কাব্যের_বিহঙ্গিনী #পর্ব_৫২ #লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

0
491

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন আর মুখর দু’জনেই ভিজে যাচ্ছে। মেহবিন যখন পাগলের মতো চিৎকার করছিল তখন মুখরের ভেতরটা হাহাকার করছিল। তবে ও শক্ত ছিল আজ ওর বিহঙ্গিনীর জন্য। মেহবিন এবার শান্ত হয়ে মুখরের বুকে লেপ্টে রইলো। ওর মাথার ভেতর কি চলছে ও আর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। মুখর হুট করেই বলল,,

“বিহঙ্গিনী?”

‘আজকে ঘটে যাওয়া সবকিছুর পেছনে আমি কাব্য। নেত্রী ঠিক হয়ে যখন বলবে ওর বাবা কোথায় আমি কি উত্তর দেব?”

“তোমার জন্য কিছুই হয় নি। সব নেত্রীর নিয়তি ছিল।”

“তাই বলে আমাদের দায় আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।”

“অনেক হয়েছে এখন চলো ড্রেস পাল্টে নাও। নেত্রীকে সুস্থ করতে হলে তো নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে। তাছাড়া তুমি কিন্তু একটা কাজ ভুলে গেছো।”

“হুম নামাজ পড়া হয় নি যেটা বেশি দরকার ছিল।”

মেহবিনের কথায় মুখর অবাক হলো। মেহবিন উঠে দাঁড়ালো। আর বলল,,

“কেবিনে চলুন ওখানে আমার জামাকাপড় আছে। চেঞ্জ করে নিচ্ছি। আপনি বরং বাড়ি চলে যান চেঞ্জ করুন। নাহলে আপনি অসুস্থ হয়ে পরবেন।”

মেহবিন হাঁটা শুরু করলো তখন মুখর বলল,,

“লোকটা কে ছিল মেহু?”

মেহবিন পেছনে তাকিয়ে বলল,,

“আমার পার্টনার। আমার জীবনে সবাই থেকেও যেমন সবাই আলাদা। ঠিক সেভাবেই আলাদা থেকেও যেন সে আমার সাথে আছে।”

বলেই মেহবিন চলে গেল। মুখর থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে নিজেও নিচে এলো। নিচে আসতেই দেখলো আরবাজ দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে কিছু প্যাকেট। আরবাজকে দেখে মুখর বলল,,

“তুই এখানে?”

আরবাজ ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“এখানে তোর জন্য জামাকাপড় আর তোদের জন্য খাবার আছে খেয়ে নিস। আর হ্যা ফুলকেও খায়িয়ে দিস।”

“তোর মনে হয় ও খাবে?”

“না খেলে জোর করবি।”

“তা সে কোথায়? চেঞ্জ করেছে?”

“হুম একটু আগে তাজেলের কেবিনে গেল। হাতে জায়নামাজ ও দেখলাম।”

“তাহলে আজ আর খাওয়াতে পারবো না।”

“যখন পারবি তখন খায়িয়ে দিস।”

“তাজেলের বাবার দাফন হয়ে গেছে?”

“হুম!”

“বাড়ির অবস্থা এখন কেমন?”

“সবাই তাজেলের বাবার মৃত্যু নিয়েই শোকে আছে। তাজেলকে নিয়ে কারো মধ্যে তেমন কিছু নেই। তাজেলের দাদির একটু সহানুভূতি আছে তবে তিনিও পুত্র শোকে নাতনিকে ভুলে গেছে‌। আর তাজেলের সৎমা তাজেলকেই দায়ী করছে। কারন সেই মেলায় যাওয়ার জন্য নাকি আবদার করেছিল আর সেখানে যেতে গিয়েই এই ঘটনা ঘটে গেছে।”

“আল্লাহ নিশ্চয়ই উত্তম পরিকল্পনাকারী এবং কর্মবিধায়ক। আল্লাহ যা করেন তার বান্দাদের ভালোর জন্যই করেন।”

“হুম এখন যাওয়া উচিৎ অনেক রাত হয়েছে।”

“তোর ফুলের পার্টনার কে আরবাজ?”

