#হিয়ার_মাঝে ২৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
দুপুরের ঝাঁঝালো রোদ মাথার উপর। অন্যদিকে ভয়ে বক্ষস্থল ঢিপঢিপ করছে নুবাহর। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ম্যাথ বিভাগের সামনে। আজকে তার প্রথম মিশন ইমদাদকে খোঁজার। তিন ইমদাদের মধ্যে একজনের নাম্বারে কল গিয়েছে শুধু। বাকি দু’জনের নাম্বার বন্ধ। ইমদাদুল হক জাকী তার নাম্বারে কল গিয়েছে কিন্তু রিসিভ হয়নি। কতবার চেষ্টা করেছে। শেষে তাকে ব্লক করে দিয়েছে। ব্যর্থ হয়ে এখন অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। ক্লাস শেষ, তাই করিডোরের সামনে মাস্টার্সের একজন সিনিয়র ছাত্রকে পেয়ে বেশ খুশি হল। তাকে দেখে প্রথমে সালাম দিল। ছেলেটা কিছুসময় তার দিকে হা’ হয়ে থাকল। রয়েসয়ে বলে উঠল,
‘জ্বী, বলুন।’
নুবাহ চটজলদি বলে উঠল, ‘আপনি ইমদাদুল হক জাকী ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন না। ভালো আছেন ভাইয়া।’
ছেলেটা আপাদমস্তক ভালো করে দেখল নুবাহর। কালো হিজাবের আদলে আবৃত মুখ। কিন্তু উন্মুক্ত কালো দু’চোখ বেশ মায়াবী। হলদেটে বর্ণের হালকা পাতলা শরীরে রুপালি রঙের অবয়া পরিহিত। মেয়ে হিসেবে বেশ কমনীয়। মুখ না দেখলেও বাইরে থেকে বেশ বুঝা যায়। কিন্তু অবাক হল জাকীর এমন বোন থাকলে তাহলে তাকে বলেনি কেন। কিঞ্চিৎ রাগ হল তার। নরম গলায় বলল,
‘তুমি জাকীরের কি হও?’
নুবাহ কিছুটা সাহস পেল। এতক্ষণ ভয়ে কাঠ হয়ে ছিল। অবশেষে একজনকে পেল, যে ইমদাদ হক জাকীকে চেনে। দ্রুতই জবাব দিল,
‘আমি তার খালাতো বোন। ভাইয়াকে একটু ডেকে দিবেন।’
ছেলেটা আরও কিছু বলতে চেয়েও বলল না। জাকীরের এমন সুন্দর বোন আছে আজ জানল। আগে তো বলেনি তাদের। সে নুবাহকে দাঁড়াতে বলে ভিতরে গেল। ভিতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে কালো বর্ণের বেশ মোটাসোটা একজন ছেলে আসল। এসেই বলে উঠল,
‘তুমি আমায় ডেকেছো। কিন্তু,,,, বলে ছেলেটা থেমে গেল। একহাত দিয়ে নিজের কপাল চুলকালো। ফের বলে উঠল, ‘কেন ডেকেছো?’
