#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_২৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
তড়িঘড়ি করে বাসার ভেতরে ঢুকলো সমুদ্র ও বিনা। বসার ঘরে নিজের নানা-নানিকে দেখে চমকায় বিনা। কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আনন্দে হেসে উঠলো বিনা। কিন্তু পরক্ষনেই নজর পড়ে কবিরের উপর। বিনা আঁতকে উঠে ভয়ে। হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে স্পন্দিত হতে শুরু করেছে বিনার। ধুকপুক আওয়াজে মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি গলা দিয়ে হৃদপিণ্ডটা বের হওয়ার উপক্রম হলে বলে।
” কী রে বিনা সোয়ামী থাকতেও অন্য বেডার সঙতে শুইবার লাগি তোর এত্ত শখ? বাড়তে চল তোর শরীলের শখ আমি মিটাইয়া দিয়াম।”
কবিরের কুৎসিত কথায় চোখমুখ বন্ধ করে ফেললো বিনা। সমুদ্রর মাথায় যেনো দাবানল ছেয়ে গেছে। মুহুর্তেই তড়িৎ গতিতে কবিরের উপর আক্রমণ করে বসে সমুদ্র।
” তুই কে আমি জানি না কিন্তু আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে, আমারই সামনে বিনাকে এরকম কুৎসিত কথা বলার সাহস কীভাবে হয় তোর? তোকে আজ শেষ করে ফেলবো।”
অল্প কিছুক্ষণের ব্যবধানে দু’জনের মধ্যে একপ্রকার ধস্তাধস্তি লেগে গেছে। বিনা সমুদ্রকে ধরে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কবির থামছে না। শায়লা ও শারমিন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। বিনার নানা-নানির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান। দরজা খোলাই ছিল। এমন সময়ে ইফতি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এরকম দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরেই দ্রুত ভেতরে ঢুকে কবিরকে আগলে ধরে ইফতি। বিনা আর কন্ঠ সামলায় সমুদ্রকে। মিনিট দুয়েক স্তব্ধ কাটে। পিনপতন নীরবতা ঘরে। কেমন দম বন্ধ করা পরিবেশ।
” এসব কী হচ্ছে ঘরে? উনারা কারা? আর সমুদ্রর সাথে কেনো ঝামেলা হলো কন্ঠ? আর মা, বড়ো মা তোমরাও তো আছো এখানে! তারপরেও এসব কীভাবে হলো?”
” তুমি শান্ত হও। সমুদ্র মাথা ঠান্ডা কর। বিনা এদিকে এসো।”
কন্ঠর গুরুগম্ভীর কথায় ইফতি ঘটনার ভয়াবহতার আন্দাজ করে নিলো আপন মনে। বিনা সমুদ্রর কাছ থেকে সরে কন্ঠর পাশে দাঁড়াল। এবার মুখ খুললো মেয়েটা।
” নানা তোমরা ওকে নিয়ে কেনো এখানে এসেছো? তোমরা কি জানো না ওই লোকটা কতটা খারাপ! ”
” পাগলামি বন্ধট কর বিনা। ও তোর সোয়ামী লাগে। আমগো সঙ্গে ফিরে চলল। ও তুকে না নিয়ে যাইবার লয়।”
বৃদ্ধার কথায় সমুদ্র ও ইফতি বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতোই চমকে উঠে। কবির কথায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও বিনার নানার কথায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সমুদ্র। মনে হচ্ছে সময় থমকে গেছে এই মুহুর্তে। বিনার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সমুদ্র। বিনার চোখে অসহায়ত্ব।
” নানা! তোমরা কীভাবে এতো বড়ো মিথ্যা কথা বললে? ওই জানোয়ারটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে কবে? বিয়ে হওয়ার আগেই তো ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিলো। তোমরা তো সব জানো তবুও কেনো সবাই মিলে আমার সাধের সংসার ভাঙতে চলে এসেছো! দয়া করে মিথ্যা বলা বন্ধ করো।”
” বিনা! তোর তো সাহসটা কম লাই বটে। তুই তোর নানাকে মিথ্যাবাদীট বলছিস? এইজন্য তোরে খাওয়াপরা দিয়া বড়োট করছিলাম রে!”
