#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব০৬
বাসে উইন্ডোর পাশের সিটে কোনো মেয়েকে বসে থাকতে দেখে জারিফের ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়।কোনো মেয়ের পাশে বসতে হবে,এটা ভেবেই জারিফের অস্তিত্ববোধ আকাশসম হয়।জারিফ প্যান্টের পকেট হতে একহাতে টিকিটটা বের করে সিট নম্বর চেক করে। উফ্!সিট নম্বর ঠিকই আছে।এটাই জারিফের সিট।জারিফ সিটে বসতে খানিকটা ইতস্তত বোধ করে। আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে বাকি সিটগুলোতে নজর বুলায়। নাহ্,আর একটাও ফাঁকা সিট মিলছে না।এদিকে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে।জারিফ কোনো উপায় না পেয়ে নিজের সিটে বসে পড়ে। ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে থাকে।
জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি লিয়ার।নিজের পাশে করিডোরের সিটে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরেও নির্বিকার থাকে।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে বসা মানুষটাকে দেখার কোনো আগ্রহও কাজ করছে না নিজের মধ্যে।লিয়ার এখন শুধু একটাই টেনশন হচ্ছে।বাসায় গিয়ে কপালে প্রচন্ড দুঃখ আছে। আম্মুর বকুনি শুনতে হবে।এবার ব’কুনির সাথে চ’ড় থা”প্প”ড় না পড়ে।এটা ভাবতেই লিয়ার একহাত আপনাআপনিই ফর্সা গালে চলে যায়।লিয়া নজরজোড়া বড়বড় করে
বারকয়েক শুকনো ঢুক গিলে নেয়।লিয়ার চোখের সামনে ভাসছে,ঠা ‘স ঠা’স করে আম্মুর হাতের থা’প্প’ড়।হাতটা আলতোকরে গালে বুলাতে বুলাতে লিয়া মনেমনে আওড়ায়, ওহ্!নো।অনেকদিন বাদে আজকে নির্ঘাত লিয়া তোর টসটসে দুইগালে আম্মুর পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ পড়বে।এসব ভেবে লিয়ার ফর্সা মুখে অন্ধকার নেমে আসে।
কারন এইতো গাড়িতে উঠার আগে রাজিয়া সুলতানা ফোনে শাসিয়েছেন,কে বলেছিলো এভাবে জিদ করে যেতে। আবার জিদ করে একরোখা গো ধরে চলে আসতে।এখন যদি কোনো সমস্যা হয়।তাহলে লিয়ার কপালে শনি আছে।একদম রক্ষা থাকবে না।এতক্ষণের কঠোর মনটা ধীরে ধীরে নরম হতে থাকে।লিয়া ভাবে,মোটেও একরোখা গো ধরে এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি।কালকে মামার সাথে আসলেই ভালো হতো। উফ্!নানুভাই কতো করে বললো,মামীও বললো।সবার কথা না শুনে বড্ড ভুলই হলো।এখন একা একা এতটা পথ জার্নি করতে কেমন জানি আনইজি লাগছে।যতই মনকে শক্ত করতে বলছি,কোনো ভ’য় নেই। কিচ্ছু হবে না।ততই যেনো ভ’য় এর পাহাড় বাতাসের গতিতে মনে জেঁকে বসছে। উফ্!বাতাসের বললে ভুল হবে,আলোর গতিতে আসছে। ভ’য় আর টেনশন দুইটাই।এইজন্য মহাজ্ঞানীরা বলেছেন,,ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না।আমার হয়েছে সেই দশা।হুটহাট মনের ইচ্ছাকে প্রায়োরিটি দিয়ে কোনো কিছু করে ফেলি।পরে মাশুল দিতে হয়, টেনশন করতে করতে। আর নয়তো আম্মু আব্বুর ব’কুনি খেতে হয়।
