#হিয়ার_মাঝে ২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
আশেপাশে কি হচ্ছে হুঁশ নেই নুবাহর। নিশ্চুপ এককোণে নিজ ভাবনায় মশগুল। কিন্তু আচমকাই কারও আলতো স্পর্শে ধ্যানভঙ্গ হল। মুখ তুলে তাকাতে দেখে কবিতা তাকে ডাকছে। চোখ পিটপিট করে বুঝার চেষ্টা করছে। কেন ডাকছে বুঝল না। সে জিজ্ঞেস করার আগে কবিতাই বলে উঠল, ‘তোমার দাদী শাশুড়ী কথা বলবে।’
নিজের হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে দিল নুবাহকে। ইশারায় বলল, হাতে নাও। বারান্দায় গিয়ে কথা বলে আস। এখানে হৈচৈ, উনি কথা বুঝবেন না।’
নুবাহ বোকার মত হা’ হয়ে আছে। নিজমনে বিড়বিড় করল, দাদী শাশুড়ী। নুবাহর এমন নির্লিপ্ততা দেখে পাশে থাকা রুবি এগিয়ে এলেন। নুবাহকে সোফা থেকে উঠিয়ে বারান্দায় বসালেন। হাতের ফোনের মাঝে ইয়ারফোন কানেক্ট করা। রুবি ইয়ারফোন নুবাহর কানে গুজে দিলেন। শান্ত গলায় বলল, ‘এবার কথা বল।’
নুবাহর মন বিষাদময়। কিন্তু এখন লজ্জায় আড়ষ্ট। মুঠোফোনে চোখ বুলাতেই দেখে স্ক্রিনে ভিডিও কল ভাসছে। শুকনো ঢোক গিলল। কি করবে এখন। পাশে দাঁড়ানো রুবি আবারও হতাশ হল। মেয়েটাকে দিয়ে কি হবে কে জানে। সে দ্রুতই কল রিসিভ করল। চোখের ইশারায় বলল, কথা বল। নুবাহর গলার স্বর কাঁপছে ভীষণ। স্ক্রিনে তাকাতেই পারল না। মাথা নিচু করে ধীরগলায় সালাম দিল।
অপর পাশ থেকে মুখে জড়ানো উচ্ছ্বসিত এক বৃদ্ধা মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘দেহি আমার সতীনটার মুখ দেহি। এত নিচু হইয়া থাকলে মুখটা কেমনে দেখুম?’
নুবাহ কিঞ্চিৎ নিজের মুখটা উপরে তুলল। আর তখনিই বলে উঠল,
‘মুখটা এত শুকনো ক্যান? খাবার দেয় না মা-বাবায়। শোন, জামাইদের কিন্তু এমন শুকনা বউ পছন্দ না। একটু স্বাস্থ্য না হইলে কি ভালো লাগবো। কও দেহি!’
নুবাহ বেশ লজ্জা পেল। জবাবে কি বলবে বুঝল না। শুধু মাথা নাঁড়ালো। তবে আচমকাই এক পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এল অপর প্রান্ত থেকে।
‘দাদু, কার সাথে কথা বলছো?’
