একটি_সাঁঝরঙা_গল্প #তানিয়া_মাহি #পর্ব_০২

0
303

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_০২

দুদিন ধরে নিশোর একটু ভালো ঘুম হচ্ছে। কিছু করার চিন্তা যদিও মাথা থেকে কখনোই যায় না তবুও এখানে একটু শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। ফালাকদের বাড়িতে কখনো আসলেই তার এমন শান্তি শান্তি লাগে। যদিও এটা তার চাচার বাড়ি তবুও আবিরের বন্ধু হিসেবেই বেশি সমাদৃত সে। আবির আর নিশো একসাথে বড় হয়েছে। অন্যান্য চাচাতো ভাই বোনদের মধ্যে ঝগড়া, মা*রামা*রি হলেও নিশো আর আবিরের মাঝে কখনোই এমন ছিল না। নিশো আর আবিবের বাবারা মায়ের পেটের ভাই নয়। তারা সৎভাই। এক বাড়ির দুই বোনকে বিয়ে করেছিল তাদের দাদা। সম্পর্ক একটা থাকলে নিশোর বাবা জাফর সাহেব এবং আবিরের বাবা জাভেদ সাহেবের মাঝে ভেতরে ভেতরে অপছন্দের একটা ব্যাপার আছে। নিশো এ বাড়িতে আসুক সেটা জাফর সাহেব কিছুতেই চান না। কোন একসময় দুই ভাইয়ের ঝগড়া, ফ্যাসাদের জন্য নিশোর দাদা নিজের দুই ছেলের মধ্যে থেকে এক ছেলে অর্থ্যাৎ জাভেদ সাহেবকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেয় যার দরুন নিশো আর তোয়া ব্যতীত এ বাড়ির কারো ও বাড়ির কারো সম্পর্ক নেই।

নিশোকে থাকার জন্য আলাদা দুই কামরার একটা বিল্ডিং দেয়া হয়েছে। দোতলা বিল্ডিংয়ের পাশেই একতলাবিশিষ্ট দুই রুমের একটা ছোট বিল্ডিং। সামনেই বড় একটা বাগান আর মেইনগেইট পর্যন্ত একটা রাস্তা চলে গিয়েছে বাহিরেই মেইন সড়ক। নিশোর রুমের পিছন দিকে একটা দরজা আছে। পাশেই একটা সাদা রঙের জানালা। দরজার বাহিরে শ্যাওলাযুক্ত সিঁড়ি আর একটু সামনেই একটা পুকুর। প্রতি মাসে ফালাক লোক নিয়ে পুকুর এবং পুকুরের আশেপাশে পরিষ্কার করে।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছে নিশোর। গত দুইরাত, একদিন কীভাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে তার কোন হদিস নেই। আজ সকাল ঘুম ভাঙতেই পেছনের সিঁড়িতে এসে বসলো সে। এখান থেকে ও বাসার ছাদ একদম কাছাকাছি। ছাদের সবটা স্পষ্ট দেখা যায়। ছাদের একদম শেষভাগে এলে তবেই এখানে সিঁড়িটা দেখা যায়। চিলেকোঠার দরজা খুলে কাজের মহিলাটি ছাঁদে উঠল। বড় এক বালতি জামাকাপড় রোদে দিচ্ছিল সেটাই আনমনে তাকিয়ে দেখছিল সে। হঠাৎ সামনের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। নিশো উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।

বাহিরে রাবেয়া বেগম দাঁড়িয়ে। উনি জাভেদ সাহেবের সহধর্মিণী। নিশো ঘুম থেকে উঠেছে কি না সেটাই দেখতে এসেছেন ভদ্রমহিলা। পেছনের দিকের দরজা খোলা দেখে তিনি মৃদু হেসে বলে উঠলেন,

“উঠেছিস কখন?”

