#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৩||
১০৯।
রাগান্বিত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে আহি। আহিকে এর আগে কখনোই এতোটা রোষাগ্নি মেজাজে দেখে নি আফিফ। সে আহির হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল,
“কি করতে যাচ্ছো তুমি?”
আহি ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
“কেন আটকাচ্ছো আমাকে? কাকে বাঁচাতে চাইছো? ওই ফেরাউনকে?”
“তোমাকে বাঁচাতে এসেছি আমি।”
“আমার জন্য এতো ভাবতে হবে না তোমার।”
“আহি, আন্টি আমাকে কল দিয়েছিলেন। আন্টির সাথে কথা বলে আমি উজ্জ্বলকে কল দিয়েছি। তারপর জানলাম তুমি এদিকে এসেছো। শুনো আহি, তুমি হুট করে এমন ডিসিশন নিয়ে তোমার জীবনটা এলোমেলো করে দিও না।”
আহি করুণ দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তাজওয়ার রাদের উপর কেন গুলি চালালো, জানো?”
আফিফ চুপ করে রইলো। আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“কারণ রাদ আমাকে ভালোবাসে। দেখেছো, আমি একটা অভিশপ্ত মেয়ে। আর কতোবার প্রমাণিত হবে, আমিই সবার পথের কাঁটা? আমার জন্য লিনাশার বাবা মারা গিয়েছিল। আমার জন্য পদ্মের সাথে এতো বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে, আর এখন রাদ!”
আফিফ আহির হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“পদ্মের সাথে যা হয়েছে, তার জন্য তুমি নিজেকে দায়ী করছো?”
“আমার জন্যই তো হয়েছে সব।”
“মোটেও না। তোমার জন্য পদ্মের কিছুই হয় নি। ও তো নিজের কাজের শাস্তি পেয়েছে।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ বলল,
“তুমি পদ্মকে যতোটা ভালোবাসো, মেয়েটা ঠিক সেভাবে তোমাকে ভালোবাসে না, আহি।”
“কি বলছো তুমি?”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উজ্জ্বলের গাড়ি সেখানে এসে পৌঁছালো। উজ্জ্বলকে দেখে আফিফ থেমে গেলো। এদিকে উজ্জ্বল গাড়ি থেকে নেমে আহির দিকে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে। এতো সহজে তুমি এমন একটা ডিসিশন নিয়ে নিলে? পুলিশ তাজওয়ারকে খুঁজছে। তার উপর ও এখন একটা খুন করেছে।”
কথাটি বলেই উজ্জ্বল থমকে গেলো। আহি মলিন মুখে বলল,
“খুন! রাদ বেঁচে আছে। মা বলেছে, ও হাসপাতালে ভর্তি।”
উজ্জ্বল আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, খুন করার চেষ্টা করেছে, ওটাই বোঝাতে চেয়েছি।”
আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই আহি তড়িৎ গতিতে তা মুছে ফেললো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“রাদ নেই, এটা আমি মানতেই পারবো না। আর তাজওয়ারকে আমি আর জীবিত দেখতে চাই না। আমি ওকে নিজের হাতে শেষ করে দেবো।”
“তুমি জানো তাজওয়ার খান এই মুহূর্তে কোথায়?”
“হ্যাঁ, এই মুহূর্তে তাজওয়ারের আপনজন তো একজনই আছে। লাবণি মেহেরা। তাজওয়ার এরেস্ট হওয়ার পরই ওর বড় ভাই সরওয়ার খান, নিজের ওয়াইফ আর মাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছে। কারণ সে নিজেও এমন ক্যারেক্টারের লোক। এরপর এখনো তারা দেশে ফিরে নি। আর তাজওয়ারের মতো লোকের কোনো বন্ধু হয় না। সজিব আর জিলান তাজওয়ারকে জেল থেকে বের করার কোনো চেষ্টায় করবে না। করবে শুধু একজনই। লাবণি মেহেরা। কারণ তার আর কোনো পথই খোলা নেই। বাবা উনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। এখন উনার তো তাজওয়ার খানই একমাত্র ভরসা।”
“সব বুঝলাম, কিন্তু লাবণি মেহেরার তো কোনো ক্ষমতা নেই। সব ক্ষমতা তোমার বাবার ছিল। ক্ষমতা ছাড়া তাজওয়ারকে জেল থেকে বের করাটা অসম্ভব।”
আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“তাজওয়ারকে যেই কারাগারে রাখা হয়েছে, ওখানের দায়িত্বরত কারারক্ষীদের মধ্যে যে প্রধান তাকে আমি চিনি। মঈনুল বাগ। লোকটার ক্যারেক্টর সম্পর্কে আমার ভালোই ধারণা আছে। লোকটা বাবার এমপ্লয়ির ভাই। অনেক বার অফিসে এসেছিল। নোংরা দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকাতো। আর লাবণি মেহেরা এমন লোকেদের ভালোই হ্যান্ডেল করতে পারেন। উনার ক্যারেক্টারের সাথে মঈনুল একদম ফিট বসে।”
উজ্জ্বল বলল, “এটা তোমার ধারণাও হতে পারে।”
“আপনি কি ভাবছেন, তাজওয়ার এই মুহূর্তে লাবণির সাথে থাকবে না?”
