#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।
বাবার সাথে কথা বলে কিছুটা শান্তি পেলেও মা তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। মায়ের অভিমান বরাবরই একটু বেশি। আর এখন তো সাথে যোগ হয়েছে রাগও। প্রিয়তার মনের আক্ষেপ বাড়ল। দেশে না ফিরা অবধি মা’কে সে মানাতে পারবে না, জানে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওয়াদি ধরা না পড়া অবধি দেশে ফেরাও যাচ্ছে না যে। তার চিত্ত জুড়ে বইল বিষন্নতার স্রোত। সবাই বোঝাল, মায়ের রাগ পড়ে যাবে অবশ্যই; সন্তানের কাছ থেকে মা কখনোই মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে না, এটা অসম্ভব। দিলরুবা বেগম ভীষণ আদর করে বোঝালেন। নীহালও আশ্বস্ত করল তাকে।
গেস্ট রুমে নীহালের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, আর প্রিয়তা শুয়েছে মৌমির ঘরে। সকল চিন্তা ভাবনার মলাট বন্ধ করে অবশেষে কিছুটা শান্ত হয়ে বিছানায় গা লাগায় প্রিয়তা। মৌমি তার পাশেই। প্রিয়তার রিক্ত শূণ্য চোখ। মৌমি জিজ্ঞেস করল,
‘এখনো মন খারাপ?’
প্রিয়তা মলিন হেসে বলল,
‘না।’
‘আন্টির রাগ কমে যাবে, তুমি দুশ্চিন্তা করো না।’
প্রিয়তা মৌমির দিকে পূর্ণ মনোযোগে চাইল। বলল,
‘তুমি না ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে, কত সহজে মানুষকে আপন করে নাও।’
মৌমি অমায়িক হেসে বলল,
‘তাই? অবশ্য এই কথাটা আমাকে সবাই বলে। তবে, তুমিও মিষ্টি কম নও কিন্তু।’
প্রিয়তাও হাসল। বলল,
‘বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে করে না তোমার?’
মৌমি অধিক আগ্রহ দেখিয়ে বলল,
‘করে তো। কিন্তু, আম্মি যেতে চান না।’
‘আমার সাথে যাবে?’
চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল মৌমি। বলল,
‘আম্মি কি রাজি হবেন? আর আম্মি রাজি হলেও ভাইয়া তো জীবনেও রাজি হবেন না।’
প্রিয়তা মুচকি হেসে বলল,
‘উনারা যাতে তোমাকে নিজ থেকেই দেশে পাঠান, আমি বরং সেই ব্যবস্থাই করব।’
মৌমি অবাক কন্ঠে বলল,
‘কীভাবে?’
‘সেটা তো তোমাকে এখনই বলা যাবে না। সময় এলে নিজেই দেখতে পাবে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।’
মৌমিকে গভীর ভাবনায় ডুবিয়ে প্রিয়তা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মেয়েটা হয়তো এখন সারারাত তার এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজতেই খুইয়ে দিবে।
________
রোদ ঝলমলে চমৎকার সকাল। সকালের নৈমিত্তিক কাজে ব্যস্ত দিলরুবা বেগম। ওয়াশরুম থেকে সবেই বেরিয়েছে ফারজাদ। তার ভেজা চুলে তোয়ালে চালাচ্ছে। আজ নিজেকে একটু হালকা লাগছে, অফিসে কোনো মিটিং এর চাপ নেই বিধায়। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাই তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। গায়ে জড়ানো সাদা শার্টটাতে একটু আতর মাখল। চুলগুলো গুছিয়ে নিল পরিপাটি করে। খেয়াল করল, দাড়ি বেড়েছে। মুখ থেকে বিরক্ত ধ্বনি “চ” উচ্চারণ করল সে। ভাবল, গোসলের আগে কেন দেখল না?
খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সবাই। তবে নীহাল এখনো আসেনি। দিলরুবা বেগম মৌমিকে ডাকার জন্য পাঠাবেন ভাবতেই, নীহালকে ঘর থেকে বের হতে দেখা গেল। মৌমি তাকাল বিশিষ্টতাহীন দৃষ্টিতে। কিন্তু আচমকাই থমকে গেল সেই দৃষ্টি। নিদ্রা থেকে সদ্য জাগ্রত কোনো পুরুষ মানুষকে বুঝি এত চিত্তগ্রাহী লাগে? সে চোখ নামাতে পারছে না কেন, আশ্চর্য! নীহালের ঘুম ঘুম চোখ, ফোলা ফোলা মুখ আর এলোমেলো চুল যেন মারাত্মক প্রীতিকর ঠেকছে তার নিকট। সে তার বেহায়া দৃষ্টিকে যেন সংযত করতে ব্যর্থ, আর যার দরুন নীহালের চোখে চোখ পড়ে যায় তার। ভয়ানক লজ্জা পেয়ে সাথে সাথেই চোখ নামায় সে। ঢোক গিলে। ভাবে, লোকটা যদি তার ভাইকে এখন বিচার দিয়ে বলে, “আপনার বোন এমন নির্লজ্জের মতো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কেন? ওকে কি আপনারা এই শিক্ষা দিয়েছেন?” হায় হায়! কী হবে তখন? মৌমি দুশ্চিন্তায় পড়ল ভীষণ। নীহাল বসল তার মুখোমুখি। দিলরুবা বেগম খাবার বেড়ে দিলেন তার প্লেটে। নাস্তা খেতে খেতেই সে ফারজাদের কাছ থেকে তার পেশা নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুনে ফেলল। নীহালও জানাল, সে মাস্টার্স শেষ করে এখন একটা কোচিং সেন্টার চালায়। তার সাথে বিসিএস এর জন্যও ট্রাই করছে, হয়ে গেলেই একটা সরকারী কলেজে চাকরি নিবে।
কথা বলতে বলতেই খাবার শেষ কর উঠল ফারজাদ। তার এখন বের হতে হবে। হাত ধুয়ে বসার ঘরের সোফা থেকে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয়। ততক্ষণে বাকি সবার খাওয়াও শেষ। সবাই যার যার মতো উঠে গিয়েছে।
দরজা খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে জুতা পরছে ফারজাদ। তবে দ্বিতীয় জুতা পায়ে লাগানোর আগেই বিস্মিত হয়ে তাকায়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হেসে বলে,
‘স্যার, আপনারা?’