নিশো পিছনে ফিরে একটা কাঠের পুরোনো চেয়ার এগিয়ে বসতে ইশারা করে বলল,“এই তো মিনিট দশেক আগে। ছত্রিশ ঘণ্টা আমার কীভাবে চলে গেল বুঝতে পারছি না। দুইবার উঁঠে খেয়ে আবার ঘুমিয়ে গেছিলাম। কতদিন ঘুমাই নাই।”

রাবেয়া বেগম চেয়ার টেনে বসলেন।
“আমি একটু বাবার বাড়ি গেছিলাম বলে এভাবে থাকতে পেরেছিস। আজ থেকে তোর সবকিছু আমাদের নিয়মেই করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওই বিল্ডিংয়ে চলে যাবি। নাশতা শেষ করবি। বারোটার দিকে গোসল শেষ করে যোহরের আজান দিলে মসজিদে চলে যাবি। নামাজ শেষ করে সোজা গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আসবি। রাতের খাবার নয়টায়। নামাজ ঠিকমতো পড়বি। আমি আমিনাকে বলব শুকনো কিছু খাবার এখানে দিয়ে যেতে। ”

নিশো পিছনের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে বাহিরে এক দলা থুথু ফেলে বলল,“চাচি, গতকাল পানি দিয়ে কুলকুচি করে ভাত খেয়েছি। ”

“আচ্ছা, ব্রাশ-পেস্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি। ট্যাপ ভালো আছে? পানি আসছে?”
“হ্যাঁ সেটা ঠিক আছে।”
“জামা-কাপড়ের কিছু তো দেখছি না। ”
“এক কাপড়ে জাফর সাহেব বের করে দিয়েছে।”
“বাপের নাম ধরে বলতে লজ্জা লাগে না?”
“লাগে না।”
“শোন, তুই তো আবিরের বাবার কাছে থেকে এমনি টাকা নিবি না, এক কাজ কর। ”
“কী কাজ?”
“ফালাকের চার মাস পর উচ্চমাধ্যমিক৷ ওর সিলেবাস চারমাসে শেষ করে দিতে পারবি না?”

নিশো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“ওকে পড়াতে হবে?”
“হ্যাঁ। কোচিংয়ে এত মানুষের মাঝে মেয়েটা পড়তে পারে না। তুই পড়ালে উপকার হইতো৷ মাসে ভালো একটা টাকা পাবি৷ আমিও দিব।”
“ঠিক আছে।”

রাবেয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অসহায় চোখে নিশোর দিকে তাকিয়ে বললেন,“তোর মতো একটা ভালো ছেলের এত ভালো রেজাল্ট থাকার পরও কেন যে চাকরি হয় না!

নিশো হেসে বলল,“মানি লাগে আম্মা, মানি লাগে।”
______

নিশো দরজা লক করে বাহিরের দিকে আসতেই ফালাকের সাথে দেখা হয়ে যায়। বিকেলবেলা সে প্রতিদিন গাছগুলোর দেখাশোনা করে, পানি দেয়। একপাশে ফলের কিছু গাছ আর তার পাশেই সবজির বাগান তাছাড়া পুরো বাড়ির আনাচে-কানাচে নানানরকম ফুলের গাছ।

প্রতিদিনের মতো আজও গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছিল সে। নিশোকে দেখেই মাথায় ওরনা টেনে নিল৷ মৃদু হেসে সালাম দিল। নিশো সালামের জবাব দিতে দাঁড়িয়ে গেল।

ফালাক মুখে হাসি লেপ্টে বলল,“কেমন আছেন এখন?”
“এ বাড়িতে অদ্ভুত একটা শান্তি আছে। এখানে আসলে খারাপ থাকা যায় না।”

ফালাক হেসে বলল,“কেন খারাপ থাকা যায় না বলুন তো?”
“সেটা জানি না কিন্তু শান্তিতে শ্বাস ফেলা যায়।”
“চারদিকে একটু দেখুন। এই পরিবেশে থাকলে খারাপ থাকা যায়?”