“যদি থাকে, তাহলে তো আমরা তাকে এরেস্ট করাতে পারবো৷”
“এরেস্ট? আবার পালানোর সুযোগ দিয়ে দেবো? নো ওয়ে। আই উইল কিল হিম।”
এবার আফিফ বলল,
“ওকে ফাইন। কিন্তু তাজওয়ারকে মেরে তুমি আইন যদি নিজের হাতে তুলে নাও, তোমারই তো শাস্তি হবে। তাজওয়ারকে এমন ভাবে মারতে হবে, যাতে ওর মৃত্যুর জন্য তোমাকে দায়ী করা না যায়।”
আহি আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“লাবণি মেহেরা। উনাকে তো ফাঁসানো যাবে। এক তীরে দু’জনই মরলো।”
উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“লাবণি মেহেরা তাজওয়ারকে ছাড়ানোর পর তাজওয়ারকে খুন করবে এটা ভাবা যায়? এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে?”
“অবশ্যই করবে। কারণ প্ল্যানটাই আমাদের ওরকম হবে।”
আহি তার পরিকল্পনাটা উজ্জ্বল আর আফিফকে শোনালো। আহির পরিকল্পনা শুনে উজ্জ্বল বলল,
“আমার একদিন সময় নিতে হবে।”
আফিফ উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি তাহলে সাক্ষী জোগাড় করো। আমরা কল রেকর্ডটা বের করবো।”
আফিফ এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বাবা কি তোমাকে এই কাজে সাহায্য করবেন?”
আহি বলল,
“লাবণির বিরুদ্ধে বাবা যে-কোনো কিছুই করবেন। তবে আমাকে এক্ষুণি গিয়েই বাবার সাথে কথা বলতে হবে। আর বাবার একটা ফোন কলেই কাজ হয়ে যাবে। আমি এতো বড় কোনো দায়িত্ব তো দিচ্ছি না বাবাকে।”
(***)
মোজাম্মেল চাচা গেট খুলে আহিকে দেখে অবাক হলেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“ছোট মা, তুমি এইখানে? কোনো সমস্যা হইছে?”
