#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_৩৫_ও_৩৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” বইন আমি টেক্সটে কথা বলতেছি রাখবো কীভাবে? কলে তো না।”
অতঃপর অপরদিক থেকে কয়েকটা সেন্টি মার্কা ইমোজি দিয়ে অফলাইনে চলে গেলো ইভা। পূর্ণতাও হারালো ঘুমের দেশে সংগোপনে। বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো অন্য রকম সুন্দর হয়।
সমুদ্রর শরীর একটু একটু করে ঠিক হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে এভাবে মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসা চলমান থাকলে আশা করা যায় মাস ছয়েকের আগেই সে সুস্থতা লাভ করবে। শায়লা মল্লিক এখন সব সময় ছেলেকে চোখে চোখে রাখে। বিনা সারাক্ষণ সমুদ্রর সেবা করার জন্য প্রস্তুত। কন্ঠই আপাতত রান্নাঘরের হাল ধরেছে। সবকিছুই চলছে ভালো। পূর্ণতার সাথে সমুদ্রের কথা হয় প্রায়। সমুদ্র নিজ থেকে কথা বলে মাঝে মধ্যে। তবে নিজের মেয়ে হিসেবে না। মেয়েটাকে তার ভীষণ ভালো লাগে বলেই কথা বলে। যতই হোক রক্তের সম্পর্ক বলে কথা!
আসরের নামাজ শেষে ঘরে চা তৈরি করে নিয়ে এলো বিনা। সমুদ্র ঘরে বিছানায় বসে বিভিন্ন বই ঘাটাঘাটি করছে। বিনা চায়ের কাপ পাশের টেবিলে রাখলো। সামনে রমজান। কেমন একটা খুশি খুশি অনুভূতি চারদিকে।
” শুনেছেন?”
সমুদ্র তাকাল বিনার দিকে। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। বিনা চায়ের কাপটা সমুদ্রর সামনে এগিয়ে দিলো। সে নিঃশব্দে চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিলো। বিনা ফের গেলো ঘরের বাইরে। পূর্ণতা এলো বাবার সাথে আলাপচারিতা বাড়াতে।
” বাবা কি করছো?”
চায়ের কাপ থেকে মনোযোগ সরিয়ে পূর্ণতার দিকে দৃষ্টিপাত করলো সমুদ্র। মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে দেখলে কেমন আপন আপন লাগে।
” চা খাচ্ছি। তোমার বাবা আমি? ”
” অবশ্যই! কোনো সন্দেহ আছে তোমার? ”
” আমার তো কিছু মনে পড়ে না।”
” পড়বে,পড়বে। সময় হোক।
সমুদ্র এক হাতে চায়ের কাপ ধরে অন্য হাতে মাথা চুলকাচ্ছে। পূর্নতা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বাবা চিনতে পারুক বা নাই পারুক,তিনি যে চোখের সামনে আছে এটাই অনেক। সেটুকু নিয়ে পূর্ণতা খুশি।
লোকাল বাসে বসে জ্যামে আটকে আছে নৈশ। গাবতলী এসেছিল একটা কাজে। সেখান থেকে শাহবাগ যাবে আবার একটা বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কিন্তু জ্যামের কারণে আধঘন্টার রাস্তায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো নৈশ, বেলা বারোটা ছুঁইছুঁই। এমন সময় কল এলো শাহবাগে অপেক্ষা করতে থাকা বন্ধুটির। নাম তার শান্ত। এমনিতেই বসে বসে বোর হচ্ছিল নৈশ। তাই কল রিসিভ করতে বিন্দুমাত্র দেরি করলো না সে।
” কী রে মামা কই তুই? ”
” আর বলিস না বেটা। বাসে বসেই আছি।”
হতাশা ভরা কন্ঠে বললো নৈশ।
” তুই একটা বাসে আসতে গেলি কেন? ভেঙে ভেঙে বাস পাল্টে আসতি!”
” থাম তুই তোর আবা*লমার্কা কথা নিয়া। শালা প্রেম করতে পারো না আবার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে আসছোস। আসবে তোর গফ,তুই ঘুরবি। সাথে আমাকে নিবি কি কাবাবে হাড্ডি করতে?”
