ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম] ৪৩,,

0
366

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৪৩,,

বেশ কিছুদিন যাবৎ অরিক নিজে তদারকি করে তিলোকে পড়িয়েছে। চেষ্টা করেছে কোনোভাবে ওকে স্কলারশিপ পাওয়ানোর জন্য। তিলো পড়েছে ঠিকই। কিন্তু এই নিয়ে অরিকের উপর বেজায় অখুশি। একদিকে এই ভার্সিটিতে পড়ো আরেকদিকে স্কলারশিপের জন্য পড়ো।
প্রায় নয়মাস পর অরিক ওকে নিয়ে ইউএসএ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। অরিক সেখানে ইউনিভার্সিটি অব পেন্সিলভেনিয়াতে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। যাওয়ার আগে এখানকার সেই ভাড়া ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দেবে। বলে দিয়েছে বাড়ির মালিককে। সানজিদের বেশ খারাপ লেগেছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

ওদের যাওয়ার আগেরদিন অরিকের কাজিনেরা একসাথে আবারও সানজিদদের বাড়ির ছাদে আড্ডা বসিয়েছে। তিলোর যেতে মন চাইছে না। আবার অরিককে একাও সে ছাড়তে নারাজ। অগত্যা সে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ওদের অগোচরেই রোৎশী আলাদা গিয়ে ছাদের আলোর বাইরের সীমানায় দাঁড়িয়েছে। সানজিদও ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করলো কিছুক্ষণ পর।

-আপনার কি মন খারাপ?

রোৎশী পেছনে দাঁড়িয়ে সানজিদ মৃদুস্বরে বললো। রোৎশী একবার ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। সানজিদ ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলো। রোৎশী ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,
-তা জেনে আপনার কোনো কাজ আছে?

সানজিদ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-না আসলে। কিন্তু ওখান থেকে কিছু না বলেই চলে আসলেন যে।

-আপনি কেন আসলেন?

-এমনিই।

রোৎশী কোনো প্রত্যুত্তর না দেওয়ায় আবারও দুজনের মাঝে নিরবতা স্হান করে নিলো। রোৎশী চাইছে সানজিদ কিছু বলুক। বিশেষ করে কোনো কথা বলুক ওর সাথে। ওর বহু প্রতীক্ষিত কথাগুলো আজ ওকে বলুক। এতোগুলো দিনেও কি ওর প্রতি একবিন্দু মায়া জন্মেনি তার? আজকের পর এই বাড়িতেও তো আসার কোনো অযুহাত ওর থাকবে না। অযুহাত দেখিয়ে অন্তত দেখা করা যেতো। এরপর আর কি বলবে? হঠাৎ করে চাইলেই পারবে না। সানজিদ কিছু বলতে চেয়েও কোথাও বাঁধা পাচ্ছে। সোহা এখনও ওর সাথে জড়িয়ে আছে। চাইলেও হুট করে আর কাউকে কিছু বলা যায় না।
পাশাপাশি দাঁড়ানো দুজন। কিন্তু এরপরও নিজেদের মধ্যে যেন অনেক বেশি দূরত্ব। নিজেদের জড়তা আর সংকোচবোধ দুজনের চারপাশেই দেওয়াল তুলে রেখেছে। একজন অপরজনের থেকে যেন বহুদূরে।

সংকোচ ভেঙে সানজিদ বললো,
-তিল ভাবি আর আপনি একই বয়সী না?

-হুম।

সানজিদ নিজের মাঝে আটকে রাখা কথাগুলোকে কোনোমতে সাজিয়ে নিয়ে সাহস করে জিজ্ঞাসা করলো,
-তা বিয়ে শাদির কোনো পরিকল্পনা নেই? না মানে, ভাবির তো অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। আপনার নেই?

রোৎশী একবার সানজিদের দিকে তাকালো। সানজিদ সে দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও। রোৎশী নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
-ছেলে পক্ষের পছন্দ হয়না কখনো আমাকে।

সানজিদ হয়তো মনে মনে হাসতে সক্ষম হয়েছে। তবে সেটা সামনে একদমই প্রকাশ করলোনা। কেবল প্রশ্ন জুড়লো কথার পিঠে,
-কেন?

