#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
২১,,
অটোটা এসে বাড়ির গেটের সামনে থামতেই নাসীরা পারভীন খুব দ্রুত নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। পারলে হয়তো চলন্ত অটো থেকে লাফ দিতেন। তুলি ঘুমন্ত ইশানকে তুষারের কোলে তুলে দিয়ে নিজেও নাসীরা পারভীনের পেছনে পেছনে ঢুকলো। নাসীরা পারভীন তিলোর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজা খোলা পেয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। নিশ্চিত হলেন তিলো বাড়ি ফিরেছে। তিনি তিলোর রুমে ঢুকে দেখেন, ও অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছে। খানিকটা রাগ হলো ওনার এটা ভেবে যে, এই সন্ধ্যায় বাড়ির দরজা হাট করে খোলা রেখে অরক্ষিত অবস্থায় বসে আছে ও!
নাসীরা পারভীন ওর দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-কাউকে কিছু না বলে এভাবে চলে আসো কোন আক্কেলে। ফোন বন্ধ করে রেখেছো কেন? বাড়ির বাকি মানুষগুলোর কথা চিন্তা করার প্রয়োজনবোধ করো না?
তিলো ওনার এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে বললো,
-আমাকে একা ছেড়ে দাও মা।
নাসীরা পারভীন ওর কথায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে চিৎকার করে বললেন,
-একেক জন একেক ঢং শুরু করেছে। বাড়িতে হচ্ছেটা কি? একজন হুট করে বিয়ে ভেঙে দেবে। একজন হুট করেই সবার সামনে মান সম্মানের কিছুই বাকি রাখবে না। একজন তাতে আবার সায় দেবে। বলি এতোই যখন বিয়ে করার ইচ্ছা তো তার পরিবারকে বলুক। আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে ন্যাকামি করার কি…
নাসীরা পারভীন কথাটা শেষ করার আগেই তিলো হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো,
-আমাকে একা থাকতে দিতে বলেছি তোমাদের। কেন বিরক্ত করছো? আমার মতামতের কোনো মূল্য আছে তোমাদের কাছে? বলো আমাকে। আছে কোনো দাম? এই কয়েকদিন ধরে সব কথা আমাকে নিয়ে হচ্ছে। কিন্তু কেউ একবারও আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করো না তোমরা। মামা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে কাউকে দেখানোর আগে? মেনে নিয়েছি। তবুও মেনে নিয়েছি। হুট করে ওরা আংটি পড়িয়ে গেলো। তাও মেনে নিয়েছি। অবশেষে রেজা সাহেবকে বিয়ে করতে মতও দিয়েছি। এখন আবার এই নাটক কেন?
তিলো প্রথম কথাগুলো চিৎকার করে বললেও, কথা বলতে বলতে নাসীরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে ফেললো। একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, এটা ওর বোধগম্য হলো। নাসীরা পারভীন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তুলি দরজার সামনে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তিলোর অগ্নিমূর্তিটা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছে। তিলো কখনো এতোটা জোরে কথা বলে না। নরম মেয়ে বলে এলাকায় একটা সুনামও আছে। কোনোদিন কেউ ওকে ওর বাবা মায়ের সাথে জোর গলায় কথা বলতে শোনেনি। শুধু বাবা-মা কেন? ও তো তুলি তুষারের সাথেও খুব একটা ঝগড়া বাঁধায় না। কখনো বাঁধলেও প্রথমেই নিজের হার মেনে নেয় ঝামেলা এড়িয়ে যেতে।
আজকে ওকে এরূপে ঠিক মানিয়ে উঠতে পারছেন না নাসীরা পারভীন।
তিলো কয়েক মূহুর্ত চুপ করে চোখ বন্ধ করে থেকে নিজেকে সামলে নিলো। গলা চিড়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে নাসীরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমিও মানুষ আম্মা। আর জীবনটা আমার। দেখতে খারাপ বলে যার যা খুশি তাই করতে পারে না আমার সাথে।
নাসীরা পারভীনের গলা ধরে এসেছে। মেয়ের থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণটা ওনাকে আঘাত করেছে। ওনি নাক টেনে বললেন,
-তোমার রেজার সাথে বিয়েটা ভেঙে গিয়েছে তিল। তাই তোমার বাবা অরিকের সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিলো শান্ত কন্ঠে বললো,
-এবার আমার সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে দাও। প্লিজ।
নাসীরা পারভীন আরো কিছু বললেন। তবে তিলো সেদিকে কর্ণপাত না করে বারান্দায় গিয়ে বসলো। নাসীরা পারভীন বুঝতে পারলেন এখন আর কোনো কথায় কাজ হবে না। ওনি বেরিয়ে গেলেন তিলোর রুম থেকে।
আনিস সাহেব ভাড়া মিটিয়ে লিভিং এ সোফায় বসে তিলোর চিৎকার শুনতে পেলেন। কিন্তু তিনি আর ঝামেলা বাড়াতে চাইলেন না৷ এখন কথায় কথা বাড়তেই থাকবে। কখনোই তিনি তিলোর সাথে ঝামেলা করেননি৷ আর কখনো করতেও চাননা।
ক্লান্তিতে ওনার চোখ বুজে আসছে। আজকে কম ধকল যায়নি সকলের উপর থেকে। সোফার ব্যাকরেস্টে শরীরটা ঠেকিয়ে মাথা পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ফেললেন। কয়েক মূহুর্ত পরই ওনার ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত হলেন ওনি এতে। ফোনটা বের করে স্ক্রিনে অরিক নামটা দেখে ওনি নিজের বিরক্তি ধামাচাপা দিয়ে মনটা হালকা করে রিসিভ করলেন। কানে ধরতেই অরিকের উত্তেজিত কন্ঠস্বর কানে এলো ওনার।
-ছোট বাবা, তিল বাড়িতেই ফিরেছে তো?
