#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫৩
১৪৫.
ইমারজেন্সিতে তন্নীকে নেওয়া হয়েছে।অপারেশন রুম থেকে তন্নীর চিতকার ভেসে আসছে।দিহান সাহেব অন্তরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
এসব কি করে হলো?অন্তর চুপ থাকায় দিহান সাহেব ছেলের গালে ঠাসস করে থাপ্পড় লাগিয়ে বসেন।জেনিফার এগিয়ে আসতে নিলেই চোখ রাঙিয়ে ইশারায় সরে দাড়াতে বলেন।
কি হলো জবাব দিচ্ছো না কেনো?যার দুই দিন পরে বাচ্চা হওয়ার কথা ছিল।আজ তার এই অবস্থা কে করলো?তোমার মা,আর আমি দরকারি কাজে বাহিরে গিয়েছিলাম।কিন্তু তুমি বাড়িতে থাকা অবস্থায় মেয়েটার সাথে এসব হলো কি করে?অন্তর চুপ করে থেকো না।জবাব দাও।আমি না হয় আমার পছন্দের মেয়েকেই তোমার ঘরের ঘরণী করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তাতে তোমার আপত্তি ছিল মেনে নিয়েছি।নিজের পচ্ছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেও সুখে রাখতে পারলে না?তাহলে সারাজীবন কি করবে তুমি?এতদিন ভাবতাম ছেলেটা আর যাই হোক।ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে রাখতে জানে।সেই ধারণা তুমি আজ পাল্টে দিলে।তুমি একজন সঠিক মানুষ হওনি।তুমি তোমার মায়ের মতোই নির্দয় এবং কুৎসিত মনের মানুষ হয়েছো।যার মনে ভালোবাসা তোও দূরের কথা।সামান্য মনুষ্যত্বটুকু নেই।তোমার এই মায়ের মন পেতে আমাকে দিন রাত পরিশ্রম করতে হয়েছে।কারণ তার মুখে একটাই শব্দ ছিল।আর সেটা হলো টাকা।সে টাকা ছাড়া কিছু বুঝতে চাইতো না।তাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতাম ব’লেই সব সময় তার আবদার,বায়না মিটিয়ে এসেছি।তবুও মন গলেনি।ভেবেছিলাম একটা সন্তান গর্ভে আসলে নারী পূর্ণ হয়।মা হওয়ার মাঝে তার পরিবর্তন আসবে।সে-ও একই কাজ করে।তোমার মতোই এর্বোশন সিদ্ধান্ত নেয়।এবং তোমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়নি।কিন্তু আমি যখন জানতে পারি।তখন তার হাতে পায়ে ধরে অনেক কেঁদেছি।সে যেন আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি না করে।তার এই সন্তানের কোনো দায়িত্ব নিতে হবেনা।সব আমি নিজ হাতে করব।সে মেনেছিল।তার বিনিময়ে জার্মান শহরে একটা ফ্ল্যাট করে দিতে হবে।যেটার মালিক সে থাকবে।তখন আমিও টাকা উর্পাজনের ধান্দায় থাকতাম।কত রাত নিঘুম কে*টেছে তা একমাত্ত আমি এবং আমার আল্লাহ ভালো জানে।
তার শর্ত মতাবেগ পালন করেছি।বিনিময়ে সে আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে।এরপর তার কোনো দায়িত্ব সে পালন করেনি।সে নিজের পার্টি আর বন্ধুদের সাথে মেতে ছিল।এই যে তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।জিজ্ঞেস কর তাকে।যখন তোমার বয়স দেড় বছর।তুমি ফ্লোরে বসার চেষ্টা কর।গড়িয়ে খেলা কর।আমি ছিলাম তোমার বাবা।তোমার ছোট বেলার খেলার সাথী।আমাকে বাবা শব্দ বলার চেষ্টা,আমাকে আলতো হাতে আদর করে খিলখিল করে হাসি দিয়ে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখা।এসব দেখতে দেখতে তার মাঝে মায়া কাজ করে।মমতা জেগে ওঠে।তোমার প্রতি তার টান দেখেই আমি ওপর ওই আসমানে যে বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে দুই চোখের পানি ফেলেছি।সময় চলতে চলতে তুমি বাবাকে একজন কঠোর পুরুষ হিসেবে দেখে এসেছো।তোমার দুনিয়ায় তখন তোমার মা’ই সব।কিন্তু আজ সেই একই জিনিস তুমি পুনরাবৃত্তি করে ছাড়লে।লোভ তোমাদের সব কিছু শেষ করছে।তোমাদের চাহিদা মতো সব
পেতে পেতে লোভ বেড়ে গেছে।যত পা-ও ততই চাও।তোমাদের চাওয়া শেষ নেই।একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো।ভালো ছেলে এবং ভালো স্বামী তুমি কখনোই হতে পারো নিই।ভালো বাবা হবে কি না।তাতেও সন্দেহ রয়েছে।আর তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তোমার সম্পত্তি আমি সব তোমার সন্তানের নামে করে দিবো।তাও তোমাকে এক কানা করি দিব না।যে সম্পর্কে মূল্য বুঝতে পারে না।তাকে আর বুঝাতেও চাই না।দিহান সাহেব কথা শেষ হতেই বেবি কান্না ভেসে আসে।দিহান সাহেব আলহামদুলিল্লাহ বলে এগিয়ে যান অপারেশন রুমে দরজা সামনে।ডাক্তার বেবিকে তোয়ালে করে নিয়ে আসেন।দিহান সাহেবের কোলে দিয়ে বলেন।
ছেলে হয়েছে।দিহান সাহেব নাতির মুখে চুমু দিয়ে বলেন,
-;আলহামদুলিল্লাহ।আমার অন্ধকার রাজ্যের আসল রাজা এসেছে।এবার আমার কোনো চিন্তা নাই।দাদু ভাই তুমি কেমন আছো?ছোট্ট নাদুসনুদুস বাবুটা গোল গোল চোখে চেয়ে আছে।তার দুই চোখের ভ্রু দ্বয়ের সামনে অল্প কুঁচকে,কেমন ডেবডেব করে তাকিয়ে।ভাবছে।সে কই আসলো?মায়ের পেটের ভিতর ভালো ছিল।এমন অদ্ভুত জায়গায় বের করে আনার মানে কি?
নার্স বেবি নিয়ে যাওয়ার সময় বললো,
মা এবং বেবি দুইজনই সুস্থ আছে।
১৪৬.
অর্পন,পুতুলকে ডাক্তার কাছে নিয়ে এসেছে।
ডাক্তার পুতুলকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কাগজে লিখতে থাকেন।কিছু সময় পরীক্ষা নিরীক্ষার পর পুতুলকে তার জায়গায় বসতে বলেন।
মিষ্টার অর্পণ।আমি আপনার স্ত্রী’র সমস্যা বুঝতে কিছু টেস্ট করেছি।রির্পোট আসলেই বুঝতে পারব।এবং আপনাকে জানানো হবে।
জি।ডক্টর।ধন্যবাদ।আবার কবে আসতে হবে?
দুইদিন পর আসলেই ভালো হয়।আমার আপনার ওয়াইফের রির্পোট নিয়ে বাকি ডাক্তার সাথে একটা আলোচনা করব।তাই দুইদিন পর আসবেন।
ওকে।
পুতুলকে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই একটা পরিচিত কল আসতেই রিসিভ করে।
আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?
শেষ পর্যন্ত আমার ভয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে পারি জমালি।কিন্তু পালিয়ে কতদূর। ওখানে পৌঁছাতে আমার সময় লাগবে না।
অর্পন নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
ওকে আই এম ওয়েটিং।তাড়াতাড়ি আসলে খুশি হব।বাংলাদেশে বাপের জন্য থাকতে পারলাম না।বউ নিয়ে হানিমুন করতে ঠিক পাঠিয়ে দিয়েছে।সেখানে মামা যদি নিজে থেকে ফোন দিয়ে আসার জন্য এতটা কৌতুহল দেখায় তাহলে আসতেই পার।আমি আরো ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি ঢাকায় ব্যাক করব।ইনফেক্ট দুইদিন পরই আমরা ব্যাক করছি।তুমি এখানে আসতে আসতে আমি দেশের মাটিতে থাকব।সো গুড বায়।অর্পন ফোন কেটে চিন্তায় পরে গেলো।তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরতে হবে।পুতুলকে এখানে দূর দেশে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।পুতুলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে যাব।
চাচী এত রাতের বেলা নারকেল কুড়াও কেন?
আর বলিস না।তোর চাচার রাতের বেলা সেমাই খাওয়ার নেশা উঠছে।এত রাতে আমার শান্তি নাই।তাই করতাছি।
ওহ।তা চাচি সামনে তোও রোজা।তুমি আর চাচা কয়টা রোজা রাখবা।
দেখি আল্লাহ যদি তৌফিক দেন।তাইলে সবগুলো রাখার ইচ্ছা আছে।রিফাত তুই বাড়িত যাইস না।বস। সেমাই খাইয়া যাইস।
আইচ্ছা।
দুইদিন পর।মাহে রমজানের চাঁদ উঠেছে।আকাশের চাঁদ দেখে মিলন,সাজু লাফিয়ে উঠে।
ওই আম্মা আকাশে চাঁদ উঠেছে।আজ রাতে ভাত খাইয়া কাল থেকে রোজা শুরু।
রেনু রাতের বেলা হারিকেনের সাহায্যে রান্না শেষ করতে ব্যাস্ত।ভোরে আবার উঠতে হবে।এখনো এশার নামাজটুকুও পড়তেই পারেনি।গরমের জন্য কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা।
ভোর রাতের জন্য দুই মুইখা মাটির চুলায় রান্না বসিয়েছে।ভাত,তেলাপিয়া মাছ ভুনা আর ডাল গনো করে রান্না করছে।তাতে লাল দুইটা গাছ থেকে পাকাঁ টমেটো আরো আগেই পেরে নিয়েছিল।টমেটো টুকরোগুলো তাতে ছেড়ে দিয়েছে।হালকা ঝাল করতে কতগুলো কাঁচা মরিচ ফালি করে ছড়িয়ে দিল।তার একটু পড়ে ধনেপাতা কুচি ছেড়ে নেড়ে নামিয়ে নিয়েছে।সবশেষে দুধ গরম করে নিলো।তিনজনের শেষ পাতে দুধ মাখা ভাত খাবে।তা ওহ আবার বেশি করে চিনি দিয়ে।এটা ছাড়া তাদের চলে না।
রান্না শেষ করে রেনু এশারের নামাজ পড়ে নিলো।মেয়েটার কথা মনে পড়ছে।কি খাচ্ছে? কি করছে?কে জানে?একটু কথা বলতে পারলে শান্তি লাগতো।এই প্রথম আমাদের ছাড়া একা একা রোজা পালন করছে।যদিও জামাই আছে।তারপরেও মনটা মানে না।কথা বলার জন্য মনটা আনচান করে।দেখি উনি আসুক একটু কথা বলার একটা ব্যাবস্থা করা যায় কি না?
পুতুলের এই প্রথম রোজা তা-ও আবার দুর দেশে হয়েছে।ফজরের নামাজ পড়ে পুতুল বেলকনিতে বসেই বাহিরে পরিবেশ দেখতে থাকে।এমন সময় ভেতর থেকে সুন্দর কোরআন তিলাওয়াত ভেসে আসছে।পুতুল রুমে প্রবেশ করতে দেখে তার স্বামী মসজিদ থেকে ফিরেছে।আর এত সুন্দর করে কোরআন তিলাওয়াত সেই করছে।প্রতিদিন ভাইয়েদেরটা শুনেই অভস্ত্য।নিজে এমন করে তিলাওয়াত করতে পারেনা ব’লে আফসোস লাগে।আজ স্বামীর কন্ঠে কোরআন তিলাওয়াত তার কাছে মধুর লাগছে।পুতুল চুপচাপ স্বামীর পাশে বসে।তার ডান কাঁধে মাথা রাখল।অর্পন,একপলক বউকে দেখে আবার কোরআন তিলাওয়াতেই ব্যাস্ত রইল।
অর্পন দুই পাড়া পরে শেষ করতেই দেখে পুতুল ঘুমিয়ে গেছে।পুতুলকে ঠিক করে বিছানা ঘুম পাড়িয়ে মাথা হালকা ফু দিয়ে দিল।
চলবে…..