তারপর পাশে থাকা ছেলেটাকে বলল, ‘তুই ভিতরে যা, ওর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।’
নুবাহ অস্বস্তিতে ডুবে আছে। কি বলবে এখন। আর কিভাবে বা বলবে? বেশ ভেবে চিন্তে বলল, ‘ভাইয়া আসলে আমার একজন বান্ধবী আছে। সে বরিশাল থেকে এসেছে। সে না’কি আপনাকে চিনে। তাই একটা মিথ্যে বলেছি, আমি আপনার খালাতো বোন।’
ছেলেটা আবারও কপাল চুলকালো। নুবাহর দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নুবাহ ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ছেলেটার চাউনি কেমন? তার অস্বস্তি লাগছে বেশ। হুট করে জাকী বলে উঠল, ‘সমস্যা নেই। তোমার বান্ধবী বরিশাল থেকে এসেছে। হ্যাঁ, চিনি তো। তা কোথায় তোমার বান্ধুবী, ডাকো তাকে।’
‘আসলে সে আপনার মোবাইল নাম্বার নিতে বলেছে।’
‘তোমার বান্ধুবী নিজে আসল না, তোমাকে পাঠালো। না’কি তুমি সেই মেয়ে? আমাকে খুঁজছিলে।’
নুবাহ ধরা পড়ার ভয়ে আমতা আমতা করল,
‘নাহ ভাইয়া, আসলে সে লজ্জা পায়। তাই আমাকে পাঠিয়েছে।’
জাকী কিছুসময় আবার ভাবল। ফের বলে উঠল, ‘যদি মেয়েটা তুমি হও, তাহলে বিনা বাক্যেই মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিব।’
নুবাহর দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। অস্বস্তিতে ফের ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে। উত্তর দিতেও কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার মন বলছে, এ তার ইমদাদ নয়। তার কথা এমন হতেই পারে না। জাকীর কথার মধ্যে কোন ভালোলাগা কাজ করছে না। উল্টো কেমন যেন বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে তার। মাথা না তুলে বলল,
‘আচ্ছা, তাহলে আমি আসছি ভাইয়া। নাম্বার না হয় আজকে থাক। আমার বান্ধুবীকে বলবো আপনার সাথে দেখা করতে।’
জাকী পথ আগলে দাঁড়ালো নুবাহর। দন্তপাটি দেখিয়ে হেসে উঠল। গলার সুরও বেশ নরম। বলল, ‘আরে, আমি তো মজা করছি। কি নাম তোমার? তুমিও কি ম্যাথ বিভাগে পড়?’
‘জ্বী, আমার নাম নিশাত। আমি ম্যাথ বিভাগের না, কেমেস্ট্রি বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্রী।’
‘ওহহ, আচ্ছা। আমার সাথে এসো। তোমাকে আসল জাকীর সাথে দেখা করাবো। আমি তো জাকীর বন্ধু। আমি জাকি নই।’
নুবাহ যেতে চাইলো না। তার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগছে। সেতো ইমদাদকে চেনেই না। কেউ মিথ্যে বললেও ধরতে পারবে না। তার মন বলছে ফিরে যেতে। কিন্তু জাকী নাছোড়বান্দা। সে নুবাহর পথ আগলে দাঁড়িয়েই আছে। নুবাহ ধীর কদমে পা বাড়ালো জাকীর সাথে। সামনে কি আছে জানা নেই তার। ভেতরের দিকে যতই যাচ্ছে ভয়ে আৎকে উঠছে। এক জনশূন্য নির্জন দিকে যাচ্ছে তারা। এটা উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের পেছনের দিক। কিন্তু এদিকে কেনো নিয়ে যাচ্ছে বুঝল না। কিছুদূর আসতেই দেখল পাশে জনশূন্য ক্লাস। নুবাহ আৎকে উঠল ভয়ে এবার। সে বাইরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল। জাকী আকুল ভরা কন্ঠে বলল,
‘এসো নিশাত, ভেতরে এসো। তোমার জন্য জাকী অপেক্ষা করছে।’
নুবাহ দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ সরাসরি নিষেধ করল। নুবাহ ভুল করিস না। ফাঁদে পা দিস না। দৌড় লাগা। সে জাকীর কথায় ভেতরে প্রবেশ না করে থমকে দাঁড়াল। যতটা দ্রুতই দৌড়ানো যায়, তাই করল। যাই হয়ে যাক, পেছনে তাকালো না একবারের জন্যও। জাকী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি হল তার সাথে? মেয়েটা কি তাহলে তার চালাকি ধরে ফেলেছে। এভাবে শিকার ফসকে গেল। খুবই অনর্থক হল তার সাথে।
নুবাহ ছুটে এল সেই নির্জন জায়গা থেকে। দৌড়ে আসায় হাঁপিয়ে গেছে। মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। তাই অনেক ক্লাসরুম ফাঁকা এখন। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও তুলনামূলক বেশ কম। কলেজ বাস মাত্র দুইটা ছিল। ঝটপট সামনে যেটা পেল উঠে পড়ল সে। ক্লান্তিতে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আছে তার। বাসে উঠেই কিছুটা অবাক হল। ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা বেশ সীমিত এখানে। তাও পাশ কাটিয়ে একটা খালি সিটে গিয়ে বসল। কিছুসংখ্যক ছেলে সামনে বসা আর কিছু পেছনে। মাঝখানে দু’চারটা মেয়ে ছিল শুধু। সিটে বসতেই দু’চোখ আপনা আপনি মুদে এল। নিজের কাঁধের ব্যাগ কোলে রেখেই তাকে জড়িয়ে ধরল। মুহুর্তের মাঝে দু’চোখ তার নিদ্রা আচ্ছন্ন হল। আধাঘন্টা পেরুলো, কিন্তু নুবাহর ঘুম ভাঙলো না। গাড়ির ঝাঁকুনি কিংবা আশেপাশের শব্দেও তার হুঁশ নেই। বাস থেকে একে একে বাকি মেয়ে’রাও নেমে পড়ল। বাকি একা মেয়ে নুবাহ পড়ে আছে। কয়েকটা সিট ছেলেরা দখল করে আছে। বাকি সিট খালি।
বাস থামল। গন্তব্যেই আসতেই জিতু নামার জন্য প্রস্তুতি নিল মাত্রই। পেছনের সিট থেকে বেরিয়ে আসতেই নামার আগে দৃষ্টি পড়ল নুবাহর দিকে। সহসাই চোখ বুলালো বাসের দিকে। পুরো বাসে একটা মাত্র মেয়ে সে। গুটিকয়েক ছেলে, বাস ট্রাইভার আর হেল্পার আছে। হুট করে তার রাগ গিয়ে পড়ল নুবাহর উপর। বাচ্চামেয়ে তো নয়, ভার্সিটিতে পড়ে। যথেষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি আছে। বাসে এভাবে কেউ ঘুমায়। আশেপাশে কি আছে এই মেয়ের কোনো ধারণা আছে। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে এই মেয়ে কোনো খোঁজ খবরই রাখে না বোধহয়। যেকোন সময় যেকোনো দুর্ঘটনার স্বীকার হতে পারে সে। অথচ সেই মেয়ে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এই মেয়েকে উঠিয়ে সপাটে দুইটা চড় দিতে। কিন্তু তার কথা বলার একদমই ইচ্ছে নেই এই মেয়ের সাথে।
নামার জন্য প্রস্তুতি নিয়েও নামল না। নিজের কদম ফের পেছনে নিল। ড্রাইভারকে আবার গাড়ি চালাতে বলল। নুবাহর ঠিক পেছন সিটে গিয়ে বসল। শুধু নজরে রাখল নুবাহর কোনো বিপদ হচ্ছে কি’না? এর আগে সে দেখে এসেছে ম্যাথ বিভাগের জাকীর সাথে কথা বলতে। তার মাথায় এটা আসে না, জাকীর মত বখাটে ছেলের সাথে এই মেয়ের কিসের সম্পর্ক। মাত্রই কলেজে আসল চারদিন হল। এর মাঝে কত ছেলের সাথে এর ভাব। নিরবের সাথেও দেখেছে বেশ গলায় গলায় ভাব। বির্তক ক্লাবে তাদের সেই মাখো মাখো ভাব সে দেখেছে। আবার এই মেয়েকে ম্যাথ বিভাগের সামনে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। তাহলে কি এই জাকীর জন্য অপেক্ষা করে। জাকীর সাথে কি ওর সম্পর্ক আছে।
তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল জিতু। থাকলেই বা তার কি?