জানালা দিয়ে হুহু করে শীতল বাতাস আসছে।জারিফ পাশে বসা মেয়েটার দিকে আড়চোখে একবার তাকায়।মনে হচ্ছে মেয়েটা একহাত বাইরে দিয়ে কি সুন্দর প্রকৃতি বিলাশ করছে।এদিকে শীতের দিনের ঠান্ডা বাতাস পাশে বসা ব্যক্তির ভালো নাও লাগতে পারে।সেদিকে তার কোনো হুঁশ নেই।জারিফের কপালের ভাঁজ প্রগাঢ় হয়।জারিফ ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবে,,এই হলো মেয়েদের ছেলেমানুষী।শীতে লোমকূপ শিহরিত হবে তবুও তাদের কোনো হেলদোল হবে না।জানালা দিয়ে হুহু করে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস আসছে।আর এ আছে প্রকৃতি বিলাশ করতে।জারিফের একবার ইচ্ছে করলো মেয়েটাকে ডেকে বলতে,উইন্ডোটা বন্ধ করুন। ঠান্ডা বাতাস আসছে তো। পরক্ষনে ইতস্তত বোধটা জেগে উঠতেই জারিফের বলার ইচ্ছাটাও ওখানেই দমে যায়।জারিফ সোজা হয়ে বসে ফোনে মুখ ডুবিয়ে থাকে।
শহরের পিচঢালা পথ ফেলে গাড়ি যখন হাইওয়ে দিয়ে যেতে লাগলো।শীতল বাতাসের প্রকোপ অনেকটাই বেড়ে গেলো।লিয়ার সমস্ত লোমকূপ শিহরিত হয়ে উঠল।লিয়ার পাতলা গোলাপী ওষ্ঠ মৃদু কম্পিত হলো।লিয়া একহাতে গায়ের উপর দেওয়া শালটা একটু ভালো করে জড়িয়ে নিলো।অবশেষে ঠান্ডা বাতাসের কাছে পরাজিত হয়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিয়া একহাতে উইন্ডোটা টেনে দিল।লিয়া সোজা হয়ে বসে।সময় কাটানোর জন্য হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ফোন আর ইয়ার ফোন বের করে।ইয়ার ফোনটা কানে গুজার সময় লিয়ার দৃষ্টি যায় পাশে বসা মানবের দিকে।যেকিনা ফোনে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। প্রায় আধা ঘন্টা হবে গাড়ি চলছে।এই সময়টা ধরে লিয়া খেয়াল করেছে।পাশের মানুষটা না লিয়াকে কোনো ডিস্টার্ব করেছে।আর না কথা বলার ট্রায় করেছে। এটা ভেবে লিয়ার খানিকটা কৌতুহল হলো একনজর পাশে বসা মানুষটাকে দেখতে।ইয়ারফোন কানে গুজতে গুজতে লিয়া আড়চোখে একপলক তাকায়।একপলক তাকাতেই লিয়ার পলক থমকে যায়।পাশে বসা সুদর্শন পুরুষটাকে দেখে লিয়া ঘনঘন পলক ঝাপটায়।অফ হোয়াইট টিশার্ট এর উপরে ব্ল্যাক জ্যাকেট।জ্যাকেটের চেইনটা খোলা।এ্যশ কালারের ডেনিম প্যান্ট।পায়ে ব্ল্যাক কেডস। আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় বসে ফোন স্ক্রল করছে।লিয়া অবাক চাহনিতে চেয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো,,
“আ আ আপনি।আপনি এখানে।আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো।আমার পাশে আপনি।অবশ্য সেদিনের পর এর আগে যে কয়বার আপনাকে দেখেছি সেটা স্বপ্নেই। এখন গাড়িতে বসে জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখছি নাতো।আই ক্যা’ন্ট বিলিভ মাই আইস।”
লিয়া এতক্ষণ এক্সাইটেড হয়ে গড়গড় করে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ফেলে।জারিফ মাথাটা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে উপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে শীতল চাহনিতে লিয়ার দিকে তাকায়।জারিফের শীতল চাহনিতে লিয়ার নজর পড়তেই লিয়া থমথমে মুখাবয়ব করে চুপ হয়ে যায়। লিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,এইরে এক্সাইটেড হয়ে একনাগাড়ে কতকি বলে ফেললাম।উনি কি ভাববে?লিয়া এক আঙ্গুল দিয়ে মাথা চুলকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে।লিয়া দৃষ্টি সরু করে কাঁপাকাঁপা গলায় বলতে থাকে,,
“নাহ্।ইয়ে মানে।সাইকোলজির ভাস্যমতে শুনেছি, কেউ যখন কাউকে নিয়ে ভাবে।অপর প্রান্তের মানুষটা তখন তাকে স্বপ্নে দেখতে পায়।আপনিও বোধহয় আমাকে নিয়ে ভেবেছিলেন।তাই হয়তো আমার স্বপ্নযোগে আপনাকে দেখতে পেয়েছিলাম।ঠিক বলেছিনা না?”
