হিয়ার_মাঝে ১১. #মেঘা_সুবাশ্রী

0
684

#হিয়ার_মাঝে ১১.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

নুবাহ, তমা দু’জনেই নির্লিপ্ত। নিশ্চুপতায় আচ্ছন্ন দু’জন একে অপরকে ইশারায় সংকেত দিল। প্রস্তুত তো। দু’জনের অধরকোণে সূক্ষ্ম কুটিল হাসি। বাবলু কিঞ্চিৎ ঝুঁকলো নুবাহর হাত ধরতে। অন্যপাশে তমার হাত ধরতে তার এক চ্যালাও হাত বাড়াল। বাবলু মাত্রই হাত ধরে টানতে যাবে। তার ভাবনার অতীত এমন একটা কাজ নুবাহ করে বসল। হুট করেই তার দু’পা ধরে টান দিল নুবাহ। তৎক্ষনাৎ বেচারা বাবলু নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাল। চিৎপটাং হয়ে পড়ল গিয়ে পিচঢালা রাস্তার মাঝখানে। আহ! করে শব্দ তুলতেই জায়গা মত একটা কি,ক মারল সে।

বাবলু ওমা’গো বলে আর্তনাদে ককিয়ে উঠল। নুবাহর দু’চোখে অগ্নিবর্ষণ। মুখে গজগজ করল। অনেক জ্বালিয়েছিস, অনেক সহ্য করেছি তোকে। কিন্তু আর না। আজকে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই ফেলেছিস। দ্রুতই ফের একই জায়গায় দ্বিতীয় একটা কি,ক মারল। একসাথে দু’টো কি,ক পড়ায় বাবলু গগনবিদারী চিৎকার দিল। অন্যপাশে তমাও ঠিক একই কাজ করল। সেই ছেলেও পিচঢালা রাস্তার মাঝে পড়ে আর্তনাদ করছে। দু’জনের মুখ থেকে শুধু আল্লাহ’গো, মা’গো, মরে গেলাম এই শব্দগুচ্ছই বের হচ্ছে। একসাথে দু’জন রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

আরও দু’জন ছেলে বাকি ছিল। একজন কিঞ্চিৎ দূরত্বে দাঁড়ানো। অন্যজন গাড়িতে বসা। আকস্মিক এমন হওয়ায় বাইরে থাকা সেই ছেলে ভয়ে সেঠিয়ে গেল। দু’মেয়ে এরকম করবে তাদের ভাবনাতেও ছিল না। অতর্কিত এমন উত্তম মাধ্যম দেখে সেই ছেলে পুরোই হতভম্ব। নুবাহ তমাকে বলল, ব্যাটাকে ধর। জন্মের শিক্ষাটা দিই। এই কথা শুনে ভয়ে সেই ছেলে দিল ভৌ-দৌঁড়। ভুল করেও পিছনে তাকাল না।

ছেলেটার এমন দৌড় দেখে নুবাহ তমা দু’জনে অট্টহাসিতে লুটোপুটি খেল। আহারে! মদনা তাদের ভয় দেখাতে এসে নিজেই গো-বেচারা হয়ে গেছে। গাড়িতে বসা ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে। দরজা খুলে বের হওয়ার দুঃসাহস দেখাল না। কিন্তু তমা তাকে ডাকল, কি’রে বল্টু বের হবি না। ভেতর থেকে কোন শব্দ বের হল না। ছেলেটা নিশ্চুপ বসে আছে। দু’জনে সামনের দিকে কদম বাড়াতেই বেরিয়ে আসল। বাবলু আর তার পাশে পড়ে থাকা ছেলেকে টেনে গাড়িতে উঠানোর চেষ্টা করছে।

আসলে গো-বেচারা বাবলু তাদের সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখেনি। স্কুলে রোজ তাদেরকে নিরাপত্তার জন্য কিছু মার্শাল আর্ট শিখানো হয়। সেই মার্শাল আর্টের আইডিয়াই কাজে লাগিয়ে দিল তারা। নিজমনে পিটি স্যার কে ধন্যবাদ দিল দু’জন। তাদের এসব কৌশল শিখানোর জন্য।

