#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩১।
রওফিক সাহেবের কথা শুনে হতভম্ব হলেন দিলরুবা বেগম। তিনি বিভ্রান্ত হয়ে চাইলেন ফারজাদের দিকে। ফারজাদের চোয়াল শক্ত। বস না হয়ে অন্য কেউ হলে এতক্ষণে তাঁকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দিত অবশ্যই। বস বলে সম্ভব হলো না আর।
দিলরুবা একটু সময় ভেবে বললেন,
‘ভাই, আমার ছেলে তো কোনো দেওয়ার জিনিস না। তবে তাও যদি আমার ছেলে চায়, তবে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
ফারজাদ কপাল কুঁচকাল। মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘আমি কী চাই না চাই, সেটা তো আপনি খুব ভালো করেই জানেন, আম্মি।’
রওফিক সাহেব আগ বাড়িয়ে বললেন,
‘আমার মেয়েটাকে আর ফিরিয়ে দিও না, ফারজাদ। ও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।’
ফারজাদ দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সংযত করল। বলল,
‘উনি কষ্ট পাবেন বলেই আমি শুরুতেই নাকচ করে দিয়েছি। তবে উনি কেন এখনো এই বিষয়টা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছেন? আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাচ্ছে না, আর পাল্টাবেও না।’
কথাটা বলেই জোরে নিশ্বাস ফেলল সে। জারা অসহায় বোধ করছে। এই মানুষটা কেন তাকে পছন্দ করে না। অথচ কত ছেলে জীবন দিতেও রাজি তার জন্য।
জারা দিলরুবা বেগমের পাশে গিয়ে বসল। তাঁর হাত ধরে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,
‘আমি আপনার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসি, আন্টি। উনাকে একটু বোঝান না, আন্টি। আমি যে কষ্ট পাচ্ছি ভীষণ।’
ফারজাদ ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তবে দিলরুবা বেগম চোখের ইশারায় শান্ত হতে বললেন তাকে। ফারজাদ শক্ত হয়ে বসে। দিলরুবা বেগম জারার দিকে মায়ার চোখে চাইলেন। নরম সুরে বললেন,
‘দেখো মা, ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যেটা তুমি জোর করে কারোর ভেতর এনে দিতে পারবে না। এটা নিজ থেকেই তৈরি হয়। এখন মা, তুমি যাকে যাও সে যদি তোমাকে না চায় সেখানে আমি কী করতে পারি, বলো? এটা এমন একটা জিনিস যেটা জোর খাটিয়ে হয় না; সময়, ধৈর্য্য আর একনিষ্ঠতা প্রয়োজন।’
জারা বিচলিত হয়ে বলল,
‘সময় লাগবে? ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করব। যতদিন বলবে ততদিন অপেক্ষা করব। তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিও না, ফারজাদ।’
ফারজাদ চট করে উঠে দাঁড়াল। চোখ বুজে শ্বাস ফেলল জোরে। এসব আর সহ্য হচ্ছে না তার। তাও ধাতস্ত করল নিজেকে। বলল,
‘আমার কোনো সময় লাগবে না। আজ আমি যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দশ বছর পরও আমার সেই সিদ্ধান্ত’ই থাকবে। স্যার, আমাদের বোধ হয় এবার অফিসে যাওয়ার দরকার।’
রওফিক সাহেব মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে অনুরোধ করলেন,
‘তুমি আরেকটা বার ভেবে দেখো, ফারজাদ। প্রয়োজনে তুমি যা চাইবে আমি তাই দিব।’
ফারজাদ এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। রেগে গেল খুব।
‘আপনার কী মনে হয়, স্যার; আমি লোভী? নাকি আপনি আপনার মেয়েকে টাকা দিয়ে বিক্রি করে দিতে চাইছেন? কোনটা? আমি যেখানে না বলেছি, সেখানে এত বাড়াবাড়ি আপনারা কেন করছেন? নিজেদের সম্মান কমছে যে বুঝতে পারছেন না? জোর আর টাকা দিয়ে সবকিছু পাওয়া যায় না, স্যার? মন, হৃদয় যেখানে সায় দেয় না সেখানে কিছুই সম্ভব না, এইটুকু আপনাদের বোঝা উচিত।’
অপমানে মুখ থমথমে হলো রওফিক সাহেবের। মেয়ের জন্য এসবও হজম করে নিলেন তিনি। বললেন,
‘ফারজাদ, মা বাবা সন্তানের সুখের জন্য নিজের জীবন অবধি দিয়ে দেয়, সেখানে তোমার এই সামান্য অপমান আমার জন্য কিছুই না। আমি এখনো আশাহত হব না, আমার মেয়ে যতদিন চাইবে আমি ততদিন’ই বলে যাব তোমায়। সময় দিলাম, ভাবো আরো। তারপর সিদ্ধান্ত নাও। জারা, আম্মিজান, চলো আমরা বাসায় যাই। ভাগ্যে থাকলে একদিন অবশ্যই তোমার চাওয়া পূর্ণ হবে।’
জারা ঢোক গিলে উঠে দাঁড়াল। দিলরুবা বেগমের দিকে চেয়ে বলল,
‘আন্টি, আসি। দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার মনে আশা পূর্ণ করেন।’
দিলরুবা বেগমও উঠে দাঁড়ালেন। জারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘দোয়া করি, তোমার সমস্ত নেক চাওয়া পূর্ণ হোক।’
রওফিক সাহেব তার মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে ফারজাদকে বলে গেলেন,
‘তোমার আজ আর অফিসে যেতে হবে না। কালকে থেকেই এসো।’
ফারজাদ জবাব দেয় না কোনো। তারা প্রস্থান করেন।
শার্টের উপরের দুই বোতাম খুলে সোফায় গা এলিয়ে বসল ফারজাদ। মাথার ভেতরে ধপ ধপ করছে। রাগটা যেন কমছেই না কোনোমতে। মৌমি বসার ঘরে ছুটে এল। বলল,
‘একদম ঠিক করেছ, ভাইয়া। ঐ মেয়েকে আমারও পছন্দ হয়নি। চুলগুলো দেখেছ, পুরো ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে রেখেছে।’
দিলরুবা বেগম তাকে ধমকে উঠে বললেন,
‘আহ মৌমি, তুই এখন রুমে যা তো।’
মায়ের মেজাজ ভালো না দেখে মৌমি আর কথা বাড়াল না। নিজের রুমে চলে গেল। দিলরুবা বেগম ফারজাদের পাশে বসলেন। ফারজাদ চোখ বুজে বসে আছে। দিলরুবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
‘একটা কথা বলবে, ফারজাদ?’
ফারজাদ চোখ বোজা অবস্থাতেই উত্তর দিল,
‘কী?’
‘তোমার সমস্যাটা আসলে কী নিয়ে? জারাকে নিয়ে? নাকি বিয়ে নিয়ে? বলো তো আমায়।’
ফারজাদ চোখ মেলল। চাইল মায়ের দিকে। দিলরুবা বেগমের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘আম্মি, আমার এগুলো কোনোকিছু নিয়েই কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে আমার মন নিয়ে। আমার মন সায় দিচ্ছে না, মন যে কাজে সম্মতি দেয় না সেই কাজ আমি কী করে করব, আম্মি?’
দিলরুবা বেগম কিছু সময় চুপ করে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তাহলে তুমি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ, বিয়ে করবে না কোনোদিন?’
ফারজাদ চাইল। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘যেদিন মনে হবে, আমি একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষ পেয়েছি, যেদিন মনে হবে, এই মানুষটা আমাকে আমার মৃত্যু অবধি ধরে রাখতে পারবে, আর যেদিন মনে হবে, এই মানুষটা ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, সেদিন সেই মুহুর্তেই সেই মানুষটাকে আমি বিয়ে করে নিব। এর আগ অবধি এই নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না।’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘সেই মানুষটা কি এখনো আসেনি?’
ফারজাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘না।’
দিলরুবা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘অপেক্ষা ভালো, তবে অপেক্ষার অজুহাতে যোগ্য সময় আর যোগ্য মানুষ যেন হারিয়ে না যায়, সেটা খেয়াল রেখো।’
ফারজাদ আর জবাব না দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। দিলরুবা বেগম তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে দোয়া করলেন,
“ছেলেটার এই অপেক্ষা যেন শেষ হয় অতি দ্রুত।”
________
মৌমি একা ঘরে। আজকে কলেজে যায়নি। প্রিয়তা ভাইয়ের সাথে এতক্ষণ কথা বলে এখন মৌমির ঘরে গিয়েছে। মৌমি গল্পের বই খুলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। প্রিয়তা মৌমির পাশে গিয়ে বসল। অথচ মৌমির এখনো মত্ত তার খেয়ালেই। প্রিয়তা আস্তে করে মৌমির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘কী দেখছো উপরে?’
আচমকা শব্দে হকচকিয়ে তাকায় মৌমি। প্রিয়তাকে দেখে বোকা বোকা হাসে। প্রিয়তা ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হলো, কী দেখছিলে ওভাবে?’
মৌমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘কই, কিছু না তো।’
প্রিয়তা তখন ডানে বামে তাকিয়ে আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
মৌমি তার মতো করে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘করো।’
‘তোমার ভাইয়ের কি গার্লফ্রেন্ড আছে?’
মৌমি বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?’
‘না, উনি তখন যেভাবে রাগ দেখালেন। জারা মেয়েটা তো বেশ ভালোই, যেমন উচ্চশিক্ষিত তেমনি সুন্দরী। তাহলে তোমার ভাই এত রেগে গেলেন কেন?’
মৌমি নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘রেগে গিয়েছে ভালো করেছে। জারাকে আমারই পছন্দ হয়নি, আর ভাইয়ার কী পছন্দ হবে।’
প্রিয়তা হাসল। বলল,
‘তা, তোমার কাকে পছন্দ?’
‘তোমাকে।’
বলেই জিভ কাটল মৌমি। প্রিয়তা তাজ্জব বনে চেয়ে রইল। মৌমি মাথা চুলকে হেসে বলল,
‘না মানে, তোমার মতো নম্র, ভদ্র, ভালো, লক্ষী মেয়েদের আমার পছন্দ। আমি চাই, আমার ভাবিজান যেন তোমার মতোই হয়।’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘আচ্ছা, আমি দোয়া করি আমার থেকেও ভালো কেউ তোমার ভাবিজান হোক।’
মৌমি মিনমিনিয়ে বলল,
‘অন্য কেউ লাগবে না, তুমি হলেই হবে।’
চলবে…