রোৎশী তাচ্ছিল্যভরে হেসে বললো,
-এই স্থুলকায় জলহস্তির মতো দেহ দেখে। তারা তো তাদের বাড়িতে বউ নিতে চায়। হাতি নয়।

সানজিদ এবার আর নিজের হাসিটা দমিয়ে রাখলো না। গালের সামনে হাত দিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। অন্ধকারে দেখা না গেলেও রোৎশী বেশ ভালোই বুঝতে পারছে সেটা। ও বিরক্ত হয়ে উল্টো ঘুরে বড় বড় পা ফেলে ফিরে গেলো ওদের আসরে।

পরদিন যাওয়ার সময় তিলো বেশ কেঁদেছে। বিশেষ করে নাসীরা পারভীন ওর সামনে আসতেই ও অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। নাসীরা পারভীন অরিকের সাথে রাগ করে কথা বলেননি। অরিক ওদের আবেগ দেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। বিয়ের সময় একবার দেখেছে, আজ আবার দেখলো। ফাহমিদা বেগমও কেঁদেছেন। অরিক হতাশ চোখে কেবল ওদের কাজ দেখেছে।

ওরা চলে যাওয়ার পর যে যার বাড়িতে ফিরে চললো দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। রোৎশীর মনটা একটু বেশিই খারাপ। ওর সাথে রাকিব এসেছিলো। এখন রাকিবের সাথে বাসে করে ফেরত যাচ্ছে নিজেদের ছোট্ট শহরে।

রেস্টরন্ট এ সামনাসামনি বসে আছে সোহা এবং সানজিদ। সানজিদ ওকে জরুরি কথা আছে বলে দেখা করতে বলেছিলো। এখানে পৌঁছানোর পর থেকে চুপচাপ বসে আছে সানজিদ। সোহা নিজে কথা বলেও ওর মুখ থেকে কথা বের করতে পারছে না। শেষে সোহা বিরক্ত হয়ে উঠতে নিতেই সানজিদ ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-সোহা, আমার কথাটা তো শুনবে।

সোহা সানজিদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-সেটা তো তখন থেকে আমিও জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি। তুমি কোনো কথা বলছো আদৌও?

-আচ্ছা, আচ্ছা। বলছি। একটু সময় দাও।

সোহা ধপ করে চেয়ারটায় বসে বললো,
-আর কতক্ষণ? অনন্তকাল এখানে বসে থাকতে পারবোনা আমি।

সানজিদ একবার চোখ বুজে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললো,
-আসলে সোহা…আসলে…

সোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-আসলে কী?

-আসলে আমার মনে হয়, আমাদের এখানে থেমে যাওয়া উচিত। মানে, সম্পর্কটা আমি আর এগিয়ে নিতে চাচ্ছি না। আমাদের অনেক কিছু মেলে না। দেখো, আমার মা নেই। তোমার মা আছে। তোমার বাবা সরকারি চাকরি করে। আমার বাবা ব্যবসা করে। তুমি ফর্সা। আমি শ্যামলা। তুমি …

সানজিদ আর কিছু বলার আগে সোহা অতিষ্ঠ হয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-ওয়েএএট। কি বলছো এসব তুমি?

সানজিদ একবার সোহার দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে বললো,
-আসলে এতো অমিল নিয়ে তো আর সংসার করা যায়না। তাই এখন থেকে তুমি তোমার মতো, আমি আমার মতো।

সোহা টেবিলের উপর জোরে নিজের হাতের তালু দিয়ে শব্দ করে বললো,
-তুমি আমার সাথে মজা করছো? লিসেন সানজিদ, এতোক্ষণ চুপ করে থেকে, আমাকে বসিয়ে রেখে মেজাজটা এমনিতে গরম করে দিয়েছো। এখন এইসমস্ত ফালতু অযুহাত টেনে আনছো!