পিটি স্যার সবসময় বলেন সামনে থাকা আসন্ন বিপদ দেখে ভয় পেও না। প্রথমে বুঝে নাও বিপদের মাত্রা কেমন? তারপর সংখ্যা এবং তার মনোভাব। বিপদের ধরন অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করবে। শুধু দুইটা কাজ করবে, এক বুকের বাম পাশে নয়ত জায়গা মত একটা দিবে। সামনে থাকা লোক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে আর উঠে দাঁড়াতে পারবেনা।

নুবাহ তমা সাচ্ছন্দ্য বাড়ির দিকে রওনা দিল। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে এখনও হাসছে। তাদের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। অন্যদিকে বাবলুর সেই গগনবিদারী আর্তনাদ এখনও কিঞ্চিৎ ভেসে আসছে। তবে দৌড় দেয়া ছেলেটার কথা ভাবতে দু’জনের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। নুবাহ দীর্ঘ সময় পর বলে উঠল,
‘উফফ! তমা আমি আর পারছি না। পেট ব্যথা করছে।’

রাস্তার ধার থেকে নুবাহ বুনোফুল নিয়ে তোড়া বানিয়ে তমাকে দিল। তমা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তোড়া কিসের জন্য। আচমকাই নুবাহ তমাকে জড়িয়ে ধরল। নরম ভেজানো গলায় বলল, ‘ধন্যবাদ নয় বন্ধু। হাজারও শুকরিয়া, যার এমন একজন বন্ধু আছে। যে বিপদে ভয় না পেয়ে মনে সাহস এনে দেয়। লড়াই করার শক্তি দেয়। সারাজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তাই ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না।’

চোখের কোণে জল চিকচিক করছে নুবাহর। ফের আহতস্বরে বলল, আজ যদি তুই না থাকতি, এত সাহস কখনও পেতাম না। তমা হা’ হয়ে আছে। নিজের হাতের ধারালো নখ দিয়ে নুবাহর বাহুতে এক চিমটি দিল। তাচ্ছিল্যর সুরে বলল, সব আমার জন্য, মোটেও না। তোর মনোবল আর সাহসিকতার জন্যই পেরেছিস। যেটা সব মেয়েরা পারে না। তুই তো বীরাঙ্গনা। নুবাহ ফিক করে হেসে দিল।
‘হইছে আর তেল দিতে হবে না। এমনিতেও তেলের যা দাম।’
তমা কটমট করে তাকাল।
‘আসলে তুই একটা বদ মহিলা। যা সর, একশ হাত দূরে গিয়া মর।’

তমা গজগজ করে নিজের বাড়ির দিকে গেল।
নুবাহ ক্যাবলাকান্তের মত তমার যাওয়া দেখল। হায়রে! মিস তামা তো আজ ক্ষেপে গেছে। এবার কি হবে, কে জানে?’
_____________

বিজয়ীনির বেশে বাড়িতে প্রবেশ করল নুবাহ। ঢুকতে দেখল রুকাইয়া কিচেন থেকে বের হচ্ছে। মা’কে দেখে লম্বা করে সালাম দিল সে। ‘আসসালামু আলাইকুম আম্মু।’

রুকাইয়া অবাক হল প্রথমে। সালামের উত্তর দিতে দিতে বলল, কি ব্যাপার? আজ কি মনে করে এত লম্বা করে সালাম দেয়া হচ্ছে। কখনো তো সালাম দিতে দেখলাম না। কাহিনী কি!’
নুবাহ গিয়ে জড়িয়ে ধরল। আদুরে গলায় বলল, আম্মু আমার ভর্তা খাইতে ইচ্ছে করছে। একদম ঝাল ঝাল কাঁচামরিচের ভর্তা। রুকাইয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। টিপ্পনী মেরে বলল, ও তাহলে এ কাহিনী। আজকে এমনিতেই তিনটা তরকারী রান্না করছি। কালকে খাইছ।
নুবাহর কন্ঠে ফের আকুলতা। কি কি রান্না হয়ছে আজকে। রুকাইয়া টেবিল মুছতে মুছতে জবাব দিল। মুলাশাক ভাজা, শিম দিয়ে পাঙ্গাস মাছ আর আলু ভর্তা আছে। নুবাহ তড়িৎ বলে উঠল, মাছের পেট আছে আম্মু।

