#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব০৪
“নীল রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কত জানিনা।তবে আমার সামনে থাকা, কারেন্টের খুঁটির মতো লম্বা নীলের দৈর্ঘ্য জানি। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি।”
কথাটা শেষ করেই জারার চোখে মুখে বিশ্ব জয় করা হাসি ফোটে।জারার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছে,নীলকে জব্দ করার মতো একখানা কথা সে বলেছে। প্রশ্নের সঠিক উত্তর পারেনি তাতে কি হয়েছে।নীলকে বাঁকা উত্তর দিয়েই জারার শান্তি লাগছে।এতেই যেনো জারার মনেপ্রাণে শান্তির বন্যা বয়ে যায়। আহ্!কি শান্তি লাগছে এবার।এমন মুখাবয়ব করে জারা সোফার হেডে মাথাটা আস্তে করে রাখে। চোখ বন্ধ করে মনেমনে হাসে। গোলগাল ফর্সা মুখে চমৎকার হাসি নিয়ে নিরুপমা বেগম জারাকে সাপোর্ট দিয়ে বললেন,,
“একদম ঠিক বলেছিস জারা।তোর উত্তর টা আমার বেশ মনে ধরেছে।নিজের পড়াশোনার কোনো খোঁজ নেই।সেদিকে নজর নেই।নিজের লেখাপড়ার ব্যাপারে উদাসীন।বাতাসে গা ভাসিয়ে চলে।আর অন্যদের প্রাইভেট, কোচিং নিয়ে মশকরা করে।নিজে তো সারাদিন বাইক নিয়ে সারা শহর টইটই করে মাড়িয়ে বেড়ায়।”
কিয়ৎক্ষন থেমে নীলকে উদ্দেশ্য করে মোটা চোখে তাকিয়ে কন্ঠে খানিকটা রা’গ মিশিয়ে বলতে থাকেন,,”বাড়িতে তো আরো একটা ছেলে আছে।তাকে দেখেও তো কিছু শিখতে পারিস নীল।বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু আচরণ-ও তো শিখতে পারিস।এই যে জারিফকে দেখ কত সুন্দর নিপুণতার সহিত সব কিছু করে। ছেলেটা সবদিকে নজর দিয়ে চলে।ভাবী হাই প্রেশারের মানুষ।প্রায় সময় অসুস্থ থাকে।আবার জারার প্রাইভেট কোচিং আছে।নাতাশাকে নিয়ে মিসের কাছে পড়াতে দিয়ে ওদের অপেক্ষা করার অবস্থা নেই। জারিফ নিজেই নাতাশাকে নিয়ে গিয়েছে।জারিফকে বলা কওয়া লাগেনি।আবার নাতাশাকে চেকআপ করাতে একাই নিয়ে যায়।জারিফ নিজ থেকে দেখেশুনে চমৎকার করে সবকিছু সামলে নেয়।আর তুই? কানের পাশে হাজারবার ঘ্যানঘ্যান করেও তোকে দিয়ে সুতোটিও নাড়ানো যায়না।তুই তাহলে কি পারিস?পারিস তো শুধু টাকা উড়িয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে,আর শপিং করতে।”
শুরু হয়েছে কানের পাশে ভাঙা টেপ রেকর্ডার। উফ্!অসয্য।ধ্যাত একই প্যাচাল সকাল -বিকেল শুনতে আর ভালো লাগে না।কে বলেছিলো ব্রো কে সবদিক দিয়ে এতো পার্ফেক্ট হতে। কথাগুলো মনেমনে আওড়ালো নীল।তবে মুখে সেটা প্রকাশ করেনি।এসব কিছু ভেবে মনেমনেই মাথা ঝাড়া দিলো।নীল না পারছে এখানে থাকতে।আর না পারছে মায়ের কথা উপেক্ষা করে উঠে যেতে।নীল মায়ের কাছে বাদড় ছেলে হতে রাজি আছে।তবে বেয়াদবি করতে রাজি না।মা যে তার ভালোর জন্যই সব সময় এরকমটা বলে তা নীল ভালোই জানে বোঝে। কিন্তু কি করার অলসতা,আর ফোরটুয়েন্টি স্বভাব যে নীলের শিরায় শিরায়।তাই তো পড়াশোনায় মনোযোগহীন। অন্যদিকে আড্ডাতে বাজিমাত তার। উফ্!জারার উপর তরতর করে নীলের রাগের পারদ বাড়তে থাকে।এই শাকচুন্নীর জন্য এখন মায়ের কাছে তার বকুনি শুনতে হচ্ছে।নীল এটা ভেবে জারার দিকে কটমট চোখে তাকায়।