#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১২
এই তো বেশি আগের কথা না। বছর কতক পূর্বে তোঁষা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখনকার ঘটনা। স্কুলে রোজকার ন্যায় তুহিন ই আনতে যায় ওকে। তোঁষা ও নেচে-কুঁদে বাবা’র হাত ধরে বাসার পথে রওনা হয়। ঘটনা নিত্যদিনেরই কিন্তু তুহিনের একটা ভুল হয় এখানে। বাড়ী’র মোড়ে তোঁষা’কে নামিয়ে সে যায় অফিসে। কোন এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো বোধহয়। তোঁষা হেলেদুলে পাশের ফুচকা’র দিকে গেলো আগে। বাসা থেকে কেউ ওকে একা ছাড়ে না। ভয় পায় যদি তোঁষা হারিয়ে যায়? তোঁষা’র আগে বিরক্ত লাগলেও বড় হতে হতে ব্যাপারটা বুঝে ও। বাড়ী’র একটামাত্র ছোট সদস্য তা ও কি না এক মাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন সকলের এই উপচে পড়া ভালোবাসা। আজ সুযোগ পেয়ে কাজে লাগায় তোঁষা। দোকানে গিয়েই চটপটে গলায় বললো,
— মামা ঝাল দিয়ে ফুচকা দিন।
দোকানী চেনে তোঁষা’কে। শেখ বাড়ীর কন্যা বলে কথা। তিনি ঝটপট আগে তোঁষা’কে দিতেই পাশে থাকা চার পাঁচজন ছেলের একজন বলে উঠলো,
— কি মামা, আগে আমরা থাকা সত্বেও ললনা’কে আগে দিলা? নট ফেয়ার।
তোঁষা’র কানে কথাটা ঢুকতেই চিরবিড়িয়ে উঠে ওর নিউরনগুলো। তখনও ফুচকায় হাত লাগায় নি৷ অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা মজা নিতে চাইলো,
— কি সুন্দরী, এভাবে তাকাও কেন? বুকে লাগে তো।
কথাটা বলেই বুকে হাত রাখে নিজে। পাশে মটকার উপরে রাখা স্টিলের গ্লাস। তোঁষা ছোঁ মেরে সেটা নিয়ই ছুঁড়ে মা’রে ছেলেটাকে। নিশানা একদম সঠিক কপাল বরাবর। ছেলেটা কপাল চেপে ধরে তোঁষা’র দিকে তাকায়। বাকিরা ঘটনার সূচনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তোঁষা রাগে লাল হয়ে ধমকে উঠে,
— কি রে বল এবার? কে ললনা তোর?
ছেলেটা তেঁড়ে যেই না তোঁষা’র কাছে আসবে তখনই কেউ ওর কলার চেপে ধরে পরপর নাক বরাবর ঘুষি মা’রে। পরপর দুই ধরণের শব্দ শুনা যায় তখন। প্রথমত ছেলেটার ব্যাথাকাতুর শব্দ দ্বিতীয়ত তোঁষা’র উচ্ছাসিত কন্ঠ। উৎফুল্ল তোঁষা বলতে থাকে,
— কিরে এবার বল সুন্দরী।
আরহাম ছেলেটা’কে বলার সুযোগ বুঝি দেয়? পরপর আঘাতে ছেলেটা নীচে পরতেই আরহাম তার বুকে আঘাত করতে করতে বলে,
— বল! বল! বুকে লাগে এবার?
