অন্তহীন💜 #পর্ব_২৯ #স্নিগ্ধা_আফরিন

0
412

#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৯
#স্নিগ্ধা_আফরিন

গগনে বসবাস রত রজনীকান্ত বিভাসিত কিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে ধরিত্রীতে। চাকচিক্যে ভর পুর নগরীর আনাচে কানাচে। পূর্ণিমা তিথি যে।লক্ষ লক্ষ তারার মেলা বসেছে অম্বরে। মিটিমিটি জ্বলছে তারা। চাঁদের গা ঘেঁষে ও আছে তারারা। শূন্য গগন আজ যেন চাঁদ তারায় সেজেছে।রাত্রির প্রগাঢ় তিমির রুপ ঘুঁচে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে থালার মত চাঁদ। স্নিগ্ধময় রশ্নি এসে পড়েছে উঠোনের ডান দিকে।বা দিকে গাছ থাকায় সে দিক আঁধারে ছেয়ে আছে। সুন্দর একটা সময়ে রুমে বসে বিরক্ত হচ্ছিল চৈতি।জুনাইদার রান্না বান্না মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসলো। সাদিক কত করে বললো,”বনু চল আমরা সবাই ছাদে গিয়ে বসি।উঠানে ঠিক ভালো লাগছে না।”
কে শুনে কার কথা। চৈতি তো শুনবেই না। সবাইকে নিয়ে উঠোনে পাটি বিছিয়েই বসে গল্প করবে এবং চাঁদের আলোয় ঝাল ঝাল মুড়ি মাখা খাবে। চৈতির আবদারে সায় দিল সবাই। শুধু সাদিক বাদে। চৈতির এক রোখা জেদের কাছে জিম্মি হয়ে অবশেষে সাদিক নিজেও রাজি হয়ে যায়।
শুধু শুধু বসে থাকলে তো কোনো মজাই হবে না।তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় গানের কলি খেলবে। জুনাইদা আর মিসেস ইয়াসমিন বসা থেকে উঠে যেতে যেতে বললেন,”তোরা খেল বাবা। আমরা এই সব গান টান পারি না। আমরা বরং রাতের রান্না টা শেষ করি।”
জুনাইদা আর মিসেস ইয়াসমিন কে বাঁধা দিলো না কেউ। সেখানে উপস্থিত ছিল শুধু, চৈতি,রুপা,সিফা, সজিব,সাদিক।তারা নিজেদের মধ্যে খেলা শুরু করতে যাবে এমন সময় বাড়ির গেট খোলার শব্দ পেয়ে সবার দৃষ্টি সে দিকে চলে যায়। প্রহন এসেছে। চৈতি কে দেখেই এক গাল হেসে এগিয়ে এলো প্রহন। নিচে মাটিতে বিছানো পাটির দিকে তাকিয়ে বললো,”কী করছো তোমরা এখানে?”
চৈতি কোলের উপর রাখা কুশন জড়িয়ে ধরে প্রহনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”গানের কলি খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। খেলবেন আমাদের সাথে?”প্রহন কোনো উত্তর না দিয়ে চৈতির পাশের খালি জায়গায় বসে পড়লো। ছোট করে বললো,”শুরু করো।”
চৈতি মুচকি হেসে বোতল ঘুরায়। বোতলের মুখ যার দিকে যাবে সে আগে গান গাইবে এবং পরের বার যার দিকে যাবে তাকে প্রথম জনের গাওয়া গানের শেষ অক্ষর দিয়ে গাইতে হবে। খেলার নিয়ম মাফিক বোতলের মুখ গিয়ে থামলো সিফার দিকে।
সিফার উদ্দেশ্যে চৈতি বললো,”ছোট ভাবী তোমার দিকে থেমেছে আগে। তাহলে তো তুমি আগে গাইবে তাই না।শুরু করো।”
সবার সামনে গান গাইতে সিফার একটু লজ্জা করছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে গাইলো,”আমারো পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই,তুমি তাই গো,,,
আমারো পরানো যাহা চায়।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই কিছু নাই গো,, আমারো পরানো যাহা চায়।”
থামলো সিফা।হাত তালি দিয়ে উঠলো সবাই।
সাদিক মুচকি হেসে বললো,”বাহ সুন্দর গেয়েছো তো সিফা।”স্বামীর প্রশংসা শুনে লাজুক হাসে সিফা। চৈতি ফের বোতল ঘুরায়।বোতলের মুখ গিয়ে থামে রুপার দিকে। রুপা আমতা আমতা করে বললো,”য় দিয়ে তো কোনো গান পারি না।”
চৈতি দ্বিমত করে বললো,”য় দিয়ে কেন?আ দিয়ে গাও।”
রুপা চৈতির কথা অনুযায়ী আ দিয়ে গাইলো,”আমাদের গল্প গুলো অল্প সময় ঘর পাতালো।
তারপর পথ হারালো তোমায় আমায় মিলে।
আগে যদি বুঝতো তারা মনের নদীর তল পাবে না, বেহায়া মুখ পুড়াতো অন্য কোথাও গিয়ে।”
“তোমার দুইজন একই। অদ্ভুত তো!শুরু করলা আ দিয়ে শেষ ও করলা য় দিয়ে।”চৈতির কথা শুনে হেসে ফেললো সবাই। রুপা ধীর কন্ঠে বললো,”এখন কোনো গানই মনে পড়ছে না।এমনিতেই সারাদিন এটা ওটা ঠিক মনে পড়ে।”
চৈতি আবারো বোতল ঘুরালো। এই বার থামলো প্রহন এর দিকে মুখ করে। চৈতি ওরেহএএ বলে উঠে। প্রহন দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে বলে,”শুধু শুধু এমন চিৎকার দেওয়ার কী আছে?”
চৈতি খুশিতে গদগদ করে বলে,”কত কিছু আছে জানেন আপনি? আপনার গান শুনতে পাবো। এই প্রথম আহা।”
প্রহন বিড়বিড় করে বললো,”কাকের গলার কা কা নামক গান শুনতে চাও বললেই পারতে। অনেক আগেই শুনাতাম।”
চৈতি চোখ পাকিয়ে ধমকের স্বরে বললো বললো,”এখন জলদি গান তো।সময় চলে যাচ্ছে।”
প্রহন চৈতির দিকে ফিরে বসলো।নেত্র পল্লব চৈতির মুখোশ্রীর দিকে তাক করে চেয়ে রইলো।কী অদ্ভুত মায়াময়ী লাগছে তার কিশোরী বউকে। চাঁদের মোহনীয় আলোয় আরো বেশি মোহনীয় লাগছে যেন। তার সামনে হাসি মুখে বসে থাকা প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে প্রেমাসক্ত প্রেমিক সুরালো গলায় গেয়ে উঠে,”Mere aakhon mein nazar teri hai..
Meri sham o seher teri hai.
To jo nehi toh main kahan..
Khil gai meri kismat
Paake teri yeh chaht
Hum pe meherbaan do jahan..
প্রহনের গানের এইটুকু শেষ হতেই চৈতি গেয়ে উঠে,
Shukran Allah wallahalam dulillah
অবাক হয়ে যায় সবাই। প্রহন হেসে ফেললে বাকিরাও খিলখিল করে হেসে উঠে। চৈতি লজ্জা পেয়ে যায়।
“খেলবো না আমি আর।”কথা টা বলে সেখান থেকে উঠে রুমে চলে যায় চৈতি।
প্রহন ও উঠতে গেলে রুপা বলে উঠে,”যান ননদাই সাহেব। আমার ননদিকে আরো কয়েক গুণ লজ্জায় ফেলতে যান।”রুপার কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসে সিফা।সাথে সজীব,সাদিক ও।

