#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৩।
অকস্মাৎ একটা বিকট শব্দ হলো। শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই নড়ে উঠল ফারজাদ। বুঝতে পারল না প্রথমে। হঠাৎ মনে হলো ডান হাতটা বোধ হয় ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। সে তাকাল সেদিকে। দেখল, তার সাদা রঙের শার্টের হাতাটা র ক্তে লাল। র ক্তের স্রোত বয়ে নিচে নামছে। প্রচন্ড ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচে নিল সে। পেছন ফিরে চাইল। দেখল, একটা গাড়ি সাঁ করে তার সামনে দিয়ে চলে গিয়েছে। ততক্ষণে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছে আশপাশ থেকে। একজন যুবক ছুটে এসে বলল,
‘ভাই, আপনার হাতে গুলি লেগেছে বোধ হয়। অনেক র ক্ত পড়ছে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এক্ষুনি।’
ফারজাদ ব্যথায় কুপোকাত। নিশ্বাস ফেলল জোরে। বলল,
‘আমার গাড়িটা নষ্ট। আমি দয়া করে একটা গাড়ি ডাকুন।’
ছেলেটি একটা রিক্সার ব্যবস্থা করল। ফারজাদকে রিক্সায় উঠিয়ে রওনা দিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার বলল,
‘পুলিশ কেইস।’
ফারজাদ ততক্ষণে ব্যথায় দিন দুনিয়া ভুলে বসেছে। চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে তার। প্রিয়তাকে এই হাসপাতালেই এনেছিল। ফারজাদ তাই কোনোরকমে কষ্ট করে সেই পরিচিত ডাক্তারের নাম বলল, যিনি প্রিয়তাকে দেখেছেন। তিনি আসেন। ফারজাদকে দেখে চিনতে পারেন। বুঝতে পারেন, আরো একটা পুলিশ কেইস। তিনি আর বিলম্ব করেন না, দ্রুত ফারজাদকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান।
বেশ অনেকক্ষণ পর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন ডাক্তার। সেই অজ্ঞাত ছেলেটি করিডোরেই বসা ছিল। ডাক্তার তাকে দেখে বলল,
‘আপনি উনার কে হোন?’
‘কেউ না। রাস্তায় উনাকে জখম দেখে সাহায্য করেছি।’
‘আচ্ছা, তাহলে উনার বাড়ির লোককে খবর দিতে হবে। আর আপনি থাকুন আরো কিছুক্ষণ, পুলিশ আসলে আপনার জবানবন্দি নিতে পারেন।’
ছেলেটি মাথা হেলিয়ে পূর্বের জায়গায় বসল। পরে কী মনে করে আবার দাঁড়িয়ে বলল,
‘উনি ভালো আছেন তো?’
‘জি, গুলিটা আমরা বের করে ফেলেছি। তবে ক্ষতটা একটু গভীর, ঠিক হতে সময় লাগবে।’
‘আচ্ছা।’
ডাক্তার তাঁর কেবিনে ফিরে গিয়ে ফারজাদের ফোনটা হাতে নিল। লক করা ফোন খুলে কল কী করে দিবেন, সেটাই ভাবছেন। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে, তখনই কল এল ফোনে। ডাক্তার দেরি না করে রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে ভেসে এল এক মহিলার স্বর। চিন্তিত সুরে তিনি বললেন,
‘ফারজাদ, কোথায় তুমি? এতগুলো কল করেছি; ধরোনি কেন?’
ডাক্তার গলা ঝারলেন। সালাম দিয়ে বললেন,
‘আমি হাসপাতাল থেকে ডাক্তার কারীম বলছি, আপনি যার নাম্বারে কল দিয়েছেন তিনি এখন হাসপাতালে আছেন।’
কথাটা শোনা মাত্রই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল দিলরুবা বেগমের। তিনি কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আমার ছেলের কী হয়েছে? ও ঠিক আছে তো?’
‘জি, ঠিক আছে। আপনি দয়া করে হাসপাতালে চলে আসুন।’
ডাক্তারের বলা হাসপাতালে দিলরুবা বেগম আর মৌমি ছুটে গেলেন। রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে উপরে এলেন তারা। অস্থির হয়ে দিলরুবা বেগম এদিক ওদিক দেখছেন। ছেলেকে খুঁজছেন তিনি। এর মাঝেই সেই অজ্ঞাত ছেলেটির তাদের দেখে মনে হলো, এরা বোধ হয় ঐ লোকটার’ই পরিবারের লোক হবে। সে তাই নিজ থেকেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কাউকে খুঁজছেন আপনারা?’
দিলরুবা বেগম অস্থির গলায় বলেন,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ছেলে, আমার ছেলে হাসপাতালে। কোন কেবিনে বুঝতে পারছি না। ডাক্তার একটু আগে কল দিয়েছিলেন।’
ছেলেটি বলল,
‘আসুন আমার সাথে।’
ছেলেটি তাদেরকে ফারজাদের কেবিনে নিয়ে গেল। ততক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে ফারজাদের। মা’কে দেখে কলিজা ঠান্ডা হয়েছে তার। দিলরুবা বেগম ছুটে এলেন। ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে যেন বুক ফেটে যাচ্ছে উনার। তিনি কেঁদে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে, বাবা তোমার? হাতে এত বড়ো ব্যান্ডেজ কেন, হাতে কি ব্যথা পেয়েছ?’
ফারজাদ নরম গলায় বলল,
‘একটু শান্ত হয়ে বসুন, আম্মি। এত অস্থির হয়ে গেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
‘আহা, আমাকে নিয়ে ভেবো না। তোমার কী হয়েছে আম্মিকে বলো।’
ফারজাদ জানাতে চাইছে না সত্যিটা। ইতস্তত সুরে বলল,
‘ঐ একটু ব্যথা পেয়েছি।’
দিলরুবা বেগম তার ব্যান্ডেজ করা বাহুতে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘এখানে কী করে ব্যথা পেলে? এক্সিডেন্ট করেছিলে?’
‘হ্যাঁ, ঐরকমই।’
তিনি তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। শক্ত গলায় বললেন,
‘মিথ্যে বলছো? সত্যি করে বলো কী হয়েছে?’
সেই মুহুর্তে ডাক্তার এলেন কেবিনে। তাঁর সাথে পুলিশ অফিসারও এলেন। পুলিশ দেখে দিলরুবা বেগমের দুশ্চিন্তার পাল্লা ভারি হলো। তিনি বুঝে গেলেন, নিশ্চয় কোনো জটিল ঘটনা, নয়তো পুলিশ আসতো না নিশ্চয়।
অফিসার ফারজাদকে আগে থেকেই চিনেন। তিনি বললেন,
‘আপনাকে সুখবর দিব ভেবেছিলাম, কিন্তু আপনি তো আমাদের বিশাল দুঃখের খবর দিয়ে দিলেন। এটা এখন আবার কী করে হলো?’
ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,
‘সুখবরটা কী, অফিসার?’
‘আমার গোপন তদন্ত টিম ওয়াদিকে ধরে ফেলেছে। তাকে নিয়ে থানায় আসছে। কিন্তু, এর মাঝে আপনার সাথে এটা কী করে হয়ে গেল?’
ফারজাদ চিন্তায় পড়ল। বলল,
‘ওয়াদি ধরা পড়েছে? তাহলে এই কাজটা করল কে?’
দিলরুবা বেগম তাদের কথায় কিছু বুঝতে পারছেন না। তিনি বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘কী কাজ আমাকে বলো না, ফারজাদ।’
ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে চাইল। নিজের ব্যান্ডেজ করা হাতটা একবার পরখ করে বলল,
‘আমার গু লি লেগেছে, আম্মি।’
দিলরুবা বেগম রা হারিয়ে বসলেন। তাঁর ছেলেটার গু লি লেগেছে? ভয়ে সিটিয়ে গেলেন তিনি। যদি হাতে না লেগে আজ গু লিটা বুকে লাগত? ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে উনার। ফারজাদ মা’কে আশ্বস্ত করে বলল,
‘আম্মি, ভয় পাবেন না, আমি এখন সুস্থ আছি।’
দিলরুবা বেগম ছলছল চোখে চেয়ে বললেন,
‘তোমাকে কেউ কেন গু লি করতে যাবে? কোন অপরাধে?’