রুকাইয়া মাথা নাড়াল। হুমম, আছে। নুবাহ দ্রুতই ফ্রেশ হতে গেল। যাওয়ার আগে তার জন্য টেবিলে খাবার রাখতে বলল। তড়িঘড়ি এসে বসল খাবার টেবিলে। মাছের পেটি আর আলু ভর্তা পেয়ে নুবাহ বেশ খুশি। আজ অনেক পরিশ্রম করেছে। মদনার বাচ্চাকে মারতে গিয়ে তার অনেক শক্তিক্ষয় হয়েছে। এখন খাবার খেয়ে দ্রুতই শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।

ভাত খেয়ে মাত্রই রুমে আসল। নিভানও আসল পিছু পিছু জিজ্ঞেস করতে। নিতাত তুমি ভাত খাতো (খাইছো)। হুমম’ বলে মাথা নাড়িয়ে নিভানকে বিছানায় তুলল সে। বিছানায় শুয়ে নিভান বলে উঠল, নিতাত একতা গপ্পো বল। হঠাৎ করে নুবাহর মাথায় একটা গল্প আসল। সে নিভানকে বলল, যাও নীলাভকে ডেকে নিয়ে আস। আজকে দু’জনকে মজার একটা গল্প বলব। নিভান এলোমেলো কদমে দৌড় দিল বোনকে ডাকতে। দ্রুতই নীলাভকে ডেকে নিয়ে আসল। নীলাভ অবাক হলেও পাশে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নুবাহ দুইজনকে বলল, জানও আজকে রাস্তায় কি হয়েছে। দুইজনে উৎসুক হয়ে আছে। নীলাভ বলল, কি হয়েছে না বললে কিভাবে জানব।

নুবাহ মাথা নাড়াল, তাই তো! তারপর বাবলুর মাইর খাওয়ার ঘটনাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্পের মত রসিয়ে রসিয়ে বলল। তবে নিজের নাম’টা চেপে গেল। নীলাভ নিভান হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল। নিভানের হাসি তো থামছেই না। নীলাভ বোনের দিকে তাকাল। চোখ পিটপিট করে বলল, আল্লাহ মেয়েটা কি সাহসীরে আপু! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ফের কাতরসুরে বলল, আচ্ছা’ ঐ ছেলে এবার হিসু করবে কিভাবে আপু?
নিভান কি বুঝলো কি জানি, খিলখিল করে সেও হেসে উঠল।

নুবাহও তাদের সাথে মুখ চেপে হাসল। কিছু সময় এভাবেই অতিবাহিত হল। সে নিভান নীলাভকে বলল, এবার তোরা যা। আমি একটু ঘুমাই। নীলাভ বলল, আপু আমি এখানে ঘুমাই। নিভানও বলে উঠল, আমিও দুমাই। দু’জনকে নিয়ে হয়ছে তার যত জ্বালা। নুবাহ কপট রাগ দেখাল। ঠিক আছে ঘুমা, তবে কোন শব্দ করতে পারবি না। ডানদিকে কাত হয়ে ঘুমাবি। তড়িৎ দু’জনে মাথা কাত করে শুয়ে পড়ল।

দু’জনকে ঘুমাতে বলে অন্যদিকে নিদ্রাহীন শুয়ে আছে নুবাহ। মুঠোফোনে চোখ বুলিয়ে সময় দেখল। বিকেল তিন’টে ত্রিশ। হঠাৎই স্কিনে চোখ পড়ল। ইনবক্সে নতুন মেসেজ পড়ে আছে। দ্রুতই সেই মেসেজ ওপেন করল।