প্রায় বিশ মিনিট পর নুবাহর ঘুম ভাঙলো। গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়েছে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে তার। ঘুমের রেশ’টা তখনো কাটেনি তার। চোখ পিটপিট করে তাকাতে দেখল বাস পুরো খালি। এমন খালি বাস দেখে আৎকে উঠল। সে মরার মত ঘুমিয়েছে না’কি, বুঝতেই পারিনি। তড়িঘড়ি সিট থেকে উঠল। নামার সময় ভাড়া দিতেই নিজের ব্যাগে হাত রাখল। হুট করে মনে পড়ল তার কাছে ভাড়ার পুরো টাকা নেই। ঐ দপ্তরিকে নিজমনে গালি ছুঁড়লো। পুরো সাত’শো টাকা গচ্চা গেলো তার। হেল্পারের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।
‘আমি যদি কালকে ভাড়ার পুরো টাকা’টা দিই, হবে না ভাই। আসলে আমার কাছে এখন পুরো ভাড়া নেই।’
হেল্পার কর্কশ গলায় চেঁচালো, ‘মশকরা করেন। জলদি ভাড়া দিয়ে ভালোয় ভালোয় ক্যাইটা পড়েন।’
হেল্পারের চেঁচামেচিতে জিতু নিজের মাথা উঠালো। গলার স্বর উঁচু করে জিজ্ঞেস করে বলল, ‘কি সমস্যা।’
হেল্পার নিজের ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘দেখেন না এই আপায় কয়, ভাড়া নাকি কাল দিব। উনার কাছে এখন ভাড়া নাই। এটা কোনো কথা ভাই, আপনেই বলেন?’
জিতু উঠে এল। কাছে এসে হেল্পারকে বলল, ভাড়া কত?
‘ষাট টাকা।’
জিতু নিজের পকেট থেকে ষাট টাকা বের করে হেল্পারের হাতে তুলে দিল। তারপর নেমে পড়ল দ্রুতই। নুবাহ ধীর কদমে বাস থেকে নামল। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না। তাও কি না শেষ পর্যন্ত এই জিতুর ডিমের সামনে অপদস্ত হতে হল। ছিঃ, কি লজ্জা! সেই দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে। তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে দাড়ানো জিতু। একবারের জন্যও তার দিকে তাকায় নি। এখন আবার রিকসায় উঠতে হবে। রিকশা ভাড়া লাগবে পঞ্চাশ টাকা। আছে ত্রিশ টাকা। এখন আবার সেই ভাড়া নিয়ে তার ঝামেলা পোহাতে হবে। বাসার সামনে গিয়ে না হয় ভাড়া মেটানো যাবে। কিন্তু এই জিতুর ডিমের সামনে কিভাবে দাঁড়াবে। আচমকাই সে আৎকে উঠলো। জিতু তার একান্তই সামনে দাঁড়ানো। এতটা সামনে দেখে শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। সে কিছু বলার আগেই জিতু বলে উঠল,
‘এখানে আরও চল্লিশ টাকা আছে। নিন, আপনার রিকশা ভাড়া। এত কিছু ভাবার দরকার নেই, আমি আবার অত দয়ালু নই। এমনেই টাকা’টা দিচ্ছি না। বাস ভাড়া ষাট টাকা আর এখন চল্লিশ টাকা। সর্বমোট একশো টাকা, আগামীকাল সুন্দর করে আমাকে ফেরত দিবেন। মনে থাকবে তো মিস কালরাত। যান সামনে রিকশা আছে। বাসায় যান দ্রুত। আর হ্যাঁ, এর পরেরবার এভাবে বাসের মধ্যে ঘুমাবেন না। কারণ, সবসময় তো আর আমি থাকব না। ঠিক আছে, আসছি, আল্লাহ হাফেজ।’
দ্রুতই নিজের কথা শেষ করে সামনের দিকে নিজের কদম বাড়াল জিতু। পেছনে নুবাহ হা’ হয়ে আছে। শুধু অপলক জিতুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বাপরে! এই জিতুর ডিম তো পুরোই হাঁড় কিপ্টে একটা।
চলবে,,,,,