ফ্লুজি #অনুপ্রভা_মেহেরিন [পর্ব ২৫ ]

0
444

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৫ ]

সেই বাসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের কিছুনা কিছু ক্ষতি হয়েছে।কেউ হাত হারিয়েছে কারো আবার পা ভেঙেছে।বাসে থাকা দুজন ড্রাইভার ঘটনা স্থলে মারা যান।এই মৃত্যুর মিছিলে সবাই তাদের আপজনদের খুঁজতে ব্যস্ত।হসপিটালে সাংবাদিকদের ঢল নেমেছে।তারা সরাসরি সম্প্রচারে ব্যস্ত।দেশবাসী টিভির পর্দায় এই নির্মম দৃশ্য দেখে চোখের পাতা ফেলছেন।এ এক মৃত্যুর মিছিল হাহাকার।

অনিমা টিভিতে ধ্যান বসিয়েছেন আরশাদ কিংবা খুশবু কাউকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।বাহারুল হক নিশ্চিত হলেন আরশাদ খুশবু ভালো নেই তাদের কিছু তো হয়েছে।
আহত এবং নিহতদের যে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে খুশবু এবং আরশাদের খোঁজ নিতে রওনা হয়েছে বাহারুল হক এবং খুশবুর মামা শামীম।
খুশবুর বাবা মনকে যতই জোর দিক তবে তিনি ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছেন দু’কদম গিয়ে বসে পড়লেন রাস্তায়।খুশবুর মামা বাহারুল হকের হাত ধরে টেনে বলেন,

” দুলাভাই সময় নেই অনেকদূর যেতে হবে।”

“আরশাদ,আমার কলিজা ঠিক আছে তো?”

” আল্লাহ’র উপর ভরসা রাখুন আল্লাহ আপনার বুক খালি করবেন না।”

বাহারুল হক উঠে দাঁড়ালেন তাকে এখন ভেঙে পড়লে চলবে না।তাকে তো যেতে হবে অনেকটা দূর।

আরশাদের কপাল ফেটেছে।গালে কাচ বিঁধেছে,হাতে পায়ে কেটে গেছে,বাম হাতের একটি আঙুল ভেঙে গেছে।এই ছাড়া তার আর তেমন কোন সমস্যা নেই।কপালে সেলাই করে অনন্য স্থানে প্রথমিক চিকিৎসা নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো।নার্সরা বারবার বলছিল তাকে বিশ্রাম নিতে কিন্তু সে তো তার ফ্লুজিকে খুঁজে পাচ্ছে না।সে কি করে স্থির থাকবে?
পা খুঁড়ে খুঁড়ে হসপিটালের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটছে আরশাদ।প্রতিটা মানুষের শরীরে রক্ত,মেঝেতে মৃত দেহগুলোকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।লাশের সারিতে একটি ছেলেকে দেখে আরশাদ চিনে ফেললো।এই ছেলেটা তার পাশের সারিতে বসেছিল।দীর্ঘ কয়েকমাস পর সে তার বাড়ি ফিরছে বলে মা’কে ফোন করে মনগোপনে থাকা উচ্ছ্বাস জানালো।ভাগ্যের পরিহাস মায়ের কাছে আর ফেরা হলো না ছেলেটির।মানুষের কোলাহল,এম্বুলেন্সের সাইরেন সবকিছু মিলিয়ে আরশাদের মস্তিষ্ক বার বার থমকে দিচ্ছে।মাথায় ঘুরছে নানান রকম চিন্তা।রক্তাক্ত শরীর টেনে হসপিটালের আনাচে-কানাচে খুশবুকে খুঁজছে সে।কোথাও নেই, কোথাও নেই মেয়েটা।একজন নার্স দ্রুত পায়ে অন্যদিকে যেতে নিলে আরশাদ তার পথ আটকায়,

” এক…একটা মেয়েকে দেখেছেন?ফর্সা নাম খুশবু।”

” এত মানুষের ভিড়ে সঠিক বলা মুশকিল।আপনি প্রতিটা ওয়ার্ডে খুঁজুন।”

” আমি খুঁজে পাচ্ছিনা।”

” তবে লাশের সারিতে খুঁজুন।”

বুকটা কেঁপে উঠলো আরশাদের।লাশের সারিতে খুঁজবে মানে কি?তার ফ্লুজি মারা যাবে?তাকে রেখে চলে যাবে?আরশাদ উন্মাদ হয়ে উঠলো আবারো খুঁজতে শুরু করলো তার ফ্লুজিকে।মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে এলো তার অন্তর, একটি বাচ্চা লাশের সারিতে পড়ে আছে।তার নিথর দেহটি আরশাদের বুক কাঁপিয়ে দেয়।হসপিটালের নিচতলা ছেড়ে দোতলায় আসে সেখানেও একই অবস্থা সব আহত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে।একে একে প্রতিটা কোন,প্রতিটা মানুষকে সে দেখলো নাহ নেই, খুশবু কোথাও নেই।