নুবাহ শুধু সেই কন্ঠস্বর শুনল। অপর পাশে কে আছে তার জানা নেই।
হঠাৎই বৃদ্ধা মহিলার মুখে মিষ্টি হাসি। চোখমুখ আনন্দে আপ্লূত। মজারচ্ছলে পুরুষালী কন্ঠস্বরের উত্তর দিল,
‘এখন থেকে সতিনের সাথে ভাব করতেছি। পরে দু’জন মিলে তোমার মজা উড়ামু।’
হঠাৎই পুরুষালী কন্ঠস্বর কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। হুট করে বলল,
‘সতিন, মানে? কার সাথে কথা বলছো দাদু? আমিও দেখি।’
নুবাহ আৎকে উঠল। তড়িঘড়ি কল কেটে দিল। পুনরায় ওপাশ থেকে বার’কয়েক কল আসল। কিন্তু সে কল রিসিভ করল না। অস্থিরতা আর অস্বস্তিতে হা’ করে ঘন ঘন দ্রুতই শ্বাস নিচ্ছে। মনটা মূহুর্তে বিষাদময় হয়ে উঠল। ফোন ফেরত দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। বসার ঘরে গিয়েও ইস্ততঃবোধ করছিল প্রথমে। পরে কাছে গিয়ে কবিতাকে ডাকল,
‘আন্টি আপনার ফোন।’
কবিতা হাসিমুখে নিজের মুঠোফোন নিয়ে নিল।
নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সহসাই একটা বাক্যে কর্ণকুহরে ভেসে এল। তার পায়ের কদম থমকে গেল মূহুর্তে। মর্মদহনে দগ্ধ হল আবার। মলিন মুখ নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। ঝাপসা হওয়া দু’চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে চিবুকে। কিন্তু তার হুঁশ নেই। আনমনে বিড়বিড় করল, ‘পাঁচদিন পর কাবিন। তারপর,, আর ভাবতে পারল না। এলোমেলো কদমে নিজ রুমে ফিরে এল।
___________
সন্ধ্যার আঁধারে চেয়ে আছে চারপাশ। ঘুম ভেঙে আচমকাই হকচকিয়ে যায় নুবাহ। ঈষৎ আঁধারেই নিমজ্জিত তার রুম। ঠাউর করতে বেশ সময় লাগল। সে আছে কোথায়? ঘুমিয়েছে কখন? মনে পড়ল না। কিন্তু আচমকা দপ করে তার ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। চোখ পড়ল রুকাইয়ার দিকে। তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। নুবাহও নিশ্চুপ চেয়ে আছে। রুকাইয়া দরজার সামনেই থেকেই বলল,
‘নাস্তা করে যা, সন্ধ্যা হইছে সেই মেলা আগে। তুই ঘুমে ছিলি তাই জাগাই নাই এতক্ষণ।’
নুবাহ আগের মতই মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিত্তোর করল না। রুকাইয়া মেয়ের এমন উদাসীনতা দেখে ফের বলে উঠল,
‘কি ব্যাপার! এমন করে চাইয়া আছস ক্যা?’
নুবাহ জবাব দেয়ার প্রয়োজন হল না। রুবি হাতে করে নাস্তার ট্রে নিয়ে প্রবেশ করল। বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপা তুই যা, আমি দেখতেছি।’
রুকাইয়া দ্বিরুক্তি করল না। কিন্তু মুখের কোণে কিঞ্চিৎ ক্রোধের আভাস ফুটে উঠল। রুবি বিছানায় গিয়ে বসল। হাতের মাঝে নুডলস বাটি নুবাহর দিকে এগিয়ে দিল। নিজের খালার হাতে বাটি দেখে শান্ত গলায় বলল,
‘খালামনি খেতে ইচ্ছে করছে না আমার।’
রুবি মুচকি হাসলেন।
‘খাবার না খেলে যে শুধু শরীর দুর্বল হয় তা না কিন্তু। মস্তিষ্কও দুর্বল হয়। মনও অসাড় হয়ে যায়। সঠিক চিন্তা ভাবনা করার শক্তিও লোপ পায় ধীরে ধীরে।’
নুবাহ আগের মতই ভাবলেশহীন। রুবি ফের বলে উঠল,
‘আচ্ছা’ আমাকে একটা সত্যি কথা বলত, তুই ছেলেটার প্রেমে পড়লি কীভাবে? আসলে, কি এমন দেখেছিস তার মাঝে। যার জন্য এত বছরেও ভুলতে পারিসনি।’
নুবাহ নিজের মাথা ঘুরাল। তার দৃষ্টি পড়ার টেবিলের দিকে। হঠাৎই মুখের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল।
‘খালামনি, বলতো আমার এসএসসির রেজাল্ট ভালো হওয়ার কারণ কি?’