শান্ত ফোনের অপরপ্রান্তে থেকে ঠোঁট টিপে হাসছে। নৈশের যে মেজাজ বিগড়ে গেছে সে বিষয় নিশ্চিত শান্ত।
” কুল কুল মামা। তোরও হবে। বাই দ্য ওয়ে, তোর কাল নাগিনীর খবর কী?”
” তুই বেটা এক্সের কথা বাদ দে। ওয়াই মানে বর্তমান নিয়ে কথা বল।”
শান্ত চমকাল এবার। বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
” কী! বললি না তো। নাম কী রে ভাই? কতদিন হলো?”
” হুঁশ! কিছু হয়নি। কথাবার্তা হয় মাঝে মধ্যে। ভালোলাগা আছে, একটু একটু মায়াও জন্মেছে। এতটুকুই! নাম পূর্ণ,পুরো নাম পূর্ণতা।”
” আলহামদুলিল্লাহ! ভাই তোর বিয়েটা তাহলে এবার খেতে পারবো।”
” তুই ফোন রাখ শালা। বাস চলতে শুরু করছে। আসতেছি।”
নৈশ কল কেটে সিটে হেলান দিয়ে বসলো। এতক্ষণ কথার জন্য খেয়াল করেনি ইতিমধ্যে তার পাশে এক সুন্দরী ললনা বসেছে। খেয়াল হতেই জানালার দিকে চেপে বসলো নৈশ। মেয়েটার যেনো ইগোতে লাগলো। কোথায় সুন্দরী মেয়েরা পাশে বসলে ছেলেরা পটাতে চায় আর এই ছেলে? এই ছেলে দূরে সরে বসলো।
পূর্ণতার দিনগুলো ভালোই কাটছে আজকাল। নৈশের সাথে টুকটাক কথা, বাবার সাথে ভাব জমানো আর বাড়ির সবার সাথে হেসেখেলে জীবনটাকে সর্গের মতো লাগে তার। এতদিন যেনো জীবনে কিচ্ছু ছিল না। তার বাবাকে ফিরে পেতেই বাড়িতে প্রাণ ফিরে এসেছে।
” শাওনের দিকে একটু নজর রাখিস কন্ঠ।”
হঠাৎ শাওনকে নিয়ে এরকম কথায় চমকাল কন্ঠ। ইফতি ডিনার শেষে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে। হাতে ফোন। কন্ঠ ঘরের এলোমেলো ভাবটা কাটানোর জন্য একটু গোছগাছ করেছিল। কোমরে গুঁজে রাখা শাড়ির আঁচল উন্মুক্ত করে বিছানার একপাশে বসলো সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল স্বামীর দিকে। শাওনকে নিয়ে কি কিছু হয়েছে বাইরে? নাকি কেউ কিছু বলেছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে কন্ঠ। চোখ দেখে স্বাভাবিক লাগছে ইফতিকে। রেগে নেই। তাহলে?
” কিছু হয়েছে কি?”
” না কিছু হয়নি। তবে যাতে না হয় তাই সাবধান করলাম। ”
” স্পষ্ট করে বলো।”
” পাড়ার ছেলেদের মতো অন্তুর কাছে গতকাল ইয়া*বা পেয়েছে শম্ভু কাকা। ওরা প্রায় বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত বাড়িটায় আড্ডা দিতো। তারজন্য সন্দেহ জাগে শম্ভু কাকার মনে। তারপর আর কী? গেলো সেখানে। ”
কন্ঠ বুঝলো ইফতির ভয়ের কারণ অহেতুক নয়। আজকালকার ছেলেরা কৈশোর থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে যায়। শম্ভু সেন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। এলাকায় সবাই তাকে মান্য করে। কন্ঠ খাটে পা তুলে আসন দিয়ে বসলো।
” তুমি ভেবোনা। আমি কথা বলবো শাওনের সাথে। ”
” ঠিক আছে। এখন এদিকে আয়।”
কন্ঠ ইফতির শয়তানি না বুঝেই কাছাকাছি গিয়ে বসলো। ইফতি আরেকটু এগিয়ে গাঘেঁষা হয়ে বসলো। দৃষ্টি মিলন হতেই কন্ঠ বুঝলো ইফতির দুষ্টমি।
” তুমি না একটা…! এই বয়সেও অসভ্যতা। ”
” এখানে একটা চুমু খা ঘুমিয়ে যাবো।”
বুকের বামদিকে ইশারা করে বললো ইফতি। কন্ঠ মুচকি হাসলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো স্বামীর বামপাশের পাঁজরের নিকট। টি-শার্টের উপর দিয়ে ছুঁইয়ে দিলো বক্ষে ঠোঁটের স্পর্শ!
