গল্পের নামঃ #বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ৮ঃ #ভুল
লেখিকাঃ #Lucky_Nova
“মিহি আমার গার্লফ্রেন্ড।” প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সহজ গলায় উওর দিল এরোন।
মিহির বাবার মেজাজ উচ্চমাত্রার বিঘড়ে গেল।
“ওর বিয়ে অন্য কারো সাথে আমি হতে দেব না। নেভার।”
ছেলেটার সাহস দেখে আরো একধাপ অবাক হলেন উনি।
এরোন আরো বলল,”ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি ওকে বিয়ে দিতে পারেন না।”
মিহির বাবা রক্তবর্ন চোখে এরোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তিনি এমনিই কাল রাতের ঘটানাটা এখনো হজম করে উঠতে পারেন নি। কারণ অত রাতে তার ছোটো মেয়ে কোনো যুবক ছেলেকে তার শোবার ঘরে ঢুকাতে পারে এটা তিনি সত্যিই আশা করেন নি।
মেয়েদের ত ভালোভাবেই মানুষ করতে চেয়েছিলেন তিনি। এমন উদ্ধতস্বভাব হলো কিভাবে সারারাত সেটাই ভেবে পান নি তিনি। কাউকে কিছু বলেনও নি পর্যন্ত।
কাজের মেয়ে বুলু একটু দূরে ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। সে বেশ বুঝতে পারছে যে আজ বড়সড় গন্ডগোল লেগে যাবে। আবার সেই পুরানো অশান্তি।
এদিকে এমন একটা মূহুর্তে মিহির মা বা কাকি কেউই বাসায় নেই। তারা বাজারে গেছে সকাল সকাল। আর মিহি নিজের রুমে এখনো ঘুমাচ্ছে।
ভোর থেকে এমনিও মিহির বাবার মেজাজ চড়াও ছিল। এর মধ্যে সকাল সকাল এই ছেলে এসে হাজির।
সদর দরজা খোলা থাকায় সে সরাসরি ভিতরে ঢুকে গেছে।
মিহির বাবা সোফায় বসে শক্ত মুখ করে কিছু চিন্তা করছিলো। তখনি এই ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
দুইপা সামান্য ফাঁকা রেখে আর দুইহাত পিছনে একত্রে ধরে গম্ভীর মুখভাবের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে মিহির বাবা কিঞ্চিৎ হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। তার বোধগম্য হতে কিছু সময় লেগে গিয়েছিল যে গত রাতে আবছা অন্ধকারে তার মেয়ের ঘর থেকে এই ছেলেটিই বের হয়েছিলো।
তবে বোধগম্য হতেই তিনি ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কঠর গলায় বললেন, “বের হয়ে যাও এখনি। বের হও। দ্বিতীয় বার এই বাড়ির চৌকাঠ পেরোবে না।”
এরোন ভ্রু সংকুচিত করলো। তার বুঝতে আর বাকি রইলো না যে এই লোক কিছু হলেও জানে। নাহলে প্রথম দেখাতেই বের হতে বলবে কেনো! তাহলে কি ওর আর মিহির সম্পর্ক মেনে না নিয়ে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছে মিহিকে!
এরোন বিয়ের ব্যাপারটা জানতো না। সকালেই মিহির মা আর কাকি বাজারে বের হবার পথে মিহির বিয়ে নিয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলো। পথের কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় কথাগুলো এরোনের কর্ণগোচর হয়েছিলো।
তার উপর আর আজ নাকি আশীর্বাদ।
এসব শুনে প্রথমে ত এরোন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। কারণ গতকাল মিহি ত কিছুই বলেনি এ বিষয়ে। এসবের কি মানে কি হতে পারে সেটা ভেবেই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল এরোন।
তবে সেই বিস্ময় নিমিষেই ক্ষোভে পরিনত হতেই সে সাত পাঁচ না ভেবেই মিহির বাড়িতে পা রাখলো।
আর পা রাখতেই মিহির বাবাকে সামনে পেলো।
আর মিহির বাবা ওকে দেখেই বের হতে যাওয়ার কথাটা বলল।
তাই এরোনও সহজ গলায় বলল,”আপনি চেনেন আমাকে?”