কথাটা শেষ করে লিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে।কি সুন্দর সুক্ষভাবে অন্যর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে।লিয়ার মনে খানিকটা প্রশান্তি বইতে থাকে।লিয়া মনেমনে আওড়ায়,যাক গে বাবা।আমার স্বপ্নে উনি এসেছেন।তারমানে দোষটা উনারই।এতে আমার দো’ষ নেই।
লিয়ার কথা শুনে জারিফ অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।এই মেয়ে নাকি জারিফকে স্বপ্নে দেখে। স্ট্রেইন্জ!আর এর কারন নাকি জারিফ নিজে।আমি আবার কখন?কবে?কোনকালে?এই মেয়েকে নিয়ে ভাবলাম। উফ্!মাথা ঠিক আছে তো এর।কি যাতা বলে চলছে।এসব কথা মনেমনে বললেও জারিফ মুখে কিছুই বললো না।জারিফ নির্বিকার থাকে।
জারিফের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে লিয়া কিছুটা হতাশ হয়।লিয়া আহত দৃষ্টিতে জারিফের দিকে তাকিয়ে ম্লান স্বরে ফের বলে,,”বাসায় ফিরছেন বোধহয়?”
জারিফ দৃষ্টি ফোনে রেখেই জবাবে বললো,,”হুম।ঢাকাতে কাজ ছিলো।কাজটা শেষ করে এখন ময়মনসিংহ ফিরছি।”
লিয়া ঠোঁট উল্টে ছোট করে বলে,,”ওহ্।”
কিয়ৎকাল থেমে লিয়া ফের বলে,,”আমি নানুবাসায় আসছিলাম।একাই ফিরছি।যাক ভালোই হলো কো-ইন্সিডেন্সলি হলেও আপনার সাথে দেখা হয়ে।”
“হুম।”
জারিফের এক শব্দের জবাব শুনে লিয়ার মেজাজটা খা’রাপ হতে থাকে।লিয়ার ভীষণ ভীষণ কান্না পাচ্ছে।লিয়ার এই এক দোষ। রা’গ হলে সাথে কান্নাও পায়।লিয়ার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, এনাবুল জান্নাত খাঁন লিয়া কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চাইছে।আর সে কিনা ইগনোর করছে।নিজের ওয়েট দেখাচ্ছে। ব্যস,আমিও আর কথা বলবো নাহ্,হু।লিয়া এসবভেবে নিজের সিটে গা এলিয়ে দেয়। ফোনে গান অন করে দেয়। চোখ বন্ধ করে গান শুনতে থাকে।মাঝে মাঝে চোখ মেলে চোরাচোখে জারিফকে পরখ করছে।
গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। ঘন্টা দুইয়েক হবে গাড়ি চলছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এরমধ্যে না জারিফ কিছু বলেছে।আর না লিয়া কোনো কথা বলার চেষ্টা করেছে।এমনিতে পিছনে বসার ফলে ঝাঁকুনিটা একটু বেশিই লাগছে।লিয়ার শরীরটা খা’রাপ করতে শুরু করছে।এরমধ্যে হঠাৎ করে গাড়ি ব্রেক চাপে। রাস্তায় আরো ছোটবড় অনেক গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে লোক মুখে শোনা গেলো। বাস আর ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।বাসের অনেক যাত্রী ইনজুর হয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পথ আটকে দিয়েছে।পুলিশ ইনভেস্টিগেশন হয়ে রাস্তা ক্লিয়ার হতে অনেক সময় লাগবে।