তপ্ত দুপুরের রোদে কলেজ ক্যাম্পাসে গোল হয়ে বসে আছে পাঁচ সদস্যের দল। এই দলে আছে ইভা,পূর্ণতা, সাইফা সজল ও রাকিব। উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই ওরা পাঁচজন একসাথে লেখাপড়া করে আসছে। সেই হিসেবে দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব পাঁচজনের। কলেজের অনেকে তো ওদের পঞ্চ পান্ডব বলেও ডাকে।
” আরে! তোর গলায় লাল লাল ওটা কীসের দাগ সাইফা?”
সজল চোখ টিপ্পনী দিয়ে কথাটা বলতেই হাসির রোল উঠলো। সাইফা জানে ওরা কেমন। দুষ্টমি না করলে পেটের ভাত হজম হয় না ওদের।
” জামাই আদ*র করছে তাই দাগ হয়ে গেছে। এটাই তো শুনতে চেয়েছিলি তোরা?”
সাইফাও কম যায় না। পূর্ণতা সাইফার গলার লাল অংশে আঙুল ঘষে বললো,
” এটা ইভার কাজ। কোন ফাঁকে গলায় লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়ে এখন আসছে লেগ ফুল করতে। তোরা পারিসও! ”
” আহ পূর্ণ! গোয়েন্দাগিরি করা কি তোর পেশা নাকি নেশা বলতো?”
রাকিব তার সবগুলো দাঁত বের করে বললো। মনে হচ্ছে ছেলেটা দাঁতের ডাক্তারের নিকট তার সমস্ত দন্ত পরীক্ষা করার জন্য প্রদর্শন করছে। পূর্ণতা ভেংচি কেটে বলে,
” পেশা হলে তোদের সাথে বসে প্যাঁচাল পারতাম? নিশ্চিত অফিস খুলে সেখানে বসতাম। সুতরাং এটা আমার নেশা। ”
হঠাৎ নেশা শব্দটা মুখে আসতেই নৈশের কথা স্মরণে আসলো পূর্ণতার। অস্ফুটে স্বরে বললো “নেশা ভাই! ”
” কী বললি?”
ইভা শুধালো। সবার দৃষ্টি পূর্ণতার দিকে নিবদ্ধ।
” আরে নৈশ নামে একজনের সাথে আলাপ হয়েছিল বান্দরবান যাওয়ার পথে। তো মাঝে মধ্যে কথা হয় মেসেঞ্জারে। আর আমি প্রায় নৈশ রেখে নেশা ভাই বলে ফেলি।”
” ডালমে কুচ কালা হ্যে ইয়ার।”
সজল হেসে বললো। তার সাথে সবাই হাসলো। পূর্ণতা সভা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর দু’টো বেজে গেছে। তাই বাড়ি ফেরার জন্য এগোতে হবে।
” তোরা সেই কালা ডাল খোঁজ। আমি আপাতত গেলাম।”
আর কোনো কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে পূর্ণতা কলজ থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। কলেজের সামনে থেকেই বাস পাওয়া যায়। বাসে চড়লেই মিনিট বিশেক পরে বাড়ির সামনের বড়ো রাস্তায় নামিয়ে দিবে।
বাসায় ফিরে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলো পূর্ণতা। চুলগুলো তোয়ালে পেঁচিয়ে কোনো প্রকার, ছুটলো ডাইনিং টেবিলের দিকে। ক’দিন হলো বাবা-মেয়ের বেশ ভাব জমেছে। একসাথে খাবার খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকে সমুদ্র। সবকিছু একসাথে মনে পড়ছে না সমুদ্রর। সবাইকে চিনতে পারছে কিন্তু স্মৃতিগুলো ঝাপসা! সেই নিয়ে বাড়ির লোকজন খুশি।
” আম্মু আমার প্লেট কই?”
