#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_২০_বর্ধিত_অংশ
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
নতুন ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কন্ঠর জীবনের প্রাক্তন নামক মানুষটা অস্তমিত গিয়েছে। সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে কন্ঠর নম্বরে অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছিল। সাধারণত রাতে অধিকাংশ সময় ফোন সাইলেন্ট মুডে থাকলেও গতরাতে সাইলেন্ট করতে মনে ছিল না কন্ঠর। ফজরের নামাজের পড়ে শোয়ার জন্য এমনিতেই ঘুম হালকা ছিল তখন৷ তাই কল আসা মাত্রই রিসিভ করেছিল কন্ঠ। ঐশী ছিল ফোনের অপরপ্রান্তে। প্রহর আত্মহত্যা করেছে। গত কয়েকদিন যাবৎ আলাদা ঘরে থাকতো ঐশী ও প্রহর। সেই সুযোগে প্রহর রাতে একা ঘরে বসে সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় দড়ি দেয়। খবরটা শুনে কন্ঠ কেমন স্থির হয়ে গেছে। কোনো টুঁশব্দ পর্যন্ত করেনি। প্রহর সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছে তার লাশটা যেন একবার কন্ঠ ছুঁয়ে দেয়। সেই আর্জি জানাতেই কল দিয়েছিল ঐশী। কন্ঠ কোনো উত্তর দিতে পারেনি। হাত থেকে ফোন বিছানায় পড়ে গেছে। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে একইভাবে বসে আছে কন্ঠ। ইফতি এখনো ঘুমাচ্ছে। কন্ঠর নীরবতা টের পায়নি সে। কন্ঠর উত্তর না পেয়ে ঐশী আবারও কল দিচ্ছে। কিন্তু কন্ঠট সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শেষমেশ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ইফতির ঘুম ভেঙে গেলো।
” কী রে ফোন বেজে যাচ্ছে তো! রিসিভ করে দেখ কে কল দিচ্ছে। আর বসে আছিস কেনো?”
কন্ঠ নির্বিকার হয়ে বসে আছে। কল বাজতে বাজতে কেটে গেলো। ইফতি নড়েচড়ে উঠলো একটু। দু’হাতে চোখ ডলে উঠে বসলো। কন্ঠর দিকে ভালো করে তাকাতেই চিন্তায় পড়ে গেলো ইফতি। এমন অদ্ভুতভাবে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আগে কখনো দেখেনি কন্ঠকে।
” কন্ঠ? এই কন্ঠ? কী হয়েছে তোর? ”
কন্ঠর কাঁধে হাত দিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো ইফতি। কিংবা কোনো উত্তর পেলো না। ইফতির ভয় লাগছে। ফোনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ফের কল আসতে দেখলো ইফতি। কৌতুহল প্রবণ হয়ে ইফতি কল রিসিভ করে ফোন কানের কাছে ধরে।
” কন্ঠ আপু? প্লিজ আপনি একবার আসুন। মানুষটা যেমনই ছিল তার শেষ ইচ্ছেটা তো অপূর্ণ রাখা ঠিক হবে না। ”
” আমি ইফতি বলছি। আপনি কে?”
” আমি ঐশী। প্রহর আর নেই…. ”
” মানে! কীভাবে হলো? কখন হলো?”
” গতকাল রাতে। নিজের ঘরে বসে আত্মহত্যা করেছে মানুষটা। আমি তাকে ভালোবাসিনি আর না তো সে আমাকে ভালোবেসেছিল। অহেতুক সম্পর্কে ঢুকে দু’টো মানুষ অশান্তিতে ছিলাম এতদিন। কিন্তু এভাবে তো মুক্তি চাইনি আমি! ”
ঐশী কান্না করছে। করাটাই স্বাভাবিক। ভালোবাসা না থাকলেও একসাথে তো থাকতো। দুজনের সন্তানও আসতে চলেছিল। ঐশী বলেই হয়তো প্রহরের মৃত্যুর খবরটা এভাবে নিজের মুখে বলতে পেরেছে। অন্য কেউ হলে পারতো না। ইফতি কল কেটে দিয়ে কন্ঠর দিকে তাকালো। এতক্ষণ চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকলেও এখন যেন সবকিছু উবে গেছে। ইফতি কী বলে কন্ঠকে স্বাভাবিক করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা পাথরের ন্যায় বসে আছে। ইফতি কন্ঠকে শান্ত করার জন্য কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই নিজের বক্ষে জড়িয়ে নিলো। কন্ঠ ইফতির বুকে মুখ লুকিয়ে দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো ইফতির পিঠ।
” আমি ঠিক আছি। তুমি চিন্তা করো না। খবরটা শুনে নিজেকে সামলাতে একটু সময় লাগলো শুধু। ”
কন্ঠর কথায় ইফতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। প্রিয়তমার ললাটে চুম্বন এঁকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” আমার কন্ঠ বড়ো হয়ে গেছে। ”
” ছোটো ছিলাম বুঝি এতদিন? ”
” তা একটু। কন্ঠ শোন!”