আহি বলল,
“বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
মোজাম্মেল চাচা উপরের তলায় এক নজর তাকিয়ে বললেন,
“স্যার কেমন যেন হইয়া গেছে, মা। দেহো তো কেমন আছে। কথাটথাও কয় না।”
আহি বাসায় ঢুকলো। অনেক দিন পর আবার এই বাড়িতে পা রেখেছে আহি। অস্থির লাগছে তার। নিচে বড় একটা ডায়নিং। এই ডায়নিংয়ে বসে বাবার সাথে সকালের নাস্তা সেরে স্কুলে যেতো সে। ডায়নিংয়ের একপাশে রান্নাঘর, অন্যপাশে বসার ঘর। আহির কেন যেন মনে হলো রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মা আর মুনিয়া খালার ব্যস্ততা। আর বসার ঘরের কার্পেটে বসে চুনি হিন্দি সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে সেখান থেকে চুনির হাততালির শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয় চুনির মন মতো কিছু একটা ঘটছে। কোণার ঘরটি চুনি আর মুনিয়া খালার। ও ঘরটি থেকে ভেসে আসছে মা-মেয়ের খুঁনসুঁটি। আহি সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠলো। দু’তলার ডানপাশে আহির ঘর। মাঝখানে বিশাল বড় একটা লাইব্রেরি আর বামপাশে বাবা-মায়ের রুম। আহির মনে হলো সেই রুমে হয়তো এখনো কিশোরী আহি একটা ক্যানভাসে তার প্রিয় অলকানন্দের ছবি আঁকছে। লাইব্রেরীতে হয়তো মা বসে বই পড়ছে। আর বাবা হয়তো রুমে বসে টিভি দেখছে, হয়তো-বা অফিসের কাজ করছে। এই মুহূর্তে সবটাই আহির কল্পনা। বর্তমান শুধু পুরো ঘরের নিস্তব্ধতা। আহি নিরবতা কাটিয়ে মৃদু পদ শব্দ তুলে বাবার ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো। কটকট শব্দ হতেই ভেতর থেকে হালকা শব্দ করলেন রিজওয়ান কবির। আহি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে মদের বোতল। আর রিজওয়ান কবির রকিং চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। আহিকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়াতেই ভারসাম্য হারিয়ে রকিং চেয়ারে বসে পড়লেন। আহি রিজওয়ান কবিরের পাশে এসে বসলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“কি অবস্থা করে রেখেছো নিজের?”
রিজওয়ান কবির আহির দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন। আহি বলল,
“বাবা, কি করছো এসব? তুমি এখন মন্ত্রী। এখন তো অন্তত এসব ছাড়ো।”
রিজওয়ান কবির ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,
“এখন খুব দেরী হয়ে গেছে। এখন এসবই আমার সংসার, আমার সঙ্গী।”
আহি নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো রিজওয়ান কবিরের দিকে। রিজওয়ান কবির আহিকে নীরব দেখে বললেন,
“তুমি এখানে কেন এসেছো?”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই মুহূর্তে তোমার সাহায্যের খুব প্রয়োজন।”
আহি রিজওয়ান কবিরকে সবটা খুলে বললো। সব শুনে রিজওয়ান কবির বললেন,
“লাবণি যে তাজওয়ারকে ছাড়ানোর জন্য মঈনুলের সাথে রাত কাটিয়েছে, এটা আমি অবিশ্বাস করবো না। কারণ মঈনুলের হাবভাবে বোঝা যায়, সে আমার চেয়ে বেশি লাবণিকে চেনে। যতোবার দেখেছি, ততোবারই আমাকে বুঝিয়েছে, সে লাবণিকে কতোটা চেনে। আমিই বুঝি নি তখন। মোহগ্রস্ত ছিলাম। এখন তো সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেদিন তাজওয়ারকে যে লাবণিই সিডিউস করতে চেয়েছিল, সেটাও এখন বুঝতে পারছি।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিজওয়ান কবির আবার বললেন,
“আমি আমার কাছের মানুষদেরই ভুল বুঝেছি। অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি।”
আহি বাবার হাত ধরে বলল, “সময় তো এখনো আছে।”
রিজওয়ান কবির কথা কাটিয়ে বললেন,
“আমাকে কি করতে হবে বলো।”
আহি লাবণির কল রেকর্ডগুলো বের করার জন্য রিজওয়ান কবিরের সাহায্য চাইলো। কারণ কোনো সিম কোম্পানিই সাধারণ কারো হাতে কল রেকর্ড দেবে না। আর পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে এই বিষয়ে যুক্ত করলে আহির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে যাবে।
এদিকে রিজওয়ান কবির লাবণির সিমের কল রেকর্ডগুলো বের করতে আহিকে সাহায্য করলেন। এরপর সালমা ফাওজিয়ার বাসায় আফিফ, আহি, উজ্জ্বল, সালমা ফাওজিয়া, লিনাশা, নায়ীব, লাবীব এবং পুষ্প একসাথে গোল হয়ে বসে এক একটা রেকর্ড শুনতে লাগলো। কয়েক ঘন্টার পরিশ্রমের পর কাঙ্খিত রেকর্ডটি পাওয়া গেলো। আহি রেকর্ডটি নিয়ে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে পেন ড্রাইভে সেইভ করে নিলো। কাজ শেষে উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কীভাবে জানলে লাবণি মেহেরা ফোনে এমন কিছু বলেছিল?”