এটা শুনতেই লিয়ার মাথায় আকাশ ভে”ঙ্গে পড়ে।টেনশনে লিয়ার হাতপা জমে আসছে। বাসের যাত্রীরা অনেকে নেমে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। উৎসুক জনতা আবার দূর্ঘটনা কবলিত স্থান সচোখে দেখতে যায়।অনেক সময় বসে থাকায় জারিফের নিজেরও বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না।তাই নিচে নেমে গিয়ে রাস্তার একপাশে দুইহাত পকেটে গুঁজে দাঁড়ায়।
লিয়ার নিজের উপর নিজেরই রাগের পারদ বাড়তে থাকে।আর একঘন্টার মধ্যে বাসায় পৌছে যাওয়ার সম্ভবনা ছিলো। সেখানে কিহলো? আম্মু তো আছেই।এবার আব্বু নিশ্চয় রক্ষে রাখবে না।নিজের খুশিমতো সব কিছু করা শেষ।পাকনামি করে আসার ফল এমন হবে।তা জানলে লিয়া ভুল করেও এভাবে আসতে চাইতো না।
অনেকক্ষণ বসে থাকায় লিয়ার কোমড় লেগে গিয়েছিল।তাই একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্য নিচে নেমে দাঁড়ায়।বাস থেকে নামতেই খানিকটা দূরে জারিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে রাস্তাটা। লিয়া একপা দু পা করে জারিফের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।হালকা কেশে এহেম এহেম। শব্দ করায়।জারিফ ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে তাকায়।লিয়া চিন্তিত মুখাবয়ব করে মৃদুস্বরে শুধালো,,
“গাড়ি কখন ছাড়বে?অনেক লেইট হবে কি?”
জারিফের স্পষ্ট উত্তর এলো,,”শিওর জানিনা।লোকমুখে শুনলাম,এক দুই ঘন্টার বেশিও লাগতে পারে।”
লিয়ার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম।লিয়া যথাসাধ্য নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।এই সময় অতিরিক্ত টেনশনের ফলে যদি জ্ঞান হারায়। তাহলে কি হবে? আল্লাহ মালুম।তাই টেনশন মুক্ত রাখার জন্য নিজের সাথে একপ্রকার যু”দ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।এমন সময় কেউ একজন জোরে বলছিলো,, অনেকেই আহত হয়েছে। রাস্তা র>ক্তে লাল হয়ে আছে।
কথাটা শ্রবণ হওয়ার সাথে সাথেই লিয়ার মাথা ঘুরে যায়।এমনিতেই শরীরটা অসুস্থ লাগছিলো।আবার ব্লাড এর কথা শুনে।লিয়ার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।লিয়া আচমকা একহাতে জারিফের বাহুর জ্যাকেটের অংশ খামচে ধরে।অন্যহাত নিজের মাথায় চেপে ধরে।জারিফ অবাক হয় সাথে বিরক্ত। জারিফ কড়া করে লিয়াকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে যাবে তখন জারিফের নজর পড়ে লিয়ার ফ্যাকাসে বিবর্ণ মুখে। লিয়ার কোনো সমস্যা হয়েছে সেটা বুঝতে পেরে জারিফ চিন্তিত হয়ে শুধালো,,
“এ্যনি প্রবলেম? সামথিং হ্যাপেন্স?”