আরবাজ অবাক হয়ে বলল,,

“মানে পার্টনার কোথা থেকে এলো?”

“তারমানে তুই ও পার্টনার সম্পর্কে জানিস না?”

“না!”

“আচ্ছা যা পরে এ নিয়ে কথা হবে।”

“ওহ ভুলেই গিয়েছিলাম তুই যাবি না? ফুল তো বলল তোকে নিয়ে যেতে।”

“না যাবো না। তোর ফুল অনেক ভেঙে পরেছে এই সময় ওকে একা রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে না ‌।”

“হুম আসছি আল্লাহ হাফেজ।”

আরবাজ চলে গেল মুখর ফ্রেশ হলো‌। তাজেলের কেবিনে উঁকি দিলো। মেহবিন ওখানেই নামাজ পরছে। রাত একটা বাজে মেহবিনের কেবিনে এসে সে নিজেও নামাজ পরতে লাগলো। মুখর নামাজ আদায় করে আবার তাজেলের কেবিনে উঁকি এখনো মেহবিন নামাজ পরছে। মুখর বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। এখনও হালকা হালকা বৃষ্টি পরছে। ও হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছুয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,,

“আল্লাহুম্মা সাইয়েবান নাফিআ”,
‎আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বৃষ্টি হতে দেখতেন, তখন বলতেন, “আল্লাহুম্মা সাইয়েবান নাফিআ”
অর্থ: হে আল্লাহ্‌ মুষলধারে উপকারী বৃষ্টি বর্ষাও। (বুখারী ১০৩২)

বলেই মুখর বৃষ্টির দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল।

অতীত,,

“এই যে মিস মেহবিন আপনি এতো অসামাজিক কেন?”

পেছন থেকে কারো কথায় মেহবিন থেমে দাঁড়ালো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো কালো রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত মুখর দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,

“মানে?”

“দেখুন আপনাকে কাল গুনে গুনে তিনটা কল দিয়েছি। যদিও দুবার কল দিলে কেউ না ধরলে তারপর আবার ফোন দেওয়া সেটা ভদ্রতার খাতিরে পরে না। তবুও আমি তিনবার দিয়েছি। দেখলেন আপনাকে কল করা হয়েছে সেহেতু কলব্যাক করা উচিৎ ছিল নয় নাকি। কোন বিশেষ দরকার ও থাকতে পারে।”

“দেখেছিলাম তবে প্রয়োজন মনে করিনি তাই কলব্যাক করিনি। তাছাড়া আমার তো মনে হচ্ছে না আপনাদের সাথে আমার কোন বিশেষ দরকার থাকতে পারে?”

মুখর মনে মনে মেহবিন কে অসামাজিক বলে আবার ও আখ্যায়িত করলো। তবে মুখে বলল,,

“আপনার একটা জিনিস গাড়িতে পরেছিল সেটা দেওয়ার জন্যই ফোন করেছিলাম।”

“নিশ্চয়ই ব্লু রঙের কলমটার কথা বলছেন। ওটার কালি শেষ হয়ে গিয়েছে ওটা ব্যাগে ছিল কখন আপনার গাড়িতে পরলো টের পাইনি। তবে হলে ফেরার পর ব্যাগ থেকে সব বের করার সময় বুঝেছিলাম কোথাও পরেছে।”

সহজে বলা কথাগুলো মুখর সহজভাবে নিতে পারলো না। ও বলল,,

“এই জন্য আপনি আমার ফোন তুলেন নি? কারন কলমটার কালি শেষ হয়ে গেছিল।”

“না আসলে আমি ফোন ইউজ করি কম। কাল ফোনটা যেই ব্যাগে ছিলো ওভাবেই পরে ছিল। আর হয়তো চাপ লেগে সাইলেন্ট ও হয়ে গেছিল। তাই আপনি ফোন দিয়েছিলেন সেটা শুনতে পাইনি। তবে সকালে উঠে দেখেছি আপনার কল। এতো ভোরে কাউকে ভদ্রতার খাতিরে পরে না তাই দিইনি। তবে আমি অবাক হলাম সামান্য কলমের জন্য আপনি আমায় ফোন করেছেন এবং ফোন না তুলায় এভাবে ক্যাম্পাসে চলে আসবেন।”

“হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস অর্থাৎ টাকা বা অন্য কিছু পেলে তা এক বছর ঘোষণা দিতে থাক। তারপর (মালিক পাওয়া না গেলে) তুমি তা ব্যবহার কর।পরে যদি এর প্রাপক আসে তবে তাকে তা দিয়ে দেবে। [সহীহ বুখারী ৯১ ]

“তাহলে একবছর পর্যন্ত না হয় অপেক্ষা করতেন।”

“এটা দুই হাজার চব্বিশ মিস। এখন আর ঘোষণা দিতে হয় না। একেবারে সোজা তাকে দিয়ে আসা যায়। আর ওটা কুড়িয়ে পাওয়ার মালিক কে না পাওয়া গেলে এর জন্য। যেখানে আমি জানি মালিক টা আপনি সেখানে এটা ফেরত দেওয়া আমার দায়িত্ব।

“তা আপনি কিভাবে জানলেন কলমটা আমারই।”

“আপনি আসার সময় কলমটা আপনার হাতে ছিল। আমাকে দেখে আপনি কলমটা ব্যাগের সাঈড পকেটে ঢুকিয়ে ছিলেন।”

“বাহ এতটা নিখুঁত নজর রাখেন আপনি?”

“সবকিছু নিখুঁত নজরে রাখতেই হয় কাজটাই এমন!”

“মানে?’

“কিছু না। বাদ দিন।”

“আচ্ছা! তবে সামান্য কলমের জন্য এতটা কষ্ট করার জন্য শুকরিয়া। তবে এটা আমার দরকার নেই। আমার ইম্পোর্টেন্ট ক্লাস আছে আমি যাই আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ!”

“দেখা নাও হতে পারে আমাদের।”

“মন বলছে হবে ইনশাআল্লাহ!”

মেহবিন কিছু না বলেই চলে গেল‌। মুখর বলল,,

“না একেবারে অসামাজিক নয় একটু সামাজিক ও আছে। তবে আমি শুধু কলমের জন্য এখানে আসিনি কলম তো বাহানা মাত্র এসেছিলাম আপনার ব্যাপারে একটু কৌতূহলের বসে । জানি না কি হয়েছিল কাল আপনার জন্য রাতে আমার ঘুমই হয় নি। তবে বুঝলাম ভুল হয়ে গেল। না আর আসা যাবে না। তকদির যদি আবার মিলিয়ে দেয় তখন এই বিষয়ে ভাববো তার আগে নয়।

বর্তমান,,

কারো ছোঁয়া পেতে মুখর অতীত থেকে বেরিয়ে এলো। পাশে তাকাতেই দেখলো মেহবিনকে। মেহবিন বলল,,

“বাড়িতে যান নি কেন?”

“না এমনিতেও যেতে চাইছিলাম না। চেঞ্জ করেই আবার চলে আসতাম। আরবাজ আবার জামাকাপড় আর খাবার নিয়ে এসেছিল তাই এখান থেকেই কাপড় চেঞ্জ করে নিলাম।”

“ওহ আচ্ছা! তাহলে আমার কেবিনে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিন।”

“তার আগে তুমি একটু খেয়ে নাও।”

“আমি কিছু খাবো না। আপনি যান একটু ঘুম দিয়ে নিন।”

“আমিও তো খাইনি বলো আমার তো ক্ষুদা লাগছে। আমি জানি তোমার ও লাগছে। এখন নেত্রী যদি উঠে শুনে তুমি তার জন্য খাওনি। তাহলে আমায় বলবে পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তুমি কি ডাক্তারের একটুও খেয়াল রাখতে পারো না। তাছাড়া না খেলে তুমিও অসুস্থ হয়ে পরবে।”