-সোজা কথায়, ব্রেক আপ।

-মানেহ? দুবছর প্রেম করে, এখন কোথায় বিয়ে করবো আমরা। আর তুমি বলছো ব্রেক আপ!! একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাও আমাকে যে, কেন তুমি সম্পর্কটা নষ্ট করতে চাইছো? আমি কি যত্নশীল নই এই সম্পর্কের প্রতি বা তোমার প্রতি? সহানুভূতিশীল? সুবিবেচক? তোমাকে ফালতু কথা বলে বিরক্ত করি? আমি দেখতে খারাপ? আমি কি ঘরের কাজ পারি না? আমি কি পড়াশোনা জানি না? আমার কি অতিরিক্ত চাহিদা? আমি কি তোমাকে প্রতারণা করেছি? আমার বাবার কি যথেষ্ট নেই? সানজিদ, কোনটা আমাকে বলো? কি কারণে তুমি আমাদের ভেতরকার সবকিছু হঠাৎ করে অস্বীকার করছো? বলো আমাকে। আমার ভেতর কিসের কমতি আছে?

সানজিদ আরেকবার সোহার দিকে তাকালো। আসলে সোহার কোনোকিছুরই কমতি নেই। সে প্রেমিকা হিসাবে তেমনই যেমনটা একজন পুরুষ চেয়ে থাকে। কোনো অল্প বয়স্ক ছেলে নয়। বরং একজন বিবেকবান, সুবিবেচক পুরুষ যেমনটা চায়। সোহার কোনো অতিরিক্ত চাহিদা বা ন্যাকামি নেই। সে পড়াশোনায় ভালো। ঘরকন্না ভালোই শিখেছে। দেখতেও একটা গতানুগতিক মেয়ের থেকে সুন্দরী। তার ভেতর যেসকল গুণাবলী রয়েছে, সেটা একটা সংসার টিকিয়ে রাখতেও যথেষ্ট। কিন্তু তারপরও। সোহার প্রতি সানজিদ এতোদিন যেটা অনুভব করতো, সেটার নাম সানজিদ এখন দিতে পারে। এটা কেবলই আকর্ষণ। সেই বেপরোয়া শব্দটার অনুভূতি সে আসলে অনুভব করেনি কখনো যেটা রোৎশীর প্রতি সে করেছে। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা স্থূল দেহের মেয়েটার মুখ বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যেমনভাবে কখনো সোহাকে সে অনুভব করেনি। কোনোপ্রকার সতর্কতামূলক সংকেত সে পায়নি রোৎশীকে মনের কুঠুরিতে জায়গা করে দিতে। আপনাআপনি মেয়েটা ইঞ্জিনিয়ার, পাশাপাশি মিস্ত্রি হয়ে গড়ে নিয়েছে নিজের ইমারত সানজিদের মনে। সানজিদ কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও ছিলো তার এবং রোৎশীর মধ্যেকার নিগূঢ়তম সম্পর্কটা সম্পর্কে একদমই অসচেতন এবং অবিবেচক। শুধু অনুভব করেছে কোনো এক স্পর্শরৈখিক উপায়ে তার সাথে সে জুড়ে গিয়েছে। রোৎশীর বিদায়টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখার সময় যখন তার বুকের ভেতর হঠাৎই কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা ভর করছিলো, হঠাৎই মনে হচ্ছিলো ফাঁকা ফাঁকা তার চারপাশ, হঠাৎই অসহায় লাগছিলো নিজেকে, হঠাৎই বুকের ভেতরটা বারবার মুচড়ে উঠতে শুরু করেছিলো, তার কাছে তার এবং মেয়েটির সম্পর্কটা প্রোজ্জ্বলতা লাভ করতে শুরু করেছিলো তখনই।
সোহার প্রতি তার ছিলো দূর্দমনীয় একটা আকর্ষণ, যেটা একসময় কেটে যাওয়ার ছিলো।

সানজিদ নিজের ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে সোহার চোখে চোখ রেখে ওর মেহেদী রাঙা হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে কাতর কন্ঠে বললো,
-তোমার ভেতর কোনো কমতি নেই সোহা। আর তাই তুমি আমার থেকে আরো ভালো ছেলে তোমার জীবনে প্রত্যাশা করো। কমতি আমার আছে। আমার মাঝে তোমার জন্য ভালোবাসার কমতি রয়েছে। তোমাকে আমি পরিপূর্ণ করতে পারবোনা। এখন যদি আমাদের সম্পর্কটা টিকেও থাকে, সেটা হবে কেবলই একটা বোঝা। অনেকটা গলায় বেঁধে থাকা কিছু, যেটা ফেলে দেওয়াও যায়না আবার গিলে ফেলাও যায়না। পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে। আমি আশা করি, তুমি নিশ্চয়ই এমন কাউকে জীবনে পাবে যে সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসবে আর ভালো রাখবে। ভালো থেকো।

সোহার অনাড়ম্বর সাধারণ সুন্দর চেহারাটা ইতিমধ্যে বিষাদের কালো মেঘে ছেঁয়ে গিয়েছে। যেন কোনো শিল্পী সুন্দর মুখশ্রীর ছবি আঁকতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছে।
সোহার অভ্যাস নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি রাখা। সবসময়ই তার হাতজোড়া রাঙিয়ে দখল করে থাকে মেহেদী। মেয়েটা আঁকেও ভীষণ সুন্দর। সোহার মুখের দিকে তাকিয়ে সানজিদের খারাপ লাগছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কারো মন সে এভাবে ভেঙে দিলো! কিন্তু তাছাড়া করার কিছু নেই। সোহার সাথে এরপরও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা ওর প্রতারণা করা হবে। সানজিদ ওর অঙ্কনে পরিপূর্ণ হাত জোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে শুরু করলো সামনে। পেছনে তাকালো না। ওর পক্ষে সম্ভব না পেছনে তাকিয়ে সোহাকে আরেকবার দেখা। সোহা কেঁদে দিয়ে ভগ্ন কন্ঠে পেছন থেকে বলে চলেছে,
-আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি সানজিদ। তোমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলে। আমাকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করলে না? কেন ঠকালে আমাকে?

সানজিদ দাঁড়ায়নি আর। সোহা মাটিতে ধপ করে বসে নিজের হাতজোড়া বুকে ধরে কেঁদে চলেছে।

আজ ঘোর অমানিশা। আকাশটা পুরো কয়লার ন্যায় কালো। চাঁদের নূন্যতম ফালি কেটেও লাগানো হয়নি। সোহার ভেতরকার অন্ধকারটুকুকেই উৎসর্গ করতে হয়তো আকাশটাও প্রকৃতির উপর রাগ করে চাঁদটা ঢেকে ফেলেছে।
সানজিদ সন্ধ্যায় রেস্টরন্ট থেকে বেরিয়ে পার্কিং এরিয়ায় এসে নিজের মোটরসাইকেলটার উপর বসে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। ‘রোদ’ নামে সেভ করা নম্বরটায় ছোট্ট একটা টেক্সট লিখে সেন্ড করে দিলো।
‘তুমি কি আমার সকালবেলা হাঁটতে যাওয়ার সঙ্গী হবে?’

সানজিদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো উত্তরের। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। সানজিদ তৎক্ষনাৎ হিসাব কষে নিলো, কতক্ষণ হয়েছে রোৎশীর ভ্রমণ করা বাসটা ছেড়েছে। বেশিক্ষণ হয়নি। সানজিদ তখনই রওনা দিলো সেই বাসটার নাগাল পাওয়ার উদ্দেশ্যে।

রোৎশী হাতে থাকা ফোনটার কম্পনে প্রথমে কোনো আগ্রহবোধ না করলেও কয়েক মূহুর্তের চিন্তায় সে নিজের ভেতর তীব্র সুপ্ত অদমনীয় কৌতুহল বোধ করলো। ফোনের স্ক্রিন আনলক করে সানজিদের পাঠানো টেক্সটটা পড়ার আগের প্রেরকের নামটা দেখেই শরীরের মাঝে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো তার। সে চাপা উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছে। কিন্তু সে নিজের সর্বোচ্চ ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেকে দমিয়ে রেখে দিলো। ব্যস্ত ভঙ্গিমায় সে টেক্সটটা পড়তেই পারছে না ঠিকমতো। তার কেবল মনে হচ্ছে, যাই লেখা থাকুক, টেক্সটটা তার পাঠানো। যেকোনো কথা শুনতে বা জানতে সে প্রস্তুত। প্রথমবার অরিকের বাসায় এসেই সে সানজিদের ফোন নম্বরটা সেভ করে রেখেছিলো। কিন্তু কখনো ডায়াল করা হয়নি আর না সেই নম্বর থেকে কখনো ডায়াল করা হয়েছে। প্রথমবার টেক্সটায় সে পুলকিত।
রোৎশী কম্পিত হস্তে ম্যাসেজটা খুললো। লাইনটা পড়ে একবারে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। পাশে তাকিয়ে রাকিবকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু তার মাথায়ও আসলোনা, ম্যাসেজটার কোনো উত্তর কেউ প্রত্যাশা করতে পারে। সে নিজের ঘোর কাটিয়েই বের হতে ব্যর্থ। বোকা একটা ধারণা, যে সে এমনিতেই বুঝতে পারবে, রোৎশীর মস্তিষ্কে নাড়া দিলো। সে আর উত্তর দিলো না টেক্সটটার।