লিয়া জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে।লিয়ার দুচোখে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসছে।লিয়া কোনোরকমে নিজেকে সামালে নেয়।লিয়া বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়। অতঃপর লিয়ার নজর যায় নিজের হাতের দিকে। এখনো জারিফের জ্যাকেট খামচে ধরে আছে।এটা দেখে লিয়ার অস্বস্তি হয়। লিয়া দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাথা নুইয়ে বলতে থাকে,,”তেমন কিছু নয়।ঠিক আছি।”
কথাটা শেষ করে লিয়া ধীর পায়ে হেঁটে গাড়িতে এসে সিটে গা এলিয়ে দেয়।লিয়ার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে।আজকেই যেনো একসাথে সব সমস্যা হওয়ার ছিলো।লিয়ার গাড়িতে উঠা পর্যন্ত জারিফ লিয়াকে লক্ষ্য করে।মেয়েটা অসুস্থ তা বুঝে আসতেই জারিফ বাইরে থেকে গাড়িতে চলে আসে।লিয়া চোখ বন্ধ করে আছে।
প্রায় দুই ঘন্টা খানেক পর রাস্তা ছেড়ে দেয় পুলিশ। অতঃপর সকল গাড়ি চলতে শুরু করে। প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় লিয়ার মাথা ছিঁড়ে আসছে এমন অবস্থা হয়েছে।পেছনে ঝাঁকুনির জন্য মাথা ব্যাথাটাও বাড়তে থাকে।সাথে লিয়ার গা গুলিয়ে আসছে। লিয়ার মনে হচ্ছে বমি হবে।এমন সময় হঠাৎ করেই লিয়া গড়গড় করে সব উগড়ে দিতে থাকে।লিয়া বমি করে নিজের গা ভাসিয়ে দেয়।মেয়েটার যে শরীর খা’রাপ করছে এটা জারিফ তখনই বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু এতটা হবে ভাবতে পারেনি।জারিফ গাড়ির সিটের সাথে রাখা নিজের মামের ওয়াটার বোটলটা লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়।লিয়া জারিফের দিকে ক্লান্তিভরা চোখে মুখে তাকাতেই।জারিফ কন্ঠে শীতলতা নিয়ে বলে উঠলো,,
“কুলি করে নিন।আর চোখে মুখে পানির ছিটা দিন।”
লিয়া একহাতে জারিফের থেকে বোতল নেয়।সব বমি লিয়ার গায়ে জড়ানো শালের উপর পড়েছে। গন্ধে লিয়ার আরো বেশি বমি পেতে থাকে। অবশেষে লিয়া অন্যহাতে শালটা গা থেকে ছড়িয়ে নেয়।তারপর জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।বমি টমি এমনিতেই লিয়ার সয্য হয়না।আবার এর গন্ধ নাকে আসা মানেই আরো বমিকে ইনভাইট করা।বমির গন্ধে গা গুলানো আরো বাড়বে।তাই লিয়া এমন কান্ড করে বসে। জারিফ লিয়ার পুরো কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করছে।লিয়া কুলি করে চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়।ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি খায়।জারিফ পকেট থেকে টিস্যু বের করে লিয়াকে দেয়।লিয়া নিয়ে মুখ মুছতে থাকে।এদিকে লিয়ার ভীষণ শীত করতে থাকে।গায়ে কোনো শীতের পোশাক না থাকায়।লিয়া দুইহাত কচলাতে থাকে। জারিফ পুরো বিষয়টা বুঝতে পেরে লিয়াকে বলে,,
“শালটা তো দিলেন সোজা জানালা দিয়ে ফেলে।আর ওটা দিয়ে এখন কিই বা করতেন।যাইহোক, এক্সট্রা শীতের পোশাক থাকলে পড়ে নিন।এমনিতেই আপনি অসুস্থ।”
লিয়া করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,” এক্সট্রা কিছুই আমার কাছে নেই।ব্যাগে আছে।আর ব্যাগ তো বক্সে আছে।”
জারিফ কন্ট্রাকটরকে ডেকে বলে বিষয়টা। কিন্তু কন্ট্রাকটরের,এক গেয়ে কথা শুনে জারিফের মেজাজ খা’রাপ হয়ে গেলো।এখন নাকি গাড়ি থামানো সম্ভব হবে না। এমনিতেই অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে।শীতের দিন যাত্রীরা রেগে যাবে দেরি হলে।গাড়ি দাঁড় করিয়ে বক্স থেকে ব্যাগ বের করতে হবে।অনেকের ব্যাগ আছে। সেখানে টোকেন দেখে দেখে নামানো।সময় সাপেক্ষ তাই কিচ্ছুতেই রাজি হলো না।
পাশের মানুষটা লিয়াকে নিয়ে ভাবছে এটা দেখে এত অসুস্থতার মাঝেও কোথাও যেনো ভালোলাগা কাজ করছে লিয়ার মধ্যে।শরীর খা’রাপের মাঝেও লিয়ার সুন্দর ফিলিংস হতে থাকে।শীত সেই ফিলিংস টাকে টিকতে দিচ্ছে না।শীতে লিয়া জুবুথুবু হয়ে আসছে।লিয়া হাতের তালু ডলতে থাকে।লিয়ার পাতলা ওষ্ঠদ্বয় শীতে কাঁপছে। কোল্ড এলার্জি থাকায়।লিয়ার হাত হালকা লাল হতে থাকে।সাথে চুলকাতে থাকে।লিয়ার এহেন অবস্থা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে জারিফ। লিয়ার অসুস্থতা দেখে জারিফের মায়া হয়।একটা মানুষ অসুস্থ।তাকে হেল্প করা মানবতার ব্যাপার।মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ।তার উপরে শীতে কাঁপছে।যদি সিরিয়াস কিছু হয় ।এটা মনে হতেই জারিফ নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়।লিয়া এটা দেখেও নির্বিকার থাকে। সেইসময় জারিফ কন্ঠে একরাশ শীতলতা নিয়ে বললো,,
“এটা পড়ে নিন।শীতে কাঁপছেন তো।আর আপনার মেবি কোল্ড এলার্জি আছে।তাই এভাবে থাকা আপনার জন্য রিস্ক হবে।”
লিয়া অবাক চাহনিতে চেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো,,”আপনি আমাকে দিচ্ছেন।আর আপনার শীত করবে না?”
জারিফের থেকে সোজাসুজি উত্তর এলো,,”আমার থেকেও এটা আপনার বেশি প্রয়োজন। কারনটা তো বললাম।আপনি অসুস্থ।আর আমার পাশে আপনি।আপনার কিছু হলে উৎসুক জনতা আমাকেই প্রশ্ন করবে।কি হয়েছে? আমি কেনো খেয়াল করিনি,হেনোতোনো।সাহায্য কেউ করবে না।অথচ দোষ ধরার বেলায়,একধাপ এগিয়ে থাকবে।সো লেইট না করে জলদি পরে নিন।”
জারিফের কথাটা লিয়ার মনোঃপুত হলো না।লোকজনের কথা ভেবে জারিফ লিয়াকে হেল্প করছে।এরকমটা শুনে লিয়া আশাহত হয়।ইশ!নিজে থেকে অদৃশ্য টান থেকে যদি কেয়ার করতো।তাহলে কি এমন ক্ষতি হতো।শুধু হিউম্যানিটি ছাড়া যদি বেশি কিছু হতো।তবে আমি নিজেকে লাকী মনে করতাম।রিজন,আই হেভ লস মাই সেন্স টু সী ইউর এটিটিউটড।লিয়াকে চুপচাপ দেখে জারিফ আর দ্বিতীয় কথা না বলে সোজা জ্যাকেটটা লিয়ার কোলের উপর দেয়।লিয়া কিছুক্ষণ জিদ ধরেই থাকে পড়বে না বলে।তবে শীত বোধহয় লিয়ার সেই জিদটাকে টিকতে দিলো না।তাইতো লিয়া হাড়কাঁপানো শীতের কাছে পরাজিত হয়ে জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিলো।জ্যাকেটের থেকে কড়া পারফিউমের স্মেইল আসছিলো।লিয়া নাক টেনে সুঘ্রাণ নিতে থাকে।দুইহাতে জ্যাকেটটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নেয়।বমি করার জন্য লিয়ার শরীর অনেকটা দুর্বল হয়।শরীর দুর্বল হওয়ার জন্য চোখ বন্ধ করে থাকার একপর্যