মন_শহরে_বসন্ত_হাওয়া |১০| #কে_এ_শিমলা ® |২৫০০+শব্দসংখ্যা|

0
299

#মন_শহরে_বসন্ত_হাওয়া |১০|
#কে_এ_শিমলা ® |২৫০০+শব্দসংখ্যা|

সবাই কে একঝলক দেখে নিয়ে রণয়ী কম্পিত কন্ঠে বলে, ‘হ্যাঁ আমার পছন্দের মানুষ আছে। তাকে আমি ভালোবাসি। খুব ভালো ছেলে। প্রতিষ্ঠিত। বাবা ব্যবসায়ী! এখন সেও ওই ব্যবসায়ে হাত দিবে। আরো উন্নত করবে।”

রহমান রহিমের মুখাবয়ব পরিবর্তন হয়‌। কাঠিন্যতা ফুটে উঠে‌। রণয়ী তা বুঝতে পেরে চট করে নিজ জায়গা থেকে উঠে বাবার কাছে গিয়ে হাত ধরে বলে, ‘প্লিজ আব্বু! না করো না। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। সেও আমাকে বাসে। এতো প্রস্তাব আসে বলেই সে বিয়ে করতে চায় এখন। না হলে আমরা সময় নিতাম। প্লিজ আব্বু! তুমি অমত করো না।” চোখের জল ছেড়ে দেয় রণয়ী।

দুই ছেলের পর এক মেয়ে। বয়সের তফাৎ অনেকটাই ছেলেদের সাথে মেয়ের। সে যখন সদ্য কলেজে পা রেখেছে তখন এক ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরী খুঁজছে তো আরেক ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে। আর এখন বড় জন বাবা হয়ে গিয়েছে। বড্ড আদরের মেয়ে। তিনি হয়তো রাজা নন। মেয়েও রাজকন্যা নয়। কিন্তু সন্তানের চোখে তিনি ছিলেন রাজা। আর সেই সন্তানরা ছিল রাজকন্যা রাজকুমার। সবসময় তেমনই রেখেছেন তিনি তাদের। দুঃখ, অভাব, শখের অপূর্ণতা কোনো কিছুই তাদের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেননি। সেদিন মেয়ের ভালোবাসা! পছন্দ! তাঁর চোখের জল উপেক্ষা করতে পারেননি রহমান রহিম সাহেব। মেনে নিলেন মেয়ের কথা। তবুও মনের মাঝে একটা খুঁতখুঁত ছিল। যে সুখের আশায় মেয়ে উনার কাছে কাউকে চাচ্ছে। সেই সুখ পাবে কী সে‌। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও পারেননি। অবশ্য সংসারটা সে করবে। পরিবারের থেকেও তাঁর মতামত কিংবা পছন্দ অপছন্দ বেশি প্রাধান্য পায়‌।”

মা বাবা মেনে নিলেও ভাইয়েরা কিছুটা নাকচ করছিলেন। যতই হোক! রণয়ী চাইলে আরো ভালো জায়গায় যেতে পারে। তারপরেও সেটা কোনো বিষয় নয়। ‘মানুষ সঠিক হলে কুঁড়েঘরেও সুখ মিলে‌’। অথচ যখন শুনলেন রক্তিমের এর আগেও একটি সম্পর্ক ছিল কয়েক বছরের। তখনই রনক সরাসরি না করে দেয়। রণয়ী কে খুব বুঝায়। কিন্তু রণয়ী বুঝে না। মা বাবার কাছেও তা জানাজানি হয়। রণয়ী অবুঝের মতো কাঁদে। বাবা বারবার বলছিলেন ভেবে দেখতে‌। সে হয়তো এখন ভালোবাসছে ঠিক। কিন্তু বিয়ের পর যদি মন উঠে যায়! যদি প্রথম ভালোবাসা কখনো ফিরে আসে‌। যতই হোক কিছু কিছু মানুষ দ্বিতীয় ভালোবাসা যতই পাক কিংবা দেখাক। প্রথম ভালোবাসা অনুভূতির কাছে তাদের দ্বিতীয় অনুভূতি ভালোবাসা কিন্তু হেরে যায়। সবার না হোক! কয়েকজনের তো হয়। সেই কয়েকজনের মধ্যে যদি রক্তিম ও থাকে।”