সানজিদ অনেক খুঁজে অবশেষে সেই বাসটার সন্ধান পেয়েছে। দুপাশেই খোঁজ করে একটা সীটের জানালার পাশে চোখ বুজে সীটে হেলান দিয়ে রোৎশীকে শুয়ে থাকতে দেখে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো। সে নিজেও জানে না কেন সে এটা করলো। কিন্তু করে ফেললো। তাকে এখন তার উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করছে। সে নিজেকে নয়।
সানজিদ মোটরসাইকেলটা বাসটার ওভারটেক করে সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো বাসটাকে।

হঠাৎ বাসটা থেমে গিয়ে জড়তার দরুন যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় অনেকেরই ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তাদের মধ্যে রোৎশী এবং রাকিবও রয়েছে। বাসের কন্ডাকটর নেমে এসে বেশ চড়া গলায় বললো,
-এটা লোকাল বাস না। এভাবে হুটহাট করে থামানো যায়না, জানেন না?
আরো বেশ কিছু কথা।
সানজিদ সেসবে পাত্তা না দিয়ে বাসটার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
-আমার জিনিস যে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি থামাবো না তা? অদ্ভুত মানুষ!

সানজিদ বাসে উঠে রোৎশীর সীটের দিকে এগিয়ে চললো।
রোৎশীর ওর উপর চোখ পড়তেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো যেন। সে খুব ভালো করেই সানজিদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে। বা সে যেটা ধারণা করছে, সেটা না হয়ে থাকলেও রাকিব এখানে উপস্থিত আর সে খুব ভালো করেই সানজিদকে চেনে। রোৎশী নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে স্থাপন করলো নিজের দৃষ্টি। যেন সেই হরিণের মতো, যাকে বাঘে তাড়া করায় সে গাছের আড়ালে নিজের মুখ লুকিয়ে মনে করে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই বোকা হরিণ এটা বোঝে না যে, তার সম্পূর্ণ শরীর দৃশ্যমান। সে বাঘকে দেখতে পাচ্ছে না মানে যে বাঘও তাকে দেখতে পাচ্ছে না, সেটা নয়।
রোৎশীর মনে হচ্ছে, নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সে যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতো বা হুট করে কোনো স্থানে টেলিপোর্ট হয়ে এই বাস থেকে হারিয়ে যেতে পারতো!

সানজিদ ওর সীটের সামনে এসে দাঁড়ালে রাকিব বলে উঠলো,
-তুমি হঠাৎ এখানে! কোথাও যাবে?

সানজিদ রোৎশীর দিকে একপলক তাকালো। তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
-হ্যাঁ। আমার শ্বশুরবাড়ি যাবো।

রাকিব ওর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে কিছু বলার আগেই সানজিদ বললো,
-রোদ, আমার টেক্সটের জবাব দিলে না কেন?

‘রোদ’ নামটা, পাশাপাশি টেক্সটটার মতোই ‘তুমি’ সম্বোধন শুনে রোৎশী কেঁপে উঠলো। আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছে একবার সানজিদের দিকে তাকাতে। কিন্তু রাকিবের কথা চিন্তা করে তাকালো না।
সানজিদ আবারও বললো,
-রোদ, আমি তোমাকে বলছি।

রোৎশী এবার ওর দিকে তাকিয়ে অবাক ভঙ্গিমায় নিজের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
-আ…আ…আমাকে? কিন্তু এখানে রোদ কে?