আনিস সাহেব অরিকের ব্যস্ততার ইঙ্গিত পেয়ে মৃদু হাসলেন। তারা ছাড়াও কেউ এখন আছে তাঁর মেয়ের জন্য চিন্তা করার। অরিক কি সময় ধরে মেপে ফোন করেছে? বুঝতে পারলো কিভাবে এখনি তারা বাড়ি ফিরেছে? রাস্তায় কি আরো দেরি হতে পারতোনা? আনিস সাহেব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
-হ্যাঁ, ও বাড়িতেই ফিরেছে।
অরিক যেন এতোক্ষণের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পেয়ে একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো।
-ও কি ঠিক আছে? মানে, তখন ওভাবে না বলে বেরিয়ে আসলো তো…।
-আমরা আছি তো। তুমি দুশ্চিন্তা করো না।
-ওহ! ঠিক আছে।
-রাখছি তাহলে।
অরিক এবার নিজের সংকোচ ভেঙে বললো,
-আহ, ছোট বাবা!
-হুম বলো।
-তিলকে ফোনটা ধরতে বলো আমার। কিছু কথা বলার ছিলো আরকি।
আনিস সাহেব আবারও একটু হাসলেন। এখন হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে অট্টহাসি দিতেন। কিন্তু তা করলেন না। মৃদুস্বরে বললেন,
-ঠিক আছে, আমি বলছি।
-ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।
আনিস সাহেব ফোন কেটে দিয়ে তিলোর ঘরের দিকে গেলেন। দরজায় নক করলে তিলো ভগ্নকণ্ঠে অনুমতি দিলো। আনিস সাহেব ওকে ঘরে কোথাও দেখলেন না। ওনি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তিলো নিচে থাকা তোশকটার উপর বসে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। আনিস সাহেব কোনোকিছু না ভেবেই ওর পাশে মেঝেতে আসন দিয়ে বসে পড়লেন। তিল চমকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সরে বসে বললো,
-ময়লায় বসছো কেন? এখানে বসো।
আনিস সাহেব হাতের ইশারায় বোঝালেন যে ওনি ওখানেই ঠিক আছেন। তিলো আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ দুজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করলো। নিরবতা ভেঙে আনিস সাহেবই বললেন,
-তোর কি অরিককে পছন্দ না?
তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-এই বিষয়টা বাদ দেওয়া যায়না?
-ছোট মা, এমন তো না যে তুমি রেজা সাহেবকে ভালোবেসে বিয়ে করছিলে। বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিক করা হয়েছে। সংসারটা মানিয়ে চলতে চলতেই একসময় মায়া থেকে ভালোবাসা জন্ম নিতো। অরিককেও ধরে নাও পরিবার থেকেই ঠিক করা হয়েছে তোমার জন্য।
তিলো দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে বললো,
-আম্মার সাথে তোমার শুরুটা অন্যরকম ছিলো। তাই না? তুলি আপু বা আমার হতে যাওয়ার মতো না।
-সেটা বলতে পারো। বিয়ে পরবর্তী শুরুটা অন্যরকম হলেও। একদম শুরুটা খুব সহজ ছিলোনা। তোমার দাদীকে তো চেনোই। তোমার মায়ের নাকটা বোঁচা বলে বেশ কথা শুনিয়েছেন।
তিলো হুট করে হেসে দিলো। ওর দাদীর আচরণগুলো ওর কাছে অদ্ভুত লাগে। মহিলা নিজে সুন্দরী বলে বাকিদের খুঁত নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যান। এই কুঁচকে যাওয়া চামড়াও তার সৌন্দর্য সেই চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। দেখলেই বোঝা যায়, যৌবনে আগুণ ছড়ানো রূপ ছিলো তাঁর। সেই রূপের আগুনে চোখ ঝলসে অন্ধ হয়ে তিলোর দাদু তাকে বিয়ে করেন। মহিলার অহংকারী ভাবটা তাঁর চোখে তখন বাঁধেনি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হাসি অত্যন্ত কার্যকর একটা পদ্ধতি। তিলোকে হাসতে দেখে আনিস সাহেব মনে পুনরায় জোর ফিরে পেয়ে বললেন,
-ফোনটা অন করো। আর অরিকের সাথে একটু কথা বলো।
-আমার সময় প্রয়োজন আব্বু।
-সময় পাবে তুমি। অনেক সময় পাবে ভাবার। এখন ছেলেটা দুশ্চিন্তায় আছে। ওর সাথে একটু কথা বলো।
-দুশ্চিন্তা করার কি আছে? এতোদিন তো আমি একজন অপরিচিত ছিলাম। আজ এতো চিন্তা করছে কেন?
