#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_১৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে কন্ঠ। রাত পোহালে ইফতি ভাইয়ার সাথে বিয়ে। নিজেকে ঠকানো যায় কিন্তু ওই মানুষটাকে? সব দায়িত্ব ঠিকঠাক মতো পালন করলেও মনে জায়গা দিতে না পারলে কি সত্যি স্ত্রী হিসেবে সকল দায়িত্ব পালন করা হবে? প্রহর প্রতারক, চরিত্রহীন। সবকিছুই জানে কন্ঠ। তবুও বেহায়া মন তার জায়গাটা ইফতিকে দিতে পারবে না কেনো? কতশত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কন্ঠর মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে। কিন্তু কোনো উত্তর নেই। ফোনের রিংটোনের শব্দে চিন্তা ভঙ্গ হলো কন্ঠর। বালিশের পাশে থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করলো।
” হ্যাঁ ভাইয়া বলুন। ”
” অভ্যাস পরিবর্তন কর কন্ঠ। যাইহোক, একটু ছাদে আসতে পারবি? গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। ”
” ঠিক আছে। ”
কন্ঠ কল কেটে দিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুটিগুটি পায়ে ছাদের দিকে অগ্রসর হলো মেয়েটা। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে খোলা চুলগুলো দু’হাতের সাহায্যে খোঁপা করে নিলো। ইফতি দাঁড়িয়ে আছে ছাদের এক পাশে। হাতে ফোন,ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করা। আজকে অন্ধকার, চাঁদের আলো নেই বললেই চলে। অমাবস্যা গেলো কালকেই। কন্ঠ ধীর পায়ে গিয়ে ইফতির সামনে দাঁড়ায়। ইফতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে কন্ঠকে। কালো রঙের কামিজের সাথে সাদা সালোয়ার আর সাদা ওড়না পরে আছে কন্ঠ। চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করা। কান,গলা খালি। নাকে শুধু ছোটো একটা নাকফুল। গ্রামাঞ্চলে বিয়ের আগেও মেয়েরা নাকফুল পড়ে। খুব ছোটো থাকতেই কন্ঠর দাদি কন্ঠর নাকে এই নাকফুলটা পড়িয়ে দিয়েছিল বলে সব সময় পরে থাকে এটা। কন্ঠকে দেখে ইফতির একটা গানের কয়েক লাইন মনে পড়লো।
” হাত খালি
গলা খালি
কন্যার নাকে
নাক ফুল! ”
” কী যেনো বলবেন বলছিলেন? ”
কন্ঠর প্রশ্নে ইফতি নড়েচড়ে উঠলো। ভাবনার অতল থেকে বাস্তবে ফিরে নিজের মনকে শাসন করলো কিছুটা। কন্ঠর মনে কোনো প্রেম নেই। তাই অহেতুক তার কাছ থেকে এসব আশা করাও ভুল।
” হ্যাঁ। সমুদ্রর কী হয়েছে কিছু জানিস তুই? ”
” সমুদ্রর! ওর আবার কী হয়েছে? ”
” তারমানে তুইও জানিস না।”
” আমাদের মধ্যে তো আগের মতো কথাবার্তা হয় না তুমি জানোই। বিনাকে কিছু বলেনি?”
” বিনাকে নিয়েই সমস্যা। মেয়েটা সব সময় চিন্তিত থাকে। সমুদ্র মাত্র ফিরলো বাসায়। তা-ও রাতের খাওয়াদাওয়া করেই। আর বিনা তো স্বামী না ফেরা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করে। ”
কন্ঠ চমকালো সমুদ্রর এরকম আচরণে। বিনার সাথে ওর আচরণ দেখে তো কখনো মনে হয় না ওঁরা দু’জন দু’জনার সাথে সুখী নয়! তাহলে এমনটা কেনো করছে ছেলেটা?