নীলের রাগের তোয়াক্কা না করে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে জারা উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর জারা মুখ ভেংচি কে’টে নিজের রুমের দিকে যেতে থাকে।নীলের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শব্দ করে বাজা নীলের ফোনের রিংটোন জারার কানে আসে।জারা কানটা আরেকটু সজাগ করে শিয়র হয়।তারপর ভিতরে গিয়ে নীলের রুমের বেডের উপর ফোনটা দেখে। জারা হাত দিয়ে ফোনটা ধরার আগেই বেজে বেজে কল কে’টে যায়।ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে জারা আওড়ালো,ভাইয়ার কাছে দিয়ে আসি।এমন সময় আবার রিং বেজে উঠে।ফোনের স্ক্রিনে ইংরেজী ফ্রন্টে এলিনা নামটা জ্বলজ্বল করছে।আবার কল কে’টে যেতে পারে এইভেবে জারা রুম থেকে বের হয়ে কয়েক পা এগিয়ে যেতে যেতেই কলটা রিসিভ করে।রিসিভ করার সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি স্টাইলি চিকন গলার স্বর ভেসে আসলো।কথাটা শোনার সাথে সাথে জারার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।
“নীল বেব।তুমি কোথায়?আমি এতবার তোমায় কল করছি।তুমি রিসিভ করছো না যে।”
জারা চোখ বড়বড় করে কথাগুলো হজম করার চেষ্টা করে।ফোনের এপাশ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে।ফোনের ওপাশের মানবী ফের মলিন স্বরে শুধালো,,”কিহলো বেবি।কিছু বলছো না কেনো?”
এবার আর জারা চুপ থাকতে পারলো না।হালকা কেশে গলাটা ঝেড়ে নেয়।ভাব নিয়ে চিকন স্বরে যাকে এককথায় বলে কোকিল কন্ঠে বলে উঠলো,,”সরি।আমি আপনার বেবি টেবি নই।ওয়েট,কলে থাকুন।আপনার বেবির কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”
ফোনের ওপাশের মানবী উৎসুকভাবে জানার জন্য প্রশ্ন করে,,”হু আর ইউ?”
জারা সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গটগট করে ড্রয়িংরুমে চলে আসে।নীলের সামনে দাঁড়িয়ে একহাত কোমড়ে দিয়ে অন্যহাতের ফোনটা নীলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। কন্ঠে শীতলতা নিয়ে বলে,,”এইযে ভাইয়া।ফোন রুমে রেখে এখানে আয়েশ করে শুয়ে স্পোর্টস দেখছিস।ওদিকে তোর মাম্মি তো ফোনের উপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে।এবার ফোনটা ধর আর কথা বল।আর তোর মাম্মিকে চিন্তামুক্ত কর।”
জারার কথা নীলের মাথার উপর দিয়ে যায়।নীল জারার কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না।নীল শোয়া থেকে উঠে বসে।একহাতে কুশনটা কোলের উপর নেয়। অতঃপর একবার জারার দিকে দৃষ্টি দেয়।আবার সামনের সোফায় বসে থাকা নিজের মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে।নীল যেনো কোনো সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত।নীল জারার হাতে নিজের ফোনটা দেখে মনেমনে আওড়ালো, শাকচুন্নী টা আবার কি ফন্দি এঁটেছে। আম্মু তো আমার সামনেই আছে।কার কথা বলছে।নীল একটু নড়েচড়ে বসে।গম্ভীর মুখাবয়ব করে জারার পানে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,,
“আমার জানামতে,আমার কোনো স্টেপ মাদার নেই।ঝেড়ে কাশ।কার কথা বলছিস? ক্লিয়ার করে বল।”
জারার স্বভাব সুলভ বাঁকা জবাব এলো,,”তুই নিজে দেখ। তোর কয়টা মাম্মি আছে তা তুই-ই ভালো জানিস।”
জারার কথাগুলো শুনে নিরুপমা বেগম ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে চেয়ে আছেন। এহেন কথা শুনে কপালের ভাঁজগুলো প্রগাঢ় হয়।নীল জারার হাত থেকে ফোনটা নিতে যাবে,সেই মূহূর্তে মায়ের গম্ভীর মুখপানে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলে নেয়।তারপর কিছু ভেবেই অবাক হয়। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ টেনে এনে বলে,,
“আম্মু তোমার বর আমাদেরকে না জানিয়ে কোনো অঘটন ঘটায়নি তো। সারাক্ষণ চোর ডাকাতের পিছনে ছুটতে গিয়ে।কোনো মহিলার খপ্পরে পড়েনি তো।”
কথাটা শেষ করে নিজের ফোনে নজর পড়তেই নীল সাইলেন্ট হয়ে যায়।নীলের মুখের কথা হাওয়া হয়ে যায়।নীলের দুই ঠোঁট আর একসাথে হয়নি।বড়সড় একটা হা হয়ে রয়েছে।যেখানে একটা গোলগাল বড়সড় লাড্ডু অনায়াসেই ঢুকে যাবে।জারা নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে শয়তানির হাসি হাসে।ছেলের কথাশুনে নিরুপমা বেগম চোখ পাকিয়ে তাকায়। মায়ের রাগি দৃষ্টি নজরে পড়তেই নীলের মুখটা চুপসে যায়।লহমায় একদম আমসত্ব হয়ে যায় নীলের মুখটা।
নিরুপমা বেগম রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভরাট গলায় বলেন,,”দিনদিন তোর কথাবার্তা আর কাজ কর্ম দেখে আমি চরমভাবে হতাশ হয়ে যাচ্ছি।এতবড় ছেলে মুখে কোনো প্রকারের লাগাম নেই।নিজের বাপকে নিয়ে কেউ এমন মজা করে।দিনদিন তোর ইঁতুড়ে স্বভাব বেড়েই যাচ্ছে।আর এটা হয়েছে তোর বাপের জন্য।এক সন্তান বলে আদরে আদরে বাদড় হয়েছিস।”
নীল মোবাইলটা হাতে চেপে ধরে।স্যান্ডেলের ভিতর পা দিতে দিতে জারাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,
“শুনেছি পরিবারের ছোটো মেয়েরা শয়তানের হাড্ডি হয়।তাদেরকে দেখলে শয়তানও নাকি ভয় পায়।”
উঠে দাঁড়িয়ে জারার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিসিয়ে বললো,,”শাকচুন্নী তোকে লাড়াতে শয়তানও তো ভ’য় পাবে।”
জারা মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে জবাবে বললো,,”গুড,ভাইয়া। বুঝেছিস তবে লেইট করে।”
নীল নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,,আরেক পেত্নী কল দিয়েছে।”রুমে গিয়ে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে।
.
.
সুন্দর ঝলমলে একটা নতুন দিন।নাতাশার চেকআপ এর ডেট আজকে।জারিফ নিজেই ডক্টরের কাছে নাতাশাকে নিয়ে যায়। প্রায় দুইমাসের মতো হবে মেডিকেলের একজন শিশু ডক্টর নাতাশার ট্রিটমেন্ট করছে। প্রথমে যখন নাতাশার রোগটা ধরা পড়ে তখন পপুলারে এডমিট ছিলো।তারপর ওখান থেকে একজন ডক্টর খানের কথা বলেন।যে কিনা এই রোগের স্পেশালিস্ট।তারপর থেকে ডক্টর খানের কাছে আসে। মেডিকেলের পার্কিং লনে গাড়িটা পার্ক করে জারিফ।গাড়ি থেকে নেমে অপর পাশের ডোরটা খুলে।নাতাশার সিট বেল্ট খুলে নাতাশাকে নিচে দাঁড় করিয়ে মুখে মাস্ক পড়িয়ে দেয়। মাস্ক পড়ার পর নাতাশা বুক ভরে জোরে করে শ্বাস টেনে নেয়।জারিফ স্মিত হেসে মায়াভরা আদূরে গলায় বলে,,
“কোনো সমস্যা হচ্ছে সোনা। কষ্ট হচ্ছে কি?”
