#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
২৬,,
আজ সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিলো তুলিকে পায়নি। সে এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আবার ভার্সিটিতে গিয়েও অনিমাকে খুঁজে পায়নি। ও আসেনি আজকে। তিলো ফোন করেছিলো ওকে। ও বলেছে, আজকে আসবে না।
অরিক আর তিলোর সম্পর্কটা ভার্সিটিতে আগের মতোই। কেউ কারো প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আলাদা কোনো অনুভূতি এখানে প্রকাশ করে না। অরিক ওর সাথে আলাদা করে কথা বললেও সেটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে বলে। এখানে তারা নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন।
তিলোর মনে হচ্ছে, আজকের পুরো দিনটাই ওর সাধারণভাবে চলেছে। অসাধারণ কোনোকিছু সামান্যতম ঘটেনি। জানার মধ্যে জানতে পেরেছে, অনিকেত খুব শীঘ্রই চলে যাচ্ছে। এদিকে তৌকিরের গোয়েন্দাগিরি সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। মীরার গোপন প্রেমিকের খোঁজ সে খুব শীঘ্রই পাবে। আহান আর রিয়া ফিরোজের ফ্ল্যাট ছেড়ে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। আহান টিউশনির সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। সাথে রিয়াও দুটো যোগাড় করে নিয়েছে। তবে ভাড়া বাড়িটা রিয়ার মনমতো না হওয়ায় ওর মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। রিয়া এমন বাড়িতে থাকতে একদমই অভ্যস্ত নয়। গত পরশু বলে, তারা ঝগড়াও বাঁধিয়েছে। মুখে কিছু বলেনি কেউই। তবে তাদের ভেতরকার প্রত্যক্ষ দূরত্বটুকু ওদের কারোরই চোখ এড়িয়ে যায়নি। গুঞ্জন উঠেছে, রিপার ছেলেরা, তাদের মায়ের জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করেছে। বাল্যবিধবা রিপার বয়স খুব বেশিও না। সাধারণত শহরের মেয়েদের এবয়সেই বিয়ে হয়। তার প্রথম স্বামী মারা গিয়েছে বলে তো সে তার সারাজীবন নষ্ট করতে পারে না। রিপাই বরং অরাজি। তবে তার তিন ছেলেও নাছোড়বান্দা। সাথে বউগুলো আর বাচ্চাগুলোও জুটেছে। পোতা পুতনি গুলো দাদীর বিয়ে দেওয়ার জন্য একপায়ে খাঁড়া। বয়স তাদের খুব বেশি না। বড়জনই সবে এগারোতে পড়েছে। তবে তারা অকালপক্ব। একটু বেশিই বোঝে।
তিলো তো পুরো কথা শুনে ওখানেই হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার যোগাড়। এজন্য না যে, রিপার বিয়ে ঠিক হচ্ছে। এজন্য যে, দাদীর বিয়ে নিয়ে নাতি নাতনিরা বেশি উত্তেজিত। এরপর রিপার বাচ্চাকাচ্চা হবে ওদের চাচা – ফুফু! অরিককেও ও এবিষয়ে বলেছে। তিলো নিজের ভেতর অদ্ভুত এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছে, ও অরিককে সবকথা বলে এখন। নিজের সমস্ত প্রকার অনুভূতি সে ভাগাভাগি করে নেয় অরিকের সাথে। অতিসাধারণ একটা ঘটনাও সে অরিককে বলে দেয়। এমন না যে ও উদ্দেশ্য নিয়েই বলে। ও কেবল বলে দেয় বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে। অরিকের সামনে নিজেকে একটা খোলা বইয়ের মতো মেলে ধরে। যে বইয়ের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল। কথাগুলো বলার পর, সেগুলো মনে পড়লে নিজের কপালই চাপড়ায়। সত্যিই! ও এতো তুচ্ছ বিষয়ও অরিককে বলেছে! কিন্তু যখন কথাগুলো বলে, তখন নিজেকে সামলাতে পারে না। মনে করে, এটাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ এই মূহুর্তে। এবং অবশ্যই অরিকের জানা উচিত। না জানলে বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অবচেতন উত্তেজনা গ্রাস করে ফেলে ওকে। অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে অরিক ওর জন্য।