নিশো চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,“তুমি অসাধারণ একটা মেয়ে, ফালাক।”

ফালাক সাগ্রহে তাকালো নিশোর দিকে।
“অসাধারণ কেন?”
“এই যে দু বছরে পুরো বাড়ির অবস্থাই বদলে দিয়েছ। তোমার মতো মেয়ে একটা বাড়িতে থাকলে সবকিছু সুন্দর হবে।”

ফালাক প্রসঙ্গ পাল্টাতে পেয়ারা গাছ দেখিয়ে বলল,“দেখুন কত পেয়ারা! খাবেন? একদম টাটকা পেয়ারা। আমি গাছটা লাগিয়েছিলাম ছোটবেলায়। এখন গাছভর্তি পেয়ারা। ”

নিশো আড়চোখে পেয়ারা গাছের দিকে দেখল৷ তারপর ফালাকের দিকে তাকিয়ে শুধালো,“তুমি কি আগের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছ?”
“হু, বয়স সতেরো বছর এগারো মাস। উচ্চতা পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি।”

নিশো হো হো করে হেসে উঠল। ফালাক মৃদু হেসে নিশোর হাসি দেখছে। এই লোকটা অসম্ভব সুন্দর করে হাসতে পারে। তাকিয়ে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে ফালাকের। সময়টাকে থামিয়ে দিতে মনে চায় তার কিন্তু উপায় নেই। সময় তো থামিয়ে দেওয়ার কোন উপায় নেই।

ফালাককে দাঁড় করিয়ে রেখে নিশো পেয়েরা গাছের দিকে এগুলো। বার কয়েক লাফ দিয়ে তিনটা পেয়ারা পেরে ফালাকের কাছে এসে বলল,

“এই দুইটা রাখো। আমি একটা নিলাম।”

ফালাক চাপা গলায় বলল,“আমাকে দুটো কেন দিলেন?”
“চাচিকে একটা দাও গিয়ে।”
“আচ্ছা। আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?”
“স্টলে। চা খাব।”
“আমি বানিয়ে আনি?”
“বেকারের জন্য বেকার বেকার কষ্ট করতে হবে না। পকেটে দশ টাকা আছে। এক কাপ রঙচা আর একটা রুটি হয়ে যাবে।”
“আমি আমিনা খালাকে দিয়ে কিছু খাবার পাঠিয়ে দিব রাতে। এই এক শার্ট কয়দিন পরে থাকবেন? বাড়ি থেকে নিজের শার্টগুলো আনলেও পারতেন।”
“এটা পরে এসেছি, এটাই অনেক। তুই যা ভেতরে যা।”

‘তুই’ করে বলায় ফালাক তেজে উঠে। ভ্রুযুগোল কুঁচকে বলল,“তুই করে বললেন কেন?”

নিশো কপালে হাত দিয়ে কপাল ঘষতে থাকলো। উপায় দেখে বলল,“ভুল হয়ে গেছে। তোয়াকে তুই করে বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে তাই তোমাকেও বলে ফেলেছি। স্যরি।”

ফালাক পেয়ারা কামড় বসিয়ে বলল,“আমি আবির ভাইয়াকে স্টলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভাইয়ার সাথে মার্কেট গিয়ে দুটো প্যান্ট আর তিন চারটা শার্ট বা টি-শার্ট কিনে নিবেন। একটা কালো, একটা সাদা, একটা অ্যাশ কালার মাস্ট। বাকিগুলো আপনার ইচ্ছে।”

এই মেয়েটাকে নিশো যত দেখে তত অবাক হয়। মেয়েটা এত কম বয়সে কত কিছু বুঝে গিয়েছে। মা দুই বছর অসুস্থ থাকায় পুরো বাড়ির দায়িত্ব সে নিয়েছে। দুই বছরে মেয়েটা বয়সের চেয়েও বেশি পরিপক্ব হয়েছে। সবদিকে নজর তার। তাই বলে বেকার ছেলেটার ওপরও!