নাতাশা মুখটা উঁচু করে জারিফের দিকে তাকিয়ে দুদিকে ঘাড় নাড়িয়ে বলে,,”উঁহুম।একদম না।আমার তো খুব ভালো লাগছে।”
জারিফ গাড়ি থেকে সবুজ রঙের বড় মেডিকেল রেকর্ড ফাইলটা বের করতে থাকে।নাতাশা সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করা অনেক লোকজন কপাল কুঁচকে দেখতে থাকে। হঠাৎ নাতাশার কিছু মনে হতেই ভ্রু কুঁচকে জারিফের এক আঙ্গুল ধরে ঝাঁকিয়ে মিষ্টি স্বরে ফের বলে,,”মামা।আজকে ভালো আন্টির সাথে দেখা হবে তো।সেদিন তো ভালো আন্টির সাথে দেখা হয়নি।সেইজন্য আমার ভীষণ ভীষণ মন খা’রাপ হয়েছিলো।”
শেষের কথা মুখটা ভারী করে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে নাতাশা।নাতাশার কথা শ্রবণ হতেই জারিফের মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে সেই মায়াবী নিষ্পাপ মুখটা। মায়াবী ফেসের অধিকারীনীর গোলাপী পাতলা ওষ্ঠ দ্বয় নেড়ে ধীরে ধীরে বলা শান্ত গলার কথা।সবযেনো ছবি হয়ে জারিফের দুচোখে ভেসে উঠলো। শুভ্র বেলি ফুলের পাপড়ির ন্যায় স্নিগ্ধ মুখটা বারংবার জারিফের দুনয়নে ভাসতে লাগলো।এখানে যে কয়বার চেকআপের জন্য আসা হয়েছে সেই কয়বারই সেই মানবীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। লাস্ট চেকআপেই দেখা হয়নি। প্রথমদিন ভুলবশত জারিফ নাতাশার ফাইলটা ফেলে চলে গিয়েছিল।সেই মানবীর মাধ্যমেই জারিফ ফাইলটা ফিরে পেয়েছিলো।ফাইলের উপর পেশেন্টের নাম আর মোবাইল নম্বর থাকায়। ইন্টার্নের মেয়েটা সেটা হাতে পেয়ে,ফেরত দেওয়ার জন্য উক্ত নম্বরে কল দেয়।ফোন রিসিভ করে ধীরে ধীরে বলা মেয়েলি সফট ভয়েজে নাতাশার ফাইলের কথা বলে।পরে বিকেলেই মেডিকেলে আসে জারিফ ফাইলটা নিতে।এসে মেয়েটার থেকে ফাইল নেয়।আর নাতাশার অসুখের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে।এরপর যে কয়বার দেখা হয়েছে মেয়েটার সাথে হালকা কথাবার্তা হয়েছে।সেটা অবশ্য নাতাশাকে নিয়েই। লাস্ট যেদিন এসেছিলো।সেদিন জারিফের নজরজোড়া বারবার মায়াময় স্নিগ্ধ মুখটার খোঁজ করছিলো।সেদিন নাতাশাকে নিয়ে ফেরার সময় জারিফের হৃদয় বারংবার বলছিলো,আজকে কিছু একটা অপূর্ণতা রয়ে গেলো।তবে জারিফের মস্তিষ্ক সেসব মানতে নারাজ ছিলো।তাইতো মনের ভাবনাকে পাত্তা দেয়নি। একয়দিনে আর বিশেষ করে মনেও পড়েনি মেয়েটির কথা।এখন নাতাশার মুখে মেয়েটির কথা শুনে জারিফের মেয়েটির কথা স্মরণ হয়।আর মনটাও যেনো তার দর্শন একনজরের জন্য হলেও পেতে চাইছে।জারিফ নাতাশার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে শুধালো,,
“ভালো আন্টিকে তোমার পছন্দ। ভালো আন্টির কথা তোমার মনেই আছে যে দেখছি।”
নাতাশা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,,”হ্যা পছন্দ তো। একটু আধটু নয়। অনেক অনেক পছন্দ।”
শেষের কথা দুই হাত মেলে ধরে বলে নাতাশা। শিশুবিভাগের গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা।গেইটের দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য কাঠের টুলের উপর বসেই একরোখা ভাবে বললো,,”এখন যাওয়া যাবেনা।ভিজিটর এলাউ হবে না।এখন রাউন্ড চলছে।একটার পর আসুন।”
জারিফ কথার পাল্টা কোনো কিছুই বললো না।শুধু হাতে থাকা ফাইলটা আনসার সদস্যের সামনে ধরলো। বয়স্ক লোকটার বুঝতে বাকি থাকলো না,যে এনারা ভিজিটর নয়।এনারা পেশেন্ট।তাইতো লোহার গ্রিল দেওয়া দরজাটা খুলে দিলো।জারিফ নাতাশার হাত ধরে এগিয়ে গেলো। ডক্টর খানের কক্ষের দরজা খোলাই ছিলো।একসাইডে দেওয়ালে টানানো,,