ফলে লোকটার রাগ আরো বেড়ে গেলো। সে বজ্র কন্ঠে বলে উঠল, “বের হয়ে যেতে বলেছি না!”
এরোন নিশ্চিত হলো যে এই লোক মিহির আর ওর সম্পর্ক সমন্ধে অবগত।
তাই এরোন ভনিতা না করে সরাসরি আসল কথাই বলল।
“মিহি আমাকে বিয়ে করতে চায় আর আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। তারপরেও আপনি কেন এমন করছেন?”
“তোমার সাহস ত কম না!” রেগে গেলেন মিহির বাবা।
এরোন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”আমি তর্ক করতে আসিনি। এটাই বলতে এসেছি যে এই বিয়েটা হবে না।”
“তুমি বলার কে?” গর্জে উঠলেন মিহির বাবা।
অতঃপর এরোন গরগর করে বলা শুরু করে দিল যে মিহি ওর গার্লফ্রেন্ড। আর অন্যকারো সাথে ওর বিয়ে সে হতে দেবে না।
এটা শুনে মিহির বাবা কয়েক সেকেন্ড রক্তবর্ণ চোখে থম মেরে তাকিয়ে থাকার পর চড়া আওয়াজে বলে উঠলেন, “তোমার মত ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব না। মিহি আমার কথাই শুনবে। আর দরকার হলে আমার মেয়েকে আমি আটকে রাখবো। তাও তোমার মত ছেলের হাতে দেব না।”
“কেনো? কি দোষ করেছি আমি?” ভ্রুকুচকে কথার পিঠে প্রশ্ন করলো এরোন।
“বের হতে বলেছি।” চোখমুখ দিয়ে আগুন বের হতে লাগলো মিহির বাবার।
এরোন কিছু বলতে যাবার আগেই ওর চোখ পরলো মিহির দিকে।
সে আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে।
চেঁচামেচিতে সদ্য তার ঘুম ভেঙে যাওয়ার কি হয়েছে দেখতে এসেছিলো। এসে যে এরোনকে ওর বাবার সাথে দেখবে আশাই করেনি ও।
ও যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হয়তো ঘটবে আজ।
এরোনকে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিহির বাবাও সেদিকে তাকালেন।
বাবার সাথে চোখাচোখি হতেই মিহি দৃষ্টি সরিয়ে নিল। নিমিষেই চোখের কোনে জল চলে এলো মিহির। যেকোনো মুহুর্তেই গড়িয়ে পরবে।
মিহির বাবা মিহির দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,”নির্লজ্জের মত কাজ করে আবার কাঁদছ কিসের জন্য?”
কথাটা কানে আসতেই চমকে গেল মিহি।
এরোন কিছু বলতে গিয়েও বলল না।
“দেখো! এই প্রতিফল দিচ্ছো তোমাদের মানুষ করার জন্য।” এরোনের দিকে আঙুল দেখিয়ে মিহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি।
চোখের জল গড়িয়ে পরতে লাগল মিহির। তবে এখন চুপ করে থাকলে চলবে না। তাই মিহি দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল, “তুমি যা ভাবছো তেমন না বিশ্বাস করো। আমার সাথে ওনার কোনো রকমের সম্পর্ক নেই।”
কথাটা শুনে বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেল এরোন।
মিহির বাবা মিথ্যা পছন্দ করেন না। অথচ তার মেয়েই কিনা আজ তার সামনে এতবড় মিথ্যা বলছে! বড় অবাক হলেন তিনি।
আর মুহুর্তেই গর্জে বলে উঠল,”মধ্যরাতে যে ছেলে তোমার শোবার ঘর থেকে বের হয়েছে, তাকে তুমি এখন চেনোই না?”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই মিহি থমকে গেল। এক শীতল শিহরণ শিরদাঁড়ায় বয়ে গেল ওর।
ও বলতে যাচ্ছিলো যে ছেলেটাকে ও ভালোবাসে না। আর বাকি সবও খুলে বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু ওর বাবার শেষ কথাটা শুনে ওর বুক ধক করে উঠলো।
এরোনও অবাক হলো। কতবড় ভুল হয়েছে সেটা এইমাত্র বুঝলো এরোন।
“আসলে…বাবা…।” মিহি কাতর গলায় কথাটা শেষ করার আগেই তার বাবা ঘৃণার চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, “ছিঃ! লজ্জা করেনি তোমার?”
