মন_শহরে_বসন্ত_হাওয়া |৭| #কে_এ_শিমলা ®

0
274

#মন_শহরে_বসন্ত_হাওয়া |৭|
#কে_এ_শিমলা ®

হঠাৎ পরিচিত পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো কানে। রণয়ী ফট করে পাশে তাকায়। প্যান্টের পকেটে এক হাত গুঁজে অপরহাতে ফোন কানে ধরে কথা বলছে দুর্জয়। হালকা নীল রঙের ফুলহাতা টিশার্ট গায়ে। সাদা প্যান্ট। রণয়ীর তাকানোর মধ্যে সেও এবার এপাশ ফিরে তাকায়। অতঃপর অপ্রত্যাশিত ভাবে দুজন মানুষের দেখা।‌ দৃষ্টি মিলন‌ হলো দুজনার। দুর্জয় রণয়ীর আশপাশ দেখলো। অর্থাৎ সে একা এখানে দাঁড়িয়ে। দুর্জয় চাইলেও আর সরলো না। দুর্জয়ের থেকে দৃষ্টি ফিরালো রণয়ী ও। সম্ভবত কোনো ম্যানেজারের সাথে কথা বলছেন। কথায় তো তাই বুঝা যাচ্ছে।”

দুর্জয়ের কথা বলা শেষ হলে রণয়ী সালাম করলো। দুর্জয় জবাব দিয়ে বললো, ‘মিস রণয়ী রহিম! ঘুরতে বের হলেন?”

‘ওইরকমই স্যার।‌ নয়নার বাসায় যাওয়া ছিল আজ আমাদের। ছোট একটি আয়োজন ছিল।”

‘বেশ। ছুটির দিনে অবশ্য ঘুরা ভালো। তবে আমার মতো গাড়ি নিয়ে বিপদে না পড়লেই হয়।”

রণয়ী খানিকটা অবাক কন্ঠে বললো, ‘বিপদ!”

দুর্জয় ফোনে দৃষ্টি রেখে বললো, ‘জ্বী। হঠাৎ গাড়ির সমস্যা দেখা দিল। এমদাদ সাহেব নিয়ে গিয়েছেন মেকানিকের কাছে। আমাকে তো বাসায় রিকশাতেই ফিরতে হবে।”

‘একদিন রিকশায় চড়ে দেখুন স্যার। ভালো লাগবে।”

দুর্জয় চোখ তুলে তাকালো রণয়ীর পানে।‌ তাঁর দৃষ্টি সামনে রিকশা খুঁজায় ব্যস্থ। দুর্জয় পর পর চোখের পলক ফেললো। মিস রণয়ী রহিম তার কথা ফিরিয়ে দিলেন না? হঠাৎ হাসলো দুর্জয় অধর কোণ বাঁকিয়ে। আজকাল এই নারীর জন্যেও হুটহাট হাঁসি ফুটে অধর কোণে। দু’জনই দাঁড়িয়ে রইল পাশাপাশি। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। রিকশা এলে হাত বাড়ায় রণয়ী। ঠিকানা বলে গিয়ে উঠে বসলো। দুর্জয় কছ যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিকশা চালক বললো, ‘ভাই আইবেন না ভাবি?”

অস্বস্তিতে পড়লো রণয়ী। এদিকে তাকালো দুর্জয় ও। রণয়ীও তাকায় একপলক। তারপর ভাবলো এতোক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে একটা পেল। আরেকটার জন্য নিশ্চয় আরো অনেক সময় দাঁড়াতে হবে। তাদের মতো দু’জন মানুষ দূরত্ব রেখেও অনায়াসে চলে যেতে পারবে ঠিক, এক রিকশায়। তাই জড়তা রেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো, ‘স্যার আসুন। এক রিকশায় যাওয়া সম্ভব। যদি আপনার সমস্যা না থাকে তো।”

‘ধন্যবাদ মিস রণয়ী রহিম। সমস্যা আমার হবে না। আপনার হতে পারে। চলে যান। এখানে দাঁড়াই একটু। পেয়ে যাবো আমিও।”