ডা:আলিফ শাহরিয়ার খাঁন
এমসিপিএস(শিশু)
এমডি,পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি (*****)
কনসালটেন্ট শিশু বিভাগ।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকাতেই সোজাসুজি টাওয়েল দিয়ে রাখা চেয়ারটা ফাঁকা দেখলো।তারমানে ডক্টর খাঁন নেই।বোধহয় রাউন্ডে আছে।জারিফ নাতাশাকে নিয়ে শিশু নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
পরনে মিষ্টি কালারের থ্রি পিস।উপরে সাদা এপ্রোন।
গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো।হাতে একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের ফাইল। নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের থেকে বের হয়ে তাবাসসুম তাসনিম আসছে।এমন সময় সামনা-সামনি জারিফের সাথে দেখা হয়। তাসনিম দাঁড়িয়ে পড়ে।জারিফও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। তাসনিম প্রথমে সালাম দেয়।তারপর নাতাশার দিকে ঝুঁকে একহাতে নাতাশার নরম তুলতুলে গালে চিকন শ্যাম বর্ণের হাত ছোঁয়ায়।আদূর মিশ্রিত স্বরে বলে,,
“কিউটি পাই কেমন আছো? কি খবর?আবার দেখা হয়ে গেলো।”
নাতাশার চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে।নাতাশা ঝকঝকে তকতকে দাঁত বের করে হাসি মুখে বলে,,”আমি ভালো আছি।ভালো আন্টি তুমি কেমন আছো?”
“ভালো সোনা।তোমার সাথে দেখা হয়ে আমার ভালোর পরিমাণ টা যে আরো বেড়ে গেলো।”
নাতাশার সাথে কথাশেষ করে মাথা উঁচু করে জারিফের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখে চোখ পড়ে।জারিফ দৃষ্টিটা সরিয়ে নেয়।তারপর আমতা আমতা করে বলে,,”ই ইয়ে ডক্টর খাঁন কে ওনার রুমে দেখলাম না।উনি রাউন্ডে আছেন কি?”
মুখের উপর আসা এলোমেলো কিছু চুল একহাতে আলতোকরে কানের পাশে গুঁজে নেয়।তারপর মিষ্টি কন্ঠস্বরে বলে,,”নাহ্।আজকে স্যারের ক্লাস ছিলো তো।স্যার ক্লাস নিতে গিয়েছেন। ক্লাস শেষ করে এসে তারপর রাউন্ডে যাবে।”
হাতে থাকা রিচওয়াচের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে ফের কোমল গলায় বলে,,”উঁমম!এতক্ষণে ক্লাস হয়তো শেষ হয়ে গিয়েছে ।আপনি ওয়েট করুন।স্যার চলে আসবে এক্ষুনি।”
“থ্যাংকস।”
এরমধ্যে তাসনিমের নজর যায় নেভি ব্লু শার্টের উপর সাদা এপ্রোন পড়া লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী বেশ সুদর্শন মানবের উপর। ডক্টর খাঁন কে দেখিয়ে তাসনিম বলে উঠলো,,”ঐতো স্যার চলে এসেছেন।”
জারিফ ডক্টর খানের সাথে দেখা করে সালাম দেয়। ডক্টর খাঁন সালামের উত্তর দিয়ে নিজের কক্ষে যান।গিয়ে নিজ আসনে বসে দুইহাত টেবিলের উপর ভাঁজ করে রাখে। নির্বিকার ভঙ্গিতে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলে,,”প্লিজ,টেক আ সিট।”
জারিফ নাতাশাকে নিয়ে বসে। ডক্টর খাঁন নাতাশার ফাইলটা উপরে মোটা কাঁচ সেট করা টেবিলের উপর মেলে ধরে ভ্রু যুগল কুঁচকে চেক করতে থাকেন।তারপর আ্যলবুমিন টেস্টের রিপোর্ট দেখে জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”আ্যলবুমিন তো নিল আছে।এটা রুটিন চেক।আপাতত প্রবলেম নেই।ইউরিন হিট কেমন?বাসায় নিয়মিত ইউরিন হিট চেক করেন তো।”
জবাবে জারিফ বলে,,”ইউরিন হিট ক্লিয়ার আছে, আলহামদুলিল্লাহ।আর রেগুলারই করা হয়।”
জারিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মলিন মুখে শুধায়,,”আচ্ছা ডক্টর এটা একেবারে কিওর হবে না?”
ডক্টর খান টেবিলের উপর থাকা পেপার ওয়েট টা একহাতে নাড়তে নাড়তে বলে,,”দেখুন মিস্টার আয়মান জারিফ।আমি আপনাকে আগেও বলেছি।আবার বলছি, নেফ্রোটিক সিনড্রোম এমন একটা রোগ যা দীর্ঘ মেয়াদি।এটা পনের থেকে বিশ বছর পর্যন্ত বারবার হতে পারে।তবে এই রোগে আক্রান্ত নাইনটি পার্সেন্ট পেশেন্ট সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় সুস্থ হয়ে যায়।তাই বলছি এতো ভয়ের কিছু নেই।”
ডক্টর খাঁন নাতাশাকে দেখে। অতঃপর উনার রুমে থাকা পিওনকে ডেকে বলেন,,,”বাচ্চার বিপি মাপতে হবে। ইন্টার্ন এর কাউকে ডেকে দিন।”
এইসময় জারিফ বেশ ভদ্রভাবে বলে,,”ডক্টর আপনি তো মনেহয় এখানে কোথাও প্রাকটিস করেন না।”
গম্ভীর মোটা স্বরে সোজাসুজি বলে,,”নাহ্।আমি প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা চলে যাই। শনিবারে আবার ময়মনসিংহে আসি।ঢাকাতে আমার চেম্বার আছে। ঐখানে যেহেতু আমার বাসা।তাই ছুটির দিনগুলোতে ওখানে চেম্বারে বসি।আর এখানে তো মেডিকেলেই আছি।তাই আর এক্সর্টা করে চেম্বার দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।”
এরমধ্যে তাসনিম আসে।এসে ডক্টর খাঁন কে নম্র স্বরে সালাম দেয়। তাসনিমের একহাতের মুঠোয় সুন্দর করে স্টেথোস্কোপটা মুড়ানো। তাসনিম বিপি মেপে বলে,,”স্যার **বাই** ।”
ডক্টর খাঁন সেটা প্রেসক্রিপশনের সাইডে লিখে রাখে।তারপর জারিফের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে থাকে,,”পেডনোসলিন ইউস করার ফলে বিপি টা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি থাকে।আর এই পেশেন্টদের ইমিউনিটি একদম কম থাকে।সেটা অবশ্য পেডনোসলিন ইউস করার জন্য। তাই বলছি, কেয়ার নিবেন বাচ্চার।আর সব সময় এলার্জি,তেল চর্বি জাতীয় ফুড এভ্যয়েড করবেন।আর ইউরিন হিট ক্লিয়ার থাকলে আমরা ধীরে ধীরে পেডনোসলিনের পরিমাণ কমিয়ে দেবো।”
ডক্টর আরো কিছু কথা বলেন।সাথে ঔষধ লিখে দেন।আর তাসনিম কে উদ্দেশ্য করে বলেন,,”মিস তাবাসসুম তাসনিম আপনি ওনাকে সবটা ভালো করে বুঝিয়ে দিন।”
কথাটা শেষ করেই ডক্টর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।যাওয়ার সময় ফের বলে,,”আসি মিষ্টার আয়মান জারিফ।আমাকে এখন রাউন্ডে যেতে হবে।”
জারিফ অমায়িক হেসে এক শব্দে বলে,,”শিয়র।”
যাওয়ার সময় নাতাশার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে যায়।মেয়েটাকে দেখলেই কেমন জানি অদ্ভুত মায়া কাজ করে।একে তো মা হারা তার উপরে এতবড় একটা অসুখ।উফফ!সত্যি বিষয়টা বেদনাদায়ক।
