ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম] ২৯,,

0
357

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২৯,,

তিলোর আজকে ভার্সিটিতে না যাওয়া নিয়ে কেউই কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এমনকি অরিকও ওকে ফোন করে কোনো কঠিন কথা শোনায়নি। তিলোর অরিকের সবকিছু খুব ভালো লাগলেও এই পোস্টার বয় এর পড়াশোনা নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি তিলোর ভালো লাগে না।
একসময় তিলোর মাঝে জ্ঞানী মানুষের আশেপাশে আসলেও ভীতি কাজ করতো। মোটামুটি কলেজ শেষে যারা ভার্সিটিতে উঠেছে, তাদেরই মনে হতো বিরাট জ্ঞানী। ওদের আশেপাশে থাকাও বিপদজনক। কখন কি জিজ্ঞাসা করে ওকে একেবারে অপ্রস্তুত করে ফেলে! এখন তো নিজেই ভার্সিটিতে পড়ে। এরপরও প্রফেসরদের ও ঠিক নিতে পারে না। দেখলেই অবচেতন আতঙ্ক গ্রাস করে।
হালিম সাহেব বাড়িতে আসলেও তিলো অনেক কমই সামনে যেতো। ফাহাদের দাদু ছিলেন ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিলোর মনে পড়ে না কখনো ও ওনার সামনে গিয়েছে বলে। অবশ্য ওনি দেশে এসে মাত্র দুবারই ওদের বাড়িতে এসেছিলেন। তাও তিলোর দাদুবাড়িতে। ওদিকে ফাহাদের বাবাও একজন অধ্যাপক। তিলোকে দেখলেই শাশুড়ী, শাশুড়ী সম্বোধন করে বেশ আহ্লাদ দিতেন। এরপরও তিলো কখনোই ওনার সাথে খুব হাসিখুশিভাবে কথা বলতে পারতোনা। তিনি কথা বলতে বলতে একগাদা জ্ঞানদান শুরু করতেন। এটাই তিলোর ভয়ের কারণ ছিলো।

তিলো খেয়াল করেছে, যে যেটা অপছন্দ করে সেটাই তার কপালে এসে জুটে যায়। তিলোর সেই দশাই হয়েছে। ওর সাথে যে সারাজীবন থাকবে বলে ও আশা করছে, সেই একজন অতিজ্ঞানী ব্যক্তি।

তিলো বিকালের দিকে অরিকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সাথে করে অনির গতকালকে দেওয়া চকলেট আর উপঢৌকনগুলোও নিয়ে এসেছে। ফেরার পথে ওর বাড়িতে দিয়ে যাবে।
আজ আবারও সেদিনের সেই ছেলেটার সাথে তিলোর দেখা। তিলো ঘটনাটাকে কাকতালীয় বলবে নাকি ছেলেটা সবসময়ই ওঠানামার মধ্যে থাকে সেটা বুঝতে পারছে না। তিলোকে ভবনের বড় গেটটা দিয়ে ঢুকতে দেখেই সেই ছেলেটা মুখে চওড়া হাসি টেনে সালাম দিলো। তিলোও ছোট করে তার উত্তর দিলো।
ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো,
-বললেন না তো আপনি এখানে নতুন কিনা?

তিলো বিব্রতবোধ করছে ছেলেটার কথায়। যদি ও বলে ও অরিকের সাথে দেখা করতে আসে তবে কথার হাত পা গজাতে সময় লাগবে না। ব্যাচেলর একটা ছেলের কাছে ও কেন আসে? প্রশ্নটা নিশ্চয়ই এই লোকের মাথায় উদয় হবে। তিলোর চোখে মুখে অপ্রস্তুতভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছেলেটা ওর মুখভঙ্গি দেখে মিটমিট করে হাসছে। তিলো বিষয়টা খেয়াল করে কোনো উত্তর না দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো। শ্যাম বর্ণের বলিষ্ঠ দেহের ছেলেটা পেছন থেকে বলে উঠলো,
-আমি কিন্তু জানি আপনি অরিক ভাইয়ার কাছে আসেন।

তিলো এবার খুব বেশি বিরক্ত হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। যখন জানেই তখন জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন কোথায়?

