ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম] ২৭,,

0
381

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২৭,,

তিলোত্তমা অনিমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েই নিজেকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-দেখ তো, আমাকে কি পিকিউলিয়ার কোনো জোকারের মতো লাগছে দেখতে?

অনি ভ্রু কুঁচকে ওকে পরখ করলো। কিন্তু কিছু বললো না। তিলো ওর এমন আচরণের সাথে একদমই পরিচিত নয়৷ অনি তো এমন সুযোগ পেলে ওকে ছেড়ে দেওয়ার মতো পাত্রী না। কিছু না কিছু বলে খেপিয়ে তুলবেই। তিলো আবার বললো,
-কি রে, বল।

অনি আগের মতো ভঙ্গিমা করেই বললো,
-কেন?

-দেখ, আমি ফ্রকের সাথে জিন্স আর তার সাথে জিতা পরেছি। কেমন যেন লাগছে নিজের কাছে?

অনি বেশ বিরক্ত হলো ওর কথায়। তবে সেটা চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে বললো,
-তা পরেছিস কেন, এমন অদ্ভুত পোশাক?

-বৃষ্টি হচ্ছে তো প্রায়ই। রাস্তাঘাট কাঁদা কাঁদা। তাই জুতা পরেছি। একদম বেমানান। তাই না?

-না। ডায়াবেটিস ওয়ালা মহিলা আর মোটা মহিলারা হাঁটার সময় এমনই পরে।

তিলো আর কিছু বললো না। কিন্তু ওর নিজের কাছে নিজেকে অদ্ভুত লাগছে। মাথার ওড়নাটার কাঁধে লাগানো পিন খুলে চাদরের মতো ঢেকে নিলো নিজের পুরো শরীর। অনি কাঁধে ঝোলানো গোলাপি বর্ণের গুচ্চির ব্যাগটা থেকে একগাদা চকলেট বের করে তিলোর হাতে দিয়ে বললো,
-এগুলো ধর।

তিলো চকলেটগুলো হাতে নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। অনি ব্যাগ থেকে আরো অনেকগুলো বের করে ওর হাতে দিলো। সাথে আর কিছু জিনিস। তিলো এবার জিজ্ঞাসা করলো,
-আঙ্কেল এনেছেন?

-হুম।

-ইন্ডিয়া থেকে চকলেট কিনে শান্তি আছে। একই টাকায় অনেক বেশি পাওয়া যায়। এদেশে ঢুকলে তো দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে যায়।

-হুম।

তিলোর কন্ঠের প্রফুল্লতাও আজকে অনির অভিব্যক্তি বদলাতে পারছে না। আগে কথাগুলোয় ও তাল মেলাতো। আজকে একদমই চুপচাপ। তিলোও দমে গেলো ওর থেকে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে। চকলেট আর উপহারগুলো নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

দুজনেই খানিকটা সময় নিরব থেকে হঠাতই অনি বললো,
-তোকে বুড়িদের মতো লাগছে দেখতে। ড্রইংরুমে হঠাৎ অতিথির আগমনে ভেতর থেকে যেভাবে পর্দা করে আসে মা চাচীরা, তেমন দেখাচ্ছে।

বলেই হেসে দিলো। তিলো একবার থমকে দাঁড়িয়ে বললো,
-আচ্ছা তো কিভাবে পড়বো বলতো।

অনি তিলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। এরপর নিজে হাতে ওর ওড়না ঠিক করে পড়িয়ে দিলো। তারপর আবারও হাঁটতে শুরু করলো। এই শহরের থেকে অপরদিকের উপশহরটাকে ভাগ করে রেখেছে যে নদীটা সেদিকের রাস্তা বেশ সুনশান। মানুষের যাতায়াত থাকা সত্ত্বেও নিরব হয়ে থাকে ভারী যানবাহন চলাচলের অভাবে। বিকালে ডায়াবেটিস এর রোগীরা বিশেষ করে এদিক থেকে ক্ষিপ্র গতিতে হাঁটাচলা করে।
নদীর পাড় থেকে উঁচু লোহার রেলিং দেওয়া। তিলো আর অনি বেশিরভাগ সময় এদিকটায় দাঁড়িয়েই কিছু ছবি তোলে। বিকালের সূর্যাস্তের, লঞ্চের, ঘোলা পানিতে বয়ে চলা কচুরিপানার।
আজ এসে ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনির নিরবতা তিলোর সহ্য হচ্ছে না। তিলো ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বললো,
-ক্যামেরাটা কি ব্যাগে ভরে রাখার জন্যই কিনেছিস?