“আমি আরেকটু পর খাবো নফল রোজা রাখবো। আপনি খেয়ে নিন। আর হ্যা আমি আগেই বলছি অনেক দৌড়ঝাপ যাবে আপনার এখন রোজা রাখার দরকার নেই।”

মেহবিনের রোজার কথা শুনে মুখর ও রোজা রাখতে চাইছিল। কিন্তু মেহবিনের কথায় ও কিছুই বললো না। শুধু বলল ,,

“ঠিক আছে আমিও না হয় তোমার সাথে খাবো। আর একঘন্টা বাদেই সেহেরির টাইম হয়ে যাবে।”

মেহবিন কিছুই বললো না আবার তাজেলের কেবিনে গেল। মুখর আর কিছু বললো না ফোন বের করে কিছু করতে লাগলো। এক ঘন্টা পর মুখর মেহবিনকে ডেকে আনলো মেহবিন ও চুপচাপ খেয়ে নিল। সে নফল রোজা রাখবে যাতে তাজেল তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে। মেহবিন মুখরকে ঘুমাতে বলে তাজেলের রুমে গেল। শরীরটা আর কুলাতে চাইছেনা দৌড় ঝাঁপ তো আর কম হয় নি। সকাল হয়ে গেল। মেহবিন সবকিছু দেখলো এখনো একই ভাব‌। ও তাজেলের হাত ধরে বসে থাকতে থাকতে একটু ঘুমিয়ে পড়লো। নার্স ডাক্তার সবাই এলো মেহবিনকে ঘুমাতে দেখে কেউ জাগালো না। সকাল সকাল নওশি তাজেলের দাদি এসেছে। নওশি এসে মেহবিনকে ডাকতে গেলে নার্স বারন করলো সে সারারাত ঘুমায়নি সকাল হওয়ার পর ঘুমিয়েছে। তারা আর কিছু বললো না। একবার দুর থেকেই তাজেল কে দেখলো। কোন কিছুর জন্য মেহবিন তাড়াতাড়ি ধরফরিরে উঠলো। তাজেলের দিকে তাকাতেই দেখলো সব ঠিক। ও হাত মুখ ধোয়ার জন্য বাইরে বের হতেই দেখলো নওশি আর তাজেলের দাদিকে। তাজেলের দাদি মেহবিনকে দেখেই কেঁদে উঠলো। মেহবিন তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। নওশি জিজ্ঞেস করল তাজেলের বাবার দাফন ভালো মতো হয়েছে কি না। নওশি সব বলল আর এটাও বলল তাজেলের মা তাজেলকেই দোষারোপ করছে। কথাটা শুনে মেহবিনের বুক ভারি হয়ে আসলো। ও ওখান থেকে চলে গেল। এভাবেই দুপুর হলো মেহবিন তাজেলের সবকিছু দেখতে লাগছিল। হুট করেই ও কানে আসলো,,

“ডাক্তার!”

মেহবিন তাজেলের দিকে তাকাতেই দেখলো ও চোখ খুলেছে। মেহবিন আলহামদুলিল্লাহ বলে তাজেলের কাছে গেল আর বলল,,

“নেত্রী ডাক্তার এখানেই আছে। এখন বলো তোমার কোথাও কষ্ট হচ্ছে নেত্রী?”

তাজেল মেহবিনের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল,,

“আমার মাথার আর হাত পায়ের ওপর মনে হয় কেউ একহাজার কেজির পাথর রাইহা দিছে ডাক্তার। আর মাথাও বিষ করতেছে।”

“আর একটু ব্যাথা করবে তারপরেই সব সেড়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

“আমারে উঠাও আমার শুয়্যা থাকতে ভাল্লাগে না।”

“কিন্তু একটু যে শুয়ে থাকতেই হবে। তুমি তো এখন অসুস্থ।”

“আমি অসুস্থ আমার জ্বর আইছে নাকি। অবশ্য শরীর ম্যাচম্যাচ করতেছে জ্বর আইতেই পারে। কিন্তু আমি উঠবার পারতেছি না ক্যান?”

“তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে নেত্রী।”

“যেরম ভাবে তোমার হইছিল। মেলা রক্ত পরছিল হেইরহম।”

মেহবিন বুঝতে পারলো ওর সাথে কথা বললে ও বেশি করে কথা বলবে এই জন্য ওকে এখন ঘুম পারাতে হবে। মেহবিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,,

“হুম!”

“আইচ্ছা তুমি কি কানছো ডাক্তার?”

“যদি বলি না?”

“তাইলে ঠিক আছে!”

“যদি বলি হ্যা!”

“তাইলে ঠিক নাই। তোমারে আমি কানতে দেহি নাই আর দেখবার ও চাইনা।”

মেহবিন একটা ইনজেকশন নিয়ে এলো কিন্তু তাজেলকে দেখালো না। মেহবিন তাজেলের মনোযোগ সরানোর জন্য বলল,,

“বলতো নেত্রী কাল আমি কিরকম কিরকম ড্রেস পরেছিলাম?”

“পরীর মতো ।”

“কি রঙের?”

“সাদা কালার।”

“হিজাব কি রঙের?”

“স্বর্নের কালার!”

“আমার গাড়ি কি রঙের?’

“তোমার চকলেট এর কালার।”

মেহবিনের কাজ শেষ। কথায় কথায় ওকে ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছে। মেহবিন এসে তাজেলের মাথায় চুমু দিয়ে বলল,,

“সব সঠিক উত্তর দিয়েছো নেত্রী।এখন একটু ঘুমাও।”

“ডাক্তার আব্বা কোনে,,

এইটুকু বলার পরেই তাজেল ঘুমিয়ে পরলো। কিন্তু মেহবিনের মনে ঝড় উঠালো। ও বাইরে এলো। মুখর বাইরেই ছিল মেহবিন ওকে তাজেলের কথা বলল মুখর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো।

দেখতে দেখতে কেটে গেল তিন দিন। এই তিনদিনে তাজেল কিছুটা সুস্থ হয়েছে। তার একটাই প্রশ্ন তার আব্বা কোথায়? মেহবিন নওশিদের না করে দিয়েছে কিছু বলতে। ও নিজে বলবে। মুখর না পুলিশ স্টেশনে গেছে। বিকেল বেলা মেহবিন তাজেলকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বাইরে নিয়ে এলো বাইরে আলো বাতাস নেওয়ার জন্য। মেহবিন হাঁটতে হাঁটতে ওকে হাসপাতালের পেছনে একটা সুন্দর জায়গা আছে সেখানে নিয়ে এলো। এখানে কেউ নেই। মেহবিন তাজেলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,,

“নেত্রী আমার কথা মন দিয়ে শুনবে?”

তাজেল মাথা কাত করলো মানে সে শুনবে।মেহবিন বলল,,

“তুমি জানো নেত্রী আমার মাও না এই তোমার মতো বয়সে আল্লাহর কাছে চলে গেছে। শুনো নেত্রী মানুষ তার আয়ু নির্ধারিত নিয়েই পৃথিবীতে আসি। হয়তো কারো মাধ্যমে তাদের মৃত্যু তবে এখানে তার মৃত্যু সেই পথেই লেখা থাকে। এই জন্য আমরা চেয়েও কিছু করতে পারি না।”

“হুম কিন্তু তুমি এইগুনা কইতেছো ক্যান?”

“তোমার আব্বা সেদিনের এক্সিডেন্ট এ সেখানেই মারা গেছে নেত্রী। তাই তুমি হাসপাতালে থাকলেও তোমাকে দেখতে আসতে পারে নি।”

মেহবিন তাজেলের চোখের দিকে তাকালো। ওর চোখ ছলছল করছে। মেহবিন সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। ও তাজেলকে জড়িয়ে ধরলো। তাজেল শুধু বলল,,

“আমার আব্বা সারাজীবনের জন্য আমারে ধোঁকা দিল ডাক্তার।”