আশেপাশে’র কেউ সাহস সঞ্চার করেও আরহামে’র ধারে কাছে যাওয়ার সাহস করতে পারলো না।
সেই ছেলেকে অবশেষে হসপিটালে ভর্তি রাখা হয় টানা দুই সপ্তাহ। তুরাগ কি বলবে ভেবে পায় না। কারণ ঐ দিন দুপুরে আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরেছিলো। দু’জন’কে দেখে বাসার কেউ ই টের পায় নি এত বড় কান্ড ঘটিয়ে এসেছিলো তারা। দু’জন বেশ হাস্যজ্বল মুখে বাড়ী ফিরে সেদিন।
এমন হাজার ও ঘটনা আরহাম ঘটিয়েছে তোঁষা’কে ঘিরে। শুরুতে শুরুতে ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক হলেও পরে আর স্বাভাবিক রইলো না। তোঁষা’কে ঘিরে ছোট্টখাট্ট ব্যাপারগুলোতেও আরহাম রোষপূর্ণ আচরণ করা শুরু করলো। কাউকে পরোয়া করা তখন পছন্দ ছিলো না ওর। বাসায় সবাই যা ই বলুক না কেন আরহাম কারো কথায় কর্ণপাত করে নি। বরং দিন কে দিন তোঁষা’কে ঘিরে তৈরি করেছিলো অদৃশ্য এক দেয়াল যা টপকানো বা ভাঙা কারো দ্বারা সম্ভব ছিলো না। শেখ বাড়ীর সকলে যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে ততদিনে তোঁষা, আরহামে’র সম্পর্ক গড়িয়েছে বহুদূর। হয়তো তারা তাদের অনুভূতি তখন গোছায় নি বা তোঁষা’র বুঝে ততকিছু আসে নি কিন্তু তোঁষা এটা বুঝে গিয়েছিলো তার জীবনের ব্যাপক এক স্থান জুড়ে আরহাম। যার বিরাজমান ব্যাতিত তোঁষা কল্পনা করতে পারে না নিজেকে।
বাসায় সবাই যখন দেখলো তোঁষা’কে নিয়ে আরহাম এর এই ওভার পসেসিভনেস ওদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন তুরাগ ডেকে পাঠায় আরহাম’কে। নিজের বড় ছেলের প্রতি তার ভালোবাসাটা হয় তো সে ততটা প্রকাশ করতে পারে না তাই বলে এমন তো না ভালোবাসে না। আরহাম আসতেই তুরাগ বলে,
— দিন দিন এই অধপতনের কারণ টা কি আরহাম?
— কিসের কথা বলছো আব্বু? সেমিস্টারে টপ করেছি।
তুরাগ এবার রেগে যান,
— ফাজলামো হচ্ছে? জানিস না কিসের কথা বলছি? তোঁষা’কে ছাড়। ওর সাথে এত কি তোর? চাচাতো বোন লাগে। ব্যাস আর কিছু না।
— কোন বোন না ও আমার। চাচা জাত বোন শুধু।
ভালোবাসা আমার।
— পাগলামি বাদ দাও। ফাজিল ছেলে। তোমার এই পাগলামি মে’রে দিবে ওকে!
— ভালোবাসি আমি।
— ভুল ভালোবাসা এটা।
— তোঁষা’কে আমার চাই ই চাই।
কথাটা বলে নিজের রুমে গিয়ে ভাংচুর করে আরহাম। ওর মা ছুটে যান ছেলের রুমে। লাভ হয় না। দরজা লক করা ভেতর থেকে। তুরাগ সহ তুহিন, তোঁষা’র মা এসেও দরজায় কড়া নাড়েন। আরহামে’র সেদিনের গর্জনগুলো ছিলো রুহ কাঁপানো। ওর একেকটা হুংকারে যেন শেখ বাড়ীর দেয়ালে গুঞ্জন তুলেছিলো। তোঁষা কোচিং থেকে ফিরতেই চিৎকার চেচামেচি শুনে। গলাটা আরহামে’র। শুনতেই দৌড়ে হাজির হয় রুমে’র সামনে। তোঁষা’কে দেখা মাত্র ভয় পান তুহিন। তার ছোট্ট মেয়েটা’র উপর না প্রভাব পড়ে এসবের। সবাই ভেবেছিলো তোঁষা ভয় পাবে কিন্তু না। তোঁষা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে শুধু দরজায় টোকা দিয়ে ডাকলো,
— আরহাম ভাই?
