#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৭
রাজশাহী ট্রিপে তথ্য’কে দেখে বিন্দুমাত্র চমকালো না তুষা’র। না ই তেমন কোন আগ্রহ দেখালো। ও চমকাতো যদি তথ্য এখানে না থাকত। ডিউটি পড়ুক আর না পড়ুক এই মেয়ে ওর পিছু নিবেই। এই যে চাইলেই এখন ক্যাম্পে থেকে নিজের কাজ করতে পারত অথচ সে এসেছে রাজশাহী। এই মেয়ে ক্লান্ত হয় না। পরক্ষণেই তুষা’রের মনে হলো আর্মিদের আবার ক্লান্তি?
বাইরে ঝলমলে সূর্যের প্রখর রোদ আজ। রাজশাহী শহরটা কি তবে গরম? চট্টগ্রামে যথেষ্ট ঠান্ডা লাগে তুষারের। সেই ঠাণ্ডাটা অবশ্য আরামদায়ক। শরীরে সহনীয়। যদিও এখন শরীর মন কিছুই তার ভালো থাকে না। পরিস্থিতি থেকে পালানো কি এতই সহজ? মোটেও সেটা সহজ না৷ তোঁষা ওর বোন হলেও বয়সের বিরাট বড় ফারাকের কারণে তাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে তুষা’র। এই যে পালিয়ে এলো পরিস্থিতি থেকে। পরিবারের উপর রাগ করে শান্তি কি মিলছে? উহু মোটেও না৷ কোন শান্তি নেই এখানে। আগের মতো রুচি জাগে না কিছুতেই। কানে বারংবার বাজে এই বুঝি পুতুল’টা ভাই বলে ডেকে উঠলো।
আরহামের হয়তো সমস্যা আছে তবে তাদের দূরে রাখাটা কতটা যুক্তিযত হলো? এখন কেমন আছে ওর পুতুলটা। গোপনে এখানে এসে খোঁজ চালাচ্ছে তুষা’র যা বাসায় থাকাকালীন করা সম্ভব ছিলো না। এখান থেকে তোঁষা’র খোঁজ চালাচ্ছে ও। আরহাম যথেষ্ট মান্য করে তুষা’রকে। তুষার বুঝাবে আরহাম’কে। ও জানে আরহাম ভালোবাসে তবে সেই ভালোবাসাটা অসুস্থ। হয়তো পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা তবে বি*ষা*ক্ত বাঁধনে ঘেরা।
ঠকঠক শব্দে ঘাড় ঘুরালো তুঁষা’র। তথ্য দাঁড়িয়ে। তুষা’রের লাল মুখটা দেখেই তথ্য’র হাসিখুশি মুখটায় আঁধার নেমে এলো। তুষারের হাসি পেলো। সে হাসলো ও। মনের মধ্যে থাকা বিধ্বস্ততা সে দেখাতে চায় না কাউকে। সবাই উপরটা ই দেখুক। ভেতরটা নিজের থাকুক। একদম একান্ত নিজের।
তবে তা হলো না। তথ্য মিথ্যা হাসি চিনে ফেললো। ঘাড় নামিয়ে ফেলে ধীরি শব্দে ডাকলো,
— তুঁষা’র?
তুষা’রের হাসি মিলে গেলো মুহুর্তেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা বলার জন্য কিছু খুঁজলো। তথ্য ওর আচরণে অবাক হয় কিছুটা। শক্তপোক্ত একজন মানুষ কিভাবে এতটা ভেঙে পরলো? তথ্য জানে তুষা’রের জন্য তোঁষা কি। আগে যখন আলাপ হতো তখন পাঁচ লাইন কথায় তার তিনবার পুতুল’কে মনে হতো। কতটা ভালোবাসে তাও জানে তথ্য। এগিয়ে এসে সাহস জুগিয়ে তুষা’রের হাত ধরলো ও। তুষা’র হয়তো এমনি সময় রেগে যেতো তবে আজ রাগলো না। তার ভীষণ ভাবে মনে হলো একজন দরকার তার হাতটা ধরার জন্য। একজন মানুষ প্রয়োজন মনটাকে তার সম্মুখে মেলে ধরার জন্য। সেই কেউ টা তথ্য হলে মন্দ কি? তুষার দৃষ্টিপাত করলো তথ্য’র দিকে। সুন্দর এক রমণী দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে যার চোখে, মুখে লেপ্টে থাকা ভয়। তুষা’রের জন্য ই সেটা। হাত বাড়িয়ে এই প্রথম তথ্য’র গাল স্পর্শ করে তুষা’র। শিউরে উঠে তথ্য। আতঙ্কিত গলায় ডাকে,
— তুষা’র?
— হু।
— তু…তুমি।
— তথ্য?
____________________________
তোঁষা সেই যে ঘুমালো এখনও উঠে নি। আরহাম ল্যাপটপে আঙুল চালনা করলেও ফাঁকে ফাঁকে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। আজ বাসা থেকেই দুটো কেস হ্যান্ডেল করছে ও। এখন তোঁষা উঠবে না জানা সত্বেও কেন জানি তোঁষা’কে একা ছাড়তে মন চাইলো না। ঘুমন্ত নিষ্পাপ একখানা মুখ। কেমন ফুলাফুলা দেখতে গালগুলো। মনে হয় আকাশের মেঘ যেন এগুলো। কাজের ফাঁকে এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখলো আরহাম। মন ভরে না তার। কিছুতেই না। মন চায় শুধু দেখেই যাক।
হাতের কাজটুকু শেষ করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে আরহাম। বিছানায় বসে হাত রাখে তোঁষা’র কপালে। মেডিসিন এর এফেক্টে অল্প জ্বর চলে এসেছে। উঠলে নিশ্চিত শরীর ও ব্যাথা থাকবে। তখন আরহাম নিজে মলম লাগিয়ে দিবে। যদিও উচিত না তাও ভাবলো একটা পেইন কিলার খায়িয়ে দিবে। তুঁষটা’কে কষ্টে রাখা যাবে না। ঠিক যতটা না দিলেই নয় ততটুকু ব্যাথা তোঁষা’কে সহ্য করতেই হবে। আরহাম কিছুতেই তাকে নিজের থেকে আলাদা করার ফাঁকফোকর রাখবে না কারো জন্য।
গতকাল যখন তোঁষা’র পিঠে ওর মায়ের দেয়া আঘাতগুলো দেখলো তখন আরহামে’র অনুভূতি দি মুখী ছিলো। প্রথমত তার রাগে শরীর কাঁপছিলো। মন চাইছিলো নিজ হাতে একটা প্রাণ কেড়ে নিতে। যে ওর তুঁষে’র নরম দেহে আঘাত হানলো তার দেহ’টাকে ছিন্ন করে দিতে কিন্তু ওর দ্বিতীয় অনুভূতিটা ছিলো ভিন্ন। ভালোবাসা পূর্ণ এক আদুরে অনুভূতি। তোঁষা’টা তাকে ভুলে নি, ছাড়ে নি এতটা বাজে আঘাত পাওয়ার পরেও।
তাই তো আরহাম এতদিন যেই কাজ ধীরে ধীরে করছিলো তা গতকাল ডোজ বাড়িয়ে দিলো। তোঁষা’কে সে নিজের করে রাখবে। তোঁষা’র চিন্তা, ভাবনা সবটা হবে তাকে জুড়ে।
কথাগুলো ভাবতেই আরহাম ঝুঁকে চুমু খেলো তোঁষা’র মুখে। আজ ঘুমের মধ্যে শব্দ করছে তোঁষা। প্রথম ডোজটা শরীরে সইতে সময় নিচ্ছে। আস্তে ধীরে সহ্য হয়ে যাবে। তখন এত কষ্ট হবে না নিশ্চিত। আস্তে করে কাঁথার নিচে ঢুকে আরহাম। তুলে নিলো তার প্রাণ’কে। বুকে শান্তি লাগে তার। কেমন একটা ভালোলাগা কাজ করে। মন চায় বুকটা খুঁড়ে এখানে দাফন করে রাখুক তার প্রাণ’টাকে।
.
টলতে টলতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ঘুমের রেশ যেন এখনও কাটতে চাইছে না। কাউচে ধপ করে বসে মাথা এলিয়ে দিলো তোঁষা। একটু ঘুম দরকার আবারও তবে সেটা আপাতত সম্ভব হলো না। আরহাম এসে টেনে তুললো ওকে। তোঁষা টেনেটুনে চোখ খুলতেই দেখা মিললো আরহামে’র। হাত বাড়িয়ে দেয় তোঁষা ওর প্রাণে’র পানে। আরহাম তোঁষা’র হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বললো,
— তুঁষ? খাবি এখন প্রাণ।
— ঘুম পায় তো।
বলেই গলা জড়িয়ে ধরে আরহামে’র। আরহাম ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। ডোজ বেশি ছিলো সেটা ও জানে তাই বলে তোঁষা’র এতটা ঘুম পাওয়ার তো কথা না। অল্প বিস্তর চিন্তা দেখা দিলো আরহামে’র চেহারায়। তোঁষা ততক্ষণে ওর বুকে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিলো। আরহাম ওকে নিয়ে পা বাড়ালো বাইরে। তোঁষা’র হাতে এক মগ ভর্তি ধোঁয়া উড়া কফি দিয়ে বললো,
— শেষ কর।
— ঘুমাই?
— না।
— খাব না এটা।
— আমি বানিয়েছি তোর জন্য।
তোঁষা মুখ বানালো। আরহামে’র কিছুই সে ফিরিয়ে দিতে পারে না। টেনে চোখ খুলে একপলক দেখে বললো,
— তোমারটা খাব।
আরহাম বিনাবাক্যে মেনে নিলো ওর প্রাণে’র আবদার। নিজের মগে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিয়ে ধরলো তোঁষা’র ঠোঁটে। তোঁষা এক চুমুক দিয়ে ঘাড় দুলালো। ভালো লেগেছে ওর। বাকিটুকু পুরোটা খেলো ও আরহামে’র। আরহাম খাওয়ালো নিজ হাতে। তোঁষা’র ছোট ছোট চুমুক বসিয়ে কফি শেষ সময় লাগলো বটে। ততক্ষণে ওর হাতের কফি ঠান্ডা হয়ে শরবত। তোঁষা জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁটের আশপাশে চেটে বললো,
— আপনার টা তো শেষ।
— হু।
— তাহলে আমারটা খাও।
উচ্ছাসিত গলায় বলে নিজের মগের কফিটা নিজ হাতে খাওয়াতে উদ্ধত হয় তোঁষা। সব সময় গরম ধোঁয়া উড়া কফি খাওয়া আরহাম আজ তৃপ্তি সহকারে চুমুক বসালো ঠান্ডা কফিতে। তার প্রাণে’র হাতের সবকিছুই তার নিকট প্রিয়। এই প্রাণ’টা ই তার প্রিয়।
.
–দুধ ভালো লাগে না আরহাম ভাই।
কথাটা বলেই কাঁথার নিচে মুখ লুকালো তোঁষা। আরহাম একবার গ্লাসটা দেখলো। কিছু মেডিসিন মেশানো এটাতে। তোঁষা’কে খাওয়াতেই হবে। এই মেডিসিন কোর্স কম্পিলিট করতেই হবে। গ্যাপ দেয়া যাবে না।
আরহাম গ্লাসটা সাইডে রেখে কাঁথা সরাতে চাইলো। তোঁষা ছাড়বে না। জোর করেই ঠ্যাটামি করে পরে রইলো। আরহাম কাঁথা টেনে পুরোটা সরিয়ে দিতেই তোঁষা’র দিকে তাকালো। আরহামে’রই ছাই রঙা টিশার্ট’টা ওর পরণে। তোঁষা’র গলায় হাত ছুঁয়ে দিলো আরহাম। কেঁপে উঠল ওর কণ্ঠনালী। চোখ মেলতেই আরহাম বললো,
— খেয়ে নে না তুঁষ।
কি অসহায় আবদার অথচ একটু আগেও মিউ মিউ করে তোঁষা’র কাছে সমর্পণ করেছিলো এই আরহাম ভাই।
তোঁষা অর্ধ চোখ খুলে বললো,
— আগে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
— কর।
— গতকাল কিসের ইনজেকশন ছিলো ওটা? অনেক জ্বলেছিলো। ব্যাথাও ছিলো। এখনও আছে।
আরহাম তোঁষা’র নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। এক হাত ওর চুলের ভাজে গলিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে উত্তর করে,
— তোর কষ্ট লাঘবের দায়িত্ব আমার না প্রাণ? সেটাই পূরণ করছি।
— কষ্ট তো বেশি পেয়েছি। ওটা দেয়াতেই ঘুম পায় আমার।
— ঘুমালে ব্যাথা কমে যাবে। উঠ দুধ শেষ কর।
তোঁষা উঠলো। আরহামে’র কানের কাছে কিছু সময় ঘ্যানঘ্যান করে দুধটুকু শেষ করে ও। তোঁষা বায়না ধরে,
— চলুন না বারান্দায় যাই।
— এখন?
— হু।
তোঁষা’কে বিছানা ছাড়তে হলো না। আরহাম কোলে তুলে হাটা দিলো বড় বারান্দায়। কাপল গোল দোলনাটাতে এই বাইশ তলার উপর থেকে বসে চন্দ্র বিলাস ভিন্ন এক অনুভূতির জোয়ারে ভাসালো দু’জনকে। একসময় তোঁষা নিজেকে দিলো ওর সবচাইতে ভরসার মানুষটার বুকে।
আরহাম এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখে ওর শরীরটা নিজের মাঝে আটকে ধরলো। ফিসফিস করে জানালো,
— তোর অতীত থাকবে না কোন প্রাণ। সব ভুলিয়ে দিব আমি। সব মুছে দিব। অতীতহীনা তুই আমার। তোর বর্তমান হব আমি। ভবিষ্যৎ ও আমি।
#চলবে….