তাসনিম জারিফকে সুন্দর করে সব কিছু বোঝাতে থাকে।যদিও জারিফ সবটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছে।একনজর প্রেসক্রিপশন দেখেই।তারপরেও মুখে সেটা ঘুনাক্ষরেও বললো না।মেয়েটার ধীরে ধীরে বলা কোমল স্বরের প্রতিটা কথা শ্রবণ করছে।জারিফের নজর যেনো আজ বেহায়া হতে চাইছে। বারংবার জারিফের দুইনয়ন চোরাচোখে মায়াবী মুখে নিবদ্ধ হচ্ছে।
অবশেষে তাসনিম এর থেকে বিদায় নিয়ে জারিফ নাতাশার হাত ধরে বাইরের দিকে যেতে থাকে।তাসনিম ওদের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।দুই হাত সাদা এপ্রোন এর পকেটে গুঁজে। হঠাৎ নাতাশা পিছন ফিরে একহাত উঁচু করে নাড়িয়ে বলে,,”বাই।ভালো আন্টি। উম্মাহ।”
তাসনিমও একহাত নাড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলে,,”বাই।কিউটি পাই।লাভিউ।”
জারিফ নাতাশাকে ফলো করে পিছনে তাকায়। তাসনিমের সাথে চোখাচোখি হয়।জারিফ স্মিত হাসে।বিনিময় তাসনিমও মিষ্টি করে হাসে।
.
.
ঘড়ির কাঁটা রাত আটটার ঘরে।ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে জারিফ।এমন সময় গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে নীল আসে।এসে জারিফের পাশে হাত পা ছড়িয়ে সটান হয়ে বসে পড়ে।মাথাটা সোফার হেডে রাখে।জারিফ একনজর নীলের দিকে শান্ত চাহনিতে চেয়ে পরক্ষণেই দৃষ্টি ফোনে নিবদ্ধ করে।নীল একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে।হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলতে থাকে,,”ব্রো।বাড়িতে তো তোর বিয়ের কথা চলছে। বড়মা বড় আব্বু কে এই নিয়ে কথা বলতে শুনলাম।”
জারিফ দৃষ্টি ফোনে রেখেই বাঁকা করে বলে,,”তোর তো খেয়ে কোনো কাজ – কর্ম নেই।ফোরটুয়েন্টি করা,এরওর কথা শুনে খবরদারি করা।”
কে বলেছে কাজ নেই।এসব করাই কি চার্টি খানিক কথা।কেউ চাইলেও কি সহজে খবরদারি কাজ করতে পারবে।উহুম!পারবে না।আর সেই কাজ কি-না নীল স্বইচ্ছায় করে বেড়ায়। খবরদারি কাজের জন্য কাউকে যদি নোবেল দেওয়া হতো।তাহলে নীল মনেহয় নোবেলটা আগে আ্যসিভ করতো,হুম।এসব ভেবে নীল মনেমনেই নিজেকে আস্বস্ত করে। অতঃপর কোনো কথা গায়ে না মেখে জারিফকে বলে উঠলো,,”ব্রো।আমি সিরিয়াসলি বলছি এবার।রিয়েলি।তোর বিয়ে নিয়ে কথা আমি শুনেছি।”
“এখন আপাতত আমি বিয়ে টিয়ে নিয়ে ভাবছি না। তাই এই টপিক বাদ থাক,কেমন?”