‘সেই তদন্ত করতেই আমরা এসেছি, ম্যাডাম। আপনি চিন্তা করবেন না, অপরাধীকে আমরা খুব শীঘ্রই খুঁজে বের করব।’
পুলিশের কাছে ফারজাদ শুরু থেকে তার গুলি লাগার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা বলল। পুলিশ সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিরও জবানবন্দি নিয়েছেন। সেই রাস্তার সি সি ক্যামেরা ফুটেজ চেক করবেন তিনি, তাহলেই সব খোলাসা হয়ে যাবে।
পুলিশ চলে গেলেন। দিলরুবা বেগম নির্বাক হয়ে বসে রইলেন পুরোটা সময়। ছেলেটার জন্য বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে উনার। তার নিষ্পাপ, নির্মল ছেলেটাকে কেন কেউ গু লি করতে যাবে? কোন অপরাধে? ফারজাদ মায়ের দিকে তাকাল। মৌমিরও মন খারাপ। সেও চুপচাপ বসে আছে এক কোণে। ফারজাদ বলল,
‘তোমরা এভাবে থ মেরে বসে আছো কেন? আমার কিছু হয়নি তো।’
দিলরুবা বেগম ভেজা স্বরে বললেন,
‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’
‘আম্মি, আমি এখন সুস্থ আছি। চিন্তার কিছু নেই।’
‘তোমাকে কে বা কারা কেন গু লি করেছে সেটা না জানা অবধি কী করে নিশ্চিন্ত হব আমি? আমার বুকের ভেতরে কেমন করছে সেটা তো আমি জানি। ভয়ে আমার গায়ে কাটা দিচ্ছে।’
ফারজাদ কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল,
‘এই জন্যই আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই না। এমন দুশ্চিন্তা করবেন বলেই। পুলিশ কেইসটা দেখছেন তো, আম্মি। আপনি এবার একটু নিশ্বাস ফেলুন।’
দিলরুবা বেগম জবাব দিলেন না কোনো। ফারজাদ জানে, মা’কে এখন হাজার বলেও দুশ্চিন্তার ঘোর থেকে বের করতে পারবে না। আর বের করারও উপায় নেই। যা হয়েছে তা থেকে তো সে নিজেই এখনো বের হতে পারছে না।
______
ফারজাদের ফোনে কল আসে। তার অফিসের গাড়ির ড্রাইভারের নাম্বার। সে ফোন রিসিভ করে। ড্রাইভার চিন্তিত সুরে বলে,
‘স্যার, আপনার নাকি গুলি লেগেছে? এখানে গাড়ি নিতে এসে সবার মুখে এই কথা শুনেছি। আপনি এখন কেমন আছেন, স্যার?’
‘আমি ভালো আছি এখন। গাড়িটা ওভাবে রেখে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য। আর শুনুন, এই কথাটা বস বা জারা ম্যাডামকে জানানোর দরকার নেই।’
ড্রাইভার আমতা আমতা করে বলল,
‘আপনাকে ফোনে না পেয়ে আমি তো উনাদের আরো আগেই জানিয়ে দিয়েছি, স্যার। উনারা এখন আপনাকেই দেখতে আসছেন।’
ফারজাদের মুখ থেকে বিরক্ত ধ্বনি বের হলো। ফোনটা কেটে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘বস আর বসের মেয়ে হাসপাতালে আসছেন, আম্মি।’
মৌমি মাঝখান থেকে বলল,
‘প্রিয়তা আপু নিশ্চয়ই এসব কিছু জানে না। আমি উনাকে জানিয়ে আসছি।’
ফারজাদ তাকে বারণ করার আগেই মৌমি ছুটে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। সে বিরক্ত হয়। বলে,
‘আম্মি, মৌমিকে বারণ করুন না। উনাদের আবার এসব কেন জানাতে হবে?’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘সবাই জানলে প্রিয়তা কেন জানবে না? প্রিয়তার জানার অধিকার আছে।’
ফারজাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘অধিকার?’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/