বিনা চুপ করে যায়। অভাবের সংসারে খাওয়াপরার অভাব থাকলেও ছোটো থেকে কখনো ভালোবাসার অভাববোধ করেনি বিনা। নানা-নানি সবসময় ভীষণ স্নেহ করেছেন। কিন্তু সেই নানা-নানি আজ কেনো আদরের নাতনির সংসার ভাঙছে? নেই! এই প্রশ্নের জবাব বিনার কাছে নেই।
” বিনা উনারা কী বলছেন? তুমি আমার নও? তুমি কি ওই লোকটার বউ? তাহলে আমার কী! আমি আমি তোমার কে?”
সমুদ্রর সমস্ত শরীর রাগ,ঘৃণার সংমিশ্রণে থরথর করে কাঁপছে। দু-চোখ রক্ত জবার মতো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। স্থান, কাল,পাত্র ভুলে বিনার কাঁধ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে ঝাঁকিয়ে উপরোক্ত প্রশ্ন শুধালো সমুদ্র। বিনা চোখ ভেঙে বেরিয়ে এলো নোনাজল।
” বিশ্বাস করুন সমুদ্র সাহেব, ওর সাথে আমার বিয়ে হয়নি। ও শুধু আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। নানা-নানি মিথ্যা কথা বলছেন। ”
সমুদ্র বিনাকে ছেড়ে পিছুপা হয়। পাগলের মতো এলোপাথাড়ি দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে বিনার সমস্ত জামাকাপড়, সবকিছু ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে। বিনা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসার ঘরেই দাঁড়িয়ে আছে। ইফতি এসেছে সমুদ্রর পিছুপিছু। সমুদ্রর যে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই ইফতির। বিনার দিকে ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শায়লা। ছেলের কাছে গিয়ে কীভাবে স্বান্তনার বাণী শোনাবে সেই সাহস উনার নেই। শারমিন সুলতানা বিনার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালো। কবিরের মনে তখন মহা আনন্দ।
” আমার মেয়ে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ছলনা করতে পারে না বিনা। তাহলে তুই কীভাবে করলি? আমার নিজের মেয়ে হলে ঠিক সবকিছু খুলে বলতি। ”
বিনা হুহু করে কেঁদে উঠলো।
” মা বিশ্বাস করো আমার বিয়ে হয়নি মা। ও নানা, ও নানি তোমরা দয়া করে সত্যিটা বলো। বলো না তোমাদের পায়ে পড়ি।”
বিনা প্রথমে নানার পায়ে লুটিয়ে পড়লো তারপর নানির। কিন্তু কেউ বিনার প্রতি দয়ামায়া প্রদশর্ন করলো না। শারমিন সুলতানা সমুদ্রর কাছে যাওয়ার জন্য ঘরের দিকে এগোলো। কন্ঠ বিনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ম্লান হেসে বললো,
” অন্তত আমাকে বলতে সবকিছু! আমি চেয়ে করতাম তোমার অতীত লুকিয়ে সব ঠিকঠাক করে বর্তমান গুছিয়ে দিতে। ”
” কন্ঠ আপা আমি সত্যি বলতেছি। কেউ অন্তত বিশ্বাস করো আমাকে!”
শায়লা মল্লিক এতক্ষণে জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছেন। বিনার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফুঁসে উঠলেন তিনি।
” কন্ঠ ওকে এখুনি ওর আত্মীয়স্বজনের সাথে চলে যেতে বল। সমুদ্রর হার্ট দূর্বল। ওকে সামনে দেখলে যন্ত্রণা বাড়বে বই কমবে না। ”
কবির তৎক্ষনাৎ বিনার হাতের কব্জি খপ করে পাকড়াও করলো। নানা-নানিকে ইশারা করতেই উনারাও এগিয়ে এলেন।
” বাড়িট চল বিনা।”
” আমার হাত ছাড় তুই। তোর জন্য আমার সবকিছু শেষ! তোকে কিন্তু আমি প্রাণে মেরে দিবো।”
বিনা চেষ্টা করেও নিজের হাত কবিরের হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করতে পারে না। নানা-নানির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় বিনা। কিন্তু বিনার নানাই যখন বললেন তাদের সাথে যেতেই হবে তখন বিনার ভীষণ কষ্ট লাগলো। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? আর কেনোই বা হচ্ছে! বিনার কোনো আপত্তি শুনলো না কেউ। কন্ঠ ও শায়লার সামনে থেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলো কবির নামক শয়তানটা। বিনার নানা-নানি নির্বাক দর্শকের ন্যায় সবকিছু দেখেও চুপচাপ রইলেন। কন্ঠর বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে। মেয়েটাকে ছোটো বোনের মতোই তো ভালোবেসে ফেলেছিল। সমুদ্র! সমুদ্র কী করছে ঘরে? কন্ঠ সমুদ্রর ঘরের দিকে এগোলো সাথে শায়লাও ছুটলো।
নিশুতি রাত! ঘড়ির কাঁটায় সময় ঠিক বারোটা। বাসের জানালার পাশে সিটে বসে আছে বিনা। পরনে পার্পল কালারের শাড়িটা! বিকেলে যে সাজগোজ করে সমুদ্রর সাথে বেরিয়ে ছিল ঠিক তেমনই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে তাকে। শত জোড়াজুড়ি করেও কবিরের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারেনি। যা-ও বা পারতো নানা-নানির কথায় তা-ও পারেনি। জানালার অল্প ফাঁক দিয়ে বাতাসেরা বিনার এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিচ্ছে। ক্ষিধে, ক্লান্তিতে শরীর যেনো এলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। মাথাভর্তি চিন্তা আর বুকভরা কষ্টের সংমিশ্রণে শূন্য শূন্য লাগছে সবকিছু।
নভেম্বরের শীতল সকাল। কুয়াশার চাদর ভেদ করে রোদের আলো উঁকি দিচ্ছে ধরণীর বুকে। বাঁশের মাচার দোচালা ঘরের বারান্দায় আনমনে বসে আছে বিনা। পরনে পেটিকোটে আর ব্লাউজের মতো দেখতে নকশা করা পোশাক। কবিরের সাথে গতকাল জীবনের সবচেয়ে বড়ো ঝামেলাটা ঘটে গেছে। সেসবই ভাবছে বসে। সেই কৈশোর থেকেই বিনার ওপর নজর স্থানীয় গুন্ডা কবিরের। কালকে প্রতিদিনের মতোই পথ আঁটকে অশ্লীল ইঙ্গিত করছিল লোকটা। তাতেই বিনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ফলশ্রুতিতে কষিয়ে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় বিনা। থাপ্পড় খেয়ে মুচকি হেসে কবির শুধু বলেছিল, থাপ্পড়ের বদলা আগামীকাল অর্থাৎ আজকে নিবে। ঘটনাটা বাড়িতে বলেনি বিনা। বললে বয়স্ক নানা ও নানি ভীষণ চিন্তা করতো।
” আমার অপেক্ষায় বসেট্ট আছিস লাকি বিনা? চল তুরে লিতে আসছি আমি। ”
হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠে ভাবনায় ছেদ ঘটে বিনার। কবির এসেছে! সাথে কয়েকজন ছেলেপেলে। বিনার কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এরমধ্যে ঘরের ভেতর থেকে বিনার নানা ও নানিও বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন। কবিরকে দেখেই দু’জন আঁতকে উঠলো। বিনা কিছু বলার সুযোগ পায়না। কবির তার দলবদ্ধ বাহিনীকে নিয়ে বিনাকে জোর করে নিজের সাথে নিয়ে যায়। বয়স্ক নানা ও নানির আহাজারি কবির কর্ণপাত করেনি মোটেই। সারাদিন একটা ঘরের মধ্যে আঁটকে রাখে বিনাকে। রাতে বিয়ে! ঠিক রাত আটটার দিকে দরজা খুলে বিনাকে বিয়ের জন্য সামনের উঠোনে নিয়ে যায় কবির। সৌভাগ্যক্রমে তখনই পুলিশ বাহিনী এসে পৌঁছে সেখানে। বিগত কেসের জন্য গ্রেফতার করে কবিরকে। ফলশ্রুতিতে বিনা বেঁচে যায়। কবিরের জেল হওয়াতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পুরো গ্রামবাসী। কবির যে শুধু বিনাকে উত্ত্যক্ত করতো সেটা নয়। গ্রামের আরও অনেক মেয়েদের সাথে খারাপ আচরণ করতো। কয়েকজনকে তো রাতের আঁধারে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ পর্যন্ত করেছে। মেয়ের পরিবার লজ্জায়, লোকসমাজেের ভয়ে সবকিছু গোপন করে গেছে। এরকম একজনের জেল হলে তো সবার খুশি হবারই কথা!
” এই বিনা! উঠ আমরা চইলা আসছি বটে।”
কবিরের ডাকে ঘুম ভাঙলো বিনার। ক্লান্তিতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারেনি মেয়েটা।
চলবে,
রিচেক দেওয়া হয়নি। কেমন লেগেছে এক শব্দে হলেও জানাবেন।💜
আগের পর্ব আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/405817015432583/