#সুখের_নেশায় পর্ব ২০
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
চুপচাপ,গুমরে মুখো হয়ে সোফায় বসে আছে চৈত্রিকা। মাথা নত তার। চোখে মুখে ভয় ভয় ভাব স্পষ্ট। সাফারাত নিরবতা ভেঙে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলে উঠল,
‘ তাহলে আপনি বিয়ে করবেন না বলছেন?’
চৈত্রিকা মাথা নাড়ালো। নিজের সিদ্ধান্তে অটল,অনঢ় মেয়েটা। সাফারাতের হাত মুঠো হয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে। রাগ উঠলে এই এক অভ্যেস তার। নয়ত রাগ কন্ট্রোল করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। আর একবার রাগ কে প্রশ্রয় দিলে সামনে কে আছে, কাকে আঘাত করছে তার কোনো পরোয়া করবে না সাফারাত। ফাহমিদা কিড়মিড়িয়ে বলে উঠলেন,
‘ কি সমস্যা তোর চৈত্র? সারাজীবন একা থাকবি?লাগবে না তোর আমাদের দেখার। নিজের কথা ভাব। মা হয়ে আর তোদের কষ্ট সহ্য করতে পারব না আমি। এবার আমায় একটু তোদের সুখ দেখে শান্তিতে ম*রতে দে। ‘
মায়ের কথায় চৈত্রিকার চক্ষু ছলছল করে উঠল। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া নিক্ষেপ করল ফাহমিদার মুখের দিকে। বাহিরে ঝড় বইছে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে দিচ্ছে ধরণীর মাটি,মৃত্তিকা। বাতাসের ঝাপটায় বা দিকের খোলা জানালাটা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল। মৃদু চমকে উঠে চৈত্রিকা, মিম, ফাহমিদা। মিম উঠে গিয়ে জানালাটা লাগিয়ে এলো। সাফারাত বদ্ধ সেই জানালার দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফাহমিদার উদ্দশ্যে অতিশয় নম্র কন্ঠে শুধালো,
‘ আমি একটু একা কথা বলতে চাই চৈত্রর সঙ্গে। যদি আপনি অনুমতি দেন! ‘
ফাহমিদা কিছুক্ষণ ভাবলেন। প্রতুত্তরে জানালেন,
‘ ঠিক আছে। ‘
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় প্রায় আধা ঘণ্টা আগে চৈত্রিকাদের বাসায় পৌঁছায় সাফারাত। আচমকা তাকে দেখে ফাহমিদা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই রেশ বেশিক্ষণ টিকতে দেয় নি সাফারাত। ফাহমিদা কে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ছেলেটার অমায়িক সৌন্দর্যে ভরপুর চেহারা,মাদকতাময় কন্ঠ শুনে ফাহমিদার সকল অবাকতা,বিস্ময় যেন নিমিষে দূর হয়ে গেল। সাফারাত কে উনার অসম্ভব ভালো লাগে। এই কয়েকটা দিনে,কয়েক মুহুর্তে উনার মনের অনেকখানি জায়গা কেঁড়ে নিয়েছে সাফারাত। যেকোনো মা -বাবা নিজের মেয়ের জন্য কেয়ারিং ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে চান। সাফারাত যেন চৈত্রিকার জীবনে সেই ব্যক্তি। তবে!তাহাফের পরিবারের তাড়াহুড়ায় উনার সাফারাতকে মেয়ের জামাই হিসেবে কল্পনা করা থেমে যায়। চৈত্রিকার বিয়ের কথা তো তাহাফের সাথে পাকা হয়ে আছে। তাছাড়া উনি ভেবেছিলেন সাফারাত ও চৈত্রিকার মাঝে কিছু আছে। বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি। কিন্তু চৈত্রিকা যখন আজ বিয়ের কথা শুনে কোনো প্রকার রিয়েক্ট অথবা নাকচ করেন নি তখন সাফারাতের ব্যাপারে সকল চিন্তা ভাবনা ভেঙে যায় তাসের ঘরের ন্যায়।
চৈত্রিকা ও মিম দু’জনেই রুমে ছিল। ফাহমিদার ডাকে বেরিয়ে আসে। চোখের সামনে সাফারাতের ভেজা চুল, উশখুশ ,অস্থিরতা,রক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয় দেখে চৈত্রিকার অভ্যন্তর বেসামাল হয়ে পড়ে। হার্টবিট বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। মিমের দিকে ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে তাকায় চৈত্রিকা। মিম কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সাফারাতকে দেখেই দিব্যি বুঝা যাচ্ছে উম্মাদের মতোন ছুটে