রনক নিজে বুঝায়। রামিন বুঝাতে না পেরে হাল ছাড়ে। সে এমনিতেও খুব বুঝিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কখন রাগে বোন কে কী বলে দেয় বলা যায় না। তাই আর কিছু বলে না। যদি পারে বোন সংসার করতে তাহলে করুক বাঁধা না দেওয়াই ভালো। অবুঝ কে না হলেও বুঝানো যায়। সাধ্য আছে। কিন্তু বুঝদার মানুষ যদি অবুঝপনা করে তবে তাকে বুঝানো ভীষণ দায় কী বৃথা। কিন্তু হাল ছাড়ে না রনক। কথা কমিয়ে দেয়! রাগ করে। কিন্তু রণয়ী বুঝে না। রিদিমা কে দিয়েও বুঝায় রনক কিন্তু বুঝে না সে।”

অতঃপর সবাই হারে মানে রণয়ীর কাছে। রক্তিমের মা বাবা এসে দেখে যান। কিন্তু তেমন পছন্দ হয় না তাদের। রক্তিমের মা চেয়েছিলেন অবশ্য নূরা কে। সে চলে যাওয়ার পর চাইলেন বোনের মেয়ে কে পূত্র বধূ করে নিয়ে আসবেন। সে একটু বোকাসোকা আছে। ছেলেকে ধোঁকা দিতে পারবে না। শ্বশুর শাশুড়ি কে সমীহ করে চলবে। কিন্তু ওই মেয়ে পছন্দ করে আরেকটা ছেলে কে। আর যখন শুনলেন সেই কলেজ জীবন থেকে রক্তিম রণয়ীর সম্পর্ক তখন তিনি খুবই ক্রোদান্বিত হোন বটে তবে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিলেন। রাজিবুল হাসান ও মানতে চাইছিলেন না। চালাকচতুর মেয়ে! আর যাই হোক একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অনেক চালাক। কখনো যদি ছেলের উপরে উঠে। তবে! তিনিৎবাহিরে বের হওয়া মেয়েদের! পছন্দ করতেন না। সেখানে এই মেয়ে অবশ্যই চাকরি বাকরী করতে চাইবে‌। যদি হয় সরকারী চাকরি। ঘরের বউয়েরা ছেলেদের চাইতে উচ্চ পর্যায়ে যাবে না। নয়তো স্বামী কিংবা পুরুষের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ তা হালকা হয়ে যাবে। অথচ তিনি বুঝতে চাইলেন না যে শ্রদ্ধা করার সে এমনিই করে‌। একজন রিকশা চালকের বউ চাকরিজীবী হলেও সে তাঁর স্বামী কে শ্রদ্ধা করবে। যদি সে মন থেকে মেনে নেয় তাকে। সম্মান তৈরি করতে পারে সে সেই নারীর মনে। সবকিছুর পরে স্ত্রীর মতো তিনিও মেনে নিলেন নিরবে।”

বিয়ের দিন আসলো ঘনিয়ে‌। রণয়ী অদূরেই যেন দেখতো পেল তাঁর সুখ। বিয়ের আয়োজন করলেন বাবা ছেলে তিনজন মিলে। লাল টুকটুকে বউ সাজে রণয়ী। কাঙ্খিত মুহুর্ত আসে তাদের। দুজনে এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের পর থেকে দিন গুলো রণয়ীর ভালোই যাচ্ছিল। শ্বশুর শাশুড়ি যে মন থেকে মানতে পারছেন না তা বুঝতে পারে রণয়ী‌ তাদের কথায় কাজে। রণয়ীর তেমন কাজ করতে হতো না। তবুও সে যা করতো দুজনে কিছু না কিছু খুঁত ধরতেন। রণয়ী সবকিছু পারফেক্ট ভাবে করার চেষ্টা করতো। এটা সত্য তাঁর বাসায় তাকে করতে হতো না তেমন কিছু‌। মা ভাবী! বেশি হলে ছোটা বুয়া এসে কাজ করতো‌। নিজের ঘর গুছানো। রুম ঝার দেওয়াটাই এনাফ। তবে স্বামীর বাড়ি এসে করতো‌। পড়ালেখা সামলে মন দিয়ে তাদের উভয়ের সেবা করতো‌। তবুও মন জয় করতে পারছিল না। রক্তিম সাহস জুগিয়ে দিত‌। একদম পারবে সে ঠিক। বছরের মাথায় রক্তিমের কথাই সত্যি হয়। হাসিখুশি মেনে ছিলেন রাজিবুল হাসান। ঈদের দিনে পূত্র বধূর হাতে সালামি গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি ভ্রান্ত ধারণা আমার বদলে দিয়েছো। সুখী হও মা জীবনে।’ মেনে নিয়েছিলেন রক্তিমের মা রাহিমা সুলতানা ও। ছেলে সুখী তাদের আর সমস্যা কোথায়?”

