#হিয়ার_মাঝে ৩০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
নিথর শরীর। কোনভাবে এলোমেলো কদমে বাবার সামনে হাজির হয়েছে জিতু।
আজমল ছেলের বেহাল অবস্থা দেখে আৎকে উঠলেন। রক্তিম অভিসিক্ত দু’চোখ, উষ্কখুষ্ক চুলে গাছের পাতা, সাদা পাঞ্জাবির কোণা জুড়ে মাটি লেপ্টে আছে। আবারও ছেলে তার পাগলামি করেছে। কবরের পাশে নিশ্চয় বসে পড়েছিল। অজান্তেই নিজের বক্ষস্থল থেকে ভারী নিশ্বাস বের হয়ে এল। তার ছেলে কবে সুস্থ জীবনে ফিরবে। তার জানা নেই। কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্ট পরামর্শ দিয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব ছেলেকে বিয়ে দিতে। তাই তো তড়িঘড়ি করছেন। তার বিশ্বাস একদিন ঠিক তার ছেলে অতীত থেকে বেরিয়ে আসবে।
জিতু টালমাটাল শরীরে গা এলিয়ে গাড়ির সিটে বসল। জলশূন্য দু’আঁখি। কান্নার দাগ এখনো মুখে লেপ্টে আছে। আজমলের হতশ্রী মুখশ্রী তখন ছেলের দিকে নিবদ্ধ। জিতু আচমকাই বলে উঠল,
‘আব্বু বিয়েটা না করলে হয় না। কেন আরেকটা মেয়েকে আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো। তাকে আমি কিভাবে মেনে নিব। ও আব্বু, বিয়েটা ভেঙে দাও। আমি পারব না সেই মেয়েকে মেনে নিতে।’
আজমল অবাক হলেন না। তিনি জানতেন, তার ছেলে এই কথায় ঘুরে ফিরে তাকে বলবে। কিন্তু তিনি অনঢ় নিজের সিদ্ধান্তে। যেভাবে হোক তার ছেলেকে অতীত থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ফের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। নমনীয় সুরে বলল,
‘একটা গল্প শুনবে, মন ভাঙার গল্প।’
‘কার আব্বু।’
আজমলের নির্লিপ্ত চাউনি। কন্ঠে আকুলতা ফুটে উঠলো। তিনি ফিরে গেলেন তার সেই বত্রিশ বছর আগের অতীত জীবনে।
‘বয়স তখন ঊনিশ। দেখতে ছিলাম বলিষ্ঠ গড়নের, সৌন্দর্যে গ্রামের মধ্যে বেশ সুদর্শন যুবক। তাই অনেক মেয়ের প্রস্তাব পেতাম। কিন্তু আমি তাদের দিকে ফিরেও তাকাই নি। কিন্তু একদিন ঘটল এক অঘটন। কলেজ থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎই মাঝপথে গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লাম, গাড়ি ঠিক হওয়ার অপেক্ষা করছি। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য রশ্মি, গরমে হাসফাস লাগছিল। গাড়ি ঠিক হতে বেশ সময় নিল। আশেপাশে দোকানপাট নেই। পানির তীব্র পিপাসা পেল। কিন্তু পানি যে খাব তার কোন উপায়ও নেই। মুখ থেকে শুধু তপ্ত শ্বাস বের হচ্ছিল তখন। আমার সাথে আরও দু’জন মহিলা এবং দু’জন মধ্য বয়সী পুরুষও ছিলেন। তারাও হাসফাস করছে। এমন একটা মধ্যাহ্ন আজও আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। আমরা পূর্ব দিকে যাব। তাই আমার দৃষ্টি ছিল পূর্ব দিকেই। আচমকাই চোখ পড়ল কালো বোরকায় হিজাবে আবৃত এক নারী অবয়বের উপর। সেও পূর্ব দিকে যাচ্ছে। আমার জানা নেই সে কে? কোথায় থেকে এসেছে। কিন্তু আমার দৃষ্টি তার দিকেই স্থির। কেন এভাবে তাকিয়ে ছিলাম আজও জানা নেই। তার কিছু সময় পর আমাদের গাড়ি ঠিক হল। গাড়িতে উঠলাম। কিছুদূর আসতেই সেই কালো বোরকাওয়ালীকে পুনরায় দেখলাম। আমার মনে কৌতূহল জাগল। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম, সে সামনের একটা বাড়িতে প্রবেশ করছে। তারপর থেকে প্রায় আমি ইচ্ছে করে ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটতাম, সেই মেয়েকে দেখার জন্য। কিন্তু এর একমাস পর সেই মেয়ের পুনরায় দেখা পেলাম। কিছু তথ্যও সংগ্রহ করলাম। মেয়েটা দশম শ্রেণির ছাত্রী। কিভাবে সেই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করব উপায় খুঁজলাম। এক বাচ্চামেয়েকে দিয়ে তার কাছে চিরকুট প্রেরণ করলাম। কিন্তু দিন, সপ্তাহ তারপর মাস পেরুলো। কিন্তু মেয়েটার উত্তর আসে না। আমি আবারও চিরকুট প্রেরণ করলাম। কিন্তু তার উত্তর আসেনি। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল আমার।
একদিন হুট করেই মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটা আমাকে দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি তাকে অভয় দিলাম। শুধু দু’মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে আসলাম। আসার সময় ধমক দিয়ে আসলাম। এবার আমার চিরকুটের জবাব যেনো পাই। মেয়েটা মাথা নাড়ালো শুধু। এরপর চিরকুট দেয়ার সাথে সাথেই জবাব আসত। শুধু আমার প্রশ্নের জবাব দিত। কিন্তু নিজ থেকে কিছুই বলতো না। আমিও তাকে তেমন জোরাজোরি করতাম না। এর মাঝে আমি ঢাকা আসি। বাণিজ্যে বিভাগ থেকে স্নাতকে ঢাকা কলেজ ভর্তি হই। ঢাকা আসার দু’মাস পর আমার কাছে একটা চিরকুট আসে। আমি অবাক হই। সেদিন প্রথমবার মেয়েটা নিজ থেকে চিঠি লিখেছিল। সবার প্রথমে আমি কেমন আছি জানতে চাইল। মেয়েটা আমাকে যে ভালোবাসতে শুরু করেছে সেদিনই আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম। আমিও তার চিঠির জবাব দিলাম। বাড়ি এলাম প্রায় তিনমাস পর। প্রথমবারের মত মেয়েটা আমার সাথে দেখা করল। কালো বোরকায় আবৃত আপাদমস্তক সে। কিন্তু তার কালো দু’চোখ ভীষণ মায়াময় ছিল। আমি তার মায়ায় পড়ে গেলাম। সেদিন সে মুখ ফুটে তার নাম বলল, আমার নাম জেসমিন। আমার দু’বড় ভাই আছে। আমি মুচকি হাসলাম তার কথা শুনে। মেয়েটা ছিল ভীষণ লাজুক। দু’শব্দ কথা বলেই চুপ হয়ে গেল। এরপর মাঝে মাঝে দেখা করতাম। কিন্তু তার মুখটা কখনও দেখা হয়নি। আমিও জোর করিনি। কিন্তু মনে মনে পণ করলাম। আমি জেসমিনকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি একটা সুপারমলে চাকরি নিলাম। বেতন যৎসামান্য ছিল। কিন্তু তাও হয়ে যেত। আমি কিছু বাড়িতে পাঠাতাম, আর কিছু জমানোর চেষ্টা করতাম। জেসমিন আর আমার তিন বছরের লুকোচুরি প্রেম চলছে। আমি ততদিনে বাইশ বছরের যুবক। বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। তা দিয়ে জেসমিন আর মায়ের জন্য কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। আকাশে চাঁদ নেই। বাড়িতে আসতেই মায়ের হাসিখুশি মুখ তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পরেরদিন আমি জেসমিনকে চিরকুট পাঠালাম দেখা করতে। কিন্তু জেসমিন আসল না। আমার মনটা বিষিয়ে গেল। কি হল জেসমিনের?