‘তুই ভালো করে পড়েছিস। তাই!’
নুবাহ কিঞ্চি মাথা নাড়ালো। মুখের কোণে কৃতজ্ঞতার হাসি।
‘না খালামনি, সব তার কারণে। সে যদি সাহায্য না করত আমি কখনই ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম না। কখনই না।’
রুবি বেশ অবাক হল।
‘তা, কিভাবে সাহায্য করল।’
নুবাহ আগের ন্যায় হাসল।
‘সে এক লম্বা কাহিনী খালামনি।’
‘তো, কি হয়েছে। শুনি তোর প্রেমে পড়ার গল্প। না’কি একান্তই ব্যক্তিগত বলে শেয়ার করবি না।’
নুবাহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,
‘নাহ তেমন কিছু নয়, খালামনি।’
‘দেখ, তোর হাতে কিন্তু এখনো চারদিন সময় আছে।’
নুবাহ আবারও হাসল।
‘না, খালামনি। যে আমি দু’বছর দশ মাসে কিছু করতে পারিনি। সে আমি চারদিনে কিছু করতে পারব। নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি সব। তবে শুনতে চাইছো, আমি তোমাকে সব বলতে পারি এক শর্তে। তুমি কারো সাথে এসব শেয়ার করবে না কিন্তু।’
রুবি হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়ালো। নুবাহ বলতে শুরু করল তার সেই সোনালী অতীতের কথা,,,
অতীত,,,
পড়ার টেবিলেই স্তব্ধ হয়ে আছে নুবাহ। শুধু ভাইয়া ডাকার জন্য লোকটা তাকে কতগুলো কথা শোনাল। সে কি এমন বলেছে তাকে। ভাইয়াই তো ডেকেছে। তা না হলে ডাকবে’টা কি? আজব! এসব চিন্তা ভাবনা ছেড়ে পড়ায় মনোযোগ দিল। কিয়ৎক্ষণ পর ফের মুঠোফোন কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল সেই লোকটা আবার কল দিয়েছে। প্রথমে ভাবল কল রিসিভ করবে না। কিন্তু দ্বিতীয় কলটা রিসিভ করল। সালাম দিয়ে চুপ করে আছে। কি বলবে তা নিয়ে বেশ দু’টানায় পড়ল।
অপর পাশ থেকে কোমল স্বর ভেসে এল।
‘এই যে বোকা মেয়ে, চুপ করে আছো কেন?’
‘কি বলবো, কথা বললেই দোষ খুঁজে বেড়ান।’
হঠাৎই উচ্চস্বরে হাসির শব্দ হল অপরপাশে।
‘তুমি ভুল করলে তা বলব না।’
নুবাহ তেতে উঠল।
‘আমি কি ভুল করেছি।’
‘আচ্ছা, যাও তুমি ভুল করনি। তাহলে বল তো আমার এইজ কত। যদি বলতে পারও তাহলে আর দোষ খুঁজে বেড়াবো না।’
নুবাহ দ্বিধায় পড়ে গেল। কি বলবে এবার।
‘ত্রি,,ত্রিশ/বত্রিশ।
হুট করেই থমথমে গম্ভীর স্বর ভেসে এল।
‘বাহ, তোমার ধারণা তো বেশ দারুণ। তবে দুঃখিত, আমি নিতে পারলাম না। তুমি নিতান্ত বাচ্চা মেয়েও না। তাও এত বোকা কেন তুমি।’
‘বাচ্চা মেয়ে না মানে!’
রগড় গলায় ওপাশ থেকে বলে উঠল,
‘আমি যদি ভুল না হই, তোমার এইজ ষোল/সতেরো। এ্যাম অ্যাই রাইট।’
নুবাহ হা’ হয়ে আছে।
‘আপনি কীভাবে বুঝলেন?’
‘তুমি কিসে পড়?’