-তোমাদের ব্যাপার। তোমরা সামলে নাও। ভেবে দেখো, তোমার বিয়েটা কিন্তু পারিবারিকভাবে হচ্ছে। সুতরাং, পাত্র বদলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
কথাটা বলে আনিস সাহেব উঠে চলে যাওয়ার সময় তিলো ওনার হাত ধরে আটকে দিলো। আনিস সাহেব ওর দিকে তাকাতেই, ও নিজের হাতের অনামিকা থেকে রেজাদের বাড়ি থেকে পড়িয়ে দেওয়া আংটিটা খুলে ওনার হাতে তুলে দিয়ে বললো,
-ওনাদের ফিরিয়ে দিও এটা। এখন এটা আমাদের মাঝে মূল্যহীন।
আনিস সাহেব একবার আংটিটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না এ বিষয়ে। হুট করে বললেন,
-চা খাবে?
তিলো ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি বানাবে?
-হুম। মাথা যন্ত্রণা করছে। তোমার আম্মা ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। পরিবেশ গরম৷ তুমি খাবে?
তিলো মৃদু হেসে শরীরটা একদিকে হেলে আয়েশি ভঙ্গিতে বললো,
– তাহলে এই যে টি বয়, একটা চা।
আনিস সাহেব মজারচ্ছলে হেসে বললেন,
-আমি তোর বাপ হই ফাজিল মেয়ে। আব্বু বলে ডাক।
-এখন তুমি ওয়েটার। গো গো। ওয়ান টি প্লিজ টি বয়।
আনিস সাহেব এবারও মজারচ্ছলে ওকে মারার ভঙ্গি করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।
তিলো নিজের আটকে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়লো।
অনেক ভেবেচিন্তে তিলো রাতে ফোন করলো অরিককে। অরিক যেন ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিলো। কলটা বাজতে না বাজতেই রিসিভ করলো। রিসিভ করেই বললো,
-এতক্ষণে ফোন করলি তুই? আর কি করলি আজকে? টেনশানে আমার কি অবস্থা হয়েছিলো তোর কোনো ধারণা আছে?
তিলো অরিকের ধীর পরিবর্তনের সাথে পরিচিত। তবে হঠাৎ এতো বড় পরিবর্তন ওকে অস্বস্তিতে ফলে দিলো। তিলো ওর কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। শান্ত কন্ঠে বললো,
-কেন করলে এমন অরিক ভাই? কি বলেছো তাদের আমার বিয়েটা ভাঙতে?
তিলোর কথাটা অরিকের বুকে বিঁধলো যেন। তিলো শুধু পরিবারের কথাতে নয় বরং মন থেকে মেনে নিয়েছিলো রেজাকে! ভাবতেই অরিকের মন ভেঙে গেলো। অরিকের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। সে অবস্থাতেই বললো,
-তুই রাগ করেছিস আমার উপর?
তিলো এবার যেন রেগে গেলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-এটা আমার প্রশ্নের উত্তর না ভাইয়া। কি বলেছো তুমি তাদের? আমার নামে কি বদনাম রটিয়েছো?
-আমি তোর নামে কিছুই বলিনি।
-তাহলে কি বলেছো ঢ়ে ওনারা এভাবে না করে দিলো?
-আমি শুধু …
কথাটা বলতে অরিকের সংকোচবোধ হচ্ছে। এক মূহুর্ত থেমে গিয়ে বললো,
-আমি শুধু শামীম রেজা নামের লোকটাকে বলেছি, তোকে কেউ ভালোবাসে। মানে আমি তোকে ভালোবাসি। ওনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমরা একে অপরকে ভালোবাসি কিনা? আমি শুধু বলেছি, আমি কেবল আমারটা জানি।
-বাহ্! এভাবে মিথ্যা বলে আমার বিয়েটা ভেঙে তোমার কি লাভ হলো?
অরিক ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-তিল আমি মিথ্যা বলিনি। যা বলেছি সত্যি বলেছি।
তিলো থমকে গেলো অরিকের মুখে বাক্যজোড়া শুনে। অরিক সত্যি বলেছে!!
#চলবে