“তুমি সবসময় জানতে চাওনা আমি যেন তোমাকে ধোঁকা না দিই। তাহলে শুনে রাখো নেত্রী যাই হয়ে যাক না কেন তোমার ডাক্তার কখনো তোমায় ধোঁকা দেবে না। সবসময় তোমার সাথেই থাকবে।”

তাজেল কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর মেহবিন বুঝতে পারলো তাদের কাঁদছে। মেহবিন বলল,,

“কেঁদে নাও নেত্রী যতো পারো কেঁদে নাও। কাঁদলে মন হালকা হবে।”

তাজেল চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। মেয়েটা আজ বুঝতে পারলো সে এতিম হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ কাঁদার পর তাদের শান্ত হলো। তখন মেহবিন বলল,,

“আজ থেকে নেত্রী তার ডাক্তারের সাথেই থাকবে সবসময়।”

তাজেল ভদ্র বাচ্চার মতো মাথা কাত করলো। মেহবিন ওকে কেবিনে শুয়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর তাজেল ঘুমিয়ে পড়লো। মেহবিন এই সময় তাজেলকে কিছু জানাতে চাইছিল না। কিন্তু ওর মুখে একটাই কথা ওর বাবা কোথায় সেদিন কি ওর বাবার ও এক্সিডেন্ট হয়েছিল নাকি। ওর বাবা কেন ওকে দেখতে আসছে না। ওর বাবা ওকে ভুলে গেছে ‌। ওর কেউ নেই। এগুলো তাজেলের অবস্থা আরো বিগরে দিচ্ছিল তাই মেহবিন ইচ্ছে করেই জানালো। হয়তো দুঃখ পেয়েছে একটু তবে ভেতরে ভেতরে আমার কেউ নেই এর থেকে গুমরে মরার থেকে এটা বেটার। মেহবিন বাইরে এসে মুখরকে কল দিল। মুখর ধরে বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম!”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আপনি কোথায়?

“পুলিশ স্টেশনে। কিছু দরকার? নেত্রী ঠিক আছে?”

“সব ঠিক আছে কিন্তু আপনি কি করছেন?”

“কি করলাম?”

“দেখুন কাল আলভি ভাইয়ার বিয়ে আর আপনি আজ পুলিশ স্টেশনে। আপনি ঐ বাড়ির বড় ছেলে এটা কেন ভুলে যাচ্ছেন।”

“দাদিজান বলে গেছেন আমি যেন তার নাতবউকে ছাড়া ও বাড়ি তে পা ও না ফেলি। আর নেত্রী কেও যেন সাথে নিই।”

“এটা পসিবল না এখন বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি প্লিজ বাড়ি চলে যান।”

“তুমি চাইলেই পসিবল। নেত্রীকে নিয়ে চলো ট্রাস্ট মি নেত্রীর কোন অসুবিধা হবে না।”

“আপনি পাগল নাকি এই অবস্থায় নেত্রীকে সাথে নেব। আমি দাদিজানকে ফোন দিচ্ছি আপনি বাড়ি যাবেন ব্যস।”

“আরে মেহু!”

“আর একটাও কথা না!”

বলেই মেহবিন ফোন রেখে দিল। তারপর আছিয়া খাতুন কে কল করলো। আছিয়া খাতুন ও মুখরের টোনে কথা বলল সে বলল,,

“সেদিন যা হওয়ার হয়ে গেছে। তবে এখন যদি মুখরের সাথে আলভির বিয়েতে না আসো তাহলে লোকজন তোমাকে এবং আমাদেরকে নিয়ে আরো বাজে কথা শোনাবে। আর হ্যা শুনলাম তোমার নেত্রী অনেকটাই সুস্থ ওরে নিয়া আসো ওর মন ভালো হবে।”