সেদিন রাতে এশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরেন রেদোয়ান চৌধুরী এবং সরদার সাহেব। দুপুর থেকেই শরীর টা খারাপ লাগছিল সরদার সাহেবের। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে শরীরের সব খারাপ লাগা হজম করছেন তিনি। বসার ঘরের সোফায় বসে বসে রেদোয়ান চৌধুরীর সঙ্গে টুকিটাকি কথা বলার মাঝখানে রেদোয়ান চৌধুরী বলে উঠলেন,”ভাই আপনি বই পড়েন তো?”
সরদার সাহেব কথা বলছিলেন প্রহন আর চৈতি কে নিয়ে।যে তাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হয়েছে কিনা সে বিষয়ে। তার মধ্যে হঠাৎ বইয়ের কথা বলায় কিঞ্চিত বিরক্ত হলেন সরদার সাহেব।কিয়ৎক্ষন রেদোয়ান চৌধুরীর মুখোশ্রীর দিকে চেয়ে থেকে বললেন,”বেয়াই সাহেব আমি আপনাকে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করছিলাম।”
রেদোয়ান চৌধুরী নরেচরে বসে বললেন,”আসলে হলো কী,”রেদোয়ান চৌধুরীর কথা সম্পূর্ণ না করতেই মিসেস ইয়াসমিন বললেন,”আসলে,নকলে কিচ্ছু না। বিষয় টা হচ্ছে কী ভাই, আপনার ভাইয়ের এখন একটু বই পড়তে হবে। না হলে খাবার খাবে যে ঐ গুলো হজম হবে না।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে মৃদু হাসলেন সরদার সাহেব। রেদোয়ান চৌধুরীর কাঁধে হাত রেখে বললেন,”যান ভাই। আপনি বরং বই পড়ুন।”
“এই বই গুলো আমার জীবন টা বরবাদ করে দিলো।”বিড় বিড় করতে করতে জুনাইদার কাছে চলে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন। রেদোয়ান চৌধুরী ও সুযোগ পেয়েছেন বই পড়ার। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য চলে গেলেন রুমে।আসার সময় যত গুলো বই নিয়ে এসেছেন সে গুলো পড়ে শেষ করতে হবে তো। না হলে যে বই গুলো তাকে দারুন লজ্জা দিবে।বই পড়ুয়া হয়ে বইয়ের দেওয়া লজ্জা সহ্য করা কষ্ট দায়ক বটে।
.
খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে। রুপা আর সিফা সব কিছু গুছিয়ে তারাও রুমে চলে গেল। লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকা সরদার বাড়ী অল্প সময়ের মধ্যেই অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে রাত্রি তখন ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট।গ্রাম্য এলাকা। মধ্যে রাতে দূর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে।এক দল কুকুর ও ডেকে উঠলো।ঝি ঝি পোকার ডাক। গভীর রাতে এই সব ডাকে ভয় পাবে না এমন মানুষ হাতে গোনা কয়েকজন। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই ঘুম ভেঙ্গে যায় চৈতির। কুকুর শিয়ালের ডাক কানে যেতেই সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দেখলো, প্রহন ঘুমিয়ে আছে।যাকে বলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চৈতির ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু উঠে যেতেও সাহসে কুলাচ্ছে না। এই দিকে প্রহনের এমন সুন্দর ঘুম টাও ভাঙ্গতে মন চাইছে না।কী জ্বালা! এইদিকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, কোনো কিছু তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।মাঝ রাতে ঘুম ভাঙলেই কেন সব ভূতুড়ে কাহিনী মাথায় আসে বুঝে না চৈতি। বাড়ির পেছনের বাঁশ ঝাড় থেকে হুতুম পেঁচার ডাক শুনে ভয়ে প্রহন কে পেছন থেকে খামচে ধরে। ঘুমের ঘোরেই প্রহন জিজ্ঞেস করলো,”কী হয়েছে চৈতি? ঘুমাচ্ছো না কেন?”
চৈতি আরেকটু জোরে ধরে বললো,”ভূত।”
ঘুমের মধ্যে হাসে প্রহন। চৈতির দিকে ফিরে চৈতি কে জড়িয়ে ধরে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,”ভূত বলতে কিছু হয় না বুঝছো। জ্বীন বলতে হয়। এখন ঘুমাও।”
চৈতি মনে মনে প্রহন কে বকা দিলো।বকতে বকতে বললো,”ভূতের ভয় দূর করতে গিয়ে আসল জ্বীনের ভয় এনে দিলো।খাটাশ একটা।”

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here