#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৪]
” চা’য়ে চিনি কম কেন আম্মু?”
বিধস্ত একটা মুহূর্তে খুশবুর এমন প্রশ্নে উপস্থিত তিনজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।সকলের প্রশ্নবিদ্ধ চোখ এড়িয়ে সে পুনরায় চায়ে চুমুক দিলো।
” চা’য়ের সাথে যে আমার টোস্ট বিস্কুট লাগে তুমি কি ভুলে গেছো?”
দ্বিতীয় বারের মতো অবাক হলো সকলে।অনিমা হতবিহ্বল হয়ে ছুটে গেলেন বিস্কুট আনতে।খুশবু বাহারুল হকের পানে চেয়ে বলে,
” আব্বু তোমার না খুব তাড়া আছে?দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও তবে।”
মেয়ের আচরণে বাহারুল হক কিছুই বুঝ উঠতে পারলেন না তিনি কি যাবেন নাকি থাকবেন তা নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না।আর দুই-চার না ভেবে তিনি চলে গেলেন নিজ কাজে।অনিমা বিস্কুট নিয়ে আসতে খুশবু বলে,
” আম্মু তুমিও নাস্তা করে নাও।”
আরশাদ বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো।সে ভেবেছিল খুশবু কাঁদবে,উন্মাদ হয়ে যাবে কিন্তু এই মেয়েতো স্বাভাবিক।অনিমার অপ্রস্তুত চাহনি দেখে খুশবু বলে,
” এখন কি আমায় বের করে দেবে?আমি তো তোমার মেয়ে নই।শুনো জন্ম না দিলেও তুমি আমার মা অতীতে যা হয়েছে তা নিয়ে এখন মন কষাকষি করলে আমাদের নিজেদেরি লস।শুধু শুধু সম্পর্কগুলো নষ্ট হবে।”
অনিমা মাথা দুলালেন।কি প্রতিক্রিয়া তিনি করবেন নিজেই ভেবে পাচ্ছে না।যাকে আদর যত্নে এত বছর যাবৎ লালন পালন করেছে সেই এখন তার মেয়ে নয়!বললেই হলো নাকি।
.
ম্যাজমেজে শরীরটা নিয়ে আবার কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো খুশবু।বাইরে থেকে শীতল হাওয়ায় গায়ে কাটা তুলছে।আসমানটা আজ একটু বেশি নীল।
আরশাদ বসলো খুশবুর পাশে ছেলেটা চিন্তায় মূঢ় হয়ে বলে,
” তুমি স্বাভাবিক!”
” হ্যাঁ কেন?”
” আসলে…”
” কি ভেবেছিলে?আমি কেঁদে-কেটে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিব?নাকি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাবো।আমার নিজের বাবা মা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে বুঝতে পারছেন আপনি?আমার ভাগ্য ভালো বলেই আজ এ পর্যায়ে এসেছি যদি তা না হতো হয়তো আমার নিয়তি হতো নীরার মতো।”
আরশাদ খুশবুর পাশে শুয়ে পড়লো।মেয়েটাকে শক্ত করে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখলো নিজের বুকে।এলোপাতাড়ি চুমুতে ছুঁয়ে দিল খুশবুর গাল কপাল।
” এসব নিয়ে ভাববে না।আমি আছি তো?”
” আপনি আছেন বলেই এসব সত্যি সামনে এলো।”
” সত্য আড়াল করে লাভ নেই একদিন না একদিন ছিটকে বেরিয়ে আসবেই।”
” হুম তা ঠিক।”
” শরীর খারাপ লাগছে?”
” মাথাটা ধরে আছে।”
” ঘুম দাও তবে।”
.
বাহারুল হক বাড়ি ফিরলেন দুপুরে।স্ত্রীর মুখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।অনিমা রান্না ঘরে ব্যস্ত।অনেকক্ষণ যাবৎ পায়চারি করে অনিমাকে হাঁক ডাকলেন তিনি।অনিমা কক্ষে ফিরে জানতে চাইলো কেন ডেকেছে? এই প্রশ্নের জবাব বাহারুল হকের কাছে নেই।তিনি কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।শ্বাস টেনে সাহস জুগিয়ে বলেন,
” সত্য প্রকাশে তোমার মতামত কী?”
” আমার মতামত আপনি জেনে কী করবেন?”
” অনিমা তুমি রেগে আছো?”
অনিমা বিছানায় বসলেন।ভেতর থেকে তার সব উজাড় হয়ে গেলেও বাইরে থেকে কেন তিনি কাঁদতে পারছেন না?
” আমি কাঁদতে পারছি না কেন?”
” অনিমা নিয়তি মেনে নাও।”
” আপনি আমাকে কেন জানালেন না?আমি কি ওই নিষ্পাপ শিশুকে ফেলে দিতাম?নাকি অস্বীকৃতি জানাতাম?”
” মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে একবারেও কি তোমার মনে হতো না সে তোমার গর্ভজাত সন্তান নয়।”
” এখন কী মনে হবে না?”
” না হবে না।নিজে সবটুকু দিয়ে খুশবুকে তুমি মানুষ করেছো সে তোমার সন্তান।”
অনিমা চুপ করে রইলেন।সত্য মিথ্যা এখন জেনে কী হবে?খুশবুকে তিনি পর কেউ ভাবতেই পারেন না।খুশবু তার নিজের মেয়ে।দু’হাতের আদর, ভরসা,যত্ন মেখে তিনি খুশবুকে বড় করেছেন।
” অনিমা তুমি আমার অনুরোধ রাখবে?খুশবুর সামনে মন খারাপ করে থেকো না।আমি জানি সত্যটা জানার পর তোমার খারাপ লাগলেও খুশবুর সামনে কখনোই তা প্রকাশ করবে না।সবসময় মাথায় রাখবে খুশবু তোমার মেয়ে।”
” খুশবু আমার মেয়ে সে শুধু আমার মেয়ে।”
.
আরশাদ কি ভেবেছিল?সত্যটা যেনে কি খুশবু থমকে যাবে?নাকি অনিমা সর্বদা খুশবুর প্রতি দূরত্বের দেয়াল তৈরি করবেন?সেই সব ভাবনাই ফিকে পড়ে গেছে।একমাস পর সবাই মাথা থেকে ঝেরে দিল সবটা।সবার জীবনের গতি ফিরলো আগের মতো।তবে খুশবুর মাথায় চলছে ভিন্ন কিছু সে চায় নীরার একটি সুন্দর জীবন হোক।মেয়েটা খুশবুর পরিবারকে নিজের পরিবার ভেবে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিক কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত ঘোর বিরোধিতা করলেন বাহারুল হক এবং আরশাদ।তারা কেউ চায় বা খুশবুর সাথে নীরার কোন সম্পর্ক থাকুক।
জীবনের ছন্দ ভিন্ন ভাবে কাটছে আরশাদের।শুয়ে বসে থাকা ছাড়া তার তেমন কোন কাজ নেই।দেশে এসেছে একমাস হতে চললো খুশবুকে নিয়ে সময়টা নিদারুণ ভালোই কাটছে।আরশাদের মনে হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো সে গ্রাম ঘুরে দেখবে।বাংলাদেশে এলেও তার গ্রাম ঘোরা হয়নি।লীলাভূমির সৌন্দর্যে ঘেরা এই দেশটাকে আরশাদের এখনো তেষ্টা মিটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।আরশাদের গ্রাম ঘোরার এই ইচ্ছের কথা জেনে বাহারুল হক উচ্ছ্বসিত হলেন তিনি জানান গ্রামে তার একজন মামা থাকেন।বৃদ্ধ মামা সেই গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি।আরশাদের খেয়াল রাখতে তার আয়োজনের কোন কমতি হবে না।
বাহারুল হকের দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক আজ সকালে গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয় আরশাদ।শহর থেকে সেই গ্রামে যেতে তিন ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।আরশাদ ভেবেছিল তার গাড়ি নিয়ে যাবে কিন্তু খুশবু বাঁধ সাধলো।আরশাদকে কখনো বাসে ঘুরানো হয়নি,বাসে জার্নির যে অনুভূতি আরশাদ কখনো পায়নি।এই সুযোগটা মিস করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।খুশবুর জোরাজোরিতে আরশাদ বাসে যাওয়ার জন্য রাজি হলো।
গাড়ির গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে আরশাদের।বাকি সময়টা সে কি করে পার করবে ভেবে কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না।খুশবু জানলার পাশে বসে চিপস খেতে ব্যস্ত।তার কোলে চিপস জুস চকলেট আচারের প্যাকেট।একের পর একটা সাবাড় করছে মেয়েটা।জার্নির সময় নাকি তার মুখ না চললে ভালো লাগে না।আরশাদের দিক্র তাকিয়ে সে বলে,
” খাবেন?”
” না তুমি খাও।”
” আমার পছন্দের চিপ্স মিস্টার টুইস্ট।একটা খেয়ে দেখুন অনেক মজা।”
আরশাদ একটা চিপস মুখে তুললো তবে তার ভালোলাগলো নাকি খারাপ লাগলো তা আর বোঝা গেল না ছেলেটার মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টায়নি।
চলে গেল বেশ কিছুটা সময়।লোকাল বাসে সবার হিড়িক দেখে আরশাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।একটি পুরুষ তার পাশে দাঁড়িয়ে নিশব্দে দেদারসে বায়ু দূষণ করছে গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠছে, অপরদিকে ঘামের গন্ধে যাচ্ছে তাই অবস্থা।কিছুক্ষণ বাদে বাদে জ্যামে গাড়ি আটকে আছে।ছেলেটার গরমে সাদা চামড়া কেমন রক্তিম হয়ে উঠছে।
আরশাদের এমন দশায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো খুশবু।
” কিরে বিদেশি গরু দেশের ফিল নেবে?গ্রামের ফিল নেবে?তার আগে লোকাল বাসের ফিল নাও।”
” একদম হাসবে না।আমি উঠতে চেয়েছি বাসে?”