তিলো অরিকের ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজানোর সাথে সাথে দরজা খুলে দিলো অরিক। যেন প্রস্তুত ছিলো খোলার জন্য। তিলোকে দেখেই হাসিমুখে সালাম দিলো। তিলো তার জবাব দিয়ে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসলো।

তিলো দ্বিতীয়বারের মতো অরিকের বাসায় আসায় অরিকের মাঝে ব্যস্ততা দেখা দিলো। সে তিলোকে যেকোনোভাবে হোক তার জন্য একটা তৃপ্তিকর পরিবেশ এনে দিতে ব্যস্ত। সে কি দুপুরে খেয়েছে? এখন কিছু খাবে? এসিটা কি রুমটা একটু বেশিই ঠান্ডা করে ফেলেছে? সে কি বসে আরাম পাচ্ছে? আসার সময় সমস্যা হয়নি কোনো? কখন আসবে সময়টা কেন বললো না, তাহলে ও নিজে গিয়ে ওকে নিয়ে আসতো?
বিভিন্ন প্রশ্নের বাণে বিদ্ধ করে ফেলছে তিলোকে প্রথম কয়েক মূহুর্তের জন্য। অরিকের আচরণ অতিব্যস্ত ছোট পাখির মতো। তিলো ওর আচরণে হেসে দিলো। ধীরে ধীরে সে একটু বেশিই সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। তিলোর পাশে বসে স্বাভাবিকভাবে সে কথা বলতে পারছে না। তিলোর মনে হচ্ছে, অরিকের ব্যস্ততা কৃত্রিম। সে তিলোর চোখের সামনে থেকে পালাতে চায় কোনো কারণে। সেই অর্থে অরিক যখন কফি বানিয়ে আনার প্রস্তাব পেশ করলো, তিলো নিষেধ করলোনা।

অরিক রান্নাঘরে যেতেই তিলো চিৎকার করে বললো,
-তোমার কাজের মেয়েটাকে কি ছুটি দিয়েছো তুমি?

অরিক রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বললো,
-কেন?

তিলো সেন্টার টেবিলের দিকে ইশারা করে বললো,
-আজকে তোমাকে অগোছালো মনে হচ্ছে।

অরিক মৃদু হেসে বললো,
-নাহ্। কিন্তু আমি কেবল অতীত চর্চা করছিলাম। হাতে কোনো কাজ না থাকায় বিরক্ত লাগছিলো।

-ওহ্। তা আমি কি সাহায্য করবো?

অরিক উত্তেজিত ভঙ্গিমায় বললো,
-কোনো প্রয়োজন নেই। আমি পারবো।

তিলো আর কিছু না বলে সোফায় শরীর ঠেকিয়ে ফোনে চোখ রাখলো। কিন্তু এরপরও ও শান্তি পাচ্ছে না। সেন্টার টেবিলের উপর ফাইলগুলো অগোছালো করে রাখার কারণ তিলো আন্দাজ করতে পারছে। অরিকের মতো সচেতন ছেলে এমন কাজ করবে না কখনো যে, ও ব্যক্তিগত কোনোকিছুকে অপর জনের আকর্ষণের জন্য ফেলে রাখবে। ও চায় তিলো সেগুলো হাতে তুলে নিক এবং পড়ুক।
তিলো করলোও সেটা। অরিকের উদ্দেশ্য সফল করা ওর উদ্দেশ্য নয়। বরং নিজেই কৌতুহলী।

সবচেয়ে উপরের খুলে রাখা ফাইলটা হাতে নিতেই, প্রথম দিক দেখেই বুঝতে পারলো কোনোকিছুর নমুনা মাত্র। মেডিকেল ফাইল আছে। সাথে আছে প্রেসক্রিপশনের কপি। কিছু নোট। লেখাগুলোর আসলে কোনো অর্থ নেই। সব আজেবাজে কথায় ভরপুর। তিলো তবুও পড়তে শুরু করলো —

আমি কেবল কামড়াচ্ছি। চুলকাতে চুলকাতে আমি বিরক্ত। এখন কামড়ে জায়গাটুকু তুলে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সে বলেছে, চুলকানো ভালো। কিন্তু আমি সহ্য করতে পারছি না।

আমার ন্যাপি বদলে দেওয়া নার্সগুলো কোন জাতের? জানতে পেরেছো তুমি? ওদের পূর্বপুরুষগুলো কি বিষ্ঠা পরিষ্কারকারী নাকি ইঁদুর পাকরাওকারী?

তুমি জানো, মিস ব্রিটনির অবৈধ বাচ্চাটার বাবা আসলে ওর আপন ভাই ই?

প্রিয় ডাক্তার কমা পরের লাইন……। এই তুমি কমা দিয়েছো তো? বিরামচিহ্ন খুবই বড় বিষয়। না হলে ঠিকানা হয়ে যাবে, গুলি ও বারুদের কারখানা ড ড নং কলিকাতা।

মিনাকে বলবে, গাছগুলোর যত্ন নিতে।

ঐ সাদা কাপড় পড়া লোকগুলো পটি সাফ করে। ওরা কি তোমার আত্মীয়?

চলো আমরা যাই গা।

সাদা পোশাক পরিহিত লোকগুলোকে আমার পাশে ঘুরতে মানা করবে?

ওরা তোমায় অপহরণ করেছিলো। তাই না? খুব মেরেছে? তোমায় কি বেঁধে রেখেছিলো? তারা কালো পোশাকধারী ছিলো। তাই না?

এই তুমি অরিক না? আমার ছেলের বন্ধু। তাই তো?

ওরা কি তোমার বিড়াল? ওরা ছেলে না মেয়ে?

আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। তোমাকে, আমাকে আর নিভ্রানকে।

এখন পা-লা-ও।

হ্যালো! তোমার সাথে পরিচিত হয়ে কি যে ভালো লাগছে!

রাজু আসামাত্র আমরা পালাবো। আমার পটির পাত্রটা সাথে নিয়ে এসো। গু’ টা রেখে যাবে।

আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার আশেপাশে অনেক মানুষ। শুধু নিয়াজ নেই। সে কি রাগ করেছে?

ওঠো!!!

আমি বাইরে যাচ্ছি। আমি হারিয়ে গিয়েছি বলে ওরা তোমাকে আটকে রাখবে। কি মারটা যে খাবা তুমি!

এটা লজ্জাজনক যে তুমি বলে বেড়াও তুমি অরিক। আসলে তুমি নও। তাই না? নিভ্রানও নিজেকে নিভ্রান বলে। আসলে সে নয়।

বৃষ্টি হচ্ছে নাকি রোদ উঠেছে।

সবকটা ছাগলের জন্য কি ওদের ওষুধ আছে?

সব চেক করে নাও আর আমরা যাই গা।

তুমি কি খেয়াল করেছো, হাই তোলার সময় মানুষগুলোকে ভেড়ার মতো দেখায়?

কখনো কখনো ওরা তোমাকে ডিসকাউন্ট অফার আর এটা খুবই ফালতু একটা ব্যাপার।

কি ভীষণ যুদ্ধ লেগেছে আমার আর মশাগুলোর মধ্যে।

সে চলে যাচ্ছে। এরপর আর কেউ। তারপর আর কেউ।

আমার টাকা কই?

এটা আমার যন্ত্র।

তিলো পড়তে পড়তে শেষ পাতার আগের পাতায় এসে থমকে গেলো। তিলোর মনে হচ্ছে এখানে অনেক কিছুই বর্জ্যের সাথে ইতিমধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর সেখানে এই লেখাগুলো নতুন করে সংযোজন করা হয়েছে। সেখানে গোটা গোটা করে খানিকটা লেখা —

ভালোবাসা সম্পূর্ণ অনুভূতির একটা বিষয়। এটাও একটা ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রের মতো। বা হয়তো জীবনের কোনো খেলা। খেলায় হার জিত থেকে থাকে। আবার ভাগ্যের উপর চলতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময় সূচনা পর্বের পরের অংশটুকু নিজের হাতে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। জীবনটা ছোটো। এই ছোট জীবনে কিছুটা স্বার্থপর হওয়াটা দোষের কিছু না। নিজেকে ভালো রাখতে স্বার্থপর হতে হয়। অপরপক্ষকে ভালো রাখতে স্বার্থপর হতে হয়। অপরপক্ষের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতেও স্বার্থপর হতে হয়। ভেবে দেখো, তুমি যদি অপরপক্ষকে ভালোবেসেই থাকো, তবে তাকে ভালো রাখতে জানতে হয়। সে কিভাবে ভালো থাকতে পারে বা কার সাথে ভালো থাকতে পারে। ছোট জীবনটায় আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকো। পাল্লা কোনদিকে ভারী?

তিলো মৃদু হাসলো লেখাটা পড়ে।

অরিক ইতিমধ্যে কফি তৈরি করে ফিরে এসেছে। তিলোর দিকে মগটা বাড়িয়ে দিতেই তিলো সেটা গ্রহণ করলো। অরিক ওর পাশের সোফাটায় বসলো।

তিলো একবার অরিকের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ওর কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। এটুকু করেই নাজেহাল দশা। তিলো টেবিলের উপর থেকে টিস্যু বক্সটা অরিকের দিকে এগিয়ে দিলো। অরিক সেখান থেকে টিস্যু নিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বললো,
-খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?

তিলো কফি খাওয়ার আগে ফাইলটা হাতে রেখেই বললো,
-সপ্তাহ জুড়ে স্টেনোগ্রাফির কাজও করো নাকি?

অরিক একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,
-আরেহ্ নাহ্। এমনিই একটা করেছিলাম।

-কার এটা?

-নিভ্রানের বড় মা, শাপলা আন্টির।

-বড় মা?

তিলো ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো।
অরিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
-হ্যাঁ। নিভ্রানের বাবা নিয়াজ আঙ্কেল ভালোবেসে একজন বয়স্ক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। ওনার কোনো সন্তান না হওয়ার কারণে ওনি নিজেই নিজের স্বামীকে আরেকটা বিয়ে দেন। নিভ্রান ওর দুই মা আর এক বাবার একমাত্র ছেলে। ওনার মৃত্যুর পূর্ববর্তী কিছুদিন।

-ওনি সি ও পি ডি তে আক্রান্ত ছিলেন। তাই না?

অরিক তিলোর এই বুঝে ফেলার ক্ষমতাটাকে একটু বেশিই পছন্দ করে। মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিলো স্মিত হাসলো নিজের ধারণা ঠিক প্রমাণিত হওয়ায়।

ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারী ডিজিস (সি ও পি ডি) এমন একটা ব্যাধি যেটা নিষ্পাপ অভিজাত বৃদ্ধ দাদী নানীদেরকে দিয়ে বেশ্যাখানার মালকিনদের মতো আচরণ করাতে পারে আবার বিশপদের মুখ থেকে গালিগালাজ করাতে পারে মাতালদের মতো। সমস্ত সংস্কার ভুলিয়ে দিতে পারে।

মাঝে মাঝে তাদের আচরণ হয়ে ওঠে শিকারপ্রবণ, আক্রমণাত্মক।

-কিন্তু তার স্টেনোগ্রাফার হিসাবে নিযুক্ত হলে কেন হঠাৎ?

অরিক সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বললো,
-নিভ্রানের ধারণা ছিলো, শাপলা আন্টি এমন কিছু জানে যেটা ও জানে না। মরণকালে নষ্ট মাথার বদৌলতে কিছু বলে দিলে, সেটা ও জানতে চায়। আমি আর মাঝে মাঝে ও নিজেও কাজটা করতো।

তিলো ভ্রু কুঁচকে বললো,
-গোপন কিছু? শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলে?

-নাহ্। নিভ্রানের ধারণা, ও শাপলা আন্টিরই গর্ভের সন্তান। ওর মাঝে বেশির গুণই তার। কিন্তু আশেপাশের সবাই বলে ও আসলে নিয়াজ আঙ্কেলের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। আসলে নিভ্রান খুব বেশি ভালোবাসতো ওনাকে। এটা হলে হয়তো খুশিই হতো। তবে জানো, নিয়াজ আঙ্কেল সত্যিই শাপলা আন্টির জানাযায় ছিলেন না? এমনকি কবরস্থানেও যাননি।

-কেন?

-জানি নাহ্।

-তিনি কি শেষের এই নোটটার কথাও বলেছেন?

তিলো অরিককে সেটা দেখিয়ে বললো। অরিক হঠাৎই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে নোটটা দেখে। অরিক প্রত্যুত্তর করলো না৷ তিলো মৃদু হেসে একচুমুক কফি খেয়ে বললো,
-অনিকে কেমন লাগে তোমার? সে নিঃসন্দেহে রাজকন্যা।

অরিক হতাশ দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকালো। তিলো সে দৃষ্টির দিকে এক মূহুর্ত তাকিয়ে সেটা উপেক্ষা করে সামনে তাকালো।
তিলো ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললো,
-তিনি আসলে অসাধারণ মহিলা ছিলেন বলে মনে হচ্ছে। নিজের মাথায় গন্ডগোল হওয়া সত্ত্বেও খুব বেশি খারাপের দিকে সেটা যায়নি।
আবার অরিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-নাকি খারাপটুকু ফেলে দেওয়া হয়েছে?

অরিক এই প্রশ্নেরও জবাব দিলো না। তিলো হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-কফিটা চমৎকার ছিলো। আমি আসছি।

অরিক এবার আর চুপ করে থাকতে পারলোনা। শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
-আমাকে কোনো কিছু পরিষ্কার করে কেন বলো না তুমি? আমি তোমাকে স্পষ্টভাষী বলে জানতাম।

তিলো থেমে দাঁড়িয়ে বললো,
-আমার মনে হয়েছে, আমাদের আজকের মতো বলার কিছু নেই।

অরিক উঠে দাঁড়িয়ে তিলোর সামনে দাঁড়ালো। ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
-তোমার থেকে স্পষ্ট ভাষায় একটা উত্তর জানতে চাই। তুমি কি এখনো আগের সিদ্ধান্তে অটল। নাকি বদলেছো?

-বদলালে বলে দিতাম।

অরিক যেন এতোক্ষণের আটকে রাখা দম হঠাৎ করে ফেললো। চোখজোড়া ইতিমধ্যে লাল হয়ে এসেছে ওর। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বললো,
-তুমি ধারণা করতে পারো না, গতকাল থেকে আমি কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম।

তিলো ওকে চমকে দিয়ে ওর দাড়িতে নিজের লম্বা সেলেন্ডার আঙুল গুলো ভরে দিয়ে বললো,
-তোমার জানা প্রয়োজন, আমি নিজেকে বড্ড বেশি ভালোবাসি। আমাকে অন্যরা অবজ্ঞা করে যতোটুকু ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে তার অধিক নিজেকে ভালোবেসে সেই অভাব পূরণ করি। আমি ভালো থাকতে চাই অরিক। আর আমাকে যে ভালোবাসে, তাকে ভালো থাকতে দেখাটাও আমার ভালো থাকার একটা অংশ। আমি জানি, সে আর কারো সাথে সুখী হবে না। নিজের পাশাপাশি তাকপ ভালো রাখতেও আমি সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবোনা।

অরিক তিলোর থেকে ইন্ধন পেয়ে নিজের ভেতরকার সংকোচবোধের দেয়ালটাও টপকে গেলো। হঠাৎ করেই তিলোর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সে। খুব কাছে, যতোটা বর্ণনা করেছিলো অনিমা তার স্বপ্নের। অরিকের নিশ্বাস এখন তিলোর মুখে আছড়ে পড়ছে। অরিক স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-একটা স্বীকারোক্তি দেই।

তিলো একপেশে হেসে বললো,
-আমি বোধহয় জানি সেটা। শাপলা আন্টি নামে কারো অস্তিত্ব নেই।

অরিক চোখ সামান্য বুজে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো। তারপর আবারও ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কিছুটা ঠিক। তবে পুরোটা না। শাপলা আন্টি ছিলেন। সবটাই হয়েছে। শুধু স্টেনোগ্রাফার আমি ছিলাম না। তবে তুমি বুঝলে কিভাবে?

-স্টেনোগ্রাফিতে শেষ অংশটুকু অতোটা যত্ন নিয়ে লেখার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া সেই রোগাক্রান্ত ব্যক্তি গুছিয়ে অতোটা বলতে পারবে না কখনো। কিন্তু শুরুটা ছলনা দিয়ে কেন করলে?

অরিক কন্ঠে অপরাধবোধ এনে বললো,
-আমি ভয় পেয়েছিলাম তিল। খুব ভয় পেয়েছিলাম। তোমার আজকে হঠাৎ দেখা করাটা নিয়ে। অনির থেকে সবটা শুনে ভেবেছিলাম তুমি আমাকে এই গোলকধাঁধায় ফেলে চলে যাবে। আমি পথ হারিয়ে ফেলার ভয় পেয়েছি। কথাগুলো তুমি শুরুই করছিলে না। আমি জানতে চাইছিলাম তোমার উত্তর। তোমার সিদ্ধান্ত। কথাগুলো শুরু করতেই শেষটুকু লিখেছি। সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না।

-যদি এই ছলনার জন্য এখন সিদ্ধান্ত পাল্টাই?

-সেটা করো না দয়া করে। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। ক্ষমা চাইছি।

-এটা আমার সিদ্ধান্ত। কি করবে তুমি?

-ভেবে দেখিনি এখনো। আসলে ভাবার সাহস পাইনি।

একটু থেমে চোয়াল শক্ত করে বললো,
-ফ্ল্যাটটা আমার। সম্পূর্ণ ফাঁকা। এমন সিদ্ধান্ত নিলে আমি কি তোমার সাথে এমন কিছুই করতে পারিনা, যাতে তোমার আমাকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না?

অরিকের কথায় তিলো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। অরিক ওর আচরণে অবাক হয়নি। বরং এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলো সে। তিলো কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললো,
-তোমার হুজুগের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্তটা কখনোই তুমি সফল করতে না। বিশ্বাস করি আমি তোমাকে। তাই তো তোমার ফ্ল্যাটেই এসেছি।

তিলো থেমে গিয়ে প্রকাশভঙ্গীমায় গাম্ভীর্যতা এনে বললো,
-প্রতিটা সম্পর্কের বলো আর যে কোনো কিছুরই বলো না কেন, সবকিছুর একটা সীমা থাকে। সেই সীমার ভেতর সবই সুন্দর। সম্পর্কের সৌন্দর্য তার সীমার মাঝে থাকে। আমি জানি, তুমি আমাদের ভেতর হতে চলা সম্পর্কের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল আর তার সৌন্দর্য রক্ষায়ও সচেষ্ট। এমন কিছু তুমি কখনো করবে না, যাতে আমাদের সম্পর্কটাকে আমরা দুজনেই ঘৃণা করতে শুরু করি। অরিক বিশ্বাস করো, তুমি যদি সত্যিই এমন কিছু করতে, আমি কখনোই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হতাম না। সীমা লঙ্ঘন করে তিক্ততা আনার কোনো মানে হয়না।

অরিক অবাক কন্ঠে বললো,
-এতটা বিশ্বাস করো আমাকে?

তিলো মুচকি হেসে বললো,
-হ্যাঁ। আর এটাও বিশ্বাস করি যে, তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে।

অনেকটা সময় দুজনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করলো। তিলো এরপর বললো,
-আমিও একটা স্বীকারোক্তি দেই? আমি আসলে আজকে তোমাকে একটা কিছু শেখাতে এসেছিলাম। আমার শেখানো কথা তুমি বলবে। তোমাকে নিষেধ করতাম, যে কোনো পরিস্থিতিতে তুমি কোনোমতেই অনিকে মেনে নেবে না। অনির বাবা তোমাকে বললেও তুমি শুনবে না, যেকোনো পরিস্থিতি হয়ে যাক না কেন।

অরিক তিলোর কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-আমি কি তাহলে নিজেকে বোকা বলবো? নাকি অনিকে?

-দুজনেই।

-আসলেই। তুমি যতোটা বুঝতে পারো, আমি ততটা তোমাকে বুঝি না। আর এদিকে তুমি দু’পক্ষই নিজের হাতে রাখছো।

তিলো পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যতোটা সম্ভব উঁচু হয়ে অরিকের কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
-আসলে তুমি যেভাবে আমাকে দেখো আমি তেমন নই। তুমি মনে করো, তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসায় বাঁধবে। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, অনেক আগেই তুমি আমার মায়ার জালে ফেঁসে গিয়েছো। আর এখন আমি তোমাকে মুক্তি দেবো না। এটা কেবল তুমি নও যে, হতে যাওয়া সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চাও। এটা আমি নিজেও যে, সম্পর্কটার যত্ন নিতে চাই। শাপলা আন্টির মতো তোমায় আর কারো সাথে বিয়ে দেবো না আমি। তাতে আমার যতো অক্ষমতাই থাকুক না কেন।

অরিক ঠোঁট কামড়ে হেসে দিলো তিলোত্তমার কথা শুনে। ও এটা আশা করেনি একদমই। অপ্রত্যাশিত খুশিতে অরিকের হৃদয় পুলকিত। তিলো ওর থেকে সরে দাঁড়িয়ে ওকে রেখে চলে যেতে নিতেই অরিক আবারও বললো,
-এতো পেঁচিয়ে কথা না বলে কেন স্পষ্টভাষায় বলে দাও না?

-এরপরও স্পষ্ট ভাষায় বলার অপেক্ষা থাকে? এতোটা বললাম। সারসংক্ষেপ সেই তিনটা শব্দ নিজে থেকে বুঝে নাও।

অরিক আর কথা না বাড়িয়ে তিলোকে দাঁড়াতে বলে ভেতর থেকে একটা ব্যাগ এনে তিলোর হাতে দিয়ে বললো,
-তুষারকেও ভাগ দিও।

তিলো সেটা খুলে দেখলো ভেতরে অনেকগুলো চকলেট। তিলো অরিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ভালোই ঘুষ খায় দেখি।

-It costs me a lot to keep him quite. অনির দেওয়া চকলেটগুলো ওকে দাওনি বলে আমাকে নালিশ করেছে। কেন দাওনি আর কেন কালকে এতো অদ্ভুত আচরণ করছিলে ভাবতেই মনে হয়েছে, অনিই তোমাকে কিছু বলেছে। ওকে আমি কল করেছিলাম।

তিলো এরপর ওর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলো অনির বাড়িতে। অরিক নিজেই ওকে বাড়ি ফিরিয়ে দেবে বললেও তিলো রাজি হয়নি। অনির বাড়ির দরজায় ব্যাগটা রেখে বেল বাজিয়ে ফিরে আসে তিলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here