” আমি কথা বলে দেখবো কাল। ”
” দেখিস তাহলে। আমি তো বড়ো ভাই! তাছাড়া তুই তো জানিস আমি কেমন। কখনো আমাদের মধ্যে তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। ”
” আচ্ছা আমি বরং কালকে জিজ্ঞেস করবো।”
” কালকে বিয়ে বাড়ির ঝামেলায় হয়তো সুযোগ পাবি না। পরে জিজ্ঞেস করে নিস।”
“ওকে। এখন তাহলে ঘুমুতে যাও,আমিও গেলাম।”
ইফতি মাথা নেড়ে “ হু” বলে। কন্ঠ ছাদ থেকে প্রস্থান করলো।
মশারী টানানো শেষে বিছানায় এলো বিনা। সমুদ্র শুয়ে শুয়ে ফোনে চ্যাটিং করছে। বিনা এসব কিছু বোঝে না। তাই সমুদ্রর পাশে শুয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ফোনের স্ক্রিনে।
” ফোনে এত কী লেখেন সমুদ্র সাহেব? ”
” কথা বলি।”
” কার সাথে? ”
” মেয়ে বন্ধুদের সাথে, ছেলে বন্ধুদের সাথে। ”
❝মেয়ে বন্ধু! ❞ কথাটা কেমন বিদঘুটে লাগলো বিনার মস্তিষ্কে। বুকটা কেমন আঁতকে উঠছে। আঁখি যুগল ছলছল করছে।
” মেয়ে বন্ধুরা কি আমার মতো করে সমুদ্র সাহেব বলে ডাকে? ”
” তুমি আর তারা এক নয়।”
সমুদ্র অন্য দিকে ফিরে শুয়ে ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো। সমুদ্রর কথাটা বুঝলোনা বিনা। ভালো বললো না-কি খারাপ? আজকে সরাসরি কথা না বললেই নয়। দিন দিন এরকম অবহেলা সহ্য করতে পারছে না বিনা।
” আপনার কী হয়েছে? ইদানীং আমার থেকে এরকম দূরে দূরে থাকেন কেনো?”
” কই? তোমার তো ভালো লাগে না আমার স্পর্শ। তাই দূরে থাকি। আর বাসায় থাকলে তোমাকে বেশি বিরক্ত করি বলেই বাইরে সময় কাটাই।”
বিনার অসহ্য লাগে সমুদ্রর সহজসরল স্বীকারোক্তিতে। মুখে ছুঁতে মানা করে বলে কি মনে মনেও তাই চায়? কখনো না। নেহাৎ লজ্জা লাগে বলেই স্পর্শ করতে মানা করে। কিন্তু সেটা কেনো সমুদ্র সাহেব বুঝবে না?
” মুখের কথা শুনেই দূরত্ব গড়ে নিলেন? মনের কথা বুঝলেন না!”
সমুদ্র চমকায়নি। সে জানে বিনা তাকে ভালোবাসে। সমুদ্র চায় বিনা সেই ভালোবাসার কথা নিজে থেকেই প্রকাশ করুক। সেই জন্যই তো এতদিন দূরে সরে থাকা। সমুদ্র এবার বিনার দিকে ফিরে শোয়। বিনা লজ্জার মাথা খেয়ে সমুদ্রর বুকের উপর মাথা রাখলো।
” তারমানে? তুমি আমাকে….”
” ভালোবাসি! ”
” ভালোবাসি। ”
সমুদ্র বিনাকে জড়িয়ে ধরে স্ব শব্দে হেসে বললো। বিনার অশ্রুতে সমুদ্রর বক্ষ ভিজে গেছে। সমুদ্র বিনার থুতনিতে হাত রেখে মাথা উপর তুলে চোখের পানি মুছে শুধায়,
” ভালোবাসি বলার পরেও অশ্রু বিসর্জন কেনো করছো শুনি?”
” এটা সুখের কান্না। আপনি বুঝবেন না।”
আলতো করে ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো সমুদ্র। বিনা আবেশে চোখ বন্ধ করে আছে। বুকে মাথা রেখে দু’হাতে পিঠ আঁকড়ে ধরে সমুদ্র।
” বেশ বুঝবো। আমি জানি এই ক’দিন তোমার খারাপ লেগেছে। কিন্তু সরি! আমারও কষ্ট হচ্ছিল। তোমার কাছ থেকে ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট। ”
” এটা বুঝি আপনার ভালোবাসা আদায় করার তরিকা? ”
” তরিকা! মানে ধরণ?”
” হু।”
সমুদ্র আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বিনার। বিনা চোখ বন্ধ করে বুকে মুখ গুঁজে আছে পরম তৃপ্তিতে।
” আচ্ছা বিনা কালকে তো ভাইয়া আর কন্ঠর বিয়ে, তোমার নতুন পোশাক লাগবে না? ”
” আমার তো অনেকগুলো নতুন শাড়ি আছে। তাছাড়া আম্মা একটা নতুন শাড়ি দিয়েছেন তো।”
” ওয়েট।”
সমুদ্র বিনাকে বিছানায় শুইয়ে রেখে আলমারি থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে ফের বিছানায় এসে বসলো। বিনা উঠে বসেছে এরমধ্যেই।
” কী আছে ওর মধ্যে? ”
” ওয়েট ম্যাডাম। ”
সমুদ্র প্যাকেট থেকে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি বের করে বিনার গায়ে ফেলে দেখছে কেমন লাগে।
” এসব কিনতে গেলেন কেনো? শুধু শুধু টাকা নষ্ট হলো। আরো আছে তো শাড়ি। ”
” এটা আমার ইনকাম করা টাকায় কেনা প্রথম শাড়ি তোমার জন্য। ক্লাস ফাইভে পড়া দু’টো বাচ্চাকে প্রাইভেট পড়াচ্ছি মাসখানেক হলো। কাউকে বলিনি। ইচ্ছে ছিল প্রথম বেতন দিয়ে তোমাকে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি কিনে দিবো। লাল শাড়ি পরে তো তোমাকে বউয়ের সাজে দেখা হয়নি আমার। ”
বিনার চোখমুখ খুশিতে চকচক করছে। সমুদ্র সাহেব তাকে এতটা ভালোবাসে!