আর অরিকও ওকে বাঁধা দেয়না। বরং সব কথাই আগ্রহ সহকারে শোনে। আর মাঝে মাঝে নিজেও কিছু অভিমত প্রদান করে।
দুপুরে খেতে বসে তিলো তুলির খোঁজ করতেই জানতে পারে, তুলি আজও বাইরে গিয়েছে। নাসীরা পারভীনকে বলে গিয়েছে। তিলোর মনে হয় না, তুলির কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বলে। তবে কেন সে বারবার বাইরে যায়, এটা ওর কাছে রহস্য বলে মনে হয়।
তিলোর ঘরটার ঠিক সামনের ঘরটা তুষারের। আজকের দিনে তুষারের বাইরের টিউশন কম। আজকে ওর বাসায় টিচার আসে বেশি। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই ওর অঙ্কের শিক্ষক এসে হাজির। তিলো নিজের ঘরে বসে দুম দুম দুটো আওয়াজ শুনলো। তারপর বেত দিয়ে বাতাস চিড়ে ফেলে পিঠে পড়ে ‘চ’ বর্গীয় একধরনের শব্দ হতে শুনলো। তিলো নিশ্চিত তুষার মার খাচ্ছে। তুষার বেশি মার খায় ওর ঝিমুনির কারণে। এতো বড় হয়েও মার খায়। লজ্জাও করে না। প্রায়ই খায়। তবে আজকে ওকর মার খাওয়ার আওয়াজ শুনে তিলোর ভেতর আতঙ্ক বিরাজ করছে। তুষারের যে স্বভাব! নিজের ধৈর্য্যসীমার বাইরে চলে গেলে ও কোনো না কোনো অযুহাত দাঁড় করিয়ে তো মুক্তি পেতে চাইবেই এই পরিস্থিতি থেকে। আজ যদি, রাতের ঘটনা বলে তিলোকে ফাঁসিয়ে দেয়!! তাহলে কি বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে!
তিলো দরজা ফাঁকা করে নিজের পূর্ণ মনোযোগ সেদিকে দিলো। ফ্যান বন্ধ করে ঘামছে এই গরমে। তারপরও ফ্যান ছাড়ছে না৷ প্রতিটা কথা ওর কানে আসা অতিব জরুরি।
নাসীরা পারভীন সামান্য নাস্তা নিয়ে ঢুকলেন তুষারের ঘরে। তখন ওর শিক্ষক ওকে দিলো একটা দাবড়। তুষার ঝাড়ি খেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গিয়েছে। স্যার ওকে মারুক, বকুক সব নিজেদের মধ্যে থাকা পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে তা নাসীরা পারভীন বা আনিস সাহেবের কানে যাওয়া ওর জন্য বিশেষ ভীতির কারণ। ভীষণ ভয় পায় ও আনিস সাহেবকে পড়াশোনার বিষয়ে।
নাসীরা পারভীন ওর শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলেন না যে কেন ওকে দাবড়ানো হলো। তিনি নাস্তার ট্রে টা সামনে রেখে ওর স্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-কি? কিছু পারছে না? শুনুন স্যার, আপনাকে আমি অনুমতি দিয়েছি, মারবেন ওকে। হাড্ডি আপনার, মাংস আমার। চামড়া ছিলে রোদে শুকাবেন।
তুষার ভীত চোখে একবার নাসীরা পারভীনের দিকে তাকালো। ওনার কঠিন দৃষ্টি দেখে চুপসে গিয়েছে সে। স্যার ইন্ধন পেয়ে আরো জোরে একটা দাবড় দিলো ওকে ঝিমানোর জন্য। তুষারের চোখে এবার পানি টলমল করছে। মায়ের সামনে এ অপমান ওর বড্ড গায়ে লাগছে। স্যার আরো কিছু বলার আগে তুষার নিজের রাগ ঝেড়ে বললো,
-আমি কি করবো? ওরা দুজন রাতভর প্রেম করে বেড়াবে আমাকে পাহারায় রেখে। সারারাত ঘুমাইনি। এখন ঘুম আসলে কি করবো আমি?
তিলোর কানে কথাটা যেতেই তিলোর মাথায় হাত! এতক্ষণ এটার ভয়ই পাচ্ছিলো। একদমই খেয়াল ছিলো না যে তুষারের স্যার এসে ওকে পড়াবে। তাহলে নিজে হাতে ঘি দিয়ে ব্ল্যাক কফি করে খাওয়াতো ওকে।
নাসীরা পারভীন সচকিত হয়ে বললেন,
-কারা রাতভর প্রেম করে তোকে পাহারায় বসিয়ে গিয়েছে?
