অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৫।

0
525

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৫।

খাবার নিয়ে বিল দিতে গিয়ে নীহাল পড়ল মহা বিপাকে। এই মৌমি মেয়েটা তাকে বিল দিতেই দিচ্ছে না। এই এত মানুষের মধ্যে এভাবে টাকা নিয়ে জোরাজুরি করা যায় না-কি? সে তাই খানিকটা গলা উঁচিয়ে বলে,

‘আহা, আপনি থামুন, মৌমি। বললাম তো আমি টাকা দিচ্ছি।’

মৌমি মুখ কালো করে বলল,

‘আম্মি আমাকে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছেন, বলেছেন খাবারের টাকা যেন আমিই দিই। তাই আমিই দিব।’

নীহাল কপাল কুঁচকে বলে,

‘আপনি তো ভারি জেদি মেয়ে।’

মৌমি টাকা সহ হাত বাড়িয়ে দিতেই নীহাল তার হাত ধরে ফেলে। শক্ত সেই হাতের বাঁধন। ভাই ব্যতিত এই প্রথম দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে খানিকটা ঘাবড়ে যায় মৌমি।চকিতে তাকায়। নীহাল অন্য হাতে ক্যান্টিনের ম্যানেজারকে টাকাটা বুঝিয়ে দেয়। তারপর মৌমির হাত ছাড়ে সে। মৌমি নির্বাক এখনো। নীহাল খাবারের প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে বলে,

‘চলুন এবার।’

মৌমি ঢোক গিলে পা বাড়াল। আর কথা বলল না কোনো। খাবার নিয়ে কেবিনে ফিরে এল তারা। দিলরুবা বেগম সব প্যাকেট খুলে ওয়ান টাইম প্লেটে পরিবেশনা করে রাখলেন। ফারজাদ উঠে বসল। দিলরুবা বেগম খাবার নিয়ে বসলেন তার কাছে। মৌমি বাকি দুই প্লেট, একটা প্রিয়তা আর একটা নীহালের হাতে দিল। সেও বসল অন্য একটা নিয়ে।

দিলরুবা বেগম ফারজাদকে খাইয়ে দিচ্ছেন। যদিও সে খেতে চাচ্ছিল না, তাও দিলরুবা বেগম জোর করে খাওয়াচ্ছেন।
প্রিয়তা খাবারের মাঝেই পানির গ্লাসটা হাতে নেয়; তখনই ফারজাদ কেশে উঠে, খাবার বোধ হয় গলায় আটকায় তার। তার কাছে পানিও নেই। দিলরুবা বেগম প্লেট রেখে উঠতে উঠতেই প্রিয়তা পানির গ্লাস নিয়ে হাজির তার সম্মুখে। গ্লাসটা ফারজাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘পানিটা খেয়ে নিন।’

ফারজাদ পানি খেল। দিলরুবা বেগম আশ্বস্ত হয়ে বসলেন ফের। প্রিয়তাও নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।

খাবার খাওয়া শেষ করে ফারজাদ বলল,

‘নীহাল, আমার মনে হয় আপনাদের এবার হোটেলে ফিরে যাওয়া উচিত। অনেক কষ্ট করলেন। ধন্যবাদ।’

নীহাল হেসে বলে,

‘না না, কীসের কষ্ট? আপনি আমার বোনের জন্য যা করেছেন, তার তুলনায় আমরা তো কিছুই করতে পারিনি।’

‘বার বার এভাবে বলে আমাকে লজ্জিত করবেন না। মানুষের বিপদে পাশে থাকাই মানুষের ধর্ম।’

‘কিন্তু সেই ধর্ম আজকাল কয়জন পালন করে? ব্যাপারটা বোধ হয় এখন উল্টো হয়ে গিয়েছে, মানুষকে বিপদে ফালানোই মানুষের ধর্ম হয়ে গিয়েছে।’

নীহালের এই কথা ধ্রুব সত্য। ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘এটাও অবশ্য ঠিক। আর ঐসব মানুষের জন্যই পৃথিবীর আজ এই বেহাল দশা। যাকগে সেসব, আপনারা বরং হোটেলে গিয়ে রেস্ট নিন।’

‘আচ্ছা। আর এখানে কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাদের ডাকবেন।’

‘জি জি, অবশ্যই।’

প্রিয়তা বের হওয়ার আগে বলে গেল,

‘আসছি।’

ফারজাদ চেয়ে রইল কেবল।

________

কেবিনের অন্য একটা বেডে দিলরুবা বেগম আর মৌমি শু’লেন। ফারজাদ পাশের বেডেই শুয়ে। মা আর বোন ঘুমিয়ে পড়লেও তার চোখে ঘুম নেই। কেন নেই, সে জানে না। অযথাই সে তার মুখ বরাবর দরজার সাদা পর্দাগুলো দেখছে। রুমে ড্রিম লাইটের আলো। সবুজ আলোয় সাদা পর্দাগুলোকেও সবুজ লাগছে। ফারজাদ ভাবছে অন্য কথা। যেই কথা এই মুহুর্তে ভাবার কোনো যুক্তিকতা নেই। তাও ভাবছে সে। তার ভাবনাটা ঠিক এরকম যে, প্রিয়তার তার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ঠিক কতটুক কষ্ট হচ্ছে? এই কষ্টের কি কোনো পরিমাণ আছে? কোনো ভাবে কি এটাকে মাপা যায়? এসব প্রশ্ন নিত্যান্তই অযৌক্তিক, অসঙ্গত, তাও অযথাই ভাবছে সে। শুনেছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। হয়তো সেই জন্যই ঘুম বাদ দিয়ে এখন এগুলোই মস্তিষ্কে ঘুরছে তার।

সকাল হলো। সূর্যের আলো এসে পড়ল প্রিয়তার চোখে মুখে। চোখ মেলে তাকাল সে। দেখল বাইরে ঝলসানো রোদ। তাকানো দায়। সে উঠে বসল। অনেকক্ষণ বসে রইল। বসে বসে ঝিমাল অযথা। তারপর উঠে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে কফি বানিয়ে গেল ভাইকে ডাকতে।

নীহাল সবসময় ঘুম থেকে উঠেই আগে এক কাপ কফি খায়, তারপর শুরু হয় তার বাকি কাজ। এতদিন বোনের দুশ্চিন্তায় এই অভ্যাস তার ভুলে বসেছিল; আজ আবার বোন তাজা করে দিয়েছে। প্রিয়তা কফি খেতে খেতে বলল,

‘ভাইয়া, ওয়াদি ধরা পড়েছে। কাল আন্টি বললেন। এখন হয়তো আমি দেশে ফিরতে পারব।’

নীহাল চমকে বলল,

‘তাই নাকি! এটা তো দারুণ খবর।’

প্রিয়তা ক্ষীণ সুরে বলল,

‘আমি দেশে যাওয়ার আগে একবার ওয়াদির মুখোমুখি হতে চাই।’

নীহাল এক পল ভেবে বলল,

‘ঠিক আছে। আজ থানায় যাব তবে।’

‘আচ্ছা।’

তৈরি হয়ে আগে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলো নীহাল আর প্রিয়তা। পথিমধ্যে ফারজাদের জন্য ফুল কিনে নিল।

ফারজাদের কেবিনে গিয়েই অবাক হলো দুজন। জারা মেয়েটা এই সকালেই হাজির? নীহাল এগিয়ে আসে। ফারজাদ কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে। বোঝা যাচ্ছে, মাত্রাধিক বিরক্ত সে। জারা ফারজাদের প্রেসক্রিপশন দেখছে, কোন ঔষধের কী কাজ জেনে নিচ্ছে সে; যেন বাসায় গেলে সে’ই খাওয়াবে সব। এর মাঝেই প্রিয়তাকে দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে। তার উপস্থিতিতে মোটেও সন্তুষ্ট করেনে তাকে।
নীহালের হাতে ফুল দেখে মৌমি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,

‘ভাইয়া, দেখো, প্রিয়তা আপু তোমার জন্য ফুলের তোড়া এনেছে।’

ফারজাদ চোখ মেলে তাকায়। প্রিয়তা অস্বস্তি নিয়ে মৃদু হাসে। ফুলের তোড়াটা নীহালের হাতে। নীহাল সেটা বেড সাইড টেবিলে রাখে, সেখানে আরো দুইটা তোড়া রাখা আছে আগ থেকেই। নীহাল দেখেই বুঝে গেল, এইগুলো এই জারা নামের মেয়েটাই এনেছে। সাথে আবার হরেক রকমের ফলের মেলা। বাজারের কোনো ফল বোধ হয় আর বাকি রাখেনি।
ফারজাদ বলল,

‘এসবের কী দরকার ছিল?’

নীহাল হেসে বলল,

‘ফুলের মধ্যে এক চমৎকার ক্ষমতা আছে। এর সুবাস অনায়াসেই একজন অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে পারে।’

ফারজাদ কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘ধন্যবাদ।’

জারা আগ বাড়িয়ে বলল,

‘আপনি ঠিক বলেছেন, তবে আমার মতে সব ফুলের সেই ক্ষমতা নেই। বিশেষ করে রজনীগন্ধা ফুলের। এর গন্ধে তো আমার বমি আসে।’

প্রিয়তা দেখল, তাদের ফুলের তোড়াতে অধিকাংশ ফুলই রজনীগন্ধা। আর এটা সে নিজে দেখেই কিনেছে। রজনীগন্ধার সুবাসের ন্যায় পবিত্র, মায়াময় সুবাস আর আছে না-কি। প্রিয়তার কাছে তো এই সুবাস এক পথ্যের ন্যায় কাজ করে। আর এই মানুষটা কি অসুন্দর ভাষাতে ফুলটার অপমান করল। মন খারাপ হলো প্রিয়তার। মৌমি তখন বলল,

‘তবে একটা কথা কি জানেন, ম্যাডাম, নর্দমার আশেপাশে থাকলে সব ফুলের সুবাস’ই জঘন্য হয়ে যায়। কারণ, নর্দমার গন্ধ এত বীভৎস হয়ে থাকে যে ফুলের এই সুবাসিত ঘ্রাণও সেটাতে প্রশমিত করতে পারে না।’

জারা ভ্রু কুঁচকাল। প্রশ্ন করল,

‘তুমি আসলে কী বোঝাতে চাইছো, বলতো?’

‘কিছুই না। বুদ্ধিমতিদের ধরে ধরে বোঝাতে হয় না, ওরা একটু ইঙ্গিতেই বুঝে ফেলে সব। আপনি হয়তো এখনো যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতি হতে পারেননি, তাই বুঝতে পারছেন না।’

জারা রেগে গেল এবার। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,

‘তুমি কি আমাকে অপমান করছো?’

‘না, না, ম্যাডাম, কী বলছেন? ও আপনাকে অপমান করছে না। এই মৌমি, কী শুরু করেছিস? এসব কী ধরনের কথা?’

ফারজাদের ধমকে চুপ হলো মৌমি। জারা রাগ দেখিয়ে বলল,

‘আপনার বোন কাল থেকেই আমার সাথে এমন আচরণ করছে। কেন করছে, ফারজাদ? আমি ওর কী ক্ষতি করেছি?’

দিলরুবা বেগম ফারজাদকে থামিয়ে নিজে জবাব দেয়,

‘ওর কথায় কিছু মনে করো না, মা। ও একটু এমনই। সবকিছুতেই মজা করে। সবার সাথেই এভাবে কথা বলে। তুমি ওর কথাগুলো এত সিরিয়াস ভাবে নিও না। মজাকে মজা ভেবে উড়িয়ে দাও।’

জারা কথা বাড়াল না আর। এমনিতেই ফারজাদের মনে এখনো তার জন্য এক তিল সমপরিমাণ মায়াও জাগাতে পারেনি। তার উপর এখনই যদি সে তার বোনের সাথে লেগে যায়, তবে ফারজাদ আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে বসবে তখন। আপাতত ফারজাদকে হাতে রাখতে হাসি মুখে মেনে নিল সবটা। বলল,

‘না না, সমস্যা নেই। ছোট বোন হিসেবে এইটুকু মজা করতেই পারে। আর ভাবি ননদের সম্পর্ক তো এমন’ই হওয়া উচিত।’

মৌমি আবারও কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই দিলরুবা বেগম চোখের ইশারায় থামিয়ে দিলেন তাকে। বোঝালেন, ভাই রেগে আছেন এমনিতেই, এখন আর কথা বাড়ালে ভাইয়ের রাগ আকাশ ছুঁবে। ভাইয়ের কথা ভেবে কোনোরকমে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে নিল মৌমি। জারা তার আহ্লাদীপনা জারি রাখল আরো কিছুক্ষণ। এরপর বেরিয়ে গেল, তাও ফারজাদের বার বার বলাতেই। সে এসবে অসহ্য বোধ করছে। জারা মেয়েটার এই গায়ে পড়া স্বভাব তার আর সহ্য হচ্ছে না। তার বাবার অফিসে চাকরি করে বলে বাধ্য হয়ে মেনেও নিতে হচ্ছে সবকিছু।

‘আমরা এখন একবার থানায় যাব, ফারজাদ।’

ফারজাদ বলল,

‘আমিও যাব সাথে।’

‘না না। আপনার এই অবস্থায় কোথাও যেতে হবে না।’

‘আমি আগের থেকে এখন অনেকটাই ঠিক আছি, নীহাল। যেতে পারব আমি। আপনারা একা যাবেন কেন?’

প্রিয়তা বলল,

‘আমরা একা যেতে পারব। আপনাকে আর এই অবস্থায় কোথাও যেতে হবে না। আপনার এখন পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজন। বিশ্রাম নিন। আমি শুধু যাব শেষবারের মতো একবার ঐ মানুষটার মুখোমুখি হতে। তাকে কিছু প্রশ্ন করার বাকি আছে এখনো, সেগুলোর উত্তর জানতে হবে যে।’

চলবে …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here