” আপনি এতো কষ্ট করলেন আমার জন্য! ”
” ইয়েস মাই ডিয়ার।”
” কিছু বুঝিনি তো।”
মুখটা হাঁড়ির মতো করে বললো বিনা। সমুদ্র ফিক করে হাসলো।
” বললাম, হ্যাঁ আমার প্রিয়। ”
” ওহ আচ্ছা। আপনি এখন আসুন। ”
” এখন কোথায় যাবো! ”
” আরে বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। দশ মিনিট পরে রুমে ফিরে আসবেন। ”
” ঠিক আছে মহারাণীর যা আজ্ঞা। ”
সমুদ্র চলে যেতেই বিনা লাল শাড়ি পরলো। সাথে চোখে কাজল আর কড়া করে লাল লিপস্টিক। এসব সাজগোছ কন্ঠর থেকে শিখেছে সে। ঠিক দশ মিনিট পরে সমুদ্র দরজার বাইরে এসে ঠকঠক আওয়াজ করে শুধালো,
” ভেতরে আসতে পারি এখন?”
” জি আসুন। ”
সমুদ্র ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে বিছানায় গিয়ে বসলো। বিনা সেজেগুজে বসে আছে। ঘনঘন পলক ফেলে মুচকি মুচকি হাসছে সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে।
” মাশা-আল্লাহ! আমার বউ এতো সুন্দর? কারো নজর না লাগুক। ”
” নজর লেগে গেছে। ”
বিনা ঠোঁট টিপে হেসে বললো। সমুদ্র নড়েচড়ে বসে চকিত বলে,
” কার?”
” সমুদ্র সাহেবের।”
” মেয়েটা তো ভারী দুষ্ট! ”
” মোটেও না। আমি খুব ভালো মেয়ে, আম্মা সব সময় বলেন।”
” আম্মার সাথে তো আর দুষ্টমি করো না এজন্য বলে।”
সমুদ্র বিনার থুতনিতে হাত রেখে ললাটে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। বিনার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেছে। লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র বিনার সমস্ত লজ্জা ভেঙেচুরে ললাট থেকে নাকের ডগায়, ওষ্ঠের সাথে ওষ্ঠের মিলন ঘটালো। দু’জন দু’জনার ভালোবাসায় সিক্ত হলো বিনা ও সমুদ্র।
ভোরের আলো ফুটতেই মল্লিক বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে মেয়ের বিয়ের জন্য কাজ করতে গিয়ে অসাবধানে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে কন্ঠর বাবা। অবস্থা বেশি সুবিধার নয়। হসপিটালের বেডে অক্সিজেন মাস্ক পড়ে শুয়ে আছেন মজিদ মল্লিক। কন্ঠ আর শারমিন সুলতানা করিডরে বসে নীরবে কান্না করছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছেন জাহাঙ্গীর মল্লিক। ইফতি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। সমুদ্র,বিনা সবাই আছে পাশেই। শুধু বাড়ি ফাঁকা রেখে আসতে পারেননি ইফতির মা। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। কন্ঠর কথা ভেবেই ইফতির খারাপ লাগছে। এমনিতেই মেয়েটা সবে একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। এরমধ্যে বাবার এরকম অবস্থা সহ্য করতে পারছে না মেয়েটা। এরমধ্যেই একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কন্ঠ বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। মেয়েদের চোখে প্রথম নায়ক তার বাবা।
জাহাঙ্গীর মল্লিক করিডরের দিকে আসতেই কন্ঠর মা দ্রুত এগিয়ে যান।
” ভাইয়া ডাক্তার কী বললেন? উনি ঠিক হয়ে যাবেন তো? ”
জাহাঙ্গীর মল্লিকের চোখমুখ দেখে সুবিধার লাগছে না শারমিনের। মনটা কেমন কু’ডাকছে। ডাক্তার কী বললো শোনার জন্য অস্থির লাগছে।
” দোয়া করো কন্ঠর মা। ইনশাআল্লাহ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে কন্ঠর কী হবে বলো।”
কন্ঠর মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কন্ঠ একই জায়গায় বসে আছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটা। ইফতি গিয়ে কন্ঠর পাশে বসেছে। বিনা ও সমুদ্র শারমিনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
চলবে,
আগামীকাল গল্প দেওয়া হবে না সম্ভবত। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পরশু দেওয়ার চেষ্টা করবো। সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য।
আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/394488813232070/
পরের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=396833099664308&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz