#হিয়ার_মাঝে ২০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
নুবাহ নিজের কদম দুইগুণ বাড়াল। সুরেলা কন্ঠস্বরের মালিককে একবার নিজচক্ষে দেখার অদম্য ইচ্ছে জাগল তার। ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে পায়ের গতি বাড়াল। দৃষ্টি তার রসায়ন সেমিনারের দিকে। সেই দিক থেকেই এই মিষ্টি সুর ভেসে আসছে। কিন্তু সেমিনার পৌঁছানোর আগেই ঘটল আরেক অঘটন। করিডোরের মাঝ বরাবর আসতেই ভৌত রসায়ন থেকে একটা পুরুষ অবয়ব দ্রুত বের হল। সেও দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিল। দৈবাৎ ল্যাব থেকে আসা ঐ অবয়বকে আগের মতই তার স্লিপার দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছে। শ্যামবর্ণা, উষ্কখুষ্ক চুল আর মাঝারি গড়নের বেশ হৃষ্টপুষ্ট পুরুষ। ভুঁড়িখানা একটু বেরিয়ে আছে। তাকাতে দেখল ছেলেটা তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। সে ভয়ে পুরো কাঠদন্ডের মত দাঁড়ানো। ভয়ে সান্ত্বনার বাণীও বের হল না তার মুখ থেকে। স্তব্ধ পুরো। নিজমনে অজস্র গালি ছুঁড়লো নিজেকে। আজ কোন কুক্ষণে এই জুতা জোড়া পরেছিল। যাকে পাচ্ছে তাকেই মাড়িয়ে যাচ্ছে। বুক ঢিপঢিপ করছে বেশ দ্রুত বেগে। অপর পাশ থেকে কোন বাক্যে বের হবে তার জন্য।
অপরদিকে সানি চেঁচালো না। শুধু অপলক নুবাহকে দেখছে। সে আপাদমস্তক নুবাহকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল। তার কাছে নুবাহকে আকাশ থেকে হুট করে খসে পড়া উল্কাপিণ্ড মনে হল। বেশ কিছু সময় পর বলে উঠল,
‘ক্যাহা ছে অ্যায়ি হো তুম। মার ডালো কি ক্যায়া?’ (কোথায় থেকে আসছ? মেরে ফেলতে চাও নাকি)
নুবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। একটু একটু হিন্দি সেও পারে। কিন্তু এতটাও ভালো না। এই লোকটা কি খাঁটি ইন্ডিয়ান। তড়িৎ জবাব দিল,
‘আপ ইন্ডিয়ান হো ক্যায়া?’ (আপনি কি ইন্ডিয়ান)
মুহুর্তে সেখানে হাসির রোল পড়ে গেল। সানির পিছনে থাকা তার বন্ধু বের হয়ে এল। রকি হাসতে হাসতে নুবাহর সামনে এসে দাঁড়ালো। সানির কাঁধে এক হাত রেখে বলে উঠল,
‘হ্যাঁ, এই ছেলে পুরাই ইন্ডিয়ান। শুধু তার বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টি বাংলাদেশী।’
নুবাহ হতভম্ব। দৃষ্টি নত করে রাখল। উত্তর কি দেয়া উচিৎ তাই ভাবল। দোটানায় পড়ে আমতা আমতা করল, ‘অহহ।’
সানি রকির দিকে চোখ পাকালো। ইশারায় বলে উঠল, কাবাবের হাড্ডি হতে ইচ্ছে তোর। শালা হারা’মি একটা। রকি ফের হেসে উঠল। আবার দৃষ্টি দিল নুবাহর দিকে।
‘তুমি কি নতুন?’
নুবাহ মাথা নাড়াল, জ্বী।
রকি ফের বলে উঠল, ‘তুমি যে আমার বন্ধুর ভালো পা ভেঙে দিলে, তার জরিমানা স্বরূপ কি দিবে এখন?’