” এই শুনো সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে বাস জ্যাম এগুলাও ফিল করার বিষয়।”
” আমার এত ফিল নিয়ে কাজ নেই শুধু তোমাকে ফিল করলেই চলবে।”
” শুনুন আরশাদ,গ্রামে যাচ্ছেন সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু ঘুরাঘুরি বন্ধ করবেন।সবাই কিন্তু এসব কটু চোখে দেখবে,খারাপ ভাববে।কেউ কেউ আপনাকে লজ্জায় ফেলতে পারে।”
” কেউ খারাপ ভাববে বলে আমি তোমার পিছু থাকবো না?তোমার আশেপাশে থাকবো না? তাহলে বিয়ে করলাম কেন? আমার বউ আমি থাকাবো তাদের কি সমস্যা?”
” সমস্যা হাজার খানেক।এই ধরুন আপনি আমার পাশে বেশি থাকবেন এটা তাদের পছন্দ হবে না।আবার আপনি আমার পাশে কম থাকবেন এটাও তাদের পছন্দ হবে না।”
” তাহলে তাদের পছন্দ হবে কি?”
” তারা সেটা নিজেরাও জানে না।”
” অদ্ভুত!”
” হু আপনার মতো।”
” আমি আবার কী করলাম?”
” আমাকে ভালোবাসলেন।”
আরশাদ প্রত্যুত্ত করার আগে তার পাশে দাঁড়ানো লোকটি আবার বায়ু দূষণ করলো।সহ্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল আরশাদ নাক চেপে খুশবুর কাঁধে মাথা আড়াল করে বসে রইল চুপচাপ।
সময় যত গড়ালো আরশাদের ভালোলাগার মাত্রা বাড়লো।মানুষ জনের চাপাচাপি কমেছে।জ্যামের মাত্রাও আগের তুলনায় অনেক কম গাড়ি ছুটছে তার আপন গতিতে।খুশবু ঘুমিয়ে আছে,তার মাথা লেপ্টে আছে আরশাদের কাঁধে।আরশাদের কাছে এই মুহূর্তটা একটু
বেশি সুন্দর।শুধু সুন্দর নয় ভালোলাগারো।অনেকক্ষণ এক রকম বসে থাকায় ছেলেটার কাঁধে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তবুও একটুও নড়লো না আরশাদ।সে চায়না খুশবুর ঘুম ভাঙুক।
আরশাদ যখন প্রেয়সীর ঘুমন্ত মুখটা আড় চোখে দেখছিল তখনি আচমকা বাসটি ঝাকুনি দিল।আরশাদ কিছু বুঝে উঠার আগে দ্বিতীয়বার ঝাকুনি দিল বাসটি।কাঁচ ভাঙার শব্দে শিউরে ওঠলো তার শরীর।ডানে বামে তাকিয়ে বুঝে উঠার আগে আরশাদের গালে এসে বিঁধলো একটি কাচের টুকরো।একটি বাচ্চা এসে ছিটকে পড়লো আরশাদের ঘাড়ে।আরশাদ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিট থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।ব্যথায় টনটন করে উঠলো তার সমস্ত শরীর।কানের ভেতর কেমন যেন শো শো শব্দ তুলছে।হাতড়ে হাতড়ে খুশবুকে খুঁজতে গিয়ে পেল মেয়েটা সিটের নিচে পড়ে আছে।খুশবুর মাথা ফেটে গলগলে রক্ত ঝরছে।আরশাদ দিশাহীন হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু তার আগে বাসটি তৃতীয়বার ঝাকুনি দিল।লোহার সাথে মাথা লেগে ফেটে গেল আরশাদের মাথা।খুশবুর কাঁচ বিঁধে থাকা হাতটার দিকে তাকিয়ে নিশব্দে দেখে চোখ বুঝলো আরশাদ।
দু’টো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে চোখের পলকে একটি এক্সিডেন ঘটে গেল।রাস্তার মানুষজন ছুটে এলো বাসের কাছে তারা সবাই মিলে যে যাকে পারছে সাহায্য করছে।সময়ের তালে তালে এম্বুলেন্সের সাইরেনে ভারী হয়ে এলো চারপাশ।
চলবে….
আসসালামু আলাইকুম পাঠক।গল্পের ছোট্ট গ্রুপে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ..
🔺গ্রুপ লিংক-https://facebook.com/groups/764407025608497/
🔺আইডির লিংক-https://www.facebook.com/profile.php?id=61555546431041