মেহবিন এদের কাউকেই বোঝাতে পারছে না। তাজেলের অবস্থা এই অবস্থায় জার্নি করাটা কতোটা রিস্ক। তাছাড়া ও বাচ্চা এতো লোড নিতে পারবে না। ও বোঝালো ও যেতে পারবে না। মুখর যেন চলে যায় একটা সময় পর দিল এক ঝাড়ি এতে কাজ হলো। দাদিও মেনে নিল তারপর মুখরকে বলল সেও বাধ্য ছেলের মতো মেনে নিল। এতে মেহবিন একটু খুশিই হলো। সেদিনের পরদিনই আছিয়া খাতুন ফোনে মাফ চেয়ে নিয়েছেন। মেহবিন ওনার অবস্থা বুঝতে পেরে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ওর কথা বলা শেষ হলেই ও দেখতে পেল তাজেলের মা এসেছে। এই চারদিন পর আজ এলো তাজেলের মা। ওনাকে দেখে মেহবিন এগিয়ে গেল। ওকে দেখে তাজেলের মা বলল,,

“তাজেল কি করে ?’

“ও ঘুমিয়েছে পরেছে। কেন কিছু বলবেন ওকে? খবরদার যদি ওকে কিছু উল্টাপাল্টা বলার চেষ্টা করেন তাহলে সেখানেই আপনার মুখ আমি সেলাই করে দেব।”

তাজেলের মা বলল,,

“না ওরে একটু দেখতে আইছিলাম। কিছু কমুনা। আসলে কার মউত কেমনে হেইডা তো আমরা জানি না। তয় মরতে হইবো এইডা সবাই জানি তহন রাগে দুঃখে ভবিষ্যতের চিন্তায় ঐসব কইছি এর জন্য আমারে মাফ কইরা দিও। এহন তো চিন্তা নাই।”

“মানে?”

****
তাজেলের মায়ের পরবর্তী কথায় মেহবিনের মুখে হাঁসি না ফুটলেও বুক থেকে পাথর টা নেমে গেল। ও শুধু বলল,,

“তাজেলের দায়িত্ব আমার ওর দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে না। এমনিতেও আপনি ঠিক ভাবে ওর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যান নেত্রী ভেতরেই আছে দেখে আসুন।”

_______________

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত চারপাশ একদম নিস্তব্ধ। এমন সময় একটা রুমে মেহবিন ও তার পার্টনার ঢুকলো। সাতদিন হয়ে গেছে সেদিনের পর। আলভি আর মাইশার ও বিয়ে হয়েছে মেহবিন কে ছাড়া। মেহবিনের কথায় মেহরব চৌধুরী ও কিছু বলতে পারেনি। মেহবিন ও ওর পার্টনার দু’জনের মুখেই মাস্ক আর গায়ে হুডি। মেহবিন আয়েশ করে ওর নিজের চেয়ারে বসলো। তার পাশের চেয়ারে পার্টনার বসলো। মেহবিন সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে হাসলো। সামনের মানুষটার শরীরে খুব একটা শক্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। না শরীরে মারের দাগ নেই তবুও লাল। মেহবিন কাউকে ইশারা করতেই এক বালটি পানি তার গায়ে পড়লো।সে ধরফরিরে উঠলো। তারপর মেহবিনের দিকে তাকাতেই মেহবিন হাত নাড়িয়ে বলল,,

“হাই নিশাচর কেমন আছেন আপনি? তাহলে বলুন নতুন অভিজ্ঞতা কেমন আপনার?”

লোকটা মেহবিনের দিকে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হেঁসে উঠল আর বলল,,

“নিশাচর কে ধরা এতোই সহজ নাকি?”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“সহজ নয় বুঝি? এই কে আছো পর্দাটা সরাও দেখি।”

মেহবিনের কথায় পর্দা সরানো হলো। আর পর্দা সরাতেই লোকটা চমকে উঠলো। পর্দার পেছনে যে ছিল তার অবস্থা উনার থেকেও খারাপ। মেহবিন হেঁসে বলল,,

“তো এখন বল সোজা নয় নাকি? নিশাচর নাম্বার এক নাকি দুই। আচ্ছা শেখ আমজাদ বলুন তো আপনি মাথা নাকি সে। নাকি দু’জনেই একমাথা ।”

“মেহবিন!”