“জানি, এখনও স্কুলে আছ। স্কুল থেকে ফিরার পর হয়তো তোমার সাথে আমার কথা নাও হতে পারে। আমি কয়েক’দিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকব। কবে সু্যোগ হবে তোমার সাথে কথা বলার, জানি না। দোয়া কর, তোমার অখ্যাত টিচারের জন্য।”

দুপুর বারো’টার মেসেজ ছিল এটা। এরপর দেখল আরও একটি ছোট্ট বার্তা।

“গাড়িতে উঠলাম মাত্র। অনেকদূর যাচ্ছি। আমি না ফিরা পর্যন্ত ভালো থেকো।”

এটার সময় ছিল দুপুর এক’টা। আচমকাই মন’টা ভারী হয়ে গেল নুবাহর।

সন্ধ্যায় পড়তে বসেও মন’টা ভীষণ বিচলিত। বইয়ের পাতায় আঁকিবুঁকি করল আনমনে। আজ তার অধম টিচারের সাথে কথা হয়নি। হঠাৎই এই লোক কোথায় গেল? হুট করে গায়েব হয়ে গেল কেন? ফোৎ ফোৎ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। সহসাই তার মুঠোফোন ভো ভো কম্পনে কেঁপে উঠল। খুশিতে লাফ দিয়ে উঠল। ভেবেছিল তার অধম টিচার হবে। কিন্তু স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই মন’টা ভারী হয়ে গেল। এটা তার খালামনির কল। কল’টা বেজেই যাচ্ছে। তার ইচ্ছে হল না ধরার জন্য। মুখ পেঁচার মত করে বসে আছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় মুঠোফোন কম্পিত হওয়ায় শেষে কল ধরতে বাধ্য হল। রিসিভ করতেই রুবির রামধমক খেল সে।

‘এতক্ষণ ধরে কল ধরিস না কেন?

বিরস মুখে জবাব দিল নুবাহ, বাইরে ছিলাম। রুবি আর বেশি গাটালো না। মৃদুহেসে বললেন, ‘আপার টাকাগুলো তোর বিকাশে দিয়ে দিলাম।’
নুবাহ অবাক হয়ে বলল, কীসের টাকা খালামনি?

‘আরে পাগলি, সেই টাকাগুলো। যার জন্য গালি খাইলি।

নুবাহর হুঁশ হল। ওহহ, সেই টাকা। আনমনে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। এই টাকার সাথে মিশে আছে অনেক স্মৃতি, অনেক গল্প। না বলা হাজারও অনূভুতি। তার আচমকাই অদ্ভুত অনুভূতি হল। রুবিকে দ্রুতই বলে উঠল, আচ্ছা ঠিক আছে। এখন রাখছি খালামনি। সে খট করে রুবির কল কাটল। নিজের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে একটা ক্ষুদে বার্তা দিল তার অধম টিচারকে।

“কোথায় আছেন ‘স্যার? খুব বেশি দূরে আছেন? আপনি ভালো আছেন তো?”

মেসেজ দিয়েও শান্তি পেল না। তার রিপ্লাই না আসায়। ইমদাদের দেওয়া সাজেশনে হাত বুলালো। সেই গতকাল দুপুরে কথা হয়েছে তার। নিজমনে বিড়বিড় করল, জানেন আপনার সাথে কথা না বললে পড়তে পারি না। টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে।

হিম করা ঠান্ডা বাতাসের সাথে সাথে রাতটাও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ঘড়ির কাটা বারো’টা ছুঁই ছুঁই। না কোন কল, না কোনো বার্তা। অন্তঃকরণ তীব্র দহনে পুড়ছিল। নিদ্রাহীন দু’চোখ। তাও নিজেকে শাসালো ঘুমা নুবাহ ঘুমা।

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here