সন্ধ্যা গড়ালো। উঠোনের এককোণে বিমর্ষ হয়ে মাচায় বসে আছি। আচমকাই এক নারী অবয়ব ছুটে এল আমার কাছে। আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। কে এই নারী? নারী অবয়ব কথা বলে উঠল। আমি জেসমিন। সেদিনই প্রথম আমি জেসমিনকে বোরকা ছাড়া দেখলাম। গোলগাল গড়নের শ্যামবর্ণা মেয়েটা হু হু করে কেঁদে উঠল। আমার দু’পা জড়িয়ে কান্নামিশ্রিত করুণ স্বরে বলল,
‘আপনি আমারে নিয়া চলুন। আমি আর বাড়ি ফিরমু না। বাবা আমার বিয়া ঠিক করছে। তারা আমাকে বিয়া দিয়া দিবে। আমাকে দয়া করুন, আপনি আমারে যা দিবেন, তা দিয়াই আমার চলে যাবে। আমারে ফিরাইয়েন না। আমি আর বাড়ি যামু না।’
আমি হতবাক। জেসমিন এজন্যই দেখা করেনি সকালে। আমি মায়ের কাছে জেসমিন’কে নিয়ে গেলাম। পরিবারের বড় ছেলে ছিলাম। এভাবে হুট করে একটা মেয়েকে পালিয়ে কিভাবে বিয়ে করব। তাই আম্মাকে সব খুলে বললাম। আম্মা আমাকে অভয় দিলেন। তিনি জেসমিনকে বাড়ি ফিরে যেতে বলল। আগামীকাল আমি আর আম্মা মিলে তাদের বাড়ি যাব বলে তাকে আশ্বাস দিলাম।
জেসমিন ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেল। তার চোখ থেকে অবলীলায় পানি পড়ছিল। আজ ভীষণ মনে পড়ে, জেসমিনের দু’চোখ বার বার বলছিল, আমাকে যেতে দিবেন না। আমি আর ফিরব না। কিন্তু আমি সেদিন সে ভাষা বুঝতে পারেনি।
আমি আর আম্মা মিলে পরেরদিন জেসমিনের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলাম। জেসমিনের বাবা আমাদের প্রস্তাব শুনেই তেড়ে এলেন। আমার আম্মাকে চরম অপমান করল। কিন্তু তারপরও আম্মা নিশ্চুপ সয়ে গেলেন। ফের হাসিমাখা মুখে জেসমিনকে চাইলেন। কিন্তু তখন জেসমিনের দু’ভাই তেড়ে এল। আমাদের কথা না শুনেই উল্টো আম্মাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। দোষ করলে আমি করেছি, আমার মা নই। শাস্তি দেবার হলে আমাকেই দেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমার আম্মা এত অপমানের পরও জেসমিনের বাবার পা’ জড়িয়ে ধরল। কত অনুনয় বিনয় করল। কিন্তু জেসমিনের বাবার মন গলল না। তিনি বজ্রকঠিন গলায় বললেন,
‘মেয়েরে কেটে টুকরো টুকরো করব, তাও এমন অজাত চাল চুলাহীন ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবো না। দু’টাকা রোজগার করার মুরোদ নাই, আবার আমার মেয়েকে বিয়ে করবে। যা ভাগ এখান থেকে।’
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অথচ আম্মা বার বার আকুতি জানাচ্ছিল তাদের। শেষে না পেরে আম্মা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আমার মাথায় হাত বুলালেন। শান্ত গলায় বলল,
‘বাপ’রে তোর ভাগ্যে জেসমিন’রে লেখে নাই। আমি তোরে এর থেকে ভালো ঘরে বিয়ে করামু। কালই মেয়ে দেখমু। ও বাপ কান্দিস না। আল্লাহর কাছে দোয়া ছা।’
আম্মা আমার নিছকই সান্ত্বনারচ্ছলে এই কথা বলেন নাই। সত্যিই মেয়ে দেখা শুরু করলেন। এক সপ্তাহ পর জেসমিনের বিয়ে হয়ে গেল। আম্মা আমাকে ঠিক তার পনের দিনের মধ্যে বিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, না সেদিন কিছুই বলেনি। শুধু দিনরাত আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতাম।
ফরিদা আমার জীবনে বউ হয়ে আসল। আমি নিজেকে সময় দিলাম। কিন্তু তোমার মা’কে কখনো অসম্মান করি নি, না অবজ্ঞা করেছি, না তাকে আমার অতীতের সাথে জড়িয়েছি। জেসমিনকে ভালোবাসলেও তোমার মায়ের প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। হয়তো মনের এককোণে জেসমিনকে এখনো রেখেছি। কিন্তু তার পাশাপাশি ফরিদাকেও ঠাঁই দিয়েছি।
তাই তোমাকে বলব না, তোমার অতীত ভুলে যাও। বরং সময় দাও নিজেকে। নিজের স্ত্রীর অধিকার না দাও, কিন্তু স্বামী হিসেবে দায়িত্ব পালন কর। এইটুকুই অনুরোধ তো বাবা হিসেবে করতেই পারি।
‘ভালোবাসা’টা না থাক, কিন্তু ভালোলাগা’টা থাক মনগহীনের এককোণে।’
জিতুর বিস্ময়কর দৃষ্টি নিজের বাবার দিকে। সত্যি সে কখনো দেখেনি তার মায়ের প্রতি বাবার অবহেলা কিংবা অবজ্ঞা। অথচো সে ভাবতো বাবা-মা বুঝি ভালোবেসে বিয়ে করেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বক্ষস্থল থেকে। নিজেকে বুঝালো সে চেষ্টা করবে। বাকি’টা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিল।
_____
কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান। তার জন্যে তৈরি হচ্ছে নুবাহ। প্রতিদিনের মত সাধারণ পোশাক পরেছে। কিন্তু রুবি তাকে দেখে ধমকে উঠল। নবীন বরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে, আর মেয়েটা সাধারণ পোশাক পরে যাচ্ছে। জোর করে সে সদ্য কিনে আনা নতুন জামদানী পরালেন নুবাহকে। সে পরতে চাইলো না। কিন্তু খালার ধমকে চুপসে গেল। শাড়ির সাথে মিলিয়ে হিজাবও পরিয়ে দিলেন।
নুবাহর গায়ে নীল রঙা শাড়ী, তার সাথে একই রঙা হিজাব। কলেজে পা রাখতেই চোখ পড়ল নানা রঙের, নানা বর্ণের শাড়ি আর পোশাক পরিহিত রসায়ন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের। মিলনায়তনের সামনে সকল ছাত্র-ছাত্রীর জটলা বেঁধে আছে। নুবাহ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। শাড়ি তার পড়া হয় না। তার উপর ভার্সিটিতে পরে এসেছে। সে তাসনিহার জন্য অপেক্ষা করছে। আচমকাই চোখ পড়ল নীল রঙা পাঞ্জাবী পরিহিত জিতুর দিকে। আজ কেন যেনো অন্যরকম লাগছিল। চুলগুলো আজ বেশ গোছালো, নীল রঙ যেন তার গায়ে একদম সেটে গেছে। বলিষ্ঠ গড়নের জিতুকে আজ বেশ সুদর্শন লাগছে। কয়েক মুহুর্তের সেই দৃষ্টি বিনিময়ে ছিল অদ্ভুত অনুভূতি।
জিতুর দৃষ্টিও তখন তার দিকে। দু’জনের আচমকাই প্রগাঢ় দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। নুবাহ ফের লজ্জায় পড়ল। জিতুর দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগছে। সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো। বন্ধুমহলের সবার আগমন ঘটল তখন। হৈ-হুল্লোড়ে মেতেছে সব।
চলবে,,,,,
রমজান মোবারক সবাইকে। রমজান উপলক্ষে হয়তো প্রতিদিন গল্প দেয়া সম্ভব হবে না। তাই একদিন পর পর গল্প আসবে। ধন্যবাদ।