কিন্তু তাদের পছন্দ কিংবা মেনে নেওয়াটাও বদলে যায় যখন বিয়ের দুই আড়াই বছরের মধ্যেও রণয়ী মা হতে পারেনি। অথচ রক্তিম বলতো বেবী না এখন। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়ের জন্য সংসার সামলে উঠাইতো কষ্টের বিষয়। সেখানে বেবী হলে! রণয়ী মনমরা হয়ে থাকতো। রক্তিমের সাথে হাসিখুশি থাকতো না। শ্বশুর শাশুড়ি মেনে নিয়ে আপন করেও কেন আবার একটি ছুতোয় পর করছেন? বুঝেও না বুঝার ভান করছেন? মানসিক চাপ পড়তো রণয়ীর উপর। এদিক দিয়ে রণয়ীর থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে রক্তিমের নিজের ও ভালো লাগতো না। আগে যখন অবসরে রণয়ী বসে গল্প গুজব করতো হাসতো হাসাতো। এখন তা করতো না। মুখ গুমরো করে বসে থাকতো‌। কিন্তু রণয়ীর এই অবস্থা থেকে বের করার জন্য কী করতে হবে তা সে বুঝতো না। কিংবা চেষ্টা করতো না তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। মা বাবার কথায় আগে যা কিছুই বলতো, তখন আর বলতো না। এতে রাহিমা সুলতানা সুযোগ বুঝে যাচ্ছে তাই বলতেন।”

ফিরে আসে তাঁর মধ্যে নূরা। তখন রক্তিম রণয়ীর বিয়ে হয়ে সংসার জীবনের আড়াই বছর পেরিয়ে গিয়ে তিন বছর ছুঁই ছুঁই। রক্তিম প্রথম প্রথম ধারে কাছে ঘেঁষতে দিত না। যে একবার ছেড়ে গেছে তাকে আর গ্ৰহণ করার ইচ্ছে নেই। তবে একা হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু এখন সে বিবাহিত। আর রণয়ী! মেয়েটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। সেও বাসে। অতীত জেনেও মেয়েটা তাকে ভালোবাসেছে। তাকে ঠকানোর ইচ্ছে কিংবা শক্তি রক্তিমের কোনোটাই নেই।”

রক্তিম নূরার সম্পর্ক ছিল সেই স্কুল জীবন থেকে। নূরা দুই বছরের জুনিয়র ছিল। একে অপরকে পছন্দ করতো‌। অতঃপর প্রণয় হয়! রক্তিম যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে শেষের দিকে‌। নূরা তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়। ভার্সিটিতে নতুন মানুষ! মন লাগে তাঁর। এর মধ্যে একটা ছেলে তাকে চেয়ে বসে। তাও বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি। রক্তিমের থেকে ভালো! বড়লোক সব। তাই নূরা পাঁচ সাড়ে পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যায়। তাদের প্রেমটাও ছিল দেখার মতোই। যে বা যারাই জানতো সম্পর্কের কথা। তারা চাইতো দুজনের প্রণয় পরিণতি পাক। রক্তিমের মাও পছন্দ করেছিলেন নূরা কে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে থাকলো না।”