নুবাহর দৃষ্টি জোড়া ভয়ার্ত। ‘আ,,আসলে আমি জানতাম না এদিক থেকে মানুষ আসবে। স,,সর্যিই ভাইজান।’
রকি ফের কিছু বলতে নিতেই জুঁই সেমিনার রুম থেকে বেরিয়ে এল। সানি রকিকে নুবাহর সাথে কথা বলতে দেখে সে এগিয়ে এল। নুবাহ জুঁইকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। তাই তড়িঘড়ি ডেকে উঠল, জুঁই আপু।
জুঁই কিঞ্চিৎ অবাক হল। সে এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিল নুবাহকে। ‘আরে নিশাত তুমি।’
জুঁইয়ের পরিচিত দেখে সানি রকি হা’ হয়ে আছে। সানি জিজ্ঞেস করল, তুই চেনোস ওরে।
জুঁই মাথা নাড়ালো। ‘হ্যাঁ, চিনি তো। ও হচ্ছে আমার স্টুডেন্ট হৃদি আর রিদান এর খালাতো বোন।’
রকি বেশ সুর টেনে বলল, ‘আচ্ছা। কিন্তু জুঁই, তোমার এই নিশাত সানির একটা পা’ ভেঙে দিছে। উল্টো আবার তাকে ইন্ডিয়ানও বলছে।’
জুঁই রগড় গলায় বলল, ‘সানি আগে তো শুধু সানলাইট ছিল। এখন থেকে ইন্ডিয়ান সানলাইট হবে। বেশ তো, খারাপ কোথায়? ভাগ্য ভালো তাকে চায়না বলে নাই।’
তৎক্ষণাৎ সবার মধ্যে আবার হাসির রোল পড়ে গেল। জুঁইয়ের কথা শেষ হওয়ার মূহুর্তে সেমিনারের সম্মুখ থেকে আরও একটা পুরুষালি সুর ভেসে এল।
‘কে ইন্ডিয়ান সানলাইট, জুঁইফুল?’
নুবাহসহ বাকিরাও সেই দিকে তাকাল। বলিষ্ঠ গড়নের বেশ লম্বা চওড়া পুরুষ, কিঞ্চিৎ কোকড়ানো চুল, মুখে হালকা চাপ দাঁড়ি, গৌরবর্ণা গায়ের রঙ। এককথায় সুদর্শন পুরুষ। অবশ্যই ছেলেদের এত সুন্দর তার একদমই ভালো লাগে না। তবে এই ছেলের সৌন্দর্য একদম নিখুঁত। অবিকল ছবির হিরোদের মতই। নুবাহ আনমনে বিড়বিড় করল, এলিয়েন না’তো আবার।
সেমিনার থেকে আরও কয়েক কদম বাড়িয়ে চিন্ময় জুঁইয়ের পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। মুখে মুচকি হাসি ঝুলছে। বলে উঠল, ‘সানির কি হয়েছে’রে?’ জুঁইয়ের সাথে বাকি’রাও হেসে উঠল। রকি বলে উঠল, ‘সানলাইটের একখানা পা’ ভেঙে গেছে। এখন অ্যাম্বুলেন্স ডাক জলদি। আরেকখানা পা লাগাতে হবে।’
আচম্বিত চিন্ময়ের নজর পড়ল নুবাহর দিকে। জুঁই নুবাহকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলে উঠল, মেয়েটা কে? জুঁই নুবাহর পরিচয় দিল। চিন্ময় উৎসুক হয়ে তাকাল নুবাহর দিকে। হুট করে বলে উঠল,
‘এই দিকে কেন এলে? তোমার ক্লাস তো এখানে না। বিজ্ঞান ভবনে প্রবেশ করলে বা’ দিকেই তো তোমার ক্লাস।’
নুবাহ শুকনো ঢোক গিলল। কি করতে এসেছিল, আর এখন কি করছে? নির্বাক-ধূসর দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। ভেবে চিন্তে মাত্র দু’ঠোঁট ফাঁক করল জবাব দিতেই। হুট করেই হন্তদন্ত হয়ে নিরব ছুটে এল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,
‘নিশাত তোমাকে এজন্যই বলেছিলাম, তুমি ক্লাস চেনো। দেখছো, এখন ক্লাস না চিনে তুমি কোন বিপদে পড়েছো।’
নিশাত কিছু বলার জন্য খুঁজেই পেল না। অথচ সে ঐ সুরেলা গায়ককে একপলক দেখতে এসেছিল। এখন তার সাথে কি থেকে কি হয়ে গেল। নিরব নুবাহর হয়ে সর্যিই বলল সানিকে। সানি হা’ হয়ে আছে। ইশারায় নিরবকে জিজ্ঞেস করল, তোমার ক্রাশ না’কি?