‘আমার সমস্যা হবে না বলেই আপনাকে বলছি‌ স্যার। চলে আসুন।”

‘রিকশা আইতে দেড়ি ওইবো ভাইজান। সব ওখন কোচিং সেন্টার আর হাসপাতালের সামনে ভীর জমাইছে।‌”

দুর্জয় সময় দেখলো। তারপর এগিয়ে উঠে বসলো রিকশায়। ওপাশে চেপে বসলো রণয়ী। মাঝখানে দূরত্ব রইলো অনেকটা। তবুও স্পর্শ করলো না একজন আরেকজনের কাপড় পর্যন্ত। রিকশা চলতে শুরু করলো তাঁর সমান্তরাল পথ ধরে। দু’জন দু’জনের মতো করে বাহ্যিক দৃশ্য দেখায় মত্ত হলো। অথচ রণয়ীর ভেতরে হাঁসফাঁস করছে। কেমন যেন লাগছে তাঁর। তারউপর রিকশাচালক কী বললো হঠাৎ। এমন কিছু ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো রিকশা। রণয়ী অপ্রস্তুত থাকায় খানিকটা হেলে পড়লো বাহিরের দিকে। এমতাবস্থায় দুর্জয় এক হাত আঁকড়ে ধরলো তাঁর শক্ত হাতে। রণয়ী নিজেও ধরলো অন্যহাতে হুড চেপে। ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছিল। ভাবতেই লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যেন। দুর্জয় কিয়ৎক্ষণ পর হাত ছেড়ে দিতেই রণয়ীর অনুভব হলো। এতোক্ষণ এই মানুষটা তাঁর হাত ধরেছিল। মনে হচ্ছে ভুল হলো তাঁর এক রিকশায় উঠে। স্যার কে তুলে দিয়ে সে নিজে দাঁড়িয়ে থাকলেই হতো।”

‘ঠিক হয়ে বসুন মিস। সাবধানে বসবেন পরেরবার রিকশায় উঠলে। এক্ষুনি পড়ে যাচ্ছিলেন আপনি।”

অস্বস্তি নিয়ে বসলো রণয়ী ঠিক হয়ে। মনে মনে বললো, ‘আপনি পাশে থাকলে আর ঠিক হয়ে বসতে হবে না। এভাবেই যথেষ্ট।”
বেশ খানিকটা সময় পর রিকশা এসে পৌঁছায় বাসার সামনে। রণয়ী থামাতে বললো রিকশাচালক কে। আর তা থামলে সে নেমে গেল। ব্যাগের চেইন খুলতে খুলতেই দুর্জয় বলে উঠলো, ‘চলুন ভাই। মিস রণয়ী রহিম ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।”

‘ভাই আমার ভাড়াডা! আর আপনে এখানেই…।

‘আপনার ভাড়া পেলেই তো হয়। সামনে চলুন।”

রণয়ী টাকা বাড়িয়ে ধরলো। রিকশাচালক পড়লো এবার দ্বিধায়। রণয়ী বললো, নিন!”

‘না উনি নিবেন না। আপনি বাসায় যান।”

‘উনি তো আর আমাকে এমনিই এমনিই এখানে নিয়ে আসেননি স্যার।”

‘আপনাকে ভাবতে হবে না। চলে যান। ভাড়া দেওয়ার জন্য কেউ একজন আছে।”

‘আপনি কেন আমার ভাড়া দিবেন স্যার?”

‘যেহেতু রিকশাটা আমার বাসায় যাবে সেহেতু ভাড়া আমিই দেবো। এখন একজন‌ কেন দশজন উঠে নেমে গেলেও ভাড়া আমার উপরেই পড়ে। যদি হোন আমার অফিসের মানুষ! তাহলে তো আমার দায়িত্বটা আরো বেশি।”

‘স্যার…!”