সানজিদ চোখ বুজে মাথা নাড়িয়ে আবারও চোখ মেলে বললো,
-হ্যাঁ, তোমাকে। আমি তোমাকে টেক্সট করেছিলাম যার জবাব পাইনি।

রোৎশীর এখন নিজেকেই মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে। জবাবটা দিলে কি হতো ওর? অন্তত সানজিদ এখানে আসতো না। রোৎশী তো ভাবতেই পারেনি, সানজিদ এতোটা বেপরোয়া। সানজিদ নামের শান্ত শিষ্ট ভদ্র একটা ছেলেকেই ও কেবল চিনতো।

রাকিব হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে সানজিদের শার্টের কলার ধরে বললো,
-তোর সাহস তো কম না, আমার সামনে আমার বোনকে তোর টেক্সটের কথা বলিস!

আর কিছু বলার আগে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। বাস ভর্তি লোকজন। এখানে কোনো দর্শনীয় দৃশ্যের উপস্থাপন অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। রোৎশী উঠে দাঁড়িয়ে রাকিবকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে।

সানজিদ নিজের কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-সাহস আছে বলেই সবার সামনে এসে বললাম। আমার মাঝে কোনো খাদ নেই ওর প্রতি আমার অনুভূতিতে। থাকলে বা আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে তো লুকিয়ে রাখতে বলতাম ওকে আমার ব্যাপারটা৷ ও না বললেও আমি এসে তো বললাম। নয় কি?

রাকিব ওর কথায় কিছুটা শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু নিজের রাগ এখনো যায়নি৷
সানজিদ নিজের কদম ফুলের মতো চুলগুলোর মাঝে হাত চালিয়ে ঘামটুকু মুছে নিয়ে বললো,
-আজ আপনাকে বললাম। কাল আমার বাবা যাবে আপনার বাড়িতে। সোজাসুজি রাজি থাকলে ভালো। না হলে…

রাকিব সানজিদের বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বললো,
-না হলে কি? কি করবি তুই?

বাসের কিছু যাত্রী এবং কন্ডাকটর ওদের ঝামেলার মাঝে চলে এসেছে। সানজিদ দুই হাত তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বললো,
-আমরা পালাবো। আমি জানি রোৎশীও আমাকে ভালোবাসে। আমি বললে ও নিশ্চয়ই আমাকে সঙ্গ দেবে।

-দেবো না আমরা ওকে তোর সাথে বিয়ে।

রোৎশীর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে রাকিব জিজ্ঞাসা করলো,
-ও যা বললো সত্যি?

রোৎশী মাথা নামিয়ে ফেললো ভয়ে। রাকিব দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করলো ধমকের সাথে। রোৎশী সামান্য কেঁপে উঠলেও মুখ থেকে হ্যাঁ বোধক উত্তর বেরিয়ে এলো। রাকিব আরো রেগে কিছু বলার আগে সানজিদ বললো,
-আমার কি খারাপ, একটু বলবেন। আপনার বোনের জন্য কি আমি যোগ্য নই?

-না।

সানজিদেরও এবার বেশ রাগ হলো। ও বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
-বেশ। আপনার মুটি বোনকে কোথায় বিয়ে দেন আমিও দেখবো।

রাকিব আরো তেতে উঠে বললো,
-ওই তুই আমার বোনকে মুটি বললি কেন? তোর সাহস কি করে হলো ওকে মোটা বলার? ওই দাঁড়া তুই। দাঁড়া বলছি।

রাকিব এগিয়ে যেতে নিলে বাসের যাত্রীরা বাঁধা দিলো। এমনিতেই এতোক্ষণ ওদের ঝামেলা দেখে তারা অতিষ্ঠ। আর ঝগড়া বাড়ালে ওদেরই বাস থেকে নেমে যেতে বললো।
রাকিব অগত্যা নিজের রাগে কাঁপতে থাকা শরীরটা ধপ করে ফেলে দিলো বাসের সীটে। রোৎশীর সাথে আর একটা কথাও বললো না সারা রাস্তা। রোৎশী চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বাকি রাস্তা চলতে থাকলো। রাকিব মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে সানজিদকে গালি দিচ্ছে, বিশেষ করে রোৎশীকে মোটা বলার জন্য। আর রোৎশীকে বলেছে, বাড়ি ফিরে ওকে দেখে নেবে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here