ডাইনিং টেবিলে বসে শুধালো পূর্ণতা। শাওনের খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে গিয়ে টিভির রুমে বসেছে মাত্র। শায়লা মল্লিকেরও! অনেকগুলো ঔষধ খেতে হয় উনাকে। তাছাড়া বয়স হয়েছে তো। এজন্য কন্ঠ আগেভাগে শ্বাশুড়িকে খেতে বলে।
” ভালো করে তাকিয়ে দেখ। ”
মায়ের কথায় আবারও টেবিলের দিকে দৃষ্টিপাত করলো পূর্ণতা। এবার তো পাশেই রাখা ভাতসহ প্লেট! সাথে ইলিশ মাছ ভাজা। পাশের ছোটো বাটিতে মুসুরি ডাল পাতলা করে রাঁধা,অন্য বাটিতে পুঁইশাক আর আলু রান্না করা।
” তাড়াহুড়ো করছো তো এজন্য সামনের জিনিসও খেয়াল করোনি। এবার খাওয়া শুরু করো। বিনা তুমিও বসো।”
ভাতের প্লেটে মুসুরি ডাল নিয়ে মাখতে মাখতে বললো সমুদ্র। ইফতি আপনমনে খাচ্ছে। কন্ঠও বসলো মাত্র। বাবার কথায় মেয়েও যোগ দিলো।
” হু আম্মু বসো।”
” হ্যাঁ বসছি। ”
সবার প্রয়োজনীয় খাবার টেবিলে সরবরাহ করে বিনাও খেতে বসলো। সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে মনটা প্রায় শান্তি শান্তি লাগে বিনার। আবার আফসোসও লাগে। মানুষটার সাথে সংসারটা ঠিক জমলো না। শুরু হওয়ার আগেই বিষাদের কালো মেঘে আড়ালে রেখেছিল দু’জনকে।
” কী ব্যাপার নৈশ? তুমি খাবার প্লেটে এভাবে আঙুল ডুবিয়ে বসে রইলে কেনো!”
স্নেহা চৌধুরী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নৈশের দিকে। নৈশের বাবা খেয়েদেয়ে রুমে গেছেন। টেবিলে উপস্থিত আছে নৈশের ছোটো বোন রাত্রি, ও মা স্নেহা।
” ক’দিন হলো ভাইয়ু যেনো কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মাম্মা। ”
স্নেহা অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। ডিপার্টমেন্ট হিসাববিজ্ঞান। ভাইয়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক তার। বোনের কথার তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো নৈশ।
” না,মা। আমার কিছু হয়নি। খেতে ইচ্ছে করছে এটুকুই। ”
” জোয়ান ছেলে! এই বয়সে কারণ ছাড়া খেতে ইচ্ছে করবে না কেনো? শরীর খারাপ-টারাপ হলো না-কি? ”
স্নেহা চৌধুরী চিন্তিত মুখশ্রীতে এগিয়ে গেলেন নৈশের দিকে। কপালে হাত ছুঁয়ে দেখেন জ্বর এলো কিনা।
” জ্বর আসেনি মা। তুমি অহেতুক চিন্তা কইরো না। ”
” তাই তো দেখছি। জ্বর তো নেই! ”
” হুহ্। তুমিও এবার গিয়ে খেতে বসো। রাত হয়েছে অনেক। ”
ছেলের কথায় স্নেহা চৌধুরী খেতে বসলেন ফের। রাত্রিও খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কেবল নৈশ পারলোনা ঠিকঠাক মন দিতে। ছেলেদের প্রথম প্রেমের চেয়ে দ্বিতীয় প্রেম বেশি ভাবায়।
স্নেহা নৈশের জন্মদাত্রী জননী নন। নৈশের বয়স যখন তিন বছর, তখন ক্যান্সারে মারা যায় ওর মা। অতটুকু ছেলেকে নিয়ে তখন হিমসিম খাচ্ছিলেন শামীম চৌধুরী। একদিকে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানোর বেদনা অন্য দিকে ব্যাবসা – বানিজ্যিক কাজকর্ম তখন নিয়ে দিশেহারা অবস্থা প্রায়। স্নেহা চৌধুরী ছিলেন শামীম চৌধুরীর অফিসে কর্মরত একজন কর্মচারী। অল্প বয়সে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন একজনকে। কিন্তু স্নেহার সাথে মাস ছয়েক থাকার পরেই সেই লোক অন্য শহরে চলে যায়। অগত্যা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসেন স্নেহে। নানান কথাবার্তা শুনতে হয় সমাজ ও পরিবার থেকে। ভাগ্য সহায় ছিলো বলে কোনো রকম লেখাপড়ার জোরে ছোটোখাটো একটা চাকরি মিলে যায় স্নেহার। শামীম চৌধুরীর স্ত্রী’র মৃত্যুর খবর পেয়ে সহানুভূতিশীল হয়েই নৈশকে একদিন দেখতে গিয়েছিল স্নেহা। মজার বিষয় নৈশকে ভীষণ ভালো রকম ভাবেই ওই সময়টুকু সামলে নিচ্ছিল স্নেহা। সেসব দেখেই শামীম চৌধুরী বিয়ের প্রস্তাব দেয় স্নেহাকে। কাজের লোক দিয়ে কি ঠিকঠাক বাচ্চা মানুষ হয়? স্নেহা নিজের অবস্থান ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে রাজি হয়। প্রথম প্রথম কেবল মাত্র সন্তানের জন্য বিয়ে করলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে স্নেহার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে শামীমের। ছেলের প্রতি স্নেহার ভালো আচরণে বরাবর মুগ্ধ হতো শামীম। অনেক মেয়েরাই বিয়ের পর রূপ বদলায়। অন্যের ছেলেকে ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু সেদিক থেকে স্নেহা ছিল অসাধারণ। নৈশকে কখনো বুঝতে দেয়নি স্নেহা তার নিজের মা নয়। অতঃপর দু’জনের মধ্যে ভালোবাসা জন্মে। তিনজনের সংসারে আরেকজন সদস্য যোগ হয়,রাত্রি!
” পূর্ণ!”
মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার সাথে সাথেই ওপেন করলো পূর্ণতা। এতক্ষণ যেনো কাঙ্খিত মানুষটির মেসেজের অপেক্ষায় ছিলো। দু’হাতে টাইপ করতে শুরু করে মেয়েটা।
” ইয়েস! নেশা ভাই ভ্লাচেন?”
নৈশ মেয়েটার মেসেজ দেখে হাসলো। উপুড় হয়ে ছিলো এতক্ষণ। এবার সোজা হয়ে শুয়ে ফোনটা উঁচিয়ে ধরে রিপ্লাই দিলো নৈশ।
” হুম,তুমি কেমন আছো? ”
” জোশ। ”
” ওওও।”
নৈশের এই তিনটা ‘ও’ একসাথে পাঠানোটাই বিরক্ত লাগে পূর্ণতার। যেনো আরকিছু লেখার নেই জগতে! পূর্ণ বিরক্ত হয়ে লিখলো,
” হু,শুভ রাত্রি। ”
নৈশের ঠোঁটের কোণের হাসি মিইয়ে গেলো। কী হলো? এখুনি শুভ রাত্রি কেনো বললো মেয়েটা? অবশ্য এই বয়সের মেয়েদের হুটহাট মুড সুইং হয়।
” এখুনি ঘুমাবে? ”
অপর পাশ থেকে আর রিপ্লাই এলোনা কোনো। পূর্ণতা ইতিমধ্যে অফলাইনে চলে গেছে। ভাবনায় পড়ে গপলো নৈশ। কল করবে একবার? যাহ! কল কীভাবে করবে? ফোন নম্বরটাই তো নেই ওর কাছে। অগত্যা মনে অশান্তি নিয়ে ফোনে ‘ কবিতার গান’ প্লে করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করলো নৈশ।
প্রিয়তমা স্ত্রীকে বক্ষে জড়িয়ে বসে আছে সমুদ্র। বিনার দু-চোখ ছলছল করছে। সমুদ্র বিনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,
” মন খারাপ করে থেকো না! এখন তো আমি এসে গেছি তাই না? ”
” আপনি তো সবকিছু ভুলে ছিলেন কিন্তু আমি? আমার প্রতিটি দিন,প্রতিটা ঘন্টা, সেকেন্ড কীভাবে কেটেছে তা কেবল আমি জানি। আমি কিছুতেই সেই দিনগুলো ভুলতে পারবো না। তবুও আলহামদুলিল্লাহ। এই বয়সে এসে তোমাকে ফিরে পাবো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। ”
” আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট। কপাল খারাপ ছিলো আমাদের। মেয়েটা আমার বাবার আদর স্নেহ পেলো না শৈশবে। ”
বিনা সমুদ্রের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আলগোছে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় প্রিয়তমর। সমুদ্র মুচকি হাসে। বিনিময়ে সে-ও ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো বিনার ললাটে।
” সেদিন ঠিক কী হয়েছিল তোমার কি এখনও পুরোপুরি মনে পড়ছে না? ”
” হুম। ”
সেদিন টিউশনির বেতন আনার জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে আনমনে হাঁটছিল সমুদ্র। একটা গাড়ির পাশ থেকে হেঁটে যাচ্ছিল সমুদ্র, কিছু বোঝার আগেই গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক সমুদ্রর মুখে রুমাল ধরে। ফলশ্রুতিতে চেতনা হারিয়ে ফেলে সমুদ্র। জ্ঞান ফিরতে নিজেকে আবিষ্কার করে কাঠ, টিন ও বাঁশের তৈরি একটা ঘরে বাঁধা অবস্থায়। এভাবেই বন্দী জীবন কাটে তার অনেকদিন। দু’বেলা দু’টো রুটি জুটতো শুধু কপালে। কয়েকদিন পরপর গোসল! ঠিক মাসখানেক পরে কবির আসে সমুদ্রর সামনে। অবাক হয় সমুদ্র। কবিরের সাঙ্গপাঙ্গরা যে কতদূর বিস্তৃত তখন বুঝতে পারে সমুদ্র। এভাবেই মাসের পর মাস চলতে থাকে। কবির সমুদ্রকে প্রাণে মারে না। কিন্তু সবদিক থেকে কষ্ট দিতে থাকে। কখনো বিনাকে নিয়ে কুৎসিত কথাবার্তা বলে কখনো দিন তিনেক খাবার না দিয়ে। সমুদ্র পারেনি সিনেমার নায়কের মতো তাদের হাত থেকে বীরের মতো চলে আসতে। ক্ষুধায়, ঘুমের অভাবে অসুস্থ হয়ে যায় সমুদ্র। বছর পাঁচেক পরে সমুদ্রকে দিয়ে চিঠি লেখায় কবির। অসহায় সমুদ্রের হাতে কবিরের কথা শোনা ছাড়া উপায় ছিলো না তখন। তারপর এলো সেই দিন! কবির এলো এক রাতে তার ঘরে। আরও একটা চিঠি লেখাতে। যাতে বিনার যন্ত্রণা দ্বিগুণ বাড়ানো যায়। ঘটনাচক্রে সে রাতে কবির একাই এসেছিল সমুদ্রর কাছে। সেই সুযোগটা কাজে লাগায় সমুদ্র। চিঠি লেখার জন্য হাতের বাঁধন খুলতেই সুযোগ বুঝে কবিরের হাতের পিস্তল নিজে নিয়ে নেয় সমুদ্র। শুরু হয় দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি। একপর্যায়ে গুলি লাগে সরাসরি কবিরের বুকেই। সমুদ্র বুঝতে পারছিল না কী করবে! কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলির আওয়াজে সবাই ঘরের দিকে আসতে শুরু করে। কোনো রকমে পালিয়ে যায় সমুদ্র। ক্লান্ত শরীরে দৌড়াতে দৌড়াতে পাথরের সাথে হোঁচট খেয়ে ছোটখাটো একটা খাদে পড়ে যায়। মাথায় আঘাত লাগে। তারপর! তারপরের কোনো ঘটনা স্মৃতিতে হাতড়ে পেলো না সমুদ্র। বিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেলো সমুদ্রকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সমুদ্র হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
” আমার সাথে জড়িয়ে আপনার জীবন থেকে এতগুলো বছর নষ্ট হলো। সেদিন যদি আমাকে বিয়ে না করতে হতো ওই জানোয়ারটার হাতে আপনি পড়তেন না।”
” বিনা! শান্ত হও। কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। এসবে তোমার কোনো দোষ নেই। আর এসব বাড়িতে বলার দরকার নেই। সবার খারাপ লাগবে ঠিক তোমার মতোই। মায়ের তো বয়স হয়েছে। আফসোস বাবাকে আর দেখতে পারলাম না! ”
” বলবো না। মানুষ মরণশীল। বাবা গেছেন আমরাও যাবো।”
সমুদ্র বাবার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাবা মানে মাথার উপর মস্ত বড়ো ছায়া। যে সেই ছায়া হারায় সেই বোঝে কী হারিয়েছে!
চলবে,