রিকশা চললো সামনে। বেশ বুঝতে পারলো সে উনারা স্বামী-স্ত্রী নন। কী আজব! এমনো বস কর্মচারী পাওয়া যায়।”

রণয়ী আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে আছে চলে যাওয়া রিকশার পানে। বিরবির করে বললো, ‘বড়লোক।”
আসলেই তো! নিজে নিজে বলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে এখন খচখচ করছে। কেন আগেই ভাড়াটা বের করে রাখলো না। তাহলে তো আর এতো কিছু হতো না। নামার পূর্বেই টাকা দিয়ে দিত। নয়তো নেমেই দিতে পারতো। খুচরা টাকা বের করতে গিয়েই যত বিলম্ব হলো।”

ঘরের দিকে এগিয়ে এসে দেখলো দরজা খোলাই আছে। রিদিমা বাহিরে কিছু একটা করছে। আরেকটু যেতেই দেখলো দুটি ফুলের টব রাখছে সে বারান্দায় একপাশে। বাহ! সুন্দর তো। জারবেরা এবং গাদা ফুলের চারা। কয়েকটি জারবেরা অবশ্য ফুটে আছে চারায়। একটি বড় গাদাও আছে। রণয়ী কে সামনে দেখতেই রিদিমা হেসে বললো,
‘ওহ তুমি এসেছো?”

‘হ্যাঁ! চারা গুলো তো সুন্দর।”

‘হুম! দেখো তো চারা গুলো এনে ভালো করিনি?

‘হ্যাঁ ভালোই। বড় হয়ে ফুল ফুটলে আরো ভালো লাগবে।”

‘ওদের স্কুল থেকে নিয়ে আসার পথে দেখলাম একজন বিক্রি করছে। ভালো দাম কম! তাই কয়েকটা নিয়ে নিলাম ওই যে দেখো আরো। দুই রকমের গোলাপ চারাও ছিল।”

রণয়ী সামনে তাকিয়ে দেখলো আসলেই। সেখানেও আরো নয় দশটার মতো চারা রাখা। বললো, ‘বাহ ভালোই তো। এসে যেগুলো দেখেছিলাম সেগুলোর মতোই‌ সুন্দর হবে।”

রিদিমা খানিকটা মুখ মলিন এবং ছোট করে বললো, ‘আর বলো না। কেন যে এতোটা ফুল গাছ এমনি মারা গেল।”

‘মন খারাপ করো না ভাবী। এগুলো ও কয়েকদিনেই বড় হয়ে ফুল ফুটবে। তোমার যা যত্ন।”

রিদিমা মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে। তুমি ঘরে যাও। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করো। চা নেবে?”

‘না না ভাবী। আজ রাতে খাবোই না আর। ঘুমিয়ে গেলে ডেকো না আমায়।”

‘সে কী! এখন রাত বাজে নয়টা। আর তুমি বলছো ডাকবো না। আচ্ছা ঘুমাও গিয়ে সাড়ে দশটায় ডেকে দেবো।”

‘না ভাবী। খেয়েই তো এসেছি। ক্ষিধে নেই আর ডেকো না। একটু ঘুমাই। কাল তো অফিস আছে।”

‘তুমি কী খেয়েছো জানিই তো। আচ্ছা বলছো যখন ডাকবো না‌।”

রণয়ী মাথা নাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। পাশের ঘর থেকে পড়ার আওয়াজ আসছে। তারমানে ভাইবোন দু’জন পড়ছে। রণয়ী টেবিলের উপর রাখলো চকলেট আর বাদাম গুলো। ঘুরে ঘরের পথে অগ্রসর হলে সামনে পড়লেন রাবিয়া খানম। মাথায় সাদা হিজাব। পড়নে বড়সর শুভ্র মেক্সি। হাতে তাসবিহ। রণয়ী কে দেখে তাসবিহ রাখলেন পকেটে‌। হেসে কাছে আসলেন।‌”

‘দেড়ি হলো না আম্মা?”

‘বেশি দেড়ি করেছি?”

‘না! সবাই ভালো আছেন তো তাদের বাসার?”