এসেছে এখানে ঝড়,বৃষ্টি অবজ্ঞা করে। চৈত্রিকা উল্টো ঘুরে রুমে চলে এলো শব্দহীন। হাতে তোয়ালে তুলে নিয়ে পুনরায় বেরিয়ে আসে। লাজলজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে সাফারাতের দিকে তোয়ালেটা বাড়িয়ে দেয়। বলিষ্ঠ হাতে তোয়ালে টা আঁকড়ে ধরে নিয়ে মাথা মুছে সাফারাত। তৎপরে ফাহমিদার সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘ আপনি বোধহয় অবাক হচ্ছেন আন্টি এই বৃষ্টিময় অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনে আমি কেন আপনাদের বাসায় এভাবে ছুটে এলাম? ‘
ফাহমিদা অবাক হলেও মুখে হাসি এনে বললেন,
‘ কিছুটা হয়েছি বটে। ‘
সাফারাত ফাহমিদার হাসিতে যেন তৃপ্তি খুঁজে পেল। কতকাল মায়ের হাসিটা দেখা হয় না। সেই সুন্দর নারীর মুগ্ধ হাসির দেখা মিলে না বছরের পর বছর। বহুকাল। সাবলীল কন্ঠে বললো,
‘ আমি চৈত্রকে বিয়ে করতে চাই আন্টি এবং তা এখুনি। ‘
নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল পুরো কক্ষ। বাহিরে ঝড়ের তান্ডব চলছে। বিস্তর নীল গগণ বুঝি চৈত্রিকার মাথায় ভেঙে পড়ল। হাসি ফুটে উঠল কেবল মিমের অধর কোণে। বিস্ময়ের চেয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে চৈত্রিকা। বিনা সংকোচে কাঠ কাঠ কথা বলা সাফারাতের চরিত্রের সাথে, ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই হলেও চৈত্রিকার যে লজ্জা অনুভূত হয়। তীব্র লজ্জা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে এবং সাফারাতের নির্লজ্জ, নির্লিপ্তভাবে চৈত্রিকার হাত চাওয়া প্রমাণ করে দেয় ওদের মাঝের গভীরতা, ভালোবাসা। তবে সাফারাতকে একটু বেশরম, রগচটা, গম্ভীর মনে হয়েছে ফাহমিদার। বিয়ের প্রস্তাব দিল না-কি আদেশ করল তা বুঝা মুশকিল।
‘ কিন্তু একটু পরেই তো তাহাফের সাথে চৈত্রর আকদ। ‘
‘ ক্যান্সেল করে দিন। ‘
থতমত খেয়ে গেলেন ফাহমিদা। সাফারাতের কি নিরলস ভঙ্গিমা!বললেই কি ক্যান্সেল করা যায়?এই ছেলের কি একটু লজ্জা,জড়তাও নেই? ফাহমিদা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন চৈত্রিকার যদি সাফারাতকে পছন্দ হয় তাহলে তিনি মেয়ের সুখটাই দেখবেন। মুখে বললেন,
‘ একটু পরেই উনারা চলে আসবেন। আমি কি বলব সাফারাত? ‘
সাফারাত চৈত্রিকার দিকে এক পলক চাইল। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিল চৈত্রিকা। সাফারাত সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
‘ বলবেন আপনার মেয়ের জামাই আমি। আমার বউ জোর করে কেঁড়ে নেওয়ার সাধ্য কি কারো আছে? ‘
চৈত্রিকার মাথা ঘুরছে রীতিমতো। মিম মুখে হাত চেপে হাসছে মিটিমিটি। সাফারাতের মতো দুলাভাই তো চেয়েছিল ও। স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে। চৈত্রিকা আজ সাফারাত কে নতুন করে আবিষ্কার করল। চিনল। রহস্যময়, গম্ভীর মানুষের ঠোঁট কাটা স্বভাবও আছে!এই নব্য রূপ বিস্ময়ের পাহাড় গড়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু চৈত্রিকা যে মনে মনে অন্য এক সিদ্ধান্ত স্থির করে নিয়েছে। লাজ উচ্ছনে দিয়ে শক্ত গলায় বললো,
‘ আমি এখন বিয়ের বিষয়ে ভাবতে চাই না। তাহাফকেও বিয়ে করতে চাই না আম্মু। আমি তোমাদের এভাবে ফেলে কোথাও যেতে পারব না। ‘
দায়িত্ব!হ্যাঁ এই দায়িত্ব নামক শব্দটাই চৈত্রিকার মনের মানুষের সাথে এক হওয়ার পথে বাঁধা, অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাইলেও চৈত্রিকা এড়িয়ে যেতে পারবে না। পারবে না কয়েকদিন আগে স্বামী হারানো ফাহিমদা,পিতৃহারা মিমকে ফেলে অন্যের ঘর আলোকিত করতে। সংসার নামক বেড়াজালে বন্দী হতে। তাহাফের পরিবারকেও ফিরিয়ে দিত আজ। যেমন করে ফিরিয়ে দিচ্ছে সাফারাতকে। তবে আজীবনের জন্য না। কিছু টা সময়ের প্রয়োজন দু’জন সদস্যের পরিবারটা সামলাতে, বাবার দায়িত্ব টা পালন করার নিমিত্তে। সাফারাতকে প্রাণপণে চায়। কিন্তু এখন না। কথাগুলো মনে না রেখে সকলের সম্মুখে ব্যক্ত করে চৈত্রিকা। ফাহমিদা মেয়ের কথা শুনে অন্তরে শীতল স্রোত অনুভব করলেন। মুহুর্তেই শৈশব হতে প্রতিনিয়ত ধুকে ধুকে বড় হওয়া চৈত্রিকার সুখের কথা ভেবে কঠোর হলেন তিনি। সাফারাত একবারও দৃষ্টি মেলে নি চৈত্রিকার পানে। উল্টো ঘুরে সোফায় গিয়ে বসে।
____________
চৈত্রিকার সারা রুমে চোখ বুলিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল সাফারাত। টব থেকে শুকনো জারবেরার পাপড়ি হাতে নিয়ে মুঠো পুড়ে নিল। চৈত্রিকা আশ্চর্যান্বিত হলো ব্যাপক। মাথায় ধরে না সবাই তার রুমে এসে কেন এই ফুলগুলোর দিকেই নজর ফেলে!সাফারাত প্রগাঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে চৈত্রিকার দিকে। চেয়ার ছেড়ে দূরত্বে জানালার ধার ঘেঁষে থাকা চৈত্রিকার কাছাকাছি এলো। চৈত্রিকা ভড়কালো। এক পা এক পা করে মিশে গেল দেয়ালের সাথে। সাফারাত সবটুকু দূরত্ব নিঃশেষ করে খুব কাছাকাছি এলো। অতিশয় নিকট। অল্প অল্প কম্পনরত গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে চোখ রেখে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,
‘ বিয়ে আপনাকে বসতেই হবে চৈত্র। আজকেই। ‘
‘ আপনি তো অবুঝ না। আমার পরিবারকে বিপদে রেখে, এই পরিস্থিতিতে ফেলে আমি নিজের চিন্তা করতে পারব না। ‘
চৈত্রিকার কন্ঠনালি কাঁপছে। সাফারাত দেয়ালের একপাশে হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে পড়ল। তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে চৈত্রিকার সারা মুখশ্রীতে। চৈত্রিকার ইচ্ছে করছে সাফারাতের জ্যাকেট আঁকড়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিতে। কি এক অসভ্য,বেহায়া ইচ্ছে জাগল!বাঁধ ভাঙা লাগামহীন স্পৃহা।
‘ তো আপনি কবে বিয়ের কথা ভাবছেন?আমি বুড়ো হয়ে যাবার পর?’
সাফারাত কি ঠেস মেরে কথা বললো?মাথা দু’দিকে নাড়াল চৈত্রিকা। মুখে আওড়ালো,
‘ আমার একটা জব হোক তারপর,,’
কথাটা কটাক্ষ করে সাফারাত বিরক্ত গলায় বলে উঠল,
‘ আপনি কাল সকালেই আমার অফিসে যাবেন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। আপনার ফ্যামিলি মানে আমার আপনজন। আমি তাদের দায়িত্ব নিতে পারি অনায়াসে। আপনি হয়ত এটা পছন্দ করছেন না। নো প্রবলেম। আপনি জব করবেন। তবে বিয়েটা আজই হবে। ‘
‘ আপনি কি আমার উপর করুণা করতে চাইছেন?’
দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল সাফারাতের ভেতর। এক টানে চৈত্রিকার কোমর জরিয়ে কাছে টেনে নিল। রোষপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লহু স্বরে বললো,
‘ ফারদার এমন কথা মুখ দিয়েও আনবেন না চৈত্র। আপনার যোগ্যতা ছাড়া কোনো জব দেওয়া হবে না। ইন্টারভিউতে সিলেক্ট হলেই জব পাবেন। এক মাস সময় দিলাম আমি আপনাকে। জবের চেষ্টা করবেন,পরিবারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবেন। আর এই এক মাসের মাঝে যদি কোনোভাবেই দু’জন কাছাকাছি চলে আসি তাহলে আই সোয়ের একদম উঠিয়ে নিয়ে যাব আপনাকে। ‘
চৈত্রিকা মৃদু কেঁপে উঠল। আঁখিপল্লব নেড়ে চক্ষু মেলে তাকালো সাফারাতের রাগান্বিত চেহারায়। আর একটা শব্দও উচ্চারণের সাহস জোগাতে ব্যর্থ হলো। সাফারাত মুখ এগিয়ে নরম,কোমল কপোলে গাল ঘষে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে নেয়। কোমরের বাঁধন ঢিলে করে আদেশের সুরে বলে,
‘ ঘোমটা টেনে বাহিরে আসুন। দিহান কাজী নিয়ে আসছে। ‘
#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)