নিরব লাজুক রাঙানো হাসি দিল। সানিসহ বাকি’রা যা বুঝার বুঝে নিল। সানি গলা খাঁকারি দিল। নুবাহর উদ্দেশ্য বলে উঠল, ‘যাও, আজকের জন্য মাফ করে দিলাম। নিরবের সহপাঠী বলে কথা।’ তারপর নিরবকে চোখ মারল সে।
নিরব নুবাহর দিকে এক হাত বাড়াল। লাজুক রাঙানো হাসিতে বলে উঠল, ‘এসো, নিশাত।’ নুবাহ ভ্রুদ্বয় কুঁচকালো। ক্ষীণস্বরে বলে উঠল, ‘সর, তোর কাজে যা।’ হনহনিয়ে সে ক্লাসের দিকে কদম বাড়াল। নিরব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নিজের হাত দ্রুত গুটিয়ে নিল।
সেমিনার থেকে তৎক্ষণাৎ গীটার হাতে আগমন ঘটল জিমানের। তার পিছু বেরিয়ে এল জিতুও। জিমান সবার মুখে এমন হাসি দেখে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোরা সবগুলো একসাথে এরকম দাঁত কেলাচ্ছিস ক্যান।’
সবার আগে চিন্ময়ই সব বলে উঠল। জিমান শুনে সানির মজা উড়ালো।
‘তুই নামেই সানলাইট, কামে পুরা টিউবলাইট।’
সানি তেতে উঠল, ‘আমি কি ইচ্ছে করে করছি না’কি? মেয়েটাই তো আমার সামনে আসল।’
জিতু সব কথা নিশ্চুপ শুনল। গম্ভীর গলায় বলে উঠল, ‘দেখ জিম, বাইরের কারো জন্য নিজের ফেন্ডের মজা উড়াবি না। দোষ তো মেয়েটাও করেছে। শুধু শুধু ওকে দোষ দিচ্ছিস কেন?’
জিমানসহ বাকি’রা হা’ হয়ে আছে। এ কোন জিতুকে দেখছে। চিন্ময় জিতুর কাঁধে হাত রাখল। ‘আরে সবাই মজা করছি। তুই এত হাইপার হচ্ছিস কেনো?’
জিতু উষ্ণ শ্বাস ছাড়ল। চিন্ময়ের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, ‘দেখ চিন্ময়, সব জায়গায় মজা মানায় না। অন্তত নিজের ফেন্ডদের ক্ষেত্রে।’
কথোপকথন অন্য পর্যায়ে যাওয়ার আগে জুঁই জবাব দিল, ‘জিতু, আমরাও সানির বন্ধু, ওর শত্রু নই।’
জিতু বিদ্রুপের সুর তুলল। ‘তা তো দেখলাম, বাইরের একটা মেয়ের সামনে সানির মজা উড়াচ্ছিস। এটা খুবই বাজে কাজ ছিল তোর। অন্তত তোর থেকে এটা আমি আশা করেনি।’
জিতু আর কিছু বলার আগে সানি জিতুর হাত ধরল। নরম সুরে বলল, ‘আরে আমরা সবাই মজা করছিলাম। এটা সিরিয়াস কিছু ছিল না ভাই। চল ক্যান্টিনে, তোরে কিছু খাওয়াই মাথা ঠান্ডা করি। আজকে মনে হয় মুবিনের ভূত ভর করছে তোর উপর, বুঝতে পারছি।’
জিতু চোখ পাকালো। কিন্তু সানি তোয়াক্কা করল না। বাকি’রাও পিছু পিছু তার সাথে ক্যান্টিনে গেল।
____
নুবাহর ক্লাস নেই আপাতত। সুযোগ খুঁজল ক্লাস থেকে বের হওয়ার জন্য। কিন্তু নাছোড়বান্দা নিরব তার পেছনই ছাড়ছে না। এই মুহূর্তে নিরব এক বন্ধুর সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। সুযোগ পেয়ে দ্রুতই ক্লাস থেকে বের হল সে। উদ্দেশ্য তার ম্যাথ বিভাগ। সেখানে অফিস রুম যাবে। তাই নিজের কদম বাড়াল। কিন্তু কিছুদূর আসতে ফের পিছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল, ‘নিশিরাত।’