‘হুম! ভালো আম্মা। আন্টি বলছিলেন কেন তোমায় নিয়ে গেলাম না? পরেরবার যেন নিয়ে যাই।”

‘সে সময় কী আর আছে আমার। যা ফ্রেশ হো গিয়ে। বৌমা কোথায় গেল?”

‘ভাবী বারান্দায়।”

‘মেয়েটা দুই বাচ্চার মা হয়েছে ফুলের শখ যায়নি। ভর দুপুরে কতকগুলো চারা নিয়ে এলো।”

‘ফুল পছন্দ করা মানুষ গুলোর মনও ফুলের স্বরূপ। তাই তো আমার ভাবী এতো ভালো‌। তাই না আম্মু!”

‘হ্যাঁ! তোর বাবার পছন্দ বলে কথা।”

‘আব্বুর পছন্দের দুই না না তিন নারী। এক উনার নিজের স্ত্রী। আর দুই পুত্রবধূরা। সবাই ভালো। আর মমতাময়ী।”

মেয়ের কথায় হাসলেন রাবিয়া খানম। রণয়ী নিজেও মৃদু হাসলো। অতঃপর বিদায় নিল মায়ের নিকট হতে। রাবিয়া খানম মলিন মুখে চেয়ে রইলেন মেয়ের যাওয়ার পানে। এই যে ছোট করেই একটু হাসে কত মায়াবী লাগে। খিলখিল করে হাসিটা ছিল মুক্ত ঝরা। এই মেয়ের মুখের মুক্তঝরা হাসি দেখার জন্য রাবিয়া খানম কত কী করতেন। আর মেয়েটাও তখন প্রাণখুলে হাসতো‌। মা মেয়ে ছিলেন বন্ধুর মতো। অথচ আজ মেয়েটা হাসতে ভুলে গেছে। মুক্ত ঝরা নয়ন জুড়ানো হাসি দেখেন না মা মেয়ের মুখে কতটা দিন পেরিয়ে গেল। এতো মায়াবী মুখ দেখেও কী সে ছেলেটার মন গলেনি। পারলো কীভাবে ছেড়ে দিতে মাঝরাস্তায়? মেয়ে হয়ে সে পিছুপা হয়নি‌। সব ভুলে তাকেই আকড়ে ধরেছিল। তবে তাঁর বিনিময়ে কেন শুধু শুন্যতা পেল?’
হিসাব মিলে না রাবিয়া খানমের। মেয়েটা হেরে গিয়েছিল ভাগ্য বিশ্বাসের কাছে। কখনো যদি হয় ভাগ্যে থাকে তবে মেয়েটি আবারো সুখের হাসি হাসবে। সেই অপেক্ষাতেই আছেন রাবিয়া খানম। মেয়েটার ভাগ্য এতোটা ও নির্মম হবে না নিশ্চয়। কেউ তো আসবেই তাঁর জীবনে। দ্বিতীয় ফাগুন হয়ে।”

~~~~~~•••••

‘কী ব্যাপার আম্মা! আপনি কথা বলছেন না কেন আমার সাথে?”

‘যে আমার কথা শুনে না আমিও তাঁর কথা শুনবো না।’

‘ওহ আম্মা! আপনার এখন ছেলেমানুষী করা সাজে? আপনার কোন কথা আমি শুনিনা বলুন?”

‘বয়স যে বাড়লো সেদিকে খেয়াল আছে আপনার আব্বা? মেয়ে দিবে কেউ?”

‘কী বলবো এখন আমি?”

‘আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমার কথা যেভাবে শুনেন না। সেভাবে কথাও বলবেন না। যান আমার ঘর থেকে।”

গেল না দুর্জয়। বরং মায়ের নিকটে গিয়ে বসলো। কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এই জায়গাটায় এতো শান্তি। ঠিক যেন কিশোর দুর্জয় হয়ে গেল বত্রিশ বছরের যুবক।”
সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিন চেয়েও পারলেন না আর ছেলেকে সরাতে। চুলের ভাঁজে হাত রেখে বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘এবার অন্তত বিয়েটা করে নিন আব্বা।”

