#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_১৯
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
——–
মিছিলদের বাড়িতে প্রবেশ করে নয়নার বিষ্ময় শেষ হলো না। আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে গেইট থেকে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত সাজানো হয়োছে। রংধনুর সাত রং যেভাবে দূর আকাশে মেলে থাকে ঠিক তেমনভাবে ফুলগুলোকে সাজানো হয়েছে। অদূরে স্টেজ সাজানো হয়েছে নয়না সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। মিছিলের আনন্দ আজ দেখে কে? প্রিয় বান্ধবীকে নিয়ে বাড়িতে এসেছে, এই আনন্দ ধরে রাখার মতো নয়! বাড়িতে প্রবেশ করে উচ্চ স্বরে হাঁক ছাড়লো মিছিল, ” মা! তোমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি। কোথায় গেলে?”
মিছিলের মা পাশের ঘরেই ছিল। মেয়ের ডাকে ঘর ছেড়ে নয়নাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। পরম মমতায় আদরের সাথে বলল,” কেমন আছিস মা!”
নয়না মুচকি হেসে উত্তর দিলো, ” ভালো আছি।”
মিছিলের বাবা নুরুল ইসলাম পেশায় একজন ব্যবসায়ী। সারা বছর তার দেখা মিলে কই? ব্যবসার কাজে এ-শহর থেকে ঐ-শহরই ঘুরে বেড়াতে হয়। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাসায় থাকা! নয়নাকে দেখা মাত্রই বলতে শুরু করলো,” সেদিন আমি বাড়ি থাকলে তোমাকে ঐ পশুদের সাথে যেতে দিতাম না। ভালো করেছো চলে এসে। এখন থেকে এখানেই থাকবে। ”
নয়না মুচকি হেসে সায় দিলো। মিছিলের মা দুই মেয়েকে এবার তাগাদা দিলো, ” তোরা ফ্রেস হয়ে খেয়ে নে। খবরদার মিছিলের সঙ্গ পেয়ে বসে থাকবি না নয়না? এই মেয়েটা আস্ত অলস, আমার সাথে কোনো কাজই করতে চায় না। দুইজন এসে আমাকে সাহায্য করবি।”
নয়না হেসে বলল,” আচ্ছা, আন্টি।”
ছেলে পক্ষের বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন হয়? মেয়ে বিদায়ের সময়ে মেয়ে পক্ষরা যেভাবে কান্না করে, ছেলে পক্ষও কী কান্না করে? নয়না ছেলে পক্ষের জমজমাট বিয়ে দেখেনি। ময়মনসিংহ থাকতে মেয়েদের ধুমধামে বিয়ে হতে দেখেছে, তাও দূর থেকে। ছেলেদের বিয়ে দেখেনি, কেনো দেখেনি সে নিজেও জানে না। ছেলে পক্ষের বিয়ে দেখার জন্য এক্সাইটেড হয়ে আছে নয়না। লজ্জায় সে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
আজ সন্ধ্যায় মেহেদীর অনুষ্ঠান, আগামীকাল গায়ে হলুদ। মেহেদী অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। মিছিলও সেখানেই ব্যস্ত! নয়না একাকী ঘরে বসে মুঠোফোন হাতে নিয়ে বসে রইলো। তূর্যের নাম্বারটাতে ডায়াল করে কয়েকবার কেটেও দিলো। সে আসার পর থেকে মানুষটার সাথে কথা হয়নি। সেও তো একবার খবর নেয়নি! নয়নার বুঝি অভিমান হয় না! পরক্ষনেই নয়নার মনে পড়লো, তূর্যের তো এখন নাইট শিফট চলছে।হয়তো মানুষটা ঘুমাচ্ছে! শুধু শুধু ফোন করে ডিস্টার্ব করা কী ঠিক হবে? মুঠোফোন রেখে দিলো নয়না। বিকালে না হয় ফোন করে নিবে সে?
এদিকে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুঠোফোন চেক করছে তূর্য। নয়নার একটি কলের আশার ঘুম হচ্ছে না তার। অথচ মেয়েটার কোনো চিন্তাই নাই সে হয়তো এতক্ষণ বিয়ে বাড়িতে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে।
সন্ধ্যা লগ্নে নয়না ব্যতীত সবাই তৈরি হয়ে নিলো। নয়নার অস্বস্তি হচ্ছে এতো মানুষের ভীড়ে যেতে। মিছিল কোথায় থেকে দৌড়ে আসলো, হাতে করে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো মেয়েটা। নয়না এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো, তার মনোযোগ মিছিলের দিকে শপিং ব্যাগে কী আছে দেখার ইচ্ছে নেই। মিছিলকে পাশে বসিয়ে বলল,” কুকুরের দৌড়ানো খেয়েছিস নাকি? এভাবে হাপাচ্ছিস কেনো?”
নয়না খেয়াল করলো, মিছিল খুব সুন্দর সবুজ রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। সবুজ রংটা বেশ মানিয়েছে মিছিলের গায়ে। আমরা সাধারণত যারা গাঢ় রঙগুলো এভয়েড করি তারা হঠাৎ সেই রঙের পোশাক পরলে ফুটে ওঠে। মিছিলের সবসময় সবুজ রং অপছন্দ। আজ পরার পর সবুজ পরী লাগছে। মিছিল শপিং ব্যাগ নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” বাঘের খপ্পরে পড়েছিলাম। এটা ধর, পরে তৈরি হয়ে নে। আমি মায়ের কাছ থেকে গহনা নিয়ে আসছি। একসাথে সাজবো।”
যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নয়নাকে একা ফেলে দৌড়ে চলে গেলো মিছিল। নয়নার প্রত্ত্যুত্তরের অপেক্ষা করলো না মেয়েটা।কী ধুরন্ধর মেয়ে! নয়না একবার হাতের কাছে পেলে উত্তম মাধ্যম দিবে।
শপিং ব্যাগ খুলে সুন্দর সবুজ রঙের আনারকলি দেখতে পেলো নয়না। সবুজ রঙের সাথে লাল ওড়নার কম্বিনেশন দারুণ লাগলো তার কাছে। সময় অপচয় না করে নয়না জামা পরে নিলো। মিছিল কাউকে বকতে বকতে ঘরে প্রবেশ করলো। তার হাতে গহনার বক্স। নয়নাকে দেখামাত্রই গহনার বক্স বিছানায় রেখে এসে জড়িয়ে ধরলো। ময়নার গালে চুমু খেয়ে বলল,” আমার নয়ন চাঁদটাকে দারুণ লাগছে। রঙটা তোর শরীরে খুব মানিয়েছে। আয় তোকে গহনা পরিয়ে দেই।”
নয়না নাকচ করলো। সে তাদের গহনা কেন পরবে? মিছিলের চোখ রাঙানো দেখে নয়না চুপটি করে বসে রইলো। সিম্পল একটা গহনার সেট নয়নাকে পরিয়ে দিলো মিছিল। তাতেই অপরূপা লাগছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কাজল এনে নয়নার চোখে পরিয়ে দিলো মিছিল। এবার যেন মেয়েটার রূপের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। নয়নাকে বসিয়ে মিছিলও তৈরি হয়ে নিলো। একসাথে দুই বান্ধবী ঘর থেকে বের হতেই মিছিলের মায়ের সামনে পড়লো। ভদ্রমহিলা নয়নার এরূপ আগে কখন দেখেনি। আঁজলা ভরে এক হাত রেখে বলল,” মাশাআল্লাহ, আমার মেয়েটাকে তো অল্প সাজেই অপরূপা লাগছে।”
নয়না লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে রাখলো। মিছিলের মা হেসে চলে গেলো। স্টেজ রেখে পুরো ছাদ ডেকোরেশন করা হয়েছে লাল নীল রং কাগজ ও শতকের মতো আয়না দিয়ে। নয়না হা করে সবটা দেখছিল। এতোকিছুর মধ্যে বেচারি মনে মনে তূর্যকে খুব মিস করছে। কিছুক্ষণ আগে সে মনে সাহস সঞ্চয় করে তূর্যকে ফোন করেছিল, লজ্জায় লাল নীল হয়ে তূর্যের স্বর শোনার অপেক্ষা করছিল, কিন্তু আফসোস! নয়নার মনের বাসনা পূরণ হলো না। তূর্যের ফোন বন্ধ ছিলো। নয়নার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। বর্তমানে নয়না ঘুরে ঘুরে ছাঁদের ডেকোরেশন দেখছে। মিছিল ছাদে আসতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নয়না একাকীই ঘুরছে। ফটোসেশানের জন্য একটা স্থান তৈরি করা হয়েছে। যেখানে দাঁড়ালে দশটি আয়নার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায়। নয়না সেখানে দাড়িয়ে ছিল। আচমকা সে পিছনে জলপাই রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত তূর্যেকে দেখতে পেলো। এক মিনিট দুই মিনিট কতক্ষণ সময় ধরে সে তাকিয়ে ছিল হিসাব নাই। তূর্যও তার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনের ভুল ভেবে নয়না দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় তাকালো। এবারও সে তূর্যকে দেখতে পেলো। নয়না বুঝতে পারলো, তূর্য তার কল্পনায় নয় বাস্তবে দাড়িয়ে আছে। মস্তিষ্কে বিষয়টা গেঁথে যেতেই নয়না চট করে তূর্যের দিকে ফিরে তাকালো। এদিকে তূর্য নয়নাকে দেখে অন্য এক পৃথিবীতে চলে গেলো। সাজগোজহীন নয়নাক যতোটা স্নিগ্ধ লাগে সাজগোজ করা নয়নাকে ততোটা অপরূপা লাগছে। লজ্জায় নয়না মাথা নত করে রাখলো। তূর্য মুঠোফোন বের করে এই অবস্থাতেই তার এবং নয়নার কিছু ছবি তুলে নিলো। নয়নার কাছাকাছি এসে মাতাল সুরে বলল,” তুমি সবুজ পাতার বুকে সেই পদ্মফুল, যার রূপের আগুনে ঝলসে যাচ্ছে আমার বুক!”
নয়না চোখ তুলে তূর্যের দিকে তাকালো। কাজলদিঘী চোখে তূর্য মুহূর্তেই ডুবে গেলো, বিড়বিড় করে বলল,” এই কাজলদিঘী মেয়েটাই তাবরেজ তূর্যের অস্তিত্ব জুড়ে আছে।”
নয়না স্পষ্ট শুনতে পেলো। কিছুটা অভিমান হলো তূর্যের প্রতি, সে অকপট সুরে বলল,” আসলেন কেনো?”
তূর্য হাসিমুখে জবাব দিলো,” তবে কী চলে যাবো!”
” বলছি কী?”
” কি বলতে চাও!”
” ফোন বন্ধ ছিলো যে?”
” সারাদিন খোঁজ নিয়েছো?”
” আপনিও তো নিলেন না।”
” আমি আর তুমি কী এক?”
” ছেলেরা কী সব পারে? মেয়েদের কোনো অধিকার নাই?”
” তা বলিনি! বাদ দাও, কাছে এসো কথা আছে।”
” দূর থেকেই বলুন, কাছে আসলে পাপ হবে।”
” বড্ড কথা বলো, কার কাছে শিখেছো? মিছিল কী পড়িয়ে পড়িয়ে নিয়ে এসেছে?”
নয়না মিছে অভিমান করে চলে যাওয়ার ভান ধরে বলল,” বোবা নই, কথা জানি। ঝগড়া ডাবল পারি।”
” বিয়ের পর করো।”
নয়না থেমে গেলো। বিয়ের পর বলবে এর অর্থ কী? তূর্যের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিলে সে বলল,” বিয়ে করবে আমায়, নয়ন?”
নয়না প্রত্ত্যুত্তর করলো না। আবার দাড়ানো থেকেও নড়লো না। তা দেখে তূর্য এগিয়ে এসে বলল,” চলে যেতে হবে, হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এবার বিদায় দাও,নয়ন!”
নয়নার বলতে ইচ্ছে করছে, “যাবেন না তূর্য!” কিন্তু সে বলতে পারলো না। গলায় কী যেন আটকে আছে। তূর্যকে এগিয়ে দেয়ার বাহানায় সম্মুখে হাঁটা শুরু করলো।
এদিকে মিছিল তূর্যকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এগিয়ে এসে বলল,” সারাদিন আমাকে জ্বালিয়ে প্রেমময়ীর সাথে কথা বলেই চলে যাচ্ছেন? এটা মানবো না।”
” আজ সারাদিন তুমি আমার খুব উপকার করেছো। এখন বলো কী চাও!”
মিছিলের হাতে মেহেদি ছিল সে ভেবে উত্তর দিলো, ” হাত বাড়িয়ে দিন, বলছি।”
তূর্য হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলো। মিছিল সুন্দর করে সেখানে টি এবং এন ইংরেজি অক্ষরে লেখে লাভসেটের মধ্যে আবদ্ধ করে দিয়ে বলল,” আজীবন আমার জানটার মুখে এভাবেই হাসি ফুটিয়ে রাখবেন, ভাইয়া! এটা আপনার এই ছোট বোনের আবদার!”
তূর্য মুচকি হেসে অন্য হাতে মিছিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” যেদিন থেকে তার দুঃখগুলো মুছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছি সেদিন থেকেই তাকে নিজের করে নিয়েছি।”
মিছিল ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। কেউ ডাক দেয়ায় তূর্যকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
মিছিলদের বাড়ির গেইটের কাছাকাছি আসতেই নয়না থেমে যায়। তার পিছনে তূর্য, ছাদ থেকে নামতে দেরী করেছে। নয়নার কাছাকাছি এসে তূর্য কঠিন এক আবদার জুড়ে বসলো,” একবার তোমার হাতটা ধরতে দিবে, নয়ন?”
নয়না কী করবে বুঝতে পারছে না। নয়না দাড়িয়ে রইলো। নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ, তূর্য এটা ভেবে মুচকি হেসে নয়নার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে বলল,” এই হাত কখনোই ছাড়বো না। সাবধানে থেকো, নয়ন!”
তূর্য চলে গেলো। রেখে গেলো থরথর করে কাঁপতে থসকা নয়নাকে। তূর্য যেই হাত ধরেছিল সেই হাত চোখের সাৃনে মেলে ধরে নয়না। তূর্যের হাতে আঁকা মেহেদির ছাপ তার হাতে লেগে আছে। নয়না আশ্চর্য হয়ে তা দেখে বলল,” মানুষটা ইচ্ছে করেই এই কাজ করলো!”
(চলবে)…
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
[১৫০০ শব্দ সংখ্যা লেখে নিজের বোকামির জন্য ডিলিট হয়ে যাওয়ার মতো কষ্ট আর কিছুই নেই। গতকাল ভোররাতে কপি করতে গিয়ে ডিলিট করে ফেলেছিলাম। আজ পুনরায় লেখে পোস্ট করলাম। সম্ভব হলে সন্ধ্যয় আরেক পর্ব দিব। ভুল ত্রুটি হলে ধরিয়ে দিবেন। আমি পরবর্তীতে সংশোধন করে নিব। ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।]