নুবাহ থমকে গেল। ঠিক কত বছর পর সে এই ডাক শুনতে পেয়েছে। হুট করে তমার কথা মনে পড়ল। এই ডাক ছাড়া কতগুলো বছর পার হয়ে গেল। ইমদাদের সাথে সাথে তমাও তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। কতদিন তমার সাথে তার কথা হয়নি। বলা হয়নি মিস তামা, দেখনা আজকে আমি তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়েছি। তুই কোথায় পড়ছিস? জানা হয়নি আজও তমা কোথায় আছে? নিশিরাত ডাক’টা শুনে সামনে এসে দাঁড়ালো।
সানি নুবাহকে ক্ষেপানোর জন্য নিশিরাত বলে ডেকেছিল। কিন্তু নুবাহ তার সামনে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে আছে। সানি আবারও ডাকল, ‘নিশিরাত, বস। আমার পা ভাঙার জরিমানা হিসেবে ট্রিট দিবে এখন।’
নুবাহর দৃষ্টি আগের মতই স্থির। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে সে। জুঁই বলে উঠল, ‘নিশাত, এস। আমার পাশে বস।’
নিশাত কিছু বলতেই উদ্বত হল। কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘এর নাম নিশাত না হয়ে কালরাত রাখা উচিৎ ছিল। কাজকর্মে সব কালই সৃষ্টি করে। আবার পোশাকেও কালো পোশাক।’
কারও তাচ্ছিল্য মাখানো কথা শুনে ঐদিকে তাকালো। কিন্তু হাতে গীটার দাঁড়ানো একজনকে দেখল। নুবাহর পাশ ঘেঁষে জিমান গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। নুবাহর দৃষ্টি তার দিকে নিবন্ধ। আচমকাই বলে উঠল,
‘গীটার আপনার?’
জিমান নুবাহর এমন প্রশ্নে অবাক হল। কিঞ্চিৎ হেসে উঠল, ‘হুমম, আমার। তোমার নাম নিশাত না রেখে কালরাত রাখা উচিৎ ছিল। আসলে এটা আমার কথা নয়। আমাদের জিতুর কথা।’
মুহূর্তে সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গেল। কিন্তু একজন ছাড়া। সে ভাবলেশহীন। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। না মুখে হাসি, না তার দিকে তাকালো। তাকে নিয়ে মজা করছে সবাই। নুবাহ চুপচাপ শুনল সবার কথা। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। সানির দিকে ফের তাকালো। নরম গলায় বলল,
‘আরেকবার বলবেন, নিশিরাত।’
সানি হা’ হয়ে আছে। বাকি’রাও অবাক। সানি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘নিশিরাত।’
নুবাহ কিঞ্চিৎ হাসল। ভেজানো গলায় বলল,
‘আমাকে সবসময় এই নামে ডাকবেন তো সান ভাইয়া। এই ডাকটা আমার ভীষণ প্রিয়। আপনার মুখেও বেশ মানিয়েছে।’
সানি হতবিহ্বল। জবাব দিল রয়েসয়ে, ‘আচ্ছা।’
নুবাহ ধন্যবাদ দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এল। পিছনে সবাই কৌতুহল হয়ে তাকে দেখছে।
চলবে,,,,
পুরো বন্ধুমহলের নাম দিয়ে দিলাম।