‘আচ্ছা করবো। আপনি পাত্রী দেখুন। যাকে পাত্রী হিসেবে পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ হবে। তাকেই বিয়ে করে নেবো এবার ইনশাআল্লাহ।”

‘না আমার নয়! আপনার পছন্দেই বিয়ে হবে আব্বা।”

‘আচ্ছা! করবো। আমার প্রথমে আপনি পছন্দ করবেন। যার সাথে আপনি বাসায় থাকবেন। তাকে আপনি আগে পছন্দ করুন।”

‘আমি কিছুদিন তাঁর সাথে থাকবো আব্বা। কিন্তু আপনি তো আপনার পুরো জীবন তাঁর সাথে পথ চলবেন। সেক্ষেত্রে আমার থেকে আপনার পছন্দ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই না! আচ্ছা আপনার আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী মাহফিলটা শেষ হোক। ইনশাআল্লাহ আপনার জন্য একজন সুন্দর মনের মানুষ আনবো ঘরে। যার হাতে হাত রেখে আপনি পারি দিবেন শত শত বছর। আপনার বিশ্বাস যে কখনো ভাঙবে না।”

‘আমার আব্বার বিশ্বাস যে নারী কখনো ভাঙেননি। সেই নারীর পছন্দ করা নারীও আমার বিশ্বাস কখনো ভাঙবে না। আমি বিশ্বাস করি।”

‘আমার কোন পুন্যের বিনিময়ে যে আল্লাহ তায়ালা আমাকে দুই চাঁদ দিয়েছিলেন। হাজার কোটি শুকরিয়া জানাই মহান তায়ালা কে। পৃথিবীর এক চাঁদ আর আমার দুই চাঁদ।”

হাসলো দুর্জয় মায়ের কথায়। বাল্যকাল থেকেই দুর্জয় মায়ের এমন হৃদয় জুড়িয়ে যাওয়া কথা শুনে এসেছে। তাই তো অবসরে মায়ের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টায় মত্ত থাকে সে। দশটি বই আর মা কে যদি একসাথে রাখা হয় তবে দুর্জয় তাঁর মা কেই বেছে নিবে হাজার বার। অথচ দুর্জয়য়ের ঘরে প্রবেশ করলে বুঝা যাবে একটি বইয়ের রাজ্যে কেউ প্রবেশ করেছে।”

সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিন ছেলের মাথায় আদরের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। দুই ছেলে মেয়ে উনার দুই চোখের মনি। সতেরো বছর বয়সে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি দেলোয়ার হক ইমামের সহিত। উনিশ বছর বয়সে মা হোন। কোল আলো করে যখন ভূমিষ্ট হলো দুর্জয়। তখন দশ মাসের হাড় ভেঙে যাওয়ার মতোও ব্যথা লাঘব হয়ে যায় কুয়াশার মতোন। অতঃপর সাড়ে পাঁচ বছর পর আবারো এক কন্যা সন্তান। জুমায়রা ইমাম হক। দুই সন্তানের জননী সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিন। খুব সুখেই ছিলেন। এখনো আছেন। কন্যাকে বিবাহ করিয়েছেন তারই পছন্দের মানুষের সাথে। কেবল পুত্রই পিছিয়ে রয়েছে। এবার আর কোনো কারণ বারণ মানবেন না তিনি। বিবাহ হবে মানে হবেই। পাত্রী দেখতে হবে!”

