#অন্তহীন💜
#পর্ব_১০
#স্নিগ্ধা_আফরিন
খোলা জানালার ফিকে রোদ্দুরে নবিনা কিশোরী কোমল আঁধারে শাড়ির কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগেই মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে গেছেন। হাঁটতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে কুচির ভাঁজে পা আটকে অগোছালো হয়ে যায় শাড়ির কুচি গুলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো সে।
সবাই তৈরি হয়েছে রেদোয়ান চৌধুরীর বন্ধুর মেয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। রেদোয়ান চৌধুরীর কলেজ লাইফের খুব ভালো বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। কতো বার করে নিমন্ত্রণ করে গেলো। না গেলে খুব বাজে দেখাবে বিষয় টা। চৈতি জানে না শাড়ি পড়ে এত সাজগোজ করার কারণ। মিসেস ইয়াসমিন শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন,সাজিয়ে দিয়েছেন টু শব্দটি ও করেনি চৈতি।
শাড়ির কুচি অগোছালো রেখেই বিছানায় বসে পড়লো সে। প্রহন সবে বাইরে থেকে এসেছে।গাল ফুলিয়ে চৈতি কে বিছানায় বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“গাল ফুলিয়ে বসে আছো কেন পিচ্চি?”
কী বলবে চৈতি? শাড়ির কুচি নষ্ট হয়ে গেছে? না কি চুপ চাপ বসে থাকবে?বুঝে উঠতে পারছে না।
চৈতির উত্তর না পেয়ে প্রহন আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে বলো আমাকে?”
“আসলে আমার পায়ের সাথে আটকে শাড়ির কুচি নষ্ট হয়ে গেছে।”মিনেমিনে গলায় উত্তর দিলো চৈতি।
প্রহন মুখ ফুলিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। চৈতির কাছে গিয়ে হাত ধরে টান মেরে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলো।ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে একটা একটা করে শাড়ির কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
চৈতি কে ডাকার জন্য মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের রুমের সামনে আসেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে, খুব যত্ন সহকারে প্রহন কে চৈতির শাড়ির কুচি ঠিক করে দিতে দেখে মুচকি হাসলেন। হাতের মোবাইল টা দিয়ে তাদের আড়ালে ক্যানডিড একটা ছবি তুলে নিলেন।
চৈতির শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো প্রহন। ভালো করে একবার চৈতির দিকে তাকালো।একটা কিছুর অভাব আছে। সেই জিনিস টা থাকলে পরিপূর্ণ হতো চঞ্চলা হরিণীর সাজটা। বিছানার উপর রাখা হলদে রঙের পাঞ্জাবি টা নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেল প্রহন।
মিসেস ইয়াসমিন যথেষ্ট সৌখিন। কোথাও যাওয়ার সময় চৈতি আর প্রহনের জন্য এক রঙা ড্রেস বের করে রাখেন। মিসেস ইয়াসমিন এর এই সব কান্ডে চৈতি বেশ অবাক হয়।
উজ্জল শ্যাম বর্ণের মানুষটাকে হলদে রঙের পাঞ্জাবিতে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। চৈতি আজ প্রথম বার প্রহনের দিকে ভালো করে তাকালো।এক প্রকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে লাগলো তার নিজস্ব মানুষ টাকে।ব্রেন্ডের কালো ঘড়িটা হাতে পড়তে পড়তে প্রহন চৈতিকে বললো,
“এই বাচ্চা,কী দেখছো এমন করে? একবারেই দেখে মুখস্থ করে ফেলবা আমাকে? একটু কমিয়ে দেখো।সারা জীবন এই আমাকে দেখতে দেখতেই না বিরক্ত হয়ে পড়ো। আমি তোমার আছি।সো কমাই দেখো পিচ্চি পেত্নী।”
প্রহনের কথায় খানিক লজ্জা পেলো চৈতি।”আমি তোমার আছি” কথাটায় বুক কেঁপে উঠলো কিশোরী চৈতির।যার কথা জানলো না প্রহন।লজ্জায় মুখ খানি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
চোখ নামিয়ে নিলো।ফ্লোরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
চৈতির লজ্জা মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে নিজে নিজেই প্রহন বলে উঠলো,
“লজ্জার ড্রাম একে বারে। সামান্য কথাতেই এত লজ্জা?বাহ ভালো। কপাল করে লজ্জাময়ী পেলাম একটা।”
ড্রইং রুম থেকে মিসেস ইয়াসমিন প্রহন আর চৈতি কে ডাক দিলেন।ড্রেসিং টেবিলের মোবাইল হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল প্রহন। প্রহনের পিছন পিছন চৈতি ও চললো। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় ঘটলো আরেক বিপত্তি।পা ফসকে পড়ে যেতে গিয়ে প্রহনের কাঁধের উপর শক্ত করে খামচে ধরে।এখনি গড়িয়ে পড়ে অঘটন ঘটে যেতো। ভাগ্যিস প্রহন সামনে ছিল।
পেছনে ফিরে চৈতি কে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“শাড়ি সামলাতে না পারলে পড়তে যাও কেন?”
নিচে থেকে দাঁড়িয়ে মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে করা প্রশ্নের উত্তর দেন।”আমি পড়িয়েছি চৈতি কে।”
“অন্য ড্রেস করালেও পারতে। পিচ্চি মেয়ে এই শাড়ি সামলাতে গিয়ে কতবার হিমশিম খাচ্ছে দেখছো না?”
প্রহনের কথা শুনে চৈতি ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,
“শাড়ি সামলাতে শিখছি।তাই আরো বেশি বেশামাল হয়ে যাচ্ছে।”
মায়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চৈতির দিকে তাকালো প্রহন।”শাড়ি সামলাতে হবে না। অন্য ড্রেস পরে আসো যাও।”
“শাড়ি না সামলাতে পারলে আপনাকে সামলাবো কী করে?
চৈতির এহেন কথায় বাকরুদ্ধ প্রহন। মিসেস ইয়াসমিন আর রেদোয়ান চৌধুরী মুখে হাত দিয়ে মিটি মিটি হাসছেন।
প্রহন আর কিছু বলার মতো পেলো না।চুপ করে চলে গেল। প্রহন কে চুপ করে চলে যেতে দেখে মনে মনে হাসলো চৈতি।যাক চুপ করিয়ে দেওয়া গেল।
.
গাড়ি করে যাওয়ার সময় প্রহনের চোখে পড়ে সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা।যেই জিনিসটার কারনে তার চঞ্চলা হরিণীর সাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতের পাশে অবস্থিত দোকান থেকে তাজা গোলাপ আর বেলি ফুলের গাজরা কিনে পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে আবারো গাড়ির কাছে ফিরে আসে।
চৈতির পাশেই বসে ফেসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রল করছে প্রহন। কৌতূহলী চৈতি হঠাৎ প্রহন কে জিজ্ঞেস করে উঠে,”কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রহন উত্তর দিলো,”আব্বুর বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে।”
চৈতি আর কিছু বললো না।চুপ করে বাইরের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। প্রহন এক পলক চৈতির দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
গন্তব্যে পৌঁছে গেলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় প্রহনরা। মিসেস ইয়াসমিন আর রেদোয়ান চৌধুরীর সঙ্গে চৈতি ও ভেতরে চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে চৈতি কে দাঁড়ানোর জন্য ইশারা করে প্রহন। শান্ত মেয়ের মতো চৈতি ও দাঁড়িয়ে পড়লো। চৈতি কে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বললেন,
“কিরে মা দাঁড়িয়ে পরলি কেন?”
“পিচ্চি আমার সাথে যাবে। তুমি আব্বুর সাথে চলে যাও আম্মু।”
প্রহনের কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন আর দ্বিমত করলেন না।দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলেন।
মিসেস ইয়াসমিন চলে যেতেই প্রহন চৈতির দিকে এগিয়ে আসে।ভ্রু কুঁচকে প্রহনের দিকে তাকিয়ে আছে চৈতি। পকেট থেকে বেলি ফুলের গাজরা টা বের করে নিজের হাতে স্বযত্নে চৈতির চুলের খোঁপায় পড়িয়ে দেয় প্রহন।
চৈতি অবাক হয়ে শুধু প্রহনের কর্ম কান্ড দেখছে।
গাজরা পড়িয়ে দিয়ে চৈতির কাছ থেকে সরে এসে চৈতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“এই আবার পারফেক্ট হয়েছে।”
ডান হাত দিয়ে খোঁপায় গুঁজে দেওয়া ফুল স্পর্শ করে চৈতি। প্রহন চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলে,
“খুব সুন্দর লাগছে পিচ্চি পেত্নী।”
সুন্দর বললো, আবার পেত্নীও বললো?এটা কোন ধরনের প্রশংসার মধ্যে পড়ে বুঝলো না চৈতি।
প্রহন আলগোছে চৈতির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
প্রহনের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো চৈতি। এই প্রথম অন্য কোনো পুরুষ বিনা অনুমতিতে তার হাত ধরার সাহস পেল। চৈতি কিচ্ছু বললো না। কিচ্ছু না!
_____________
বিয়ে বাড়ীতে মানুষের ভিড়।এত এত ছেলে মানুষের ভেতরে দুই হাত দিয়ে চৈতি কে আগলে ভেতরে নিয়ে যায় প্রহন।
বিয়ে বাড়ীর কোনো রুম খালি নেই। রুম গুলোতে মানুষে ভরপুর। রেদোয়ান চৌধুরী উনার বন্ধু আফজাল হোসেনের সাথে আলাপ করতে ব্যস্ত। মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে দেখে এগিয়ে আসলেন। বিয়ের কনে কে দেখতে যাবেন চৈতি কে সাথে নিয়ে।
প্রহন চৈতিকে সাবধানে থাকতে বলে বাবার কাছে এগিয়ে গেল। আফজাল হোসেন কে সালাম দিয়ে কথা বার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
মিসেস ইয়াসমিন চৈতির হাত ধরে বউ দেখতে চলে গেলেন।
এত মানুষের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চৈতির। মানুষের হইচই এ মুখরিত চার পাশ।
কনেকে এখনো সাজানো শেষ হয় নি। রুমের দরজা বন্ধ করে পার্লারের লোকেরা সাজাচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে পুরোনো এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে মিসেস ইয়াসমিন এর। বেশ অনেক দিন পর পুরোনো সখীকে দেখে তার সাথে কথা বলতে থাকেন মিসেস ইয়াসমিন।
চৈতি একা দাঁড়িয়ে ছিল। অচেনা একটা ছেলে চৈতির সামনে এসে দাঁড়াতেই ঘাবড়ে যায় চৈতি। ছেলেটাকে দেখে অল্প বয়সের মনে হলো চৈতির কাছে।১৯ কিংবা ২০ হবে তার বয়স।
ছেলেটা চৈতির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অস্বস্তিতে দম আটকে যাচ্ছে চৈতির।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটা চৈতির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।”
মাকে আর চৈতি কে নাস্তা করার জন্য ডাকতে আসছিল প্রহন। মাঝপথে ছেলেটার বলা কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
চৈতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রহন বলে উঠে,
“উনার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার জন্য উনার হাসব্যান্ড আছে। তোমাকে এত প্রশংসা করতে হবে না ভাই।”
#চলবে,,,,,,