অনি উদাস ভঙ্গিতে বললো,
-আজকে আনিনি।

তিলো অবিশ্বাস্য চোখে ওর দিকে তাকালো।
-তুই! আর ক্যামেরা আনিসনি!! আনবিলিভএবল!! আজকে মেঘলা আকাশটা দেখ একবার।

অনি ওর কথার প্রত্যুত্তর করলোনা। তিলোও আর কথা বাড়ালো না। নিজের ফোনটা বের করে কিছু ছবি তুলতে আরম্ভ করলো। অনি ওর কাজের মাঝেই বললো,
-তিল, তোকে কিছু বলতে চাই আমি।

তিলো নিজের কাজেই মগ্ন থেকে বললো,
-তো বল। অনুমতি নেওয়ার কি আছে?

-আমি অরিক স্যারকে ভালোবাসি।

তিলো একমুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। কথাটা বুঝে উঠতে ওর মস্তিষ্ক কিছুটা সময় নিলো। যেন মর্স কোড বলা হয়েছে আর ও বিশ্লেষণ করে নিচ্ছে। বুঝতে পারতেই তিলো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো অনির দিকে। তিলো জানতো অনির অভ্যাস আছে ক্ষণে ক্ষণে ক্রাশ নামক ছোটখাটো আঘাত পাওয়ার। কিন্তু অরিকের বিষয়ে ও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে তা ও বুঝতে পারেনি। অনি ছেলেদের সাথে প্রায়ই ফ্লাট করে বেড়ায়। তাই বলে সিরিয়াস হয়না কখনো।

তিলো কিছু সময় চুপ থেকে হঠাৎ করে যেন আটকে রাখা দম ফেলে জোরপূর্বক হেসে বললো,
-ভালো কথা।

তারপর আবারও নিজের কাজে মন দিলো। তবে তিলোর এই মূহুর্তে হাত কাঁপছে। ক্যামেরার ফোকাস ঠিক রাখতে পারছে না। অনি ওর থেকে আশানুরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আবারও বললো,
-তিল, আমি সিরিয়াস।

তিলো এবার ফোনটা ব্যাগে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-এই কথা বলতে তোর এতো আয়োজন! ফোনে বললেই হতো।

অনি ওর আচরণটা নিতে পারছে না। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-ন্যাকামি করবি না একদম।

-আজব তো! এখানে ন্যাকামির কি হলো?

-তুই কিছু কর।
অনি প্রায় কেঁদে দিয়েছে।
তিলো ওর থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
-এখানে আমি কি করতে পারি? সে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে, তাই তুই ভালোবেসেছিস। আমার কি করার আছে এখানে?

অনি ওর থেকে চোখ সরিয়ে দুবার মাথা ঝাঁকিয়ে অদ্ভুত আচরণ করছে। এবার সবটা সহ্যসীমার বাইরে চলে গিয়েছে ওর। ও ভেবেছিলো তিলো সবকিছু বুঝতে পারার মতো ম্যাচিউর একটা মেয়ে। অনি নিশ্চিত, তিলো বুঝতে পারছে আসলে অনি ওকে কি করতে বলছে। এরপরও তিলো নিজের জন্য না বোঝার ভান করে চলেছে।
হঠাৎই অনি তিলোর দুইবাহু চেপে ধরলো। অনি তিলোর থেকে স্বাস্থ্যের দিক থেকে অধিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পাশাপাশি দেড় ইঞ্চি বেশি লম্বা। তিলোকে দুইহাতে ধরতে অনির অসুবিধা বা বিব্রতবোধ কোনোকিছুই হলোনা।
তিলো নির্বিকার ভঙ্গিতে অনির দিকে তাকিয়ে আছে। অনি কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠলো,
-বুঝতে পারছিস না আমি তোকে কি করতে বলছি? বিয়েটা ভেঙে দে। করিস না এই বিয়ে।

ইতিমধ্যে রাস্তার উপর একটা দর্শনীয় দৃশ্যের উপস্থাপন হওয়ায় দর্শক জুটে যেতেও সময় লাগেনি। গাট্টা গাট্টা মহিলা, চিকন মহিলা, স্বাভাবিক মহিলারাই সিংহভাগ দর্শক। পুরুষের সংখ্যা কম। এরাস্তাটা মহিলাদের দখলে বলে ভদ্র পুরুষ এদিকটায় খুব কমই আসে।
তিলো একবার আড়চোখে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। অনি যে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘোরের ভেতর আছে, সেটা বুঝতে পেরে ওকে খুব বেশি ঘাটালো না। ধীর হস্তে নিজের বাহুর থেকে ওর হাত নামিয়ে দিয়ে বললো,
-বিয়েটা দুপক্ষের সম্মতিতে হচ্ছে। অরিক রাজি বিয়েটা করতে। তাই কেবল আমি বলে ভেঙে দিলেই যে তুই ওকে বিয়ে করতে পারবি, এমন কোনো কথা নেই। দুনিয়ায় মেয়ের অভাব পড়েনি। আমার সাথে বিয়ে না হলেই যে তোর সাথে হবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। অন্য কারো সাথেও হতে পারে। তাছাড়া দুপক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে এদিককার পাল্লা ভারী। তুই আদ্রিয়ান আঙ্কেলকে বল অরিকের সাথে বা তার বাবার সাথে কথা বলতে। তারা রাজি হয়ে যদি আমার সাথে বিয়েটা ভেঙে দেয় তখন দেখা যাবে। পারিবারিক ভাবে ঠিক করা বিয়েতে পাত্র পাত্রী বদলে যেতেই পারে। পাশাপাশি এটা কেবল আমাদের উপর নির্ভর করে না। আরো একটা প্রজন্ম জড়িয়ে থাকে। তুই বলে দেখতে পারিস।

-তিল, একজন তাকে ভালোবাসে জানা সত্ত্বেও তুই অবলীলায় তার সঙ্গে সুখে সংসার করে যাবি?

অনি ভগ্ন ভেজা কন্ঠে কথাটা বললো। তিলোর নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। ওর চোখ ছলছল করছে। এরপরও একপেশে হেসে বললো,
-অনি, একজন পাবলিক ফিগারকেও বহু মানুষ ভালোবাসে৷ তাই বলে কি তার সংসার হয়না কখনো বা অনেকগুলো সংসার হয়। নাকি তার বউ তাকে ছেড়ে চলে যায় এজন্য যে, না তাকে আরো কেউ ভালোবাসে?

-সেই ভালোবাসা আর এই ভালোবাসা এক না তিল। বোঝার চেষ্টা কর। তুই তো কেবল পরিবারের কথাতে রাজি হয়েছিস। ভালোবাসিস তাকে? নাহ্। কিন্তু আমি বাসি।

অনির কথাটা তিলোর হৃদপিণ্ডের একটা স্পন্দন হারিয়ে ফেলতে সক্ষম হলো। ও কি সত্যিই ভালোবাসে না? কথাটা আজও অজানা ওর কাছে। কিন্তু আজ অনি অরিককে ছাড়তে বলায়, ও মেনে নিতে পারছে না বিষয়টা কোনোভাবেই। স্বার্থপর করে তুলেছে মূহুর্তেই। অনির কথাটাকে অগ্রাহ্য করতে বা ওর অনুভূতিকে আঘাত করতে ওর একটু খারাপ লাগলেও ওর মন মস্তিষ্ক উভয়ে একই সাথে বলছে, এখন সে ভালো থাকতে চায়। সে চায় অরিকের সাথে সংসার করতে। এতে কেউ বাঁধা দিলেও সে উপেক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। তিলো আগের মতোই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
-তোকে তো উপায় বললাম। কাজটা করে দেখ। আমার ভেতর অরিকের জন্য কি আছে, সেটা নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। তবে বলবো, অন্যের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিতে শেখ।

অনি আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আবারও কিছু বলার আগে তিলো বললো,
-একান্তে কথাগুলো বলতে পারতিস। রাস্তার উপর এটা! এটা আসলে খুব বাজে একটা অভিজ্ঞতা।

তিলো আর দাঁড়ালো না। অনি কয়েকবার ওকে ডাকলো পেছন থেকে। তিলো ফিরে তাকালো না। রাস্তার কাঁদা মাটি বাঁচিয়েও ও চলছে না। গর্তে জমে থাকা ইটের খোয়া ধোয়া লাল পানিতে পা ডুবিয়ে কালো জুতাজোড়া একেবারে যাচ্ছেতাই দেখতে করে ফেলেছে। তিলোর চোখে পানি জমে ঘোলাটে দেখছে সামনের সবকিছু। অনি হতাশ হলেও ওর চলার ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পেরেছে, কথাগুলো তিলোর উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here