তখন বাসে আরশাদের জ্ঞান হারালে হসপিটালের বেডে তার জ্ঞান আসে এর মাঝে কি হয়েছে খুশবু কোথায় সে কিচ্ছু জানে না,কিচ্ছু না।

অন্ধকার হয়ে আসে আরশাদের পৃথিবী।কি করবে সে?কার কাছে যাবে?শরীরের সমস্ত ব্যথা খুশবুকে না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে খুব বেশি নয়।চারদিকে দ্বিতীয় বারের মতো দৃষ্টি ঘুরালো সে।কোন উপায়ন্তর না পেয়ে দ্রুত ছুটে গেলো নিচে।আরেকটি এম্বুলেন্সের গাড়ি এসেছে সেখান থেকে একে একে আহত নিহত সবাইকে হসপিটালে আনা হচ্ছে।চাতকপাখির ন্যায় এক কোনায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে আরশাদ।হঠাৎ তার চোখ যায় লাশের সারিতে থাকা একটি মেয়ের দিকে।আরশাদের চিন্তারা স্থির হয়।এই তো তার ফ্লুজি।অবশেষে সে পেয়েছে তার ফ্লুজিকে।আরশাদ ছুটে যায় তার ফ্লুজির কাছে মেয়েটার মাথা কোলে তুলতে শার্টে লেপ্টে যায় তরল রক্ত।মেয়েটি বীভৎস ভাবে আঘাত পেয়েছে।মাথার পেছনটা অনেকটা ফেটে গেছে।গলায় বিঁধে গেছে কাচের টুকরো।মুখের একপাশ কান সহ থেতলে গেছে।

” ফ্লুজি চোখ খুলো।দেখো আমি এসেছি খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?শহরের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা হবে তোমার।আরেকটু ধৈর্য ধরো আরেকটু।”

আরশাদ উন্মাদ হয়ে গেলো।মেয়েটার মাথা ঝাকিয়ে ডাকলো বারংবার।অথচ মেয়েটার কোন সাড়া শব্দ নেই।মেয়েটা নিশ্বাস অবধি নিচ্ছে না।

” কি হলো ফ্লুজি এই ফ্লুজি চোখ খোলো।আমি এখন থেকে তোমার কথা মতো চলবো তুমি যা বলবে তাই হবে শুধু একবার চোখ খুলো ফ্লুজি।”

একটি ছেলে এসে আরশাদের হাত সরিয়ে দেয়।এবং মেয়েটাকে শুইয়ে দেয় মেঝেতে।সেই ছেলেটাও কাঁদছে চোখের জলে গাল ভিজে চিবুক চুইয়ে অশ্রুপাত ঘটছে।আরশাদ রেগে যায় ছেলেটার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

” আমার ফ্লুজিকে আপনি সরিয়ে দিলেন কেন?”

” কে আপনার ফ্লুজি?ও আমার বোন।”

” আপনার বোন মানে?”

” আমার বোন তুবা।”

আরশাদ থমকে যায়।তুবা নামটার সাথে সে ভীষণ ভাবে পরিচিত।আরশার নজর ঘুরায় ভালোভাবে পরখ করে দেখলো মেয়েটির গায়ে একটি হলুদ রঙের জামা।অথচ খুশবু পড়েছে সাদা থ্রিপিস।আরশাদ মেয়েটির গলায় থাকা পেন্ডেন্ট দেখে চমকে যায়।তুবা নামক মেয়েটির সাথে আরশাদের যখন প্রেমের সম্পর্ক থাকে তখন এই পেন্ডেন্ট নিজের পছন্দ মতো কাস্টমাইজ করে আরশাদ বানিয়েছিল।দামি হীরের এই পেন্ডেন্টটি তুবা এখনো গলায় রেখেছে!বিধস্ত এই পরিস্থিতিতে আরশাদের মাথায় আসে সেদিনের কথা খুশবু বারবার তাকে বলেছিল সে ফ্লুজি নয় তবে তো খুশবুর কথাই সত্যি তুবা অন্য আরেকটি মেয়ে।এই পৃথিবীতে একই চেহারার তিনটে মেয়ের!আরশাদ কি কখনো ভেবেছিল তার সাথে এমনটা হবে?

” তুবা আপনার বোন?ওর চিকিৎসা করছেন না কেন?”

আরশাদ নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করলো।মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে কেঁদে উঠলো ছেলেটি,

” আমার বোন আর এই দুনিয়াতে নাই ভাই।আমার বোন আর নাই।”

আরশাদ থমকে গেল।খুশবুকে সে অবিশ্বাস করে না।অন্তত বিয়ের পর খুশবু যতবার বলেছে আরশাদের প্রেমিকা সে নয় আরশাদ তা বিশ্বাস করেছে।তুবার মৃত্যু আরশাদের কষ্ট বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ।তার মনে জমে থাকা প্রশ্নেরা বারবার তাকে আঘাত করে।
হঠাৎ তুবা কেন তার সাথে অযথা ঝগড়ায় লিপ্ত হয়?কেন এই দূরত্ব?তবে সেকি আরশাদকে কোনদিন ভালোবাসেনি?সবটাই তবে ছলনা।

আরশাদ শেষবার তাকালো তুবার পানে।

” আমি তোমায় ভালোবাসি না।ভালোবাসা কি আমি জানি না।তুমি আমায় শিখিয়েছিলে ছলনা।আমার ভালোবাসা আমার কাছে আছে,আমার ভালোবাসার ফ্লুজি আমার কাছে আছে।কিন্তু এই আফসোস তো আমার কখনোই যাবে না তোমার সাথে আমি মুখোমুখি হতে চেয়েছি তবে এভাবে নয় তোমায় মৃত অবস্থায় দেখার ইচ্ছে আমার কখনোই ছিল না।”
.

ব্যস্ত হসপিটালে ক্লান্ত পায়ে আরশাদ বসে যায় এক কোনায়।ছেলেটা কেমন অসহায় নজরে কাঁদছে।পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছে সে কিন্তু সবাই খুশবুর ছবি চাইছে ছবি ছাড়া মুখের বর্ননায় এত মানুষের ভীড়ে কি করে খুঁজে পাবে?আরশাদের ব্যাগ,ফোন কোথায় সে জানে না তাহলে কি করে খুশবুর ছবি সবাইকে দেখাবে?

হসপিটালে এসে উপস্থিত হন বাহারুল হক এবং খুশবুর মামা শামীম। মুহূর্তে আরশাদ বাহারুল হককে দেখতে পায়।জলের স্রোতে ভাসা আরশাদ যেন খড়কুটো খুঁজে পায় এবং আঁকড়ে ধরতে ছুটে যায়।আরশাদকে জীবিত দেখে বাহারুল হক আশ্বস্ত হন।খুশবু কোথায় আছে জানতে চাইলে সেই সম্পর্কে কোন উত্তর দিতে পারেনা ছেলেটা।

হাসপাতালের করুন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে যান বাহারুল হক।শামীম পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং খুশবুর ছবি দেয় তাদের।খুশবুকে খুঁজতে তারা তিনজন তিন দিকে ছড়িয়ে যায়।অবশেষে শামীম খুঁশবুকে পেয়েও যায়।মেয়েটা তিনতলায় একটি বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে।ব্যথায় টনটন করছে তার সমস্ত কায়া।শামীমের নির্দেশ মোতাবেক তিন তলায় এসে উপস্থিত হয় আরশাদ এবং বাহারুল হক।

খুশবুর মাথা ফেটেছে, বাম হাতটা ভেঙে গেছে।বেশ কয়েক জায়গায় পিঠের মাংস উঠে গেছে।গালে গলায় বিঁধেছে কাচ।ঠোঁট ফেটে ফুলে আছে।হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে খুশবুকে।শামীম ডাক্তারদের সাথে কথা বলেন,যত দ্রুত সম্ভব খুশবুকে ভালো একটি হসপিটালে এডমিট করতে হবে।মেয়েটার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দু’টোই ঝুঁকিপূর্ণ।আরশাদের সমস্ত শরীরের কার্যক্রম তখনি থমকে যায় যখন দেখলো তার ফ্লুজি ভালো নেই।মেয়েটার গালে হাত বুলিয়ে আরশাদ কেঁদে ফেলে।
বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে সে বলে,

” আমি ভয় পেয়েছিলাম।আমাকে কেন ভয় দেখালে?”

চলবে….
[ আরশাদের প্রেমিকা অর্থাৎ যাকে আরশাদ ফ্লুজি বলে ডাকতো অবশেষে সেই ফ্লুজিকেও সামনে আনা হলো।]
আসসালামু আলাইকুম পাঠক।গল্পের ছোট্ট গ্রুপে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ..
🔺গ্রুপ লিংক-https://facebook.com/groups/764407025608497/
🔺আইডির লিংক-https://www.facebook.com/profile.php?id=61555546431041

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here