আহি মুচকি হেসে বলল,
“ভাগ্যক্রমে সেদিন আমি তার আশেপাশেই ছিলাম।আমার কানে এসেছিল তার প্রতিটা কথা। হয়তো আল্লাহ আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন, আজকের এই দিনটার জন্য।”
১১০।
কালো হেলমেট পরে আহির সামনে এসে দাঁড়ালো আফিফ। আহি আপাদমস্তক আফিফকে দেখে নিয়ে বলল,
“সেদিন তাজওয়ারের উপর তুমিই আক্রমণ করেছিলে?”
আফিফ হেলমেটের উপরিভাগ উন্মুক্ত করে বলল, “হ্যাঁ।”
“কেন?”
আফিফ মোটর সাইকেলে উঠতে উঠতে বলল,
“একটু মেরে আসতে ইচ্ছে হলো। এসিস্ট্যান্ট বানিয়ে প্রচুর অত্যাচার করেছে। তাই সব শোধ তুলে নিতে গিয়েছি।”
আহি আফিফের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে বলল,
“তোমার এতো সাহস কখন হলো?”
“তোমার কি আমাকে ভীতু মনে হয়?”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সাহসীও মনে হয় নি।”
আফিফ মোটর সাইকেল জোরে টান দিতেই আহি আফিফের সাথে ধাক্কা খেলো। আহি শক্ত করে আফিফের শার্ট খামচে ধরলো। আফিফ বলল,
“সরি, ঠিকভাবে বসো।”
আহি আফিফকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। এরপর আফিফ মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে এলো আহির দেখানো ঠিকানায়।
শহরের বাইরে একটা দু’তলা বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল থামালো আফিফ। আহি মোটর সাইকেল থেকে নেমেই গেটের কাছে চলে এলো। গেট খোলা। আহি গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। আফিফও পিছু পিছু এলো।
পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর মতো শ্যাওলা জমে আছে দেয়ালে। আহি সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে নিচ তলা থেকে। আহির গা গুলিয়ে এলো। মুখ চেপে পেছনে ঘুরতেই আফিফের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো সে।
আফিফ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো?”
আহি বলল, “বিদঘুটে গন্ধ!”
আফিফ পকেট থেকে তার রুমাল বের করে আহিকে দিয়ে বলল,
“নাক বেঁধে ফেলো।”
আহি রুমালটি নিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “চলো।”
আহি রুমালটি নাকের কাছে আনতেই থেমে গেলো। আফিফের শরীরের গন্ধ লেগে আছে এই রুমালে। আহির সাহস হলো না আর। সে আবার আফিফকে রুমালটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“লাগবে না আমার।”
আহি রুমালটি দিয়েই দ্রুত পায়ে উপরে উঠে গেলো। আফিফ রুমালটির দিকে এক নজর তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
দু’তলায় এসে কড়া নাড়লো আহি। পীপহোল বাইরে থেকে চেপে ধরে রেখেছে সে। যাতে ভেতর থেকে কেউ না দেখে। অনেকক্ষণ পর ওপাশ থেকে ভেসে এলো লাবণির কন্ঠ, “কে? কে?”
আহি কোনো উত্তর দিলো না। দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। আহি ধীরে ধীরে গ্লাভসটা পরে হাতে একটা পিস্তল নিলো। লাবণি দরজা খুলতেই আহি ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পিস্তল ঠেকালো লাবণির কপালে। লাবণি চেঁচিয়ে উঠলো। আফিফ ভেতরে ঢুকলো। দু’রুম পর একটা ঘরের দরজা খুলতেই আহির কথা সত্য প্রমাণিত হলো। তাজওয়ার, সজিব আর জিলান একটা রুমে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর নেশাদ্রব্য পান করছে। তাজওয়ার আফিফকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুই এখানে?”
তাজওয়ারের কন্ঠ শুনে আহি দরজাটা বন্ধ করে লাবণির গালে কষে একটা চড় বসিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। এদিকে তাজওয়ার আফিফকে মারার জন্য এগিয়ে আসতে যাবে তখনই আহি রুমে ঢুকলো। আহিকে দেখে তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“সুইটহার্ট, তুমি এখানে?”
আহি তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সশব্দে তার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আই উইল কিল ইউ।”
তাজওয়ার গালে হাত বোলাতে বোলাতে আহির দিকে তাকালো। ভীষণ রেগে গেছে সে। আহির গালে হাত চেপে ধরতে যাবে তার আগেই আফিফ তাজওয়ারের হাত ধরে বলল,
“এই সাহস নেই তোর।”
তাজওয়ার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোর এতো সাহস!”
আফিফ বাঁকা হেসে বলল,
“আমার এখন অনেক সাহস।”
তাজওয়ার হাসলো। আহি তাজওয়ারের কপালে পিস্তল ঠেকাতেই তাজওয়ারের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ পিস্তলটির দিকে তাকিয়ে আরো দ্বিগুন জোরে হাসতে লাগলো। তাজওয়ারের দেখাদেখি সজিব আর জিলানও হাসতে লাগলো। তাজওয়ার হাসি থামিয়ে সজিব আর জিলানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখ, দেখ কে এসেছে! আফিফ রাফাত এসেছে। কে এই আফিফ?”
সজিব বলল,
“বোনের ভিডিও দেখে মায়ের আঁচলে লুকিয়ে যাওয়া অবোধ বালক।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে সজিবের দিকে তাকালো। এদিকে আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো। তাজওয়ার তা দেখে বলল,
“এতো রাগ কেন, আফিফ? তোর বোনের সাথে কি করেছি মনে নেই?”
আহি আফিফের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে আফিফের বোনের?”
“কেন সুইটহার্ট? তুমি জানো না কি হয়েছে? তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে শহীদ হয়েছে আফিফের বোন। যেমন রাদ হয়েছে কিছুদিন আগে।”
আহি অবাক হয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ এক দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”
তাজওয়ার বলল,
“সুইটহার্ট, তুমি জানো আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি। সেই শুরু থেকে, যখন থেকে তোমাকে দেখেছি। আর তুমি কি করছিলে? এই ক্ষ্যাতটার পেছনে সময় নষ্ট করছিলে। আমি একবার ওয়ার্ন করেছিলাম, বলেছিলাম আহি শুধু আমার। কিন্তু এই বোকা তো বুঝে নি। তার বড় আপা বারণ করার পরও সে তোমার চিঠিগুলো নিতো। তোমাকে আরো সুযোগ দিতো। এখন সোজা আঙ্গুলে যেহেতু ঘি উঠে নি, আঙ্গুল তো বাঁকাতে হবে। ব্যস, আমি আমার জিনিস কেঁড়ে নিয়েছি, বিনিময়ে আফিফ তার বোনকে হারিয়েছে।”
আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজওয়ার আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আফিফ সেদিন বাধ্য হয়ে তোমার দেওয়া সেই কার্ডটি ফেলে গিয়েছিল, সুইটহার্ট। কারণ সে এই কাজ না করলে, আমি তার ছোট বোনের সাথেও একই কাজ করতাম।”
আহির চোখ ভারী হয়ে এলো অশ্রুতে। সে আফিফের দিকে তাকালো। কিন্তু আফিফ তার দিকে তাকালো না। তাজওয়ার এবার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি যদি চুপচাপ আমার হয়ে যেতে, আজ এতোগুলো মানুষের জীবন এলোমেলো হতো না।”
আহি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। সজোরে ধাক্কা দিলো তাজওয়ারকে। হঠাৎ ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে তাজওয়ার মেঝেতে পড়ে গেলো। আহি তাজওয়ারের বুকের উপর পা রেখে বলল,
“সেদিন কি বলেছিলে তুমি, গল্পটার সমাপ্তি তুমিই করবে, তাই না? হ্যাঁ, তাজওয়ার খান, আমার এলোমেলো জীবনের গল্পটার সমাপ্তি তুমিই করবে। তোমার মৃত্যুতে শেষ হবে এই গল্প।”
আহি পিস্তলের চারটা গুলি তাজওয়ারের বুকে আর কপালে চালিয়ে দিলো, ঠিক যেভাবে রাদের উপর গুলি চালিয়েছিল তাজওয়ার। গুলির শব্দ হতেই সজিব আর জিলান ঘাবড়ে গেলো। লাবণি মেহেরাও একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আফিফ সজিবের কলার চেপে ধরলো। দেয়ালে ঠেকালো তাকে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে সজিবের মাথাটা দেয়ালের সাথে বার-বার ঠুকাতে লাগলো। জিলান আফিফকে ঝেঁকে ধরেছে। আফিফ হাতের কনুই দিয়ে ইচ্ছেমতো মারলো জিলানকেও। সজিবের মাথা ফেঁটে দেয়াল রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো। লাবণি চেঁচিয়ে পালাতে যাবে তার আগেই আহি লাবণির হাত ধরে বলল,
“তুমি কোথায় পালাচ্ছো? তোমার পালানোর দিন শেষ।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই উজ্জ্বল কিছু পুলিশ সদস্য নিয়ে ঢুকলো সেই বাড়িতে। আহত অবস্থায় জিলান আর সজিবকে উদ্ধার করলো তারা৷ তাজওয়ারের মৃত শরীরটা বের করে মরদেহ পরিবহনে উঠানো হলো। আর লাবণিকে গ্রেফতার করা হলো। লাবণি চেঁচিয়ে বলল,
“আমি কিছুই করি নি। তাজওয়ারকে আহি মেরেছে।”
একজন সিনিয়র পুলিশ আহির হাত থেকে পিস্তলটি নিয়ে বলল,
“মিস লাবণি মেহেরা, এটা আপনারই লাইসেন্স গান। আর তাজওয়ারকে আপনিই খুন করেছেন। আর এর চাক্ষুষ সাক্ষী আমরা। আপনি তাজওয়ারকে মারার জন্য মঈনুল বাগের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এরপর তাজওয়ারকে এখানে এনেছেন, যাতে তাকে খুন করতে পারেন। কারণ সে আর তার বন্ধুরা আপনার সাথে প্রতারণা করেছে। আপনাকে ব্যবহার করেছে। আপনার কল রেকর্ড আছে আমাদের কাছে, যেখানে স্পষ্ট আছে, আপনি তাজওয়ারকে মারার থ্রেট দিচ্ছিলেন। যেখানে আপনি বলেছিলেন, তাজওয়ার যদি আপনাকে বিয়ে না করে, আপনি তাকে খুন করবেন। এমনকি তার বন্ধুদেরও আপনি খুন করার হুমকি দিয়েছেন, কারণ তারা আপনার সু্যোগ নিয়েছিল।”
লাবণি অবাক কন্ঠে বলল,
“এসব আমি তাজওয়ারকে এমনিই বলেছি। আমার কোনো ক্ষমতা নেই তাজওয়ারকে মারার। তাজওয়ারকে আহি মেরেছে। মিথ্যে সাক্ষী কেন দিচ্ছেন, ইন্সপেক্টর?”
সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাটি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। উজ্জ্বল লাবণির দিকে তাকিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাটিকে বলল,
“ধন্যবাদ বন্ধু।”
লাবণি অবাক হয়ে বলল, “মিথ্যে সব।”
উজ্জ্বল হেসে বলল,
“কেন মিস লাবণি মেহেরা, পাওয়ার কি সব একা তোমার? আমরা কি ঘাস কাটার জন্য জন্ম নিয়েছি? ক্ষমতা অর্জন করে নিতে হয়। তুমি তো অন্যের ঘাড়ে চড়ে, নিজের সম্মান বিক্রি করে ক্ষমতা কিনে নিয়েছো। আর আমরা সম্মানের সাথে নিজেদের মগজ খাটিয়ে ক্ষমতা অর্জন করেছি।”
এরপর লাবণিকে ধরে নিয়ে গেলো পুলিশ। শেষ হলো এক ফেরাউনের গল্প।
তাজওয়ার খান প্রেমিকা লাবণি মেহেরার গুলিতে মারা গেলো। শিরোনাম জুড়ে শুধু এই একটাই খবর। আহত সজিবের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বেঁচে ফিরলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এদিকে জিলান সুস্থ, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা থাকায় সে ছাড়া পেলো না। খবরে এই শিরোনামটি দেখেই টিভি বন্ধ করলো পদ্ম। ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। অস্থির লাগছে তার। অন্যদিকে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে আফিফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। আফিফ এসবের উত্তর দেবে না জানে। তাই আহি জিজ্ঞেস করলো না। শুধু কয়েক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। এই জল জিজ্ঞেস করছে,
“তবে কি তুমিও আমায় ভালোবাসতে, এআর? আমার মতো করে আমাকে অনুভব করতে?”
চলবে-