#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৫,,
পরদিন ভোরে বাড়িতে নাসীরা পারভীনের দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই, হালিম সাহেব এসে হাজির হয়েছেন। হঠাৎ তার আগমনে নাসীরা পারভীন ব্যতীত কেউই আসলে খুশি হয়নি। লোকটা এককালে সচিব ছিলেন। একমাত্র মেয়ের জামাই একজন জীববিজ্ঞানী, তারা থাকে আমেরিকা। লোকটার অহংকারী ভাবটা আনিস সাহেবেরও পছন্দ না। নিজেকে কি মনে করেন, সেটা কেউ চিন্তা করেও বের করতে পারে না।
একদিন ভোরে আনিস সাহেবকে কল করে খোশগল্প শুরু করে দিলেন। তখন একদম ভোর। ঘুম ঘুম চোখে আনিস সাহেব ফোনটা রিসিভ করে কথা বলেন। কথাগুলো নিতান্তই অমূলক গল্প ছিলো। একপর্যায়ে তিনি বলেন, তার শরীর বেশ অসুস্থ হয়ে ছিলো কিছুদিন যাবৎ। ডাক্তার বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে কোনো রোগ পায়নি। এমনকি এটাও বলেন, ল্যাব রিপোর্ট নিতে গিয়ে ওনি জিজ্ঞাসা করায় ওরা বলে, ওনার স্টুলে কোনো ওয়ার্ম নেই। ঘুম ভাঙিয়ে এমন কথায় আনিস সাহেবের মেজাজ তখন তিরিক্ষি হলেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারেননি।
তিলো ঘুম থেকে উঠে ওনাকে দেখে চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই লোকের মতলব ওর ভালো লাগে না। এক কাজ পেয়েছে এখন, ঘটকালি করা। তুলির বিয়েটা ওনি দিয়েছিলেন। আজ ওনাকে দেখেই অজানা আশঙ্কায় তিলো মৃদু কেঁপে উঠলো। হঠাৎ খবর না দিয়ে একা এলেন কেন? ওনার স্ত্রী কোথায়? তিলো এসব চিন্তা করতে করতেই একেবারে রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো ভার্সিটিতে যাবে বিধায়। ওনার আগেরবার যাওয়ার সময় বলা শেষ কথাগুলো তিলোর কানে বাজছে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, তিলো বড় হয়েছে। ওর তো এখন একটা সংসার হওয়া প্রয়োজন। তুলি তো পার হলো। সামনেরবার এসে ওর জন্য জামাই ঠিক করেই যাবে।
তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে ওনার দিকে পিঠ দেখিয়ে বসে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করে নিলো। পানি পান করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছোট করে হালিম সাহেবকে একটা সালাম দিলো।
হালিম সাহেব মুখে হাসি নিয়ে মৃদুসুরে তার জবাব দিয়ে বললেন,
-তিল মা, আজ বাইরে যাসনা।
তিলো ভ্রু কুঁচকে বললো,
-যাওয়া তো লাগবে মামা। ক্লাস মিস করা যাবে না।
নাসীরা পারভীন পাশ থেকে বলে উঠলেন,
-মামা যখন যেতে নিষেধ করছে, তো একদিন না গেলে কিছু হবে না।
তিলোর সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে। হালিম সাহেব কমলা দাঁত বের করে হেসে বললেন,
-বয় বয়। সামনে বয় তো দেখি। কতকাল দেখি না তোদের।
তিলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওনার সামনের সোফাটায় বসলো। হালিম সাহেব আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বললেন,
-তা পড়াশোনা কেমন চলছে?
তিলোর একবার ইচ্ছা হলো বলবে, নিজেই তো যেতে দিলেন না ভার্সিটিতে। এখন এই প্রশ্ন অমূলক। কিন্তু বললো না। ভদ্র কন্ঠে বললো,
-এই চলছে। ভালোই। আলহামদুলিল্লাহ।
-তা ভালো।
কথাটুকু বলে ওনি চুপ করে আছেন। তিলোর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে যেন পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। এরপর নাসীরা পারভীনের দিকে ফিরে তাকাতেই। নাসীরা পারভীন তিলোকে নিজের রুমে যেতে বললো। তিলো বিরক্তির একটা মুখভঙ্গি করে নাসীরা পারভীনকে একনজর দেখে নিজের রুমে চলে এলো।
নিজের রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। নাসীরা পারভীন চিৎকার করে উঠলেন। তিলোও গলার স্বর চড়িয়ে বললো,
-সরি আম্মা। জোরে লেগে গিয়েছে।
এরপরই ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। এর কোনো মানে হয়? যেতে দেবে না আগে বললেই হলো। এতো কষ্ট করে তিলো রেডি হতোনা। তিলো কয়েক পদক্ষেপ হেঁটে নিজের শরীরটাকেও ঠাস করেই বিছানার উপর ফেলে দুইহাত দুদিকে প্রসারিত করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। তিলো ভাবছে, ওর ভাবনা সত্যি হলে, তুলির বরটা তো খারাপ হয়নি৷ তুলি নিজের দোষে সংসার হারিয়েছে। তিলোর জন্যও এমন কাউকে? নাকি ওর গায়ের রঙের জন্য ওকে ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া যাবে না?
তিলোর ভাবনার মাঝেই তুষার নক করলো। তিলো মুখ থেকে ‘চঁ’ জাতীয় একটা শব্দ করে উঠে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই তুষার হেলেদুলে রুমে ঢুকলো। তিলো দরজা চেপে দিয়ে তুষারের দিকে সন্দেহাতীত চোখে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। তুষার ওর বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে বললো,
-তিলাপু তোর বিয়ে।
তিলো এবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওর কথায়। যদিও আগেই আন্দাজ করেছিলো। তুষারের হাত টেনে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে বললো,
-বললেই হলো নাকি? বিয়ে এতো সহজ!! আমি করবো না।
-সেটা তোর ব্যাপার। আজকে যে তোকে পাকা দেখতে আসবে নিশ্চিত থাক।
তিলো কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
-তুই জানলি কেমন করে?
-মামাকে দেখলি না? আমি আম্মাকে আব্বুকে বলতে শুনেছি।
-আমার পছন্দের একটা বিষয় আছে।
-আগে তো দেখুক। বাদ দে। বলতো কালকে আম্মা তুলি আপুর উপর রেগে ছিলো কেন?
-আমি কি করে জানবো? তুই আম্মাকে জিজ্ঞাসা কর।
-সেটা পারিনা বলেই তো আমার আশেপাশে এতো রহস্য। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে বকা খাওয়ার সাধ নেই।
-জানা লাগবে না৷ তোর জানার বিষয়ও না।
-বল না। আমি জানি, তুই জানিস।
-না বললাম তো। বিরক্ত করিস না। এমনিতে মেজাজটা গরম হয়ে গেলো।
তুষার আরো কিছু সময় ওকে জোরাজোরি করা সত্ত্বেও ও বললো না। তুষার হতাশ হয়েই নিজের রুমে ফিরলো।
তুষার চলে যেতেই তিলো অনিকে ফোন করলো। ও সরাসরি আজকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলো অনিকে যে ও অরিকের সাথে আসলে কি করেছে। কিন্তু যেতে পারলোনা ভার্সিটিতে। আর ওর কৌতুহলও দমিয়ে রাখা সম্ভব না। তিলো কল করতেই অনি রিসিভ করলো। তিলো সাধারণ ফর্মালিটি বাদ দিয়ে সরাসরি ওকে বললো,
-কি করেছিস রে তুই অরিক ভাইয়ের সাথে?
অনিমা একমুহূর্ত চুপ থেকে ওর কথাটা বোঝার পর বললো,
-কি করবো? তোর ওই আনরোম্যান্টিক গম্ভীর ভাই তো শুরুতেই সব পন্ড করে দেয়। সকালের নাম্বার বাদ দিয়ে আরেক নাম্বারে ফোন করলাম। সে ধরেই আমি কথা বলছি না বলে কেটে দিলো। আমি আবার দিলাম। এবার রেগে ঝেড়ে দিলো। আমি আবার দিয়ে বুঝতে পারলাম, নাম্বার ব্লক করেছে। আমি আয়াশের ঘর থেকে ওর সীমের বক্সটা এনে আর আমার গুলো মিলিয়ে মোট তেরোটা সীম নিয়ে বসলাম, তাকে একে একে ফোন করবো বলে। সময় নিয়ে নিয়ে ফোন করলাম। আরো দুটো ব্লক করার পর আর ফোন ধরে না। এরপর সন্ধ্যায় কল করে বললাম, প্রফেসর আমি অনি। ওনি চিনলেনই না৷ তোর বান্ধবী পরিচয় দিলে বললো, কলেজে কোনো সমস্যা হলে অফিসে ফোন করতে। আবার দিলো কেটে। আমি আবার ফোন করে বুঝলাম সেটাও ব্লক করেছে। আরেকটা দিয়ে ফোন দিতেই, তিল, এই তিল…….।
অনিমা ওদিক থেকে তিলোর কোনো আওয়াজ না পেয়ে ওর নাম ধরে ডাকলো। তিলো ওর কথা শুনে ঝিমাচ্ছে। মেয়েটা এতো কথা বলে! একসাথে বলে যায়, ওদিকে কে শুনলো না শুনলো সেদিকে খেয়াল খুব কম। অনির মুখে নিজের নাম শুনে তিলোর হুস ফিরলো। আধো আধো গলায় বললো,
-হু বল।
-তুই কি আদৌও শুনছিস?
তিলো অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় বললো,
-হ্যাঁ, হ্যাঁ। বল।
-বল আমি কি বলেছি এতোক্ষণ?
তিলো এবার বিপদে পড়েছে। তিলোর কৌতুহল হলেও অনির বর্ণনায় ওর ঝিমুনি এসে গিয়েছিলো। তিলো আমতাআমতা করে বললো,
-ওই, ওই তো। কয়েকটা নাম্বার ব্লক খেলি। আবার দিলি। আবার ব্লক খেলি। আবার দিলি৷ আবার ব্লক খেলি। আবা……।
-থাম। তোকে আর বলবোই না। কিচ্ছু শুনিস না তুই।
-আরে আরে না। আমি শুনছি। বল।
অনি আবার শুরু করলো,
-ওনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন সকাল থেকে আমি বিরক্ত করছি। এবার ফোন দিতেই…
অনির কথা শেষ হওয়ার আগেই তিলো কৌতুহলী কন্ঠে বললো,
-এবার ফোন দিতেই …।
অনির কথার মাঝে থামিয়ে দেওয়ায় ওর একদমই ভালো লাগেনি। কর্কশ গলায় বললো,
-তোর ওই মারুফ ভাই আমার সাথে প্রেমালাপ করেনি। কি উগ্র মেজাজ! যা নয় তাই বললো!
-মারুফ! হেইয়া কেডায়?
-ওই মারুফের মতো গালিগালাজ চালিয়েছে।
তিলো বুঝতে পারলো, অনি প্রতিকী অর্থে তার নাম নিচ্ছে। তিলো নাক ফুলিয়ে নিজের সামান্য রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বললো,
-আমার ভাই ওরকম ভাষা ব্যবহারই করে না। বাজে কথা বলবি না ওর নামে।
-এঁহে। এসেছে আমার ভাই ভক্ত বুন্ডি। শোন, আমি না হয় একটু বাড়িয়েই বলেছি। অতো খারাপ কথা সে বলেনি। কিন্তু খুব ভালো কথাও বলেনি। এই তুই না বলেছিলি, তুষার জন্মানোর পর ওকে কেবিনে নিয়ে আসতেই তোর দাদী তখন র’চা খাচ্ছিলেন, তাই মধুর অপেক্ষা না করে ওর মুখে র’চা দিয়েছিলেন আঙুলের মাথায় লাগিয়ে? তিল, আই স্যোয়্যার তোর অরিক ভাইকে এভাবে নীম পাতার রস খাওয়ানো হয়েছে জন্মের পর।
-তুষারেরটা সত্যি। ভাইয়েরটা তো জানি না।
-জেনে নিস। এই অনির ধারণা ভুল হতে পারে না।
বাই দ্য ওয়ে, ভার্সিটি আসবি না?
-না। ভালো লাগছে না।
অনি আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দিলো। তিলোর খুব ঘুম আসছে। ভার্সিটি গেলে চা-কফি খেয়ে ক্লাস করা লাগতো। এখন উঠে গিয়ে চা বানাতে ইচ্ছা করছে না। তিলো আগে পিছে বেশি না ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো।
ওর ঘুম ভাঙলো নাসীরা পারভীনের ডাকে। ওনি বিরক্ত ভঙ্গিতে তিলোকে ডেকে চলেছেন। তিলো ঘুম থেকে উঠতেই, তিনি ওকে ফ্রেশ হয়ে এসে হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে পড়ে নিতে বললেন। তিলো পুরোটা বুঝতে পেরে বললো,
-আম্মা, আমি এখনি বিয়ে করবো না।
নাসীরা পারভীন ব্যস্ত ভঙ্গিমায় রুম থেকে বের হতে হতে বললেন,
-দেখাদেখি হলেই বিয়ে হয়ে যায়না মা। বিয়ে জীবনের খুব বড় একটা বিষয়। তোর মামার পরিচিত একটা ছেলে। দেখ তুই। পছন্দ না হলে তো আমরা আছি৷ মামা খুব আশা করে এনেছেন। তার সম্মান নষ্ট করিস না।
-আম্মা, তবুও।
তিলো ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাটা বললো। যেন এখুনি কেঁদে দেবে। নাসীরা পারভীন চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-কথা শোনো আমার। দুপুরে খাবে ওরা। মাংসটা আমি রান্না করছি। কিন্তু যখন আমি বলবো, তুমি করেছো। তুমি সম্মতি দেবে। আমি তোমাকে রেসিপি শিখিয়ে দিচ্ছি। আর একটু এসে খুন্তি নেড়ে দিয়ে যাও। দ্রুত।
নাসীরা পারভীন রুম ত্যাগ করতে নিতেই তিলো বললো,
-আমি কালো বলে, মিথ্যা যোগ্যতা দেখাতে হবে?
নাসীরা পারভীনের কানে কথাটা গেলেও তিনি কিছু না বলেই রুম ত্যাগ করলেন।
#চলবে