নিশো কিছু বলল না। একটা বেকার ছেলে এই সুযোগ পেয়ে আত্মসম্মানের জন্য তালে তাল মিলিয়ে জিনিস নিতেও চাইতে পারে না আবার জিনিসগুলো প্রয়োজনীয় বলে ‘না’ ও করতে পারে না।

চুপচাপ বাহিরে চলে আসলো সে। সোজা গিয়ে স্টলে বসলো। পকেটে হাত দিয়ে দেখল দশ টাকা না তিনটা দশ টাকার নোট আছে। একটা চা আর একটা সিগারেট আরামসে হয়ে যাবে। চাওয়ালাকে বলল,“মামা, একটা সিগারেট আর এক কাপ কড়া রঙ চা দিয়েন তো।”
______

রাত নয়টা। বাড়ির বাহিরে বোনের জন্য অপেক্ষা করছে নিশো। নিজের সার্টিফিকেট এবং কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে এসেছে। বাবার ভয়ে বা বাবার কারণে সে ভেতরে যায়নি। বাহির থেকে ছোটবোনকে কল করে সদর দরজার বাহিরে এসে দেখা করতে বলেছে। কাগজপত্র কোথায় আছে সেটাও বলেছে। মিনিট দশেকের মধ্যে তোয়া বাহিরে এলো। চারপাশ অন্ধকার। আসার সময় বাহিরের বাতি বন্ধ করে এসেছে সে। ভাইয়ের সাথে দেখা করছে এই ঘটনা বাবা দেখলে বা জানলে খুব কথা শোনাবে।

তোয়াকে আসতে দেখে নিশো এগিয়ে এলো। বলল,“কি রে এনেছিস ফাইলটা?”

তোয়া ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে সাথে ছোট একটা বক্স দিয়ে বলল,“এই যে তোর ফাইল আর এটা মা দিল।”
“কী এটা?”
“পায়েস। সেদিন তো কিছু খেতে পারিসনি। মা এটা ফ্রিজে রেখেছিল।”

নিশো ফিচেল হাসলো। বলল,“ছোটবেলায় লবন খাওয়াতে চাইছিল না মা? এখন পায়েস দিচ্ছে কেন?”
“ভাইয়া, তুই তো জানিস মা কেমন পরিস্থিতিতে আছে। তুই বল নতুন শার্ট দেখছি যে! কোথায় আছিস?”

নিশো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“আবিরদের বাড়িতে৷”
“শার্টটা কি আবির ভাইয়া কিনে দিল?”
“হ্যাঁ কিন্তু টাকা হয়তো ফালাক দিয়েছে।”

তোয়া চোখেমুখে বিস্ময় ফুঁটিয়ে বলে উঠল,“কী! ফালাক দিয়েছে?”

নিশো তোয়ার মাথায় চাটি মেরে বলল,“চিল্লাচ্ছিস কেন? এখন যা বাসায় যা। বাহিরে কেউ দেখলে অসুবিধা হয়ে যাবে। কাল বিকেলে ফোন হাতে রাখিস কল দিব।”

তোয়া মাথা নাড়িয়ে বলল,“ঠিক আছে। এবার তোর ভালো একটা কিছু হোক, ভাইয়া।”
“হুম। যা ভেতরে যা। তুই গেলে আমি যাচ্ছি।”

তোয়া মৃদু হেসে ভেতরে চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এসে নিশোর হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলল,“চাকরি পেলে এটা আমাকে ফেরত দিয়ে দিবি। আর ফালাককে বলিস আমার ভাইয়ের খেয়াল রাখতে।”

তোয়া আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। ভাই দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সে ভেতরে চলে গেল। নিশো একা হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎ পকেটের ফোনটা বেজে উঠল। পায়েসের বক্স আর ফাইলটা এক হাতে নিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখল আবির কল দিয়েছে। মুহূর্ত ব্যয় না করে রিসিভ করল কল।

ওপাশ থেকে অবিন্যস্ত গলায় আবির বলে উঠল,“নিশো, তুই কোথায়? তাড়াতাড়ি একটু এ বাসায় আয় তো।”

নিশো উলটো জিজ্ঞেস করল,“কিছু হয়েছে? আমি এক্ষুনি আসছি।”
“প্লিজ তাড়াতাড়ি আয়। হাসপাতালে যেতে হবে।”

কলটা কেটে গেল। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল নিশোর। ও বাড়ির কারো কিছু হলো না তো!

#চলবে……

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। কোনকিছু খারাপ লাগলে, ভুল হলে নিজেরা কঠোর না হয়ে আমাকে বুঝিয়ে বলবেন আমি ঠিক করে নেব।💜

রেসপন্স করবেন সবাই ❤️

পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করুন ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here