‘এসএসসি পরীক্ষার্থী।’
‘তাহলে তো আমি পুরো সিউর। তোমার এইজ ষোল।’
নুবাহ পুরাই থ’।
‘আপনি কি করে বুঝলেন। আমার বয়স ষোল। আরও বেশিও তো হতে পারে।’
‘এটা কমনন্সেস। ষোল বছর বয়সেই এসএসসি দেয় সবাই, তবে দু’য়েকজন ছাড়া। তাই বুঝলাম।
নুবাহ এবার থম মেরে বসে আছে। তার নিশ্চুপতা দেখে জবাব এল।
‘এই যে বোকা মেয়ে, তোমার সুবিধার্থে একটা হিন্টস দিচ্ছি। আমি এবার অনার্স ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। অলরেডি ফাইনাল পরীক্ষা চলছে আমার। এবার এইজ বের কর।’
নুবাহ আৎকে উঠল। অনার্সের ছেলের সাথে সে এভাবে কথা বলছে। কি সর্বনাশ! হাতের আঙ্গুলে হিসেব করল। ক্ষীণ গলায় বলল,
‘বিশ/বাইশের মধ্যে হবে আপনার বয়স।’
আচমকাই উচ্চস্বরে হাসির শব্দ হল।
‘বাহ! আমি যত বোকা ভেবেছি ততটাও বোকা নও। হুম, আমার এইজ একুশ। তোমার থেকে মাত্র চার/পাঁচ বছরের বড়। আর তুমি আমাকে আঙ্কেল ডাকছো। কি লজ্জার ব্যাপার আমার জন্য!’
হঠাৎই রুকাইয়ার গলার স্বর ভেসে এল।
‘নিশাত,,
নুবাহ কিছু না বলেই তড়িঘড়ি কল কেটে দিল। ভয়ে মুখ চুপসে আছে। তার মা’ টের পেলে এখনই জান নিয়ে নিবে। বইয়ের পাতায় চোখ বুলালো। দরজার সামনে রুকাইয়া এসে হাজির।
‘কিরে ডাকছিলাম না। জবাব দেস না ক্যা।’
হতভম্বের মত চেয়ে আছে মায়ের দিকে। না শোনার ভান করল। ‘খেয়াল করি নাই আম্মু।
‘দিন দিন বয়রা হইতেছোস। ভাত বাড়ছি। খাইতে আয়।’
নুবাহ আচ্ছা’ বলে মাথা নাড়ালো। তার মা’ যেতেই ফোৎ ফোৎ নিশ্বাস ফেলল। একটুর জন্য কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল তার।
রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসতেই তার সাথে নিভান আর নীলাভ দু’জনেই হাজির। নিভানকে দেখে যতটা না অবাক হল তার থেকে নীলাভকে দেখে দ্বিগুণ অবাক হল নুবাহ। বিরক্তিকর সুরে বলে উঠল,
‘কি ব্যাপার, ড্রামা কুইন আমার রুমে কি? আম্মুর কাছে যা।’
নীলাভ কোনো তোয়াক্কা করল না। উল্টো দ্রুতই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। গাল ভেংচি দিয়ে বলল,
‘আব্বু আইবো আজকে। হেই জন্য আইছি। নয়তো তোর লগে কেডা থাকে?’
নুবাহ বিস্মিত হল। আজকে তার বাবা’ আসবে। কিন্তু আচমকাই কেন? বৃহস্পতিবার ছাড়া তো তার বাবা আসেনি কখনো। আজ তো মঙ্গলবার। কিন্তু সে অন্যচিন্তায় আৎকে উঠল। তার কপালে কোন শনি আছে এবার কে জানে? তড়িঘড়ি নিজের ফোন খুঁজে নিল। বাটন ফোনের রিংটোন অফ করে দিল। যদি এই ছেলেটা তার বাবার সামনে কল দেয়, তখন। মহা সর্বনাশ! কি হবে এবার?
চলবে,,,,,