ফারজাদের বস রওফিক জুবায়ের চমৎকার হাসলেন। আমোদ গলায় বললেন,
‘সারপ্রাইজটা কেমন লাগল, ফারজাদ?’
“একটুও ভালো না”, উত্তরটা যদি এভাবে মুখের উপর দিতে পারত তাহলে মনে ভীষণ তৃপ্তি পেত ফারজাদ। আপাতত সেটা পারছে না বলে, দাঁত চেপে সবটা হজম করে জোরপূর্বক হাসল সে। বলল,
‘জি স্যার, দারুণ লেগেছে। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, স্যার; ভেতরে আসুন।’
ফারজাদ জুতা খুলে দ্রুত ভেতরে ঢুকল। তার পেছন পেছন ঢুকল রওফিক জুবায়ের এবং তাঁর মেয়ে জারা জুবায়ের। ফারজাদ মা’কে ডাকল,
‘আম্মি, আম্মি, এদিকে আসুন। আমার বস এসেছেন।’
দিলরুবা বেগম ভীষণ অবাক হয়ে মাথায় কাপড় টেনে বসার ঘরে এলেন। সালাম দিলেন অজ্ঞাত দুজন ব্যক্তিকে দেখে। সালামের জবাব দিয়ে রওফিক সাহেব বললেন,
‘ভালো আছেন, আপা?’
‘জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন?’
‘জি জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আসলে খুব বিপদে পড়ে আজ আমি আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। আপনার কি আমার সাথে কথা বলার মতো একটু সময় হবে?’
দিলরুবা বেগম প্রশ্ন চোখে ফারজাদের দিকে চাইলেন। ফারজাদের চোখ মুখের ভাবমূর্তিও একই রকম। এই বাপ বেটির হাব ভাব তার মোটেও ভালো ঠেকছে না। তার উপর এই জারা মেয়েটা আজ হঠাৎ এমন শাড়া টাড়ি পরে এসেছে কেন?
দিলরুবা বেগম প্রসন্ন হেসে বললেন,
‘আমার মতো একটা ক্ষুদ্র মানুষের কাছে আপনার কী সাহায্য চাওয়ার আছে বলুন, ভাই; আমি নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাকে সাহায্য করার।’
‘জি, বলছি। আপনি বসুন। আর ফারজাদ, তুমিও বসো।’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘আমি নাস্তা নিয়ে এসে কথা বলি বরং।’
‘না না, নাস্তা পরেও করা যাবে অনেক। আগে জরুরি কথাটা শেষ করি।’
ফারজাদের সন্দেহের মাত্রা এবার বাড়ল। সে ইতস্তত সুরে প্রশ্ন করল,
‘কী জরুরি কথা, স্যার?’
‘সেটাই তো বলছি, তুমি বসো আগে।’
ফারজাদের এসবে বিরক্ত লাগলেও বসল সে। দিলরুবা বেগম বসলেন অপর পাশের একটি সোফাতে। এতক্ষণ আঁড়ালে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিল মৌমি। মা যেহেতু বসে গিয়েছেন, এখন তাকেই নাস্তা বানাতে হবে। সে রান্নাঘরের দিকে যায়, প্রিয়তাও সাথে যায় তার।
‘জি ভাই, এবার বলুন।’
রওফিক সাহেব ছোট একটা নিশ্বাস ফেললেন শুরুতে। অতঃপর নরম গলায় বললেন,
‘আপা, ও হলো আমার একমাত্র মেয়ে, জারা; আমার একমাত্র অবলম্বন। ছোট বেলায় মা হারানোর পর থেকে আমিই ওর সব। ভীষণ আদর, যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করেছি। কখনো কোনো কিছুর জন্য না করিনি। তবে মেয়েটা আমার বেশ কয়েক মাস আগে একটা জিনিস চেয়েছিল, আমি প্রথমে না করেছিলাম। কিন্তু, আমার জেদি মেয়ে, আমার না’কে হ্যাঁ করিয়েই ছাড়ল। আমি চেষ্টা চালালাম। সবকিছু দিতে পারলেও, এবার আমি ব্যর্থ। আমার মেয়ের সেই চাওয়াটা এবার আর আমি কোনোভাবেই পূর্ণ করতেই পারছি না। আর তার জন্যই আজ আমাকে আপনার দোর গোড়ায় আসতে হলো। কারণ একমাত্র আপনিই আমার মেয়েকে সেই জিনিসটা দিতে পারবেন।’
দিলরুবা বেগম বুঝলেন না কিছুই। মৌমি চা নাস্তা নিয়ে এল। সালাম দিয়ে খাবারের ট্রে রেখে চলে গেল আবার। দিলরুবা বেগম অপ্রস্তুত সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আমি কীভাবে দিব, ভাই? আর সেটা কী জিনিস?’
রওফিক জুবায়ের এক পল সময় নিয়ে অতঃপর বললেন,
‘আপনার ছেলে।’
চলবে…
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/