অতঃপর ফিরে এলো সে অসময়ে‌। ইচ্ছে ছিল না রক্তিমের নূরার সাথে কথা বলারই। কিন্তু মেয়েটা পাগলামি শুরু করে। বিয়ে করার কথা থাকলেও বিয়ে হয়নি তার। দেশের বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল নূরার। সেই ইচ্ছে পূরণ হলেও শেষ অব্দি বিয়ে হয়নি। ছেলেটা বলেছিল বাহিরে যাওয়ার পর বিয়ে করবে। কিন্তু করেনি। তবে নূরা তখনই আসতে পারেনি। দুই তিনবছর থাকতে হয় দেশের বাহিরে। যখন ফিরে আসে তখন রক্তিম বিয়ে সাদি করে সংসারী। কিন্তু নূরা চাইছিল তাকেই। বেহায়াপনা বাড়ে তাঁর। বিভিন্ন ভাবে মন পাওয়ার চেষ্টা করে সে। যত টুকু বেহায়াপনা করা দরকার সবই করে। আরো ছিল পশ্চিমাদেশে। যা করা উচিত নয় একজন বাঙালি মেয়ের সবটাই করে। রক্তিমের মন দুর্বল হতে থাকে। প্রথম ভালোবাসা কোথাও নাড়া দেয়। রণয়ীর মন আগের মতো নেই। তেমন খেয়াল টেয়াল রাখে না তাঁর। নিজের মধ্যেই ব্যস্থ তাকে। নিজেকে মানসিক চাপ থেকে সরিয়ে রাখতে সে একটি কোচিং সেন্টারে পড়ায়। অন্যদিকে নূরা আবার ভুলিয়ে বালিয়ে রাহিমা সুলতানার মন ও নিয়ে নিয়েছে। তিনি চাপ দিতে থাকেন রক্তিম কে। রণয়ীর নামে যা নয় তাই ঢালেন ছেলের কর্ণে। রক্তিম বিশ্বাস করতো না। কিন্তু নূরা কেও সে দূরে ঠেলতে পারছিল না। রাহিমা সুলতানা জোর করেন। সন্তান সন্ততির কথাও বুঝান। রক্তিমের মাথা প্রায় নষ্ট!
নূরা সুইসাইড করে বসে। ভাগ্য ভালো বেঁচে যায়।‌ অভিনয় করতে গিয়েও সত্যিই হয়ে যায়। আঘাত পায় রক্তিম। নূরা সুস্থ হয়। খেয়াল রাখে তার রক্তিম। ঘনঘন কাছে আসায় দুর্বল প্রায়। এই মেয়েটা ছিলই তাঁর দুর্বলতা। এরমধ্যে ঘটে আরেকটি জঘন্য ঘটনা। সেটা না ঘটলে হয়তো বা রক্তিম রণয়ীর ঠিক হয়ে যাওয়াতে নূরার কাছ থেকে সরে আসতে পারতো। বিয়ের তখন তিন বছর পাঁচ ছয় মাস।”

সেদিন ছিল বন্ধুর জন্মদিনের পার্টি। অতিরিক্ত স্ট্রেস নিতে পারছিল না রক্তিম। তাই মাত্রাতিরিক্ত পানীয় পান করে। নেশা চড়ে তাঁর। তাঁর সেই সুযোগ নেয় নূরা। রাত নেশার কীরকম কাটে জানে না রক্তিম। কিন্তু ভোরে ঠিক অবস্থায় পায় না নূরা এবং নিজেকে। রক্তিম বিশ্বাস করছিল না। কিন্তু নূরা থেমে থাকে না। সে বাসায় গিয়ে সবকিছু সবার সামনে বলে আসে। রণয়ীর পৃথিবী থমকে যায় সেদিন। না চাইতেও রক্তিমের থেকে দূরে সরে যায়। সে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছিল। কিন্তু পারছিল না। নূরার কথা গুলো মাথায় ভন ভন করতো। এগিয়ে আসে ফাইনাল পরীক্ষা তাঁর। সবকিছু থেকে ভুলে থাকতে চাইছিল। তাই পরীক্ষা চলা কালীন সময়ে চলে আসে নিজেদের বাসায়‌। বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই রক্তিম কে চাইলেও সময় দিতে পারছিল না। আর না তো মিটমাট করে সমাধান করতে পারছিল। এতো এতো সমস্যার মধ্যে পরীক্ষা ঠিকই দেয়। বাবা খানিকটা সুস্থ হোন। না চাইতেও রণয়ী পরিবারের সাথে শেয়ার করে রক্তিম নূরার কথা। চলে আসে রক্তিমের বাসায়। একটা সমাধান চাইছিল সে। এদিকে মেয়ের দুঃখ নিকটে দেখেই আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন রহমান রহিম।”