পাত্রীর কথা মাথায় আসতেই মনের কোণে ভেসে উঠলো একটি সুন্দরী কিশোরীর অপরূপা মুখশ্রীখানা। প্রায় অনেক গুলো বছর কেটে গেছে তাকে আর দেখা হয়নি। আজ সে প্রাপ্ত বয়সী নারী। অন্যত্র বিয়ে সংসার হয়েছে। ইচ্ছে ছিল সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিনের, তাকে নিজ গৃহে একমাত্র পুত্রবধু করে নিয়ে আসার। কিন্তু কখনো তা মুখ ফুটে বলা হয়নি‌। মেয়েটা নেহাৎ কম বয়সী। চৌদ্দ পনেরো বছরের।‌ ষোলো বছরের রেখে এসেছিলেন সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিন। তাঁর মা কে বলতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন তিনি। নিজে সতেরো বছর বয়সে বিবাহিতা হয়েছিলেন। কিন্তু তবুও বলতে পারছিলেন না। অতঃপর যখন চলে এলেন দূরে। তাঁর বছর তিনেক পর শুনতে পারলেন তাঁর বিবাহ। নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন কিন্তু যেতে পারেননি তিনি। এর থেকে দেড় বছর পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পূর্বের জায়গায় একবার গিয়েছিলেন সৈয়দা জোহরা ইয়াসমিন কিন্তু তাদের আর পাননি। অতঃপর তিনি নিজেই বিদবা হলেন। বয়স বাড়লো। আর বের হোন না খুব একটা বাসা থেকে। তবে যখন তখন মেয়েটির সুন্দর মুখ ভাসে চোখের তারায়। মেয়েটা ভীষণ মায়াবতী। নয়তো একজন নারী হয়েও কীভাবে আরেকজন মেয়ের মায়ায় পড়েন তিনি। মেয়েটাকে আশেপাশে নিজ ধারেই মেয়ের মতো রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হলো না। অতঃপর ছেলের ও আর বিয়ে দেওয়া হলো না।”

এদিকে দুর্জয় নিজেও সাংসারিক জীবন নিয়ে ভাবনায় মশগুল হলো। কেমন নারী আসলে তাঁর পছন্দ। কার সাথে এক ঘরে এক বিছানায় থাকলে মানসিক শান্তি পাওয়া যাবে। একটা মায়াবী মুখ। বাহির থেকে যতই ক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক নিয়ে ঘরে ফিরে, যার মায়াবী মুখ দেখলেই হৃদয় শীতল হবে। যার এক চিলতে হাসিতে মস্তিষ্কের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। সেরকম একটা মায়াবী মুখের অধিকারীনী আর তাকওয়াবান হলেই আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা মায়াবতী হিসেবে কার মতোন? মিস রণয়ী রহিমের মতো?”

নিজের ভাবনায় নিজেই বিস্মিত হলো দুর্জয়। কী ভাবছে সে এসব? তড়িৎ মায়ের কোল ছেড়ে উঠলো। অতঃপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিজ কক্ষে প্রবেশ করলো। একটু বেশিই ভাবা হয়ে গেছে। আর এই নারী বেশিই ভাবনায় এমনকি চলার পথে বেশি চলে আসছে।”

