নাকি একখান মাইয়াও আছিল হেয় গেল কই?”

বৃদ্ধ লোকটি হাঁটতে হাঁটতে বললো,“হের কতা জানি না খুনের হওয়ার পর তোন আর খবর পাওন যায় নাই। মাইয়াডা ছোডো আছিল ইস্কুলে পড়তো কি হইছিল হেইদিন রাইতে কে জানে। ইমতিয়াজের থ্যাইক্কা দুই বছরের ছোডো আছিল। গ্রামের হগোলে কইছিল যে বা যারা খুন করছিল হেই মনে হয় মাইডারেও খুন টুন কইরা নদীর পানিতে হালাই থুইছে নইলে নিজের লগে লইয়া গেছিল। জানি না মাইয়াডার কি হইছিল।
—-
মধ্যরাত! নিজ কক্ষে বসে আছে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের অপেক্ষা করছে সে। সেই কখন বেরিয়েছে এখনো খবর নেই। কখন আসবে ইমতিয়াজ! দুয়ার খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রাগান্বিতা তৎক্ষনাৎ দুয়ারের পানে তাকালো। দেখলো খানিকটা এলেমেলো চুল আর ক্লান্তিকর চেহারা নিয়ে হাজির হলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে এগিয়ে গেল ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“অবশেষে আপনি এলেন।”

ইমতিয়াজ ভিতরে ঢুকলো ক্লান্ত মুখখানা নিয়ে বসলো পালঙ্কে। রাগান্বিতা দ্রুত ইমতিয়াজের জন্য পানি এনে দিলো। বললো,“পানি খান।”

ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে পানিটা নিল। ঢক ঢক করে পুরো পানিটা গিলে বললো, আমরা কাল রেশবপুরে যাবো বউ।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here