নীল কুশনটা কোলের উপর নিয়ে মুখটা ভার করে। ম্লান স্বরে বলে,,”তুই বিয়ে না করা অব্দি তো আমার পথ ক্লিয়ার হচ্ছে না। তাই বলছি নিজের জন্য না হলেও আমার জন্য অন্তত বিয়েটা করেনে ব্রো।”
নীলের কথা শুনে জারিফের কাঁশি উঠে যায়।জারিফ দুইবার কেশে নেয়।নিজেকে স্বাভাবিক করে।কি সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার অন্যজনের জন্য হলেও নাকি জারিফকে বিয়ে করতে হবে। উফ্! ভাবা যায়।এমন কথা কোনোকালে কেউ বলেছে? এটা ভাবতেই জারিফ অবাকের চরম সীমায় পৌছে যায়।জারিফ বিস্ফোরিত নয়নে নীলের দিকে তাকায়।গলার স্বর রুক্ষ করে বললো,,”এসব কি কথাবার্তা তোর নীল।আমাকে বিয়ে করতে হবে তাও তোর জন্য।মাথা খা’রাপ হয়েছে আমার। না-কি পা’গলা কুকুরে কামড়িয়েছে আমাকে।”
নীল একহাতে কপালে হালকা করে চাপড় দিয়ে হতাশ গলায় বলে,,”উফ্!কি জ্বালা। বললাম এক আর বুঝলি আরেক।বলছি যে,তুই বিয়ে করলে আমার পথ ক্লিয়ার হবে।বড় ভাইকে রেখে ছোট ভাই কিকরে বিয়ে করে।সেটা বলতে চেয়েছি।”
নীলের কথায় জারিফও খানিকটা বোকা সেজে যায়। উল্টো বোঝার জন্য।নীল সিরিয়াস মুখাবয়ব করে বেশ কৌতূহল নিয়ে জারিফকে শুধায়,,”আচ্ছা ব্রো এসব বাদ দে।তবে বলতো তোর কেমন মেয়ে পছন্দ।ঠিক কোন কোয়ালিটির মেয়ে তুই লাইক করিস।”
“ভেবে দেখেনি।তাই বলতে পারছি না।”
নীল ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,”ভেবে দেখতে হবে না।এখন ভেবে নিয়ে বল।যেমন বর্ণনা দিবি,ঠিক তেমনই মেয়ে খুঁজে বের করবো।সেই মেয়ে যেখানেই থাকুক না কেনো। উগান্ডা থাকলে উগান্ডা থেকেই ধরে বেঁধে আনবো,হুম।”
জারিফ নীলের দিকে তাকাতেই নীল থেমে যায়। দশ সেকেন্ড পরে ফের শুরু করে,,”তবে শুনেছি,যে যেরকম টা চায়।তার কপালে নাকি ঠিক উল্টো টা থাকে।জানিনা তোর সাথে আবার এরকমটা হবে নাতো।”
নীল বারবার প্রশ্ন করায় জারিফ কিছু সময় চোখ বন্ধ করে ভেবে নেয়। অতঃপর চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলতে থাকে,,”শ্যামবর্ণের কোমল স্বভাবের মেয়ে আমার পছন্দ। মায়াবী ফেস।যে ফেসের দিকে তাকালেই মনে হবে পবিত্র নিষ্পাপ।কোনো মেকির ছাপ থাকবে না।কথা বার্তায় যেমন নরম হবে।ঠিক তেমনি নরম মনের অধিকারী হবে।তার মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতার ছায়াও থাকবে না।উমম!এককথায় বলতে পারিস বেশি চঞ্চল মেয়ে আমার পছন্দ নয়।সাদা সিদে ঠান্ডা মেজাজের, কোমল মনের মেয়ে আমার পছন্দ। সর্বোপরি হাই পার্সোনালিটি সম্পন্ন একজন ভালো মনের মানুষ হতে হবে।তার অহংকার হবে তার পার্সোনালিটি।ইগো নয় প্লেস্যান্ট পার্সোনালিটি সম্পন্ন হতে হবে।”
কথাগুলো বলার সময় না চাইতেও আপনা-আপনি জারিফের দুচোখে আবছা আবছা তাসনিমের ফেস ভেসে আসছিলো।
চলবে…
(অনেকে প্রশ্ন করে কার সাথে কার হবে?এখনই কিকরে বলি 🥺শুধু বলছি প্লিজ ধৈর্য্য ধরে সাথে থাকুন।ঠিক সময় মতো সবটা জানতে পারবেন। দ্রুত রিচেইক দিয়েছি।তাই বানান ভুল থাকতে পারে।মানিয়ে নিয়েন।আর হ্যা, রেসপন্স করবেন প্লিজ।হ্যাপি রিডিং)