~~~••••

বেশ কিছুদিন থেকে অফিসে এমনিই কাজে, প্রতিটি পদে পদে গন্ডগোল লেগে আছে রক্তিমের। ব্যবসায় শুধু লস। এদিকে পিএ নোমান! সে নিজেও কাজের কাজ কিছুই করছে না। সারাক্ষণ কেবিনে থেকে ফোনে মশগুল থাকে। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ ও তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার হেলদোল কাজ করে না। কোনো মাথাব্যথা নেই কাজ নিয়ে। আগে যেভাবে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকতো, এখন ততোটাই যেন উদাসীন। এদিকে বাসায় ফিরলে নিজের বউ কেও সেই মোবাইলেই ব্যস্থ দেখা যায়। বাসায় ফেরার পর খাবার ভেড়ে দিবে। তারপর রুমে চলে যাবে। এরপর কিছু লাগলে কাজের মেয়ে এনে দেয়। তাঁর কোনো খবর থাকে না। বেশ রাত্রি পর্যন্ত ও মোবাইলে ব্যস্থ তাকে। বেশ অশান্তিতে ভোগছে সে‌। চেয়েও কিছু বলতে পারে না নূরা কে।”

আজকেও বাসায় ফিরে তাঁর ব্যতিক্রম দেখলো না রক্তিম। কলিং বেল বাজানোর পর কাজের মেয়ে রুনা এসে দরজা খুলে দিয়েছে। প্রথম প্রথম রক্তিম বাসায় ফিরলেই তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতো নূরা। কী লাগবে না লাগবে এসব জানার জন্য ছটফট করতো যেন। রক্তিম বুঝতো এই মেয়ের মাঝে ভালোবাসা তাঁর জন্য সীমাহীন। আর এখন বাসায় এসে ফ্রেশ টেরেশ হয়ে দুই তিনবার বলার পর সে আসে খাবার দিতে। কখনো আবার বিরক্ত হয়ে বলে খাবার দেওয়ার জন্য তো রুনা আছেই‌।”

আজ ভেতরে প্রবেশ করেই দেখলো নূরা ফোনে কিছু একটা টাইপ করছে আবার টাইপ বন্ধ করে হাসছে মুচকি মুচকি। মেয়েটার হাসি সুন্দর বটে! তবে এখন এই হাসিতে রক্তিমের কেমন যেন সন্দেহ হয়। এগিয়ে গেল সোফার দিকে। পাশে বসতেই ছিটকে দূরে সরে গেল নূরা। রক্তিম বিস্মিত চোখে তাকাতেই বোকা হেসে বললো, ‘আরেহ তুমি! আমি ভেবেছি আরো কে তো কে এসে বসেছে।”

‘তাই! তুমি জানো না আমার আসার সময় এখন? আর কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পাওনি? চোখ তুলে তো দেখা উচিত কে এসেছে। এভাবে ঘর, দোর, সংসারের প্রতি উদাসীন হলে চলে‌।”

খানিকটা মুখ ফুলিয়ে নূরা বললো, ‘এভাবে বলছো কেন রক্তিম! আমি কী সংসার করি না? আজ একটু মোবাইলে বেশিই মন চলে গিয়েছিল হয়তো। বহুদিন পর আমার একটা ফ্রেন্ড কথা বলছে।”

“হ্যাঁ প্রতিদিনই তোমার নতুন নতুন ফ্রেন্ড তোমার সাথে কথা বলে। আর তুমিও খুব মন দিয়ে কথা বলো‌। যতোটা মন এখনো পর্যন্ত আমাকে দাওনি তুমি। সংসার তুমি করো! তবে কার সাথে করো এটা আমি বুঝতে পারি না। আমার সাথে নাকি ফোনের সাথে?”

কথা গুলো বলতে গিয়েও পারলো না রক্তিম। কেন যেন কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না। আজকাল নিজেকে খুব শুন্য লাগে। কী যেন নেই! ছিল তবে হারিয়ে গেছে। নিজ দোষে হারিয়েছে। এমনটা মনে হয়‌। কোট খুলে সোফা ছেড়ে উঠলো। গলার টাই ঢিলে করতে করতে বললো, যাও খাবার রেডি করো। আমি আসছি ফ্রেশ হয়ে।”

রক্তিমের কথায় মুখটা এমন ভাবে বিকৃত করলো নূরা। যে কেউ দেখলে ভয় পাবে‌। রাগে ক্ষোভে ফোন ছুড়ে মারলো সে সোফায়। তারপর শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠলো সোফা থেকে। রাগে গজগজ করতে করতে এগিয়ে গেল কিচেনের দিকে। মন চায় একবারে জনমের মতো খাইয়ে দিতে।”

চলবে!

|আসলেই অনেক জায়গায় একটু বেশি লিখে ফেলি। খেয়াল রাখবো এখন থেকে। কয়েকটা লাইন লেখার পর মনে হয় আরো দুটো লাইন লিখলে ভালো হয়‌। এরকম করে লিখতে গিয়েই দীর্ঘ হয়ে যায়। আর তাড়াহুড়ো করতে চাই না বলে একটু ধীর হচ্ছে। যাই হোক! আগামী পর্বে অতীত নিয়েই হবো ইনশাআল্লাহ! দুই অথবা তিনটা পর্বে অতীতের সমাপ্তি টেনে আরো কয়েকটি পর্ব লিখবো‌। অতঃপর সমাপন! চাইবো রমজানের আগেই শেষ করে দিতে।|🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here