মিহির চোখ দিয়ে অঝোরে জল পরতে লাগল। যা বলার ছিল তা আর বলতে পারলো না মিহি।
কারণ এখন ওর বাবা কেনো, পৃথিবীর কেউ ওকে বিশ্বাস করবে না।
এরোন মিহির বাবাকে আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,”ওর কোনো দোষ নেই। আমি ওকে না জানিয়েই এসেছিলাম ওর কাছে। কিন্তু আপনি যা ভাবছেন…।”
“একদম চুপ।” এরোনের কথার মাঝখানে ধমকে উঠলেন উনি।
তারপর এরোনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”তোমার মত ছেলেদের ভালো ভাবেই চিনি আমি। বিয়ের আগে একটা কুমারী মেয়ের ঘরে আসার মানে আমাকে শিখাতে এসো না।”
মিহি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শত চেষ্টা করেও আর মুখ খুলতে পারলো না।
“যদি তেমন উদ্দেশ্যই হত তাহলে ওকে বিয়ে করতে চাইতাম না আমি।” প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল এরোন।
“তোমার উদ্দেশ্য আর জানতে চাইনা আমি। বের হয়ে যাও।” তেতে উঠলেন উনি।
এরোন বুঝলো এই লোকের বিশ্বাস এখন পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাই বলে ও মিহিকে এখানে রেখে যাবে না। কারণ এই লোক জোড় করে মিহিকে বিয়েও দিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া হালকা হার্ট এট্যাকের ভান ধরলে মিহিও বাধ্য হবে বিয়ে করতে। এসব নতুন কিছু না। সুতরাং যা করার এখনি করতে হবে ওকে।
এরোন নিঃশব্দে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিছু চিন্তা করলো। তারপর নিজের মনে মনে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বলে ফেলল, “আমার সাথে ওর এমন গভীর সম্পর্কের বিষয়ে জানার পরও ওকে অন্য কারো কাছে বিয়ে দেওয়ার কথা কিভাবে ভাবতে পারেন?” কথাটা বলতে বলতে নিজের হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলল এরোন।
কথাটা শুনে মিহি চমকে এরোনের দিকে তাকালো। এসব কি বলছে ও!
“ভালোভাবে ওকে আমার সাথে যেতে না দিলে আমাকে অন্য উপায় দেখতে হবে।”
মিহির বাবা বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন,”তোমার নামে কেস করবো আমি।”
“কেস করলেও দুইদিনের মধ্যে কেস ক্লোজ করার ক্ষমতা আছে আমার।” সহজ গলায় বলল এরোন।
“তুমি..?” প্রশ্নটা শেষ না করেই হতবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি।
মিহি বুঝতে পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
উনি কয়েক সেকেন্ড থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি ভেবেই অবাক হলেন যে, একইরকম ছেলের সাথে মিহি নিজেকে কিভাবে জড়ালো! বড় মেয়ের দশা দেখার পরেও যে মিহি একই ভুল করবে সেটা ওনার চিন্তার বাহিরে ছিল।
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কিছু চিন্তা করে তিনি থমথমে গলায় মিহিকে বললেন, “এখনি বের হয়ে যাও। তবে তোমার বোনের মত ফিরে এসো না। কারণ আমি মরে গেলেও তোমার এ বাড়িতে ঠাঁই হবেনা।”
মিহি এবার কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবার কাছে ধীরে পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,”প্লিজ বাবা, বিশ্বাস করো। আমি এমনটা করিনি। এসব মিথ্যে। একটা ভুলের কারণে আমি এসবে জড়িয়ে গেছি। সবটা শুনলে তুমি বুঝতে পারবে। তুমিই দেখো আমি ত বিয়েতেও রাজি হয়েছি।”
এরোন মিহির কথা শুনে অনেক বেশি অবাক হলো। মিহি ওদের সম্পর্কটাকে একদম অস্বীকার করছে কেনো সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা এরোন। আর বিয়েতেও নাকি রাজি হয়েছে! এসবের অর্থ কি!
