#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_২৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
ইফতি অনেক চেষ্টা করে একই শহরের অন্য একটা ভার্সিটিতে চাকরি ট্রান্সফার করেছে। কিন্তু তারজন্য কম ঝক্কি সামলাতে হয়নি তাকে। তবুও দিনশেষে পরিবারের সাথে থাকতে এতটুকু কষ্ট তার কাছে কিচ্ছু না।
” এটা কে আনতে বললো আপনাকে? এটা তো অনেক দামী! ”
শাড়ির ভাজ খুলতে খুলতে সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে শুধালো বিনা। পার্পল কালারের শাড়িটা। বিনার পছন্দের রঙ।
” আজ থেকে ঠিক মাস ছয়েক আগে এই শাড়িটা তুমি শপিংমলে দেখে পছন্দ করেছিলে। ইচ্ছে করলে তখনও তোমাকে শাড়িটা কিনে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটা ভাইয়ার টাকায়। আমি চাইনি অন্যের টাকায় তোমার পছন্দের জিনিস কিনতে। তাই আজ নিজের টাকায় কিনে নিয়ে এসেছি। আমার বউ আজকে আমার কেনা শাড়ি পরে ঘুরতে যাবে।”
বিনা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে ফের সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। মানুষটার চোখের দিকে তাকালে নিজের জন্য শুধু ভালোবাসার বিচ্ছুরণ দেখতে পায় বিনা। নৈশব্দে এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রর বুকে মুখ গুঁজে বিনা। সমুদ্র দু’হাতে আগলে নেয় বুকে।
” আমি জানি না সৃষ্টিকর্তা এতো সুখশান্তি আমার জন্য কতদিন বরাদ্দ রেখেছেন। আপনার মতো স্বামী পেয়েছি। শ্বশুর বাড়ির সবাই কতো ভালো! তার উপর আমি মা পেয়েছি। কন্ঠ আপাকে ঠিক যেরকমভাবে ভালোবাসেন আমাকেও তেমন করেই আজকাল আগলে রাখেন উনি। উনাকে মা ডেকে মনে শান্তি লাগে। যতদিন বেঁচে আছি যেনো আপনাদের ছায়াতলে থাকতে পারি।”
আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে বিনা। আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার নেত্র থেকে। সমুদ্র মাথার তালুতে চুম্বন আঁকে বিনার। পরম তৃপ্তি অনুভব করার মতো মুখভঙ্গি করে বিনাকে আরো একটু গভীরভাবে নিজের বুকে জড়ায়।
” তোমার চাওয়া পূর্ণ হোক। আচ্ছা শোনো, বন্ধুগুলোকে ট্রিট দিতে হবে আজ বুঝলে। ওদেরকে কালকে বললাম , ওদের সাথে বান্দরবান ঘুরতে না গেলে তোমাকে পাওয়া হতো না।”
” তাহলে বের হবেন কখন? এমনিতেই তো বিকেল চারটা ছুঁইছুঁই! ”
” তুমি যাও তো সাদা রঙের ব্লাউজের সাথে এই শাড়িটা পরে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে কাজল দিও। আর পারলে ছোট্ট একটা কালো টিপ পড়ো।”
” আমি যাবো আপনার সাথে? ”
” হ্যাঁ। যাবে না কেনো?”
” না মানে আমি তো ওসব ইংরেজি পারি না। আপনাদের শহরে মানুষদের সাথে কীভাবে ব্যবহার করে তা-ও বুঝি না। যদি…. ”
” শোনো বিনা তুমি সবার থেকে আলাদা বলেই তুমি আমার কাছে এতটা স্পেশাল। ইংরেজি না পারলেই কেউ আনস্মার্ট হয়ে যায় না। যাও রেডি হও। আমিও শার্ট পাল্টে নিচ্ছি। ”
বিনা মুচকি হেসে শাড়ি হাতে নিয়ে রেডি হতে লাগলো। সম্পর্কে ভালোবাসা একটু কম হলেও সম্মানের জায়গাটা পাকাপোক্ত থাকা চাই। একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসার পরিমাণ ঠিক দ্বিগুণ হয়ে যায়। যদি সেই সম্পর্কে সম্মান ও বিশ্বাসের ভিত্তি মজবুত হয়।
শেষ বিকেলে প্রিয়তম স্বামীর সাথে বাইরে বের হয় বিনা। দু’জনেই ম্যাচিং করে পার্পল কালারের পোশাক পরেছে। মেয়েটাকে সাজলে কতো সুন্দর লাগে অথচ একটুও সাজে না বলে সমুদ্রর কতশত অভিযোগ!
” মাঝে মধ্যে তো একটু সাজতে পারো?”
রিকশায় পাশাপাশি বসে সমুদ্র বিনাকে বললো। ইচ্ছে করেই রিকশায় চড়ে ঘুরবে বলে ঠিক করেছে দু’জন।
” এখন থেকে সাজবো।”
” এই আপনি আজ্ঞা কবে থেকে বন্ধ করবে?”