ব্যাস আর কোন গর্জন শুনা যায় না। সবটা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। তোঁষা পুনরায় আবার বলে,
— দরজা খুলবেন না?
সেকেন্ডর ব্যাবধানে দরজা ও খুলে গেলো। আরহামে’র মা আর চাচি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই চমকে যান। ফ্লোর জুড়ে কাঁচ। আরহামে’র মা আঁতকে উঠেন ছেলে’র হাত দেখে। তোঁষা’র মা তারাতাড়ি হাতটা ড্রেসিং করে দিয়ে বুয়া ডাকেন রুম পরিষ্কার করতে। তোঁষা ভেতরে ঢুকে নি আর। এসব র*ক্ত সহ্য হয় না তার। তাও যদি হয় আরহাম ভাই এর।
তুরাগ, তুহিন বুঝেন আরহাম’কে সামাল দেয়া সহজ হবে না তাই তো সবচেয়ে নিকৃষ্ট পথটা বেছে নেন আরহাম’কে তোঁষা থেকে সরানোর।
__________________
— আজকে পেটে দিব।
আরহাম ভ্রু কুঁচকায়। তোঁষা’র বাহু টেনে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,
— হাতে কিছু হয়ে’ছে?
— হু। ব্যাথা।
আরহাম’কে মুহুর্তেই চিন্তিত দেখালো। তোঁষা মুখে থাকা চোরা হাসিটা দমিয়ে রেখে পরণে থাকা কুর্তি’টা উঁচু করলো অতি সামান্য। এতেই যেন আরহামে’র কিছু হলো। ধবধবে সাদা পেট’টা অল্প চর্বি যুক্ত। ঠিক যতটা না হলেই নয়। আরহাম বাজে ভাবে ফাঁসলো যেন। এই বুঁচি ওকে জ্বালিয়ে মা’রছে। কোন মতে দাঁত চেপে পেটে দুই আঙুল রেখে চামড়া উঁচু করতেই তোঁষা মুচড়ে উঠে। প্রচন্ড স্পর্শকাতুরে কিনা। আরহামে’র নিয়ন্ত্রণ রাখাটা এবার যেন কঠিন হলো বেশ। ধমকের স্বরে বললো,
— একদম সোজা দাঁড়িয়ে থাক তুঁষ।
তোঁষা মানলো। দাঁড়ালো সোজা। আরহাম অতিশীতল হাতে স্পর্শ দিলো তোঁষা’র পেটে। শিউরে উঠে এবার মোচড়া মোচড়ি করার সময় পেলো না তোঁষা। আরহাম দক্ষ হাতে পুশ করেছে। তড়িৎ বেগে তোঁষা’র কাপড় ঠিক করতেই দেখলো তোঁষা মুখ টিপে হাসছে। আরহাম ওরদিকে তাকিয়ে শ্বাস টেনে অসহায় গলায় বললো,
— জ্বালানোটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
তোঁষা যেন অবুঝ সাজলো। বললো,
— মানে?
— জানিস না?
— না তো।
আরহাম কিছু বলার আগেই তোঁষা আজ তাড়া দিলো,
— যাবেন না? লেট হচ্ছে তো।
আরহাম ভ্রু কুঁচকায়। যেই মেয়ে পারলে ওকে টেনে নিজের কাছে রাখে সারাদিন সে আজ তাড়াচ্ছে?
অবশেষে তোঁষা’র কাছে বাধ্য হয়ে আরহাম চলে যায়। যাওয়ার আগে রোজকার ন্যায় তোঁষা’কে কিছু সীমাবদ্ধতা জানিয়ে যেতেও ভুলে না সে। তোঁষা মাথা নাড়ে শুধু। আরহাম যেতেই নিজের কাছে লেগে গেল তোঁষা। এতটা উৎফুল্ল এর আগে কখনো হয় নি ও। অথচ কাজটা করতে তোঁষা’র ভেতর ভেতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দ করেই যাচ্ছে কিন্তু তোঁষা দমবার পাত্রী নয়। একবার যেটা চাই তা চাই ই চাই।
#চলবে…