“আমার চেহারা টা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি। আচ্ছা দাঁড়ান দেখাচ্ছি। ”

বলেই মেহবিন মাস্ক খুলে ফেললো। আর বলল,,

“পাশের জনের ঘুম ভাঙাও অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে।”

মেহবিনের কথায় তাকেও এক বালটি পানি মারা হলো। তবে তার আগে শেখ আমজাদ কে পর্দা দিয়ে আড়াল করা হলো। আর বলা হলো চুপ থাকতে নাহলে ওকে এখনি মেরে দেবে। তিনি আর আওয়াজ করলো না। লোকটা পানির ঝাপটায় ধরফরিরে উঠলো মেহবিনের দিকে তাকালো। মেহবিন আগেরবারের মতো এইবার ও হাত নাড়িয়ে বলল,,

“হাই নিশাচর কেমন আছেন আপনি? তাহলে বলুন নতুন অভিজ্ঞতা কেমন আপনার?”

মেহবিনের কথায় তিনিও হেঁসে উঠল আর বলল,,

‘নিশাচর কে ধরা এতোই সহজ নাকি?”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“আমি বুঝলাম না। দু’জনের একই আচরনের মানে কি? পার্টনার আপনি কিছু বুঝতে পারছেন?”

‘বুঝতে তো পারছি পার্টনার তবে এরা বুঝতে চাইছে এরা ধরা পরে গেছে। এই পর্দা সরাও দুজন দুজনের মুখোমুখি হোক।”

পর্দা সরানো হলো। দুজন দুজনের দিকে তাকালো তখন মেহবিন বলল,,

“তো আরিফ জামান এবার বলুন সহজ না নাকি।”এবার আবার বইলেন না আপনাদের মধ্যে কেউ নিশাচর না তাহলে কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাবে আমার।”

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“না, না আমরা কেউ নিশাচর না। নিশাচর তো শেখ শাহনাওয়াজ। সেই আমাদের দিয়ে কাজ করায় !”

এবার মনে হলো মেহবিনকে কেউ জোকস্ শুনিয়ে দিয়েছে। মেহবিন হাসতে লাগলো পাগলের মতো। মেহবিনের হাঁসি দেখে দু’জনেই ভয় পেল‌। মেহবিন বলল,,

“জোকস্ অফ দা ইয়ার তাইনা পার্টনার!”

“ঠিক বলেছেন পার্টনার।”

তখন আরিফ জামান বললেন,,

“জোকস্ হলেও এটাই সত্যি। তাহলে বলো সব জেনেও কেন তোমায় খুঁজলো না।

“হ্যা হ্যা সত্যিই তো শেখ শাহনাওয়াজই তো নিশাচর। ”

“তুমি আমাদের বিশ্বাস করো না।”

“না! যাই হোক আসল কথায় আসি। তো দু’জনে বলে ফেলুন তো আপনাদের মধ্যে নিশাচর কে? না দুজনে মিলেই একজন নিশাচর। একজন ডক্টর অপরজন বিজনেসম্যান দু’জনের মাথা যখন একসাথে তখন তো লাভ হতেই হবে তাইনা। তবে আমি বুঝতে পারলাম না দুজনেই একসাথে কেন আমায় মিথ্যে বললেন। তারমানে দুজনের মাথা তো একইভাবে চলে তাই একইরকম উত্তর। ”

মেহবিনের কঠোর কথায় দুজনেই দমে গেল। তারা কিছু বলছে না তখন মেহবিন ইশারা করলো আর সাথে সাথে তাদের শরীরে কারেন্ট লাগলো। এমনিতেই একয়েকদিনে কারেন্ট খেতে খেতে অবস্থা লাল। নাম শুনলেই ভয় পায়। হয়তো ফোবিয়াও তৈরি হয়েছে। কারেন্ট পেতেই দুজনে চিৎকার করে উঠল,,

“বলছি! বলছি!”

অতঃপর

~চলবে,,

বিঃদ্রঃ রাত নয়টার দিকে বোনাস পার্ট আসবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here