” ধীরে ধীরে অভ্যাস করে নিবো।”
সমুদ্র মুচকি হাসে। বাধ্য বউ একেবারে। রিকশা থামে রাস্তার একপাশে। সমুদ্রর বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতা হয় রেস্টুরেন্টে গিয়ে। সবাই একসাথে সন্ধ্যায় নাস্তা করে সেখানে। বিনা অপ্রস্তুত হলেও সমুদ্র সবকিছু সুন্দর করে সামলে নিচ্ছে।
ভরসন্ধ্যা। শারমিন সুলতানাও ইফতিদের বাসায়। কন্ঠ, শায়লা ও শারমিন বসার ঘরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। বাবা ছেলে দু’জনেই এখনো বাহিরে।
” বিয়ের তো কম সময় হলো না কন্ঠ! আমরা দু’জন কি নাতি-নাতনীদের মুখ দেখবো না?”
হঠাৎ শ্বাশুড়ির মুখে এরকম কথা শুনে ভড়কে গেলো কন্ঠ। বিষম খেলো একেবারে। শারমিন সুলতানা মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে “সাদ” “সাদ” বললেন বারকয়েক। শায়লা মুচকি হাসছেন। মেয়েটার এতো লজ্জা আগে বুঝতে পারেনি সে। আসলে এটা লজ্জায় হয়নি। অনাকাঙ্ক্ষিত কথা ছিল বলেই চমকে গেছে কন্ঠ। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে কন্ঠ বললো,
” হুট করে এমন কথা বললে, বিষম খেলাম। আরও বছর দুয়েক পরে এসব বায়না করবে ঠিক আছে? ”
” এখনও দুই বছর? ”
” তাহলে তিন বছর পরে। ”
কন্ঠ ঠোঁট টিপে হেসে বললো। শায়লা মল্লিক মুখ মলিন করে ফেললেন। শারমিন সুলতানা বললেন,
” এতো দেরি করিস না বুঝলি। পারলে এক-দুই বছরের মধ্যে বাচ্চা নে।”
” বেশ তাহলে এক বছর পরে। ঠিক আছে মাতাদ্বয়?”
শায়লা ও শারমিন একসাথে হেসে উঠলেন। এমন সময় কলিংবেলের শব্দে বৈঠক ভঙ্গ হলো তাদের। কন্ঠ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
” তুই থাক আমি দেখছি কে।”
” ধুর আমি থাকতে তোমরা কেন? বসো তোমরা। ”
কন্ঠ শায়লাকে বসতে বলে নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অপরিচিত তিনজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। কন্ঠ খুব ভালো করে দেখেও চিনতে পারলোনা কাউকে। একজন যুবক সাথে দু’জন বৃদ্ধ, বৃদ্ধা। পোশাকআশাক শহুরে না। সম্ভবত পাহাড়ি বাসিন্দা এঁরা। কন্ঠ মৃদু হেসে সামনে থাকা তিনজনকে শুধয়,
” আপনারা কারা? চিনতে পারলাম না তো!”
” মুরা বিনার গ্রাম থেইকা আইচি বটে। মু ওর নানি লাগি। বিনা আইনচে ইখানে?”
কন্ঠর একটু সময় লাগলো বৃদ্ধার কথা বুঝতে। বিনার নানি উনি। বিনা এখানে আছে কি-না সেটাই জিজ্ঞেস করলেন।
” ও আচ্ছা। ভেতরে আসুন। বিনা আছে তবে এখন বাসায় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে।”
তিনজনই বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো বিনাবাক্যে। ভেতরে ঢুকে সবকিছু অবাক দৃষ্টিতে দেখছে তিনজনই। এতো বড়ো বাড়িঘরে বিনা থাকে ভাবতেই ফোঁস করে উঠে যুবক। শায়লা ও শারমিন ততক্ষণে দরজার দিকে এগিয়ে এসেছে। কন্ঠ আগবাড়িয়ে বললো,
” উনারা বিনার আত্মীয় মা। বিনার নানা-নানি। ”
” ও আচ্ছা। আপনারা আসুন। এখানে বসুন। শরবত খেয়ে তারপর না হয় ঘরে ফ্রেশ হতে যাবেন।”
” মুরা থাকতে আসিলাই। বিনাকে লিয়া চইলা যাইবোক। বিনা আমার বউ লাগে। মুর জেলে থাকার সুযোগে ইহারা বিনাকে আপনাদের বাড়ির ছেলেটর সঙ্গে বিয়া দিয়া দিচে।”
লোকটার কথায় সবাই চমকায়। লোকটার নাম কবির। দেখতে ঠিক জেল ফেরত আসামির মতোই লাগে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চোখগুলো বড়ো বড়ো। নাকটা বোঁচা, লম্বাটে চেহারার গঠন। গায়ের রঙ চাপা,পরনে লুঙ্গি ও ফতুয়া।
” আপনার মাথা ঠিক আছে? ”
কন্ঠ কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললো। কন্ঠকে থামিয়ে দিয়ে বিনার নানা বলে উঠলেন,
” কবির ঠিকটাই বলিচে বটে। আমরা শহুরে পোলা পাইয়া লোভ সামলাইতে পারিলাই। তাই সমুদ্রররের লগে বিয়া দিছিলাম। এহন কবির জেল থেইকা বাইর হইচে। ওর বউ না ফিরাইয়া দিলে আমাদের গেরামে থাকতে দিবেক না কেউ। ”
বিনার নানার কথাটা যেনো কফিনে শেষ পেরেক মারার মতোই ছিল। শায়লা মল্লিক হুট করেই ফ্লোরে বসে পড়েছেন। নিজের ছেলের কথা ভেবেই উনার দিকবিদিকশুন্য লাগছে। মা হিসেবে উনি তো বোঝেন বিনাকে কতটা ভালোবাসে সমুদ্র। কন্ঠ দৌড়ে গিয়ে শায়লাকে ধরলো। শারমিন সুলতানা এক গ্লাস পানি এনে শায়লাকে পান করতে বলে।
” পানি খেয়ে নাও। মাথা ঠান্ডা করো। সবকিছু তোমাকে সামলাতে হবে। সমুদ্রকেও!”
