#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৭।
অফিসার বললেন,
‘ওয়াদির বাবা একজন বড়ো মাপের ব্যবসায়ী, বেশ উপরে হাত আছে উনার। কিছুক্ষণ আগেই থানায় এসে হুমকি ধমকি দিয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে ওয়াদিকে কোর্টে তোলার আগেই ছাড়িয়ে নিবেন।’
নীহাল কপাল কুঁচকে বলল,
‘আশ্চর্য! ছেলে এমন একটা জঘন্য কাজ করার পরও বাবা এই ব্যবহার করার সাহস পান কী করে? আর বললেই কি ছাড়িয়ে নেওয়া যায় না-কি? আইন কি এত দূর্বল?’
‘দেখুন, কোর্ট থেকে অর্ডার এলে আমাদেরও কিছু করার থাকবে না।’
‘কোর্ট এমন বেআইনি অর্ডার দিবে কেন?’
‘আজকাল মানুষ টাকা আর ক্ষমতার জোরে সব’ই করছে, কিছু করার নেই।’
নীহাল গর্জে উঠে বলল,
‘তাই বলে এত এত অন্যায় করার পরেও ছেলেটা ছাড়া পেয়ে যাবে?’
‘না, কেইস তো আর সলভ হয়নি। কেইস আমি অবশ্যই কোর্টে উঠাব, আর এই ওয়াদির শাস্তির ব্যবস্থাও করব। আপনাদের আপাতত একজন শক্ত উকিল প্রয়োজন, যে কেইসটাকে জিততে সাহায্য করবে।’
‘আচ্ছা, আমি কালকের মধ্যেই ব্যবস্থা করছি।’
ফোন রাখল নীহাল। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে, নীহাল?’
নীহাল বিদ্বিষ্ট সুরে বলল,
‘আর বলবেন না, ওয়াদির বাবা নাকি আজ থানায় গিয়ে খুব ক্ষমতা দেখিয়ে এসেছেন, ছেলেকে নাকি ছাড়িয়ে নিবেন। অফিসার বললেন, আমাদের পক্ষের একজন উকিল লাগবে এই কেইস জেতার জন্য। এখন বুঝতে পারছি না কী করব? সহজে তো মনে হচ্ছে কিছুই হবে না, এমন চলতে থাকলে দেশে ফিরব কবে?’
ফারজাদও চিন্তায় পড়ল। আজকাল ক্ষমতার জোরে মানুষ জঘন্য সব পাপ করেও রেহাই পেয়ে যাচ্ছে, কী বিদঘুটে ব্যাপার! ফারজাদ ভাবল, ওয়াদির বাবা’ই বা কেমন, ছেলের এত সব অন্যায়ের কথা শুনে তাকে শাস্তির দেওয়ার বদলে উল্টো আরো ছাড়িয়ে নিতে এসেছেন? যেখানে বাবার শিক্ষাতেই ঠিক নেই, সেখানে ছেলে আর মানুষ হবে কী করে।
নীহালকে অতি চিন্তিত দেখে ফারজাদ তাকে আশ্বস্ত করল। বলল,
‘আমার এক কলিগের বড়ো ভাই উকিল, বেশ নাম ডাক আছে উনার। শুনেছি কোনো কেইস নাকি হারেন না। আমি না হয় তার সাথে একবার কথা বলব।’
নীহাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘আপনারা আছেন বলে আমি এখনো বোনকে নিয়ে এইদেশে এতটা নিশ্চিন্তে আছি। নয়তো এমন অপরিচিত একটা দেশে যে কীভাবে কী করতাম কে জানে?’
‘চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। যতদিন পাকিস্তানে আছেন, ততদিন অবধি আমরা সাহায্য করে যাব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
নিচে নেমে প্রিয়তাকে সব খুলে বলল নীহাল। সব শুনে সবাই চিন্তিত হলো বেশ। অন্যায়ের শাস্তি না পেয়ে ওয়াদি ছাড়া পেয়ে যাক সেটা কেউ চায় না। প্রিয়তার দুশ্চিন্তার মাত্রা অধিক। তার চোখে মুখ দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে তা। ফারজাদ বলল, এখনই সে একবার তার কলিগকে কল করে জানাবে সবটা। কলিগের বড়ো ভাই রাজি হয়ে গেলেই সব চিন্তার অবসান ঘটবে।
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘তাহলে এখনই কলটা করো।’
ফারজাদ তাই করল। তার পরিচিত সেই কলিগের নাম্বারে কল লাগাল। কথা বলল তার সাথে। খুলে বলল সব। সে তাকে তার ভাইয়ের নাম্বার দিয়ে বলল, তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে। ফারজাদ নাম্বার পেয়ে কল করল তাকে। দুবারের মাথায় রিসিভ হলো সেটা। ফারজাদ পরিচয় দিয়ে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানাল সব। সব শুনে সে বলল,
‘এই ঘটনা আমিও জানি। কোনো এক সাহসী মেয়ে বেশ সাহস দেখিয়েই কেইসটা করেছে। তার হয়ে কেইসটা আমি লড়তে পারলে আমি বরং খুশি হব। চিন্তা করবেন না, কাল একবার আমার অফিসে চলে আসবেন। বাকি কথা সামনা সামনি হবে।’
বলেই ফোন কাটলেন তিনি। ফারজাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘কাজ হয়েছে। উনি রাজি।’
আশ্বস্ত হলো সবাই। নীহাল ফারজাদকে ধন্যবাদ জানাল। প্রিয়তাও। দিলরুবা বেগম তাদের আজ রাত আর হোটেলে ফিরতে দিলেন না।
তখন হয়তো মধ্যরাত। ঘুমে বিভোর সকলে। তবে কেউ একজন প্রহর কাটাচ্ছে নির্ঘুম চোখে। তার ভেজা পাপড়ি জানান দিচ্ছে, একটু আগেই চোখ বেয়ে বর্ষণ নেমেছিল হয়তো। সে অস্থির, উদাসীন। কিছুতেই বক্ষঃস্থলে শান্তি পাচ্ছে না। এভাবে ছোট্ট একটা ভুল যে এত বড়ো বিপদ ডেকে আনবে তা কে জানতো। প্রতিনিয়ত এই এক আফসোস করেই দিন যাচ্ছে তার। কবে এই আফসোসের পাল্লা প্রশমিত হবে কে জানে?
প্রিয়তা উঠে বসল। না, ঘুম আসছে না। আসবে বলেও মনে হচ্ছে না। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তাকায় শান্ত পরিশ্রান্ত আকাশের পানে। চাঁদ নেই, তারা আছে মিটিমিটি। সে তাকিয়ে থাকে অবিরাম। দৃষ্টি সিক্ত ভেজা। সে ঐ দূরের তারাকে ডেকে বলে,
‘আজ যদি তুমি আমায় ভালোবাসতে তাহলে আমাকে এত কষ্ট পেতে হতো না, ওয়াদি। তুমি এত নির্দয় কী করে হতে পারলে? কেন একটু ভালোবাসলে না? আমার এত এত ভালোবাসাকে কীভাবে অগ্রাহ্য করলে তুমি? তোমার কি একটুও কষ্ট হয়নি?’
প্রিয়তার গাল বেয়ে দগ্ধ অন্তঃস্থলের হাহাকার চুইয়ে পড়ে। সে আঁচলে মুছে নেয় তা সন্তর্পনে, যেন কেউ না দেখে, কেউ না জানে। তারপর ঘরে ফিরে আসে আবার। শুয়ে পড়ে, ঘুম না আসলেও এভাবেই ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতে হবে যে।
_______
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল তিনজন; প্রিয়তা, নীহাল আর ওয়াদি। উকিলের অফিসে হাজির তারা। তখনও উকিল, আফসার খান অফিসে আসেননি। ঠিক দশটায় অফিসে আসেন তিনি। দশটা বাজতে এখনো পনেরো মিনিট দেরি। তারা তিনজন অফিসের বাইরে অপেক্ষা করছে।
বরাবর দশটা, কালো রঙের একটি গাড়ি সাঁ করে এসে তাদের সামনে থামল। গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত নেমে এল গাড়ি থেকে। তারপর খুলে দিল পেছনের দরজাটা। নেমে এল একজন কালো স্যুট গায়ে সুঠাম দেহের পুরুষ। নেমেই স্যুটের মাঝের বোতামটা খুলে দিল। চশমটা খুলে পড়ে নিল চোখে। তারপর হাঁটা ধরল তার গন্তব্যে। অথচ তিনটা মানুষ যে অধির আগ্রহে চেয়ে আছে, সে খেয়াল’ই তার নেই। কিছুক্ষণ পরেই একজন লোক এল, তাদের তিনজনকে এসে বলল ভেতরে যাওয়ার জন্য। তিনজনেই ভেতরে গেল। আফসার খান চোখের চশমা নামিয়ে পরখ করল তিনজনকে। প্রিয়তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। কিছুক্ষণ মনোযোগের সহিত তাকে দেখে বলল,
‘আপনি প্রিয়তা?’
প্রিয়তা চকিত হলো প্রথমে। তারপর মাথা নাড়াল। সে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি বোবা?’
প্রিয়তা আবারও ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘না না।’
‘তাহলে, মাথা নাড়াচ্ছেন কেন?’
প্রিয়তা অস্বস্তিতে আর জবাব দিল না। আফসার বলল,
‘আপনারা দুজন, ফারজাদ আর নীহাল, একটু বাইরে বসুন। আমি আগে প্রিয়তার সাথে একা কথা বলব।’
নীহাল খানিকটা ভড়কে ফারজাদের দিকে চাইল। লোকটা তার বোনের সাথে একা কি কথা বলবে। ফারজাদ চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল তাকে। নীহাল প্রিয়তাকে বুঝিয়ে বের হয়ে আসল।
আফসার বলল,
‘বসুন, প্রিয়তা।’
প্রিয়তা বসল। আফসার জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার নামটা সুন্দর। কে রেখেছেন?’
এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে খানিকটা বোধ হয় বিরক্ত হলো প্রিয়তা। তাও জবাবে বলল,
‘ভাইয়া রেখেছেন।’
‘আচ্ছা। তা প্রিয়তা, আপনার মূর্খ প্রেমিক কী করে এমন প্রিয় একটা জিনিসকে অগ্রাহ্য করল বলুন তো?’
প্রিয়তা কপাল কুঁচকাল। বলল,
‘ঐ যে বললেন, সে মূর্খ; তাই হয়তো।’
আফসার হাসল। লোকটার হাসি চমৎকার সুন্দর। তবে প্রিয়তার কাছে এই চমৎকার সুন্দর হাসিটাকেও অযাচিত মনে হলো। আফসার বলল,
‘তা মিস প্রিয়তা, আপনার মূর্খ প্রেমিকের মূর্খতার ঘটনা খুলে বলুন সব। আমিও শুনে একটু আফসোস করি।’
চলবে…
(সময় করে এইটুকুই লিখতে পেরেছি। ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। আর সবাইকে রমাদান মোবারক।)
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/