” হ্যাঁ বলো।”
” প্রহরকে শেষবারের মতো দেখতে যাবি না? ওর শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করবি না?”
” তোমার ভালো লাগবে সেসব? ”
” যে মানুষটা পৃথিবীতে নেই তার সাথে হিংসা করার কোনো মানেই নেই। ”
” তবে যাবো। তুমি সময় করে নিয়ে যেও। মানুষটা আমার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছিল বলে ঐশীর কাছে গিয়েছিল। শেষমেশ জীবনের প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেললো।”
” মাঝে মধ্যে একটা ভুল আজীবন অশান্তির কারণ হয়ে যায়। কিছু ভুলের মাশুল সারাজীবনেও শেষ হয় না। তোকে ঠকিয়ে যে ভুল করেছিল তার শাস্তি এতদিন পেতে পেতে আজ তার জীবনের যবনিকা পতন ঘটেছে। ”
কন্ঠ ভেতর ভেতর পুড়ছে কিন্তু ইফতির সামনে ধরা পড়তে চায় না। এই মানুষটাকে কষ্ট দিতে চায় না কন্ঠ। প্রহরের জন্য কষ্ট পেলে ইফতির কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক।
” আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। ”
কন্ঠ ইফতিকে ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে বললো। ইফতি মৃদু হেসে কন্ঠর গা ঘেঁষে শোয়।
” কন্ঠ! ”
” বলো।”
” আমাকে ভালোবাসতে তোর কতো সময় লাগবে? একজীবনে ভালোবাসবি তো? নাকি ভালোবাসাহীন সম্পর্কে থাকতে হবে? ”
কন্ঠর খোলা চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিয়েছে ইফতি। কন্ঠ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইফতির অন্য হাত নিজের হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে।
” ভালো না বাসলে কি ছোঁবে না? আমি কি কিছু টের পাইনি? মাঝরাতে প্রায় তৃষ্ণায় ছটফটিয়ে ছুটে আসো আমার কাছে। আমি নিদ্রা-ঘোরে থাকলেও তোমার স্পর্শ অনুভব করি। ললাটে, গালে থুতনিতে তোমার ঠোঁটের স্পর্শ ফিল করি। কিন্তু তারপর? নিজেকে গুটিয়ে ফেলো কেনো? ”
ইফতি চমকাল। এই মুহুর্তে কী ভীষণ বিব্রত লাগছে তার বোঝাতে পারবে না কন্ঠকে। ভালোবাসার মানুষকে খুব কাছে পেয়ে এতটুকু কাছাকাছি না গিয়ে পারেনি ইফতি। ভালোবাসা আছে বলেই প্রিয়তমার প্রতি এতো কামনাবাসনা প্রিয় পুরুষের বুকে। অন্য কোনো নারীর প্রতি সেই কামনাবাসনা নেই। তাই পুরুষ মানুষ হওয়ার সুবাদে এটুকু নির্লজ্জ না হয়ে আর থাকতে পারেনি ইফতি। স্ত্রী’র অবচেতনে একটু-আধটু আদর করে ফেলেছে।
” কন্ঠ সরি! ”
” কেনো?”
ইফতি অপরাধীর মতো কাচুমাচু হয়ে বললো,
” বিনা অনুমতিতে, তোর অচেতন অবস্থায় এভাবে স্পর্শ করার জন্য। ”
” আই নিড ইউর টাচ। চেতনে আছি এখন,কপালে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিবে? মনটা বড্ড অশান্ত হয়ে আছে। একটু প্রশান্তি দিবে? ”
কন্ঠর চোখদুটো আজ ভীষণ মায়াবী লাগছে ইফতির কাছে। সেই সাথে দু-চোখ জুড়ে বিষাদের ছাপ। মেয়েটা প্রহরের অনুপস্থিতি প্রাণপণে ভুলতে চাচ্ছে। আর সেইজন্যই যে ইফতিকে কাছাকাছি চাচ্ছে সেটাও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না ইফতির। ইফতি আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কন্ঠর।
” একবার এই নীড়ে বাসা বেঁধে দেখ,আজীবন প্রশান্তি পাবি। ঘুমো এখন। আটটার দিকে উঠতে হবে আবার। ”
কন্ঠ মাথা নাড়লো। ইফতির হাত আঁকড়ে ধরেই ঘুমানোর চেষ্টা করলো কন্ঠ। কিন্তু ঘুম যে আর আসবে না সেটা কন্ঠ ভালো করে জানে। কন্ঠ চেয়েছিল মানুষটা তার ভুলের শাস্তি আজীবন একটু একটু পাক। কন্ঠকে হারিয়ে প্রহর কতবড় ভুল করেছে সেটা আস্তে আস্তে অনুভব করুক। কিন্তু এভাবে যে সব শাস্তির পাট চুকিয়ে পালিয়ে যাবে প্রহর সেটা কখনো ভাবেনি কন্ঠ। দু-চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কন্ঠ। না চাইতেও পুরনো স্মৃতিগুলো হানা দিচ্ছে বারবার।
রান্নাঘরে অল্পস্বল্প আওয়াজ শুনতে পেয়ে এগিয়ে এসেছেন শায়লা মল্লিক। সকাল সাতটার সময় বিনা ছাড়া কেউ রান্নাঘরে আসার কথা না। কিন্তু বিনার শরীর খারাপ। এই অবস্থায়ও কি কোনোভাবে মেয়েটা নাস্তা তৈরি করতে এলো? এতকিছু ভেবেই দ্রুত রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন শায়লা। নাহ কন্ঠ এসেছে। বিনা তাহলে ঘুমোচ্ছে। ডিম সেদ্ধ দিয়েছে চুলোয়। সাথে চায়ের জন্য পানি গরম করতে বসিয়েছে।
” কী রে আজকে সকাল সকাল রান্নাঘরে? রাতে ঘুম হয়নি ঠিকমতো? ”
” সকালে ঘুম ভেঙে গেলো। তারপর আর ঘুম আসছিল না। ভাবলাম শুয়ে না থেকে কাজ এগিয়ে রাখি। ”
শ্বাশুড়ির প্রশ্নে কন্ঠ কাজ করতে করতেই উত্তর দিলো। শায়লা নিজেও কাজে হাত দিলেন। জুসার মেশিনে কমলা আর আপেলের আলাদা আলাদা জুস তৈরি করছে কন্ঠ। শায়লা পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে রাখছে।
” আমি ভাবলাম বিনা আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে এলো কি-না। ”
” এসেছিল সে-ও। আমি বলেকয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সমুদ্র ঘুমিয়ে ছিলো বলে সুযোগে কাজ করতে এসেছিল। ”
শায়লা মল্লিক মুচকি হাসলেন।
” মেয়েটা ভীষণ কাজ পাগলি। ছোটো থেকে কাজ করতে হয়েছে তো। কাজ করায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ”
” এখন আবার টিপিক্যাল শ্বাশুড়ির মতো বলবে না, ছোটো বউ সব কাজ পারে আর বড়ো বউটা ঢেঁড়স! ”
শায়লা মল্লিক খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন। কন্ঠও মুচকি হাসলো। নিজেকে ভালো রাখতে হবে আগে। কারণ নিজে ভালো না থাকলে অন্যকেও ভালো রাখা যায় না। কন্ঠ নিজের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে ভালো রাখার যুদ্ধ!
চলবে,
সবাই কমেন্ট করে যাবেন। আর শেয়ার করা কমে গেলো কেন? রাতে আরেক পর্ব আসবে। বেশি বেশি রেসপন্স করুন। টাইপিং মিসটিক থাকতে পারে। ❤️
আগের পর্ব https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=402501115764173&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz
পরের পর্ব https://www.facebook.com/100080128645410/posts/403056059042012/?mibextid=Nif5oz