শায়লার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। সেই সাথে বিনার প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা কাজ করছে মনে। মেয়েটা এতগুলো দিন সবকিছু অনায়াসে লুকিয়ে গেলো? স্বামী থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে তো হারাম মেয়েদের জন্য। তারমানে এতদিন একটা অবৈধ সম্পর্কে ছিলো বিনা ও সমুদ্র! শায়লা আর কিছু ভাবতে পারে না। দুচোখ কেমন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। মনে হয় জ্ঞান হারাবে এমন অনুভূত হচ্ছে উনার। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। কন্ঠ ও শারমিন ধরাধরি করে সোফায় বসালো শায়লাকে। বিনার নানা-নানি ও কবির এখনো আগের মতোই তাদের জায়গায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে। কিছু সময় পরে নিজেকে সামলে নেন শায়লা। কন্ঠ সমুদ্রকে কল দিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরতে বলেছে। মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগবে না বলে জানিয়েছে সমুদ্র।
” হুট করে কন্ঠ কল দিয়ে এভাবে বাসায় যেতে বললো কেনো বলো তো! বাসার সবাই ঠিক আছেও বললো। তাহলে কী?”
গলির মোড়ে রিকশা থেকে নেমে হাত হাত রেখে হাঁটছে বিনা ও সমুদ্র। বিনার এক হাতে হাওয়াই মিঠাই। অন্য হাত সমুদ্রর কব্জায়।
” আপনি যেখানে আমিও তো সেখানেই তাই না।”
সমুদ্র থমকে দাঁড়াল। আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলো। তারপর হঠাৎ করেই বিনার ওষ্ঠে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কন্ঠর চোখগুলো বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে থেকে বের হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
” চলো চলো পা চালাও।”
সমুদ্র হেসে বললো। বিনা নিজেকে স্বাভাবিক করে আলতো করে সমুদ্রর বুকে ঘুষি বসিয়ে দিলো। সমুদ্র ততক্ষণে আবারও বিনার হাত ধরে ফেলেছে।
” আপনি একটা অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন দিন দিন। ”
” নিজের বউয়ের কাছে পৃথিবীর সব স্বামীই অসভ্য। ”
বিনা মাথা নিচু করে একা একাই হাসলো আবারও। কী যে সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে দু’জনার সেটা ভালো না বাসলে কেউ বুঝতে পারবে না। প্রেমের অনুভূতি বরাবর সুন্দর।
কলিংবেল বাজতেই কন্ঠ দরজা খুলে দিলো। সমুদ্র একগাল হেসে কন্ঠর গাল টেনে দিয়ে বললো,
” কী হয়েছে রে? দরজার পাশেই দাঁড়িয়েছিলি নাকি? কলিংবেল চাপতেই সিসিম ফাঁক! ”
” ভেতরে আয় সমুদ্র। ”
কন্ঠর থমথমে আওয়াজে সমুদ্র থমকাল। নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ঘটেছে। বিনাও চিন্তিত হয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে বাসার ভেতরে ঢুকলো সমুদ্র ও বিনা। বসার ঘরে নিজের নানা-নানিকে দেখে চমকায় বিনা। কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আনন্দে হেসে উঠলো বিনা।
চলবে,
রোমান্টিক গল্প পড়তে চাইলে লিংকে (https://link.boitoi.com.bd/TbfX) গিয়ে আমার লেখা ই-বুক ❝মন ফাগুনের পবন❞ পড়তে পারেন। গল্প কেমন হচ্ছে মন্তব্য করবেন। আলোচনা, সমালোচনা সবকিছু চাই আপনাদের থেকে।
আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/405587995455485/
পরের পর্বের লিংক পরের পর্ব https://www.facebook.com/100080128645410/posts/406210862059865/