রণয়ীর অনুপস্থিতি এবং কথা না বলা। এড়িয়ে চলায় রক্তিম জোকে পড়ে নূরার দিকে‌। নূরা তাঁর সুযোগ নেয়। রাহিমা সুলতানা সবকিছু সাজিয়ে নিলেন। রণয়ীর গ্ৰ্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়। মাস্টার্সে ও ভর্তি হয়। একটা ধরাবাঁধা সম্পর্ক ছিল তাদের বৈবাহিক। রণয়ী চিন্তিত সবদিক দিয়ে এদিকে বাবার অসুস্থতা। স্বামীর জীবনে প্রথম ভালোবাসার আগমন! পরনারী। বাবার কথা ফেলতে পারেনি তাই মাস্টার্সে ভর্তি হয়।”
অতঃপর চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকীর মাত্র কয়েকটা দিন আগে রক্তিম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। রণয়ী খুব চেষ্টা করেছিল সম্পর্ক ধরে রাখতে তাও নয়। সে মানতেই পারছিল না রক্তিম নূরার সেই ঘটনা। তবুও কিছু একটা টানছিল তাকে। রক্তিম কে অবিশ্বাস করে দূরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। খুব কষ্ট হচ্ছিল। অতঃপর ডিভোর্স। চিৎকার করে কেঁদেছিল রণয়ী ডিভোর্সের আগেরদিন রাতে। রক্তিম তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেটাই ছিল শেষ জড়িয়ে ধরা। কিন্তু রণয়ী সে বন্দন স্থায়ী হতে দেয় না। দূরে ঠেলে দেয়। পাগলের মতো কান্না করে বলে,

“বেঈমানি করলে কেন আমার সাথে রক্তিম? কেন এমন অবিচার করলে? আমার অপরাধটা কী ছিল? বলো কী অপরাধ ছিল আমার? তোমাকে ভালোবাসা? তোমার অতীত আছে জেনেও তোমায় এতোটা ভালোবাসা দেওয়াই কী আজ আমার এমন পরিণতির কারণ? রক্তিম আমি খুব ভালোবাসি তোমায়। প্লিজ তুমি সবকিছু মিথ্যা প্রমাণ করে দাও। আমি তোমাকে নিয়ে খুব দূরে চলে যাবো। যেখানে শুধু আমরা দুজন থাকবো। আর কেউ তোমায় দুর্বল করতে পারবে না। আমার জায়গায় আসতে পারবে না। প্লিজ সবকিছু মিথ্যা করে দাও।”

‘আমি সত্যিই জানিনা রণয়ী! সে রাতে কী হচ্ছিল বুঝতে পারিনি। কিন্তু মিথ্যা নয়। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। আমার মাথা কাজ করছে না রণয়ী। আমারো খুব কষ্ট হচ্ছে।”

রক্তিমের বাহুবন্ধন থেকে ছিটকে দূরে সরে আসে রণয়ী। বলে, “বেইমান দেখেছি। তোমার মতো প্রতারক বেইমান আমি দেখিনি। তুমি রক্তে মিশে ছলনা করেছো। খুব তো নিজের প্রেমিকাকে ছলনাময়ী বলতে। আজ তোমায় কী বলবো আমি? ও পরাণ পুরুষ! আমার মানুষ। বলো কী বলি আমি তোমায়?”
এই এই বলো, তোমায় সুখ দিতে পারিনি আমি? আমার মাঝে কী কমতি ছিল? কী কম ছিল আমার ভালোবাসায়? এতোকিছু! তোমার মায়ের এতো কটুকথা সহ্য করেও তোমার হয়ে থেকে গিয়েছি। অথচ তুমি আমায় এই প্রতিদান দিলে?”

“ও রক্তিম! আমি বাঁচবো না তোমায় ছাড়া। বেঁচে থেকেও আমি মরে যাবো। আমি তো মরেই গিয়েছি। তুমি মেরে ফেলেছো আমায়‌। বেঁচে থেকেও মরে গিয়েছি আমি‌। সেদিন! মিথ্যা বলো প্লিজ! আমি আবার তোমাকে বিশ্বাস করবো! সবকিছু ভুলে যাবো একটি দুঃস্বপ্ন ভেবে‌। আমাকে এভাবে আঘাত দিও না।’
তুমি আজ এমন পরিস্থিতিতে আমায় দাড় করিয়েছো, আমি না পারছি মানতে না তো পারছি অবিশ্বাস করতে। গলায় যেমন কাঁটা বিঁধে! তুমিও তেমন কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছো। না পারছি বের করতে! আর নাতো পারছি গিলে নিতে। শুধু বিষাক্ত ভাবে আঘাত করছে আমায়। এই যে হৃদয় দেখছো! এই বুকের বা পাশটায় তোমাকে খুব যত্নে রেখেছি। অথচ তোমার জায়গা আজ তুমিই নিঃশেষ করে দিলে। কষ্ট হচ্ছে রক্তিম! আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি, আমার হৃদয় ভালো নয়! রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে তোমার বসবাস করা জায়গাখানি। তুমিই করেছো। ভালোবাসার অস্ত্রাঘাতে তুমি আমায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছো। টুকরো টুকরো করে দিয়েছো তুমি আমার হৃদয়। খুব কষ্ট পাচ্ছে আমার হৃদয়। খুব কষ্ট পাচ্ছে! নীল বিষ ব্যথায় বিষিয়ে গিয়েছে গো! সইবো কী করে আমি‌।”

‘আমাকে ক্ষমা করে দাও রণয়ী। আমি তোমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইনি। চাইনি নিজেই তোমার থেকে দূরে যেতে। আমি সহ্য করতে পারছি না আর। আমায় তুমি ক্ষমা করো প্রিয়।”

‘তুমি! তুমি প্রিয় বলো‌ না। প্রিয় বলেছিলে আর বলেছিলাম বলেই আজ আমার এমন পরিণতি। তুমি না বলতে আমার ভালোবাসা তুমি বুঝতে পারো‌। একজনের ভয় আরেকজন কে স্পর্শ করে। তুমি কী আজ আমার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছো না? হৃদয় স্পর্শ করছে না তোমার। আমার বিষিয়ে যাওয়া ব্যথীত হৃদয় তোমার হৃদয় ছোঁতে পারছে না কী আজ? তুমি তাহলে মিথ্যা কেন বলতে আমায়? এক হৃদয়ের ভালোবাসা, ভয় যদি আরেক হৃদয় স্পর্শ করতে পারে‌। তবে যন্ত্রণা, কষ্ট কেন করছে না? মিথ্যাই বলতে তুমি আমায়।’তুমি ভালোবাসি বলেও আমায় ভালোবাসোনি প্রিয় নিটুর পুরুষ।’
‘কী বলবো বলো তোমায়? প্রিয় নিটুর পুরুষ! নাকি অপ্রিয় প্রতারক পুরুষ।’ কী বলো বলি তোমায়? ‘তুমি সূচনায় আমায় যতটা সুখ দিয়েছো। সমাপনে বিচ্ছেদে ঠিক তাঁর থেকে দশগুন বেশি যন্ত্রণা দিয়েছো।’
‘সমাপনে এমন বহুগুন যন্ত্রণা যদি দেওয়ারই ছিল। তবে কেন সুখ রঙে রাঙালে আমার হৃদয় সূচনায়?”
‘তোমায় পারছি না আমি ক্ষমা করতে। আমার আমি দুই সত্তার হয়ে গিয়েছি। যুদ্ধ করেছে তারা দুই সত্তা। এক সত্তা তোমায় ক্ষমা করতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে। অপর সত্তা ঘৃণা করতে গিয়ে নিজেকেই মৃত অনুভব করছে।”

‘তোমায় ঘৃণা করতে পারছি না।‌ কাছে টানতে পারছি না। ক্ষমা করতে পারছি না। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। বারবার নিজের মৃত্যু চেয়ে বসছি। এ কোন পরিস্থিতিতে! কোন আদালতে দাড় করালে তুমি আমায়‌। ঠকে গিয়েও নিজেকেই প্রতারক মনে হচ্ছে। এভাবে তিলে তিলে না মেরে এক আঘাতেই মেরে ফেলতে‌। হাসি মুখে মৃত্যু বরণ করে নিতাম। এখন যে আমার ভেতর জ্বলছে। বুক ফেটে যাচ্ছে। হৃদয় ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গিয়েছে‌। দায়ভার নিচ্ছ না কেন তুমি? আমার পুরুষ! আমার মানুষ। প্রথমে না হোক। আমাকে দ্বিতীয় বলেই শেষ ভালোবাসা বানিয়ে একান্ত আমার হয়েই থেকে গেলে না কেন তুমি?’ ‘এক পৃথিবী সমান ঠকিয়েছো তুমি আমায়, এক বুক অসীম ভালোবাসার বিনিময়ে। আসলেই বলে মানুষ, বেশি ভালোবাসলে শেষে অবহেলিত হতে হয়‌।”

‘রক্তিম! ও রক্তিম আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় হতো তোমার চার বছর আগে। অথচ আমি তখনো তোমার ছিলাম না, ব্যক্তিগত নারী হিসেবে। শ্রেফ এক প্রেমিকা‌।’
আজ তো আমি তোমার ব্যক্তিগত নারী। হারিয়ে যাচ্ছি তোমার জীবন থেকে। তুমি হারিয়ে ফেলছো আমায়‌। তোমার ভয় করছে না? যে হারানোর ভয়ে নিজের করেছিলে, সেই পেয়ে নিজের করে হারাচ্ছো আমায়‌। তোমার কষ্ট হচ্ছে না! আমার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে না? তোমার ভয় আমায় স্পর্শ করেছিল। আমার যন্ত্রণা কেন তোমায় স্পর্শ করছে না? আমার ভালোবাসায় কম ছিল? খাদ ছিল কী তবে! ও বেইমান পুরুষ! তোমায় ঘৃণা করতে পারছি না কেন আমি? বলে দাও কীভাবে ঘৃণা করবো।”

ফ্লোরে বসা রক্তিমের কাছে এগিয়ে যায় রণয়ী পা টেনে হিচড়ে ক্লান্ত দেহ নিয়ে। হাঁটু মুড়ে খানিকটা উপরে উঠে‌। অষ্ট ছোঁয়ায় রণয়ী রক্তিমের ললাটে। অতঃপর নিজেই ছিটকে দূরে সরে যায়। অতঃপর অষ্টযুগলে আঙ্গুল রেখে বলে, ‘আমি কী অপবিত্র হয়ে গেছি? অপবিত্র তোমায় ছোঁয়ে? আমি তো এই জীবনের শেষ তোমায় ছোঁয়ে দিলাম।”

‘আমি অপবিত্র রণয়ী?”

‘হ্যাঁ। আমার আগে তোমায় কেউ ছুঁয়নি। তবে আমার পর কেন ছুঁলো? তুমি অপবিত্র হয়ে গেছো। যতটা হলে আর এক ঘরে থাকা যায় না। সে নারী কে তুমি নিজের ঘরে তুলবেই। আমি কী করে সহ্য করি? এই সহ্য করতে পারবো না বলেই তুমি অপবিত্র। নয়তো তোমাকে হৃদয়ের পুরোটাতেই স্থান দিয়েছি। তুমি কী করে অপবিত্র হও? তোমায় ছাড়া থাকতে না, আমার খুব কষ্ট হবে রক্তিম!”
‘শুনলে তুমি রক্তিম! আমার খুব খুব কষ্ট হবে তোমায় ছেড়ে থাকতে‌। তাঁর থেকেও বেশি কষ্ট হবে তুমি অন্যের ভেবে। এতো কষ্ট আমি সইবো কী করে। ওই সাত বছর আগে তোমার কথা শুনলে ভালো হতো। আমি নরম মনের বিচ্ছেদ সইতে পারবো না। আফসোস!”

‘ওহে নিটুর প্রিয়’র অপ্রিয় পুরুষ!
আমরণ সাথে থাকার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল! অথচ তুমি এক যুগ ও আমার হয়ে থাকলে না।”

চলবে!

|লিখেছিলাম ২১০০+ শব্দসংখ্যা! কিন্তু রিচেক দিতে গিয়ে এখন ২৫০০+ হয়ে গেছে। হয়তো মনে হবে রণয়ী খুব কথা বলেছে। আগেও শুনতে হয়েছে এটা। তাঁর অভিযোগ গুলো সে জমা রেখেছিল। এখন বললো। এতে বেশি কথা মনে হতেই পারে। তবে যদি অসুন্দর হয়। ভালো না লাগে তাহলে আমি ভীষণ দুঃখিত! এই পর্ব লিখতে গিয়ে তার অভিযোগ আমায় ব্যথীত করেছে। আপনাদের কাছে কেমন লাগলো জানাবেন।|🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here