মিহির বাবা মিহিকে এক হাত দেখিয়ে কাছে আসতে নিষেধ করে দিলেন।
তারপর বুলুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এই দুইটাকে এখনি বাড়ি থেকে বের করে দে। যা তামাশা করার বাড়ির বাহিরে গিয়ে করুক। এত নিচে যখন নেমেছেই তখন পতন না হওয়া অব্দি শিক্ষা হবেনা।”
মিহি না সূচক মাথা নেড়ে অস্ফুটস্বরে বাবা বলে আরেক পা এগুতেই ওর বাবা গর্জে বলে উঠল, “খবরদার যদি বাবা বলেছো! আমার ভালো চাও ত বের হও এ বাড়ি থেকে। এখানে এসব সস্তা নোংরামি চলবে না।”
মিহি থমকে দাঁড়িয়ে পরল।
ওর বাবা ওকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত উপরে উঠে গেলেন। আর নিজের ঘরে ঢুকে সজোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন।
দরজা লাগানোর আওয়াজ কানে আসতেই মিহি ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো। শেষ পর্যন্ত সবই শেষ হয়ে গেল।
এরোন এগিয়ে এসে ওকে ধরতে যাওয়ার আগেই ও ঝাঁঝাঁলো গলায় বলে উঠল,”ছোবেন না আমায়। চলে যান এখান থেকে।”
“মানে?”এরোন অবাক হয়ে সংকুচিত চোখে তাকালো।
“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন। আমি ভালোবাসি না আপনাকে। আমি ঘৃণা করি আপনাকে।”
এরোন চমকে গেলেও পরক্ষণে মনে করলো মিহি রাগের বশে এমন করছে। তাই ও বলল, “আমি বুঝতে পারছি তুমি রাগ করে…।”
“কিছু বুঝতে পারছেন না আপনি। বুঝতে পারলে কখনো এখানে তামাশা করতেন না। মোট কথা আমি জীবনেও আপনার হব না। জীবনেও না।”
এরোন ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে ফেলল।
“আসলে আপনার সাথে ভালোবাসার নাটক করাই উচিত হয়নি আমার।” তিক্ত গলায় বলল মিহি।
“নাটক!” হতবাক হয়ে গেল এরোন।
“হ্যা নাটক। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল এটাই ছিলো। তাই এখন দয়া করে মুক্তি দিন আমাকে।” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মিহি।
এরোনের হাত মুষ্টি বদ্ধ হয়ে এলো।
মিহি এত বড় বড় কথা এত সহজে কিভাবে বলছে সেটাই বুঝতে পারছে না এরোন।
তাও নিজেকে ঠান্ডা রেখে বলল,”I promise আমি সব ঠিক করবো। তোমার বাবাও মেনে নেবে। কিন্তু এখন আমি তোমাকে এখানে রেখে যেতে পারবো না।তাই…”
মিহি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল,”আমি জীবনেও আপনার সাথে যাব না। বাংলা কথা বুঝতে পারছেন না! আমি ত বলছি সব নাটক ছিল। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমি তাকেই ভালোবাসি আর তাকেই বিয়ে করবো।”
একথা শুনেই এরোনের মেজাজ প্রচন্ডভাবে বিঘড়ে গেল।
(চলবে…)