কথাটা বলে ওনার খেয়াল হলো, ওনি আসলে ওর স্যারের সামনে এ কথা বলছেন। বিষয়টা মাথায় আসতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। নিজের বেখেয়ালির মাশুল হিসাবে তুষারকে দু ঘা দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তিনি তা করলেন না।
এদিকে তুষারেরও খেয়াল হলো, ও আসলে কি বলে ফেলেছে! অরিক ওকে বারবার একথা কারো সামনে বলতে নিষেধ করেছিলো। তুষার নিজেও বিব্রতবোধ করছে একটু আগে খামখেয়ালিতে বলা কথাটার জন্য। অযুহাত খুঁজতে খুঁজতে সত্যিটাই বলে দিয়েছে। তুষার দ্রুত নিজেকে সামলে বললো,
-না। কারো না।
নাসীরা পারভীন আগের অপ্রস্তুত হয়ে পড়া আর তুষারের অস্বীকৃতি, সাথে সাথে ওর পড়াশোনা নিয়ে গাফিলতির কারনে সব রাগ নিয়ে ওর ফোনের উপর ফেললেন। টেবিলের তাকের উপর রাখা তুষারের স্মার্ট ফোনটা হাতে নিয়ে বললেন,
-এই ফোনটাই তো যতো নষ্টের গোড়া! সারারাত জেগে তুমি গেইম খেলো। কি মনে করো? আমি কিছু টের পাই না? তুষার, তুমি আমার পেটে জন্মেছো। সব বুঝি আমি। তুমি কতোটুকু ফাঁকা করে পা ফেলো সেটাও আমার মাপা। এখন থেকে নিয়ম করে একঘন্টা ফোন পাবে তুমি। বাকি সময় আমার কাছে থাকবে।
নাসীরা পারভীন শান্ত কন্ঠে তবে তিক্ততার সাথে কথাগুলো বলে ফোনটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন। এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি, ছেলের থেকে ফোনটা আলাদা করার। যন্ত্রণা একদম বিগড়ে দিয়েছে তুষারকে।
তুষারের স্যার সম্পূর্ণ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। তুষার এদিকে প্রচন্ড হতাশ! যতো রাগ, সব গিয়ে শেষমেশ ওর অবলা, মাসুম ফোনটার উপরই পড়ে! তিলো, অরিকের পাশাপাশি স্যারের উপরও রাগ হচ্ছে ওর। কিন্তু কিছু বলার নেই। ফোনটা চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে, ওর শরীরের একটা অংশ কেটে নিয়ে গিয়েছেন নাসীরা পারভীন। ওর হৃদয় ছেঁড়া ধন। কান্না আটকাতে পারলোনা তুষার। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। গেইমের যে লেভেলে আছে সেখান থেকে দ্রুত পরের লেভেলে উঠতে না পারলে ও বন্ধুূদের থেকে পিছিয়ে পড়বে! ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওদের প্রেম টিকাতে নিজের প্রেমিকাকে হারাতে হলো!!
তুষারকে কাঁদতে দেখে ওর স্যার আবার ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হলেন।
তিলো সারাদিনে তুলির দেখা পায়নি। নাসীরা পারভীন ইশানকে সামলিয়েছেন। তিলোর নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। যখন তুলি নিজে থেকে বলতে চাইলো, ও শুনলো না। আর এখন সবটা শুনতে ও খুবই আগ্রহী। কিন্তু তুলির দেখা নেই।
বিকালে অনি ফোন করে ওকে হাঁটতে বের হতে বললো। এটা একসময় ওর আর অনির নিয়মিত কাজ ছিলো। তারা বিকালে একসাথে হাঁটতে বের হতো। গল্প করতো। চা খেতো। বাড়ি ফিরতো। একটা আলাদা পরিতৃপ্তি। নিজেদের ব্যস্ততায় এখন খুব বেশি সেটা হয়না। মাঝে মাঝে হয়।
তিলো আছরের নামায আদায় করে প্রস্তুত হয়ে বের হলো। রাস্তাটা মাথায় পৌঁছে তিলো দেখে অনি আগের থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
#চলবে
পর্ব ছোট হয়ে থাকলে দুঃখিত।
গতকাল গল্প না দেওয়ার জন্যও দুঃখিত। উপায় ছিলোনা দেওয়ার। মাথায় বৃষ্টির পানি লেগে মাথা ব্যথা করছিলো। রাত সাড়ে আটটায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় ঘুম থেকে উঠেছি।😪 মাঝখানে একঘন্টা জেগে ফোন টিপে আবারও ঘুমিয়েছি। আমার সুইট কিউট আম্মা, না ডেকে বরং আরো আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে গিয়েছে ঘুমানোর। How lucky I am! Alhamdulillah.
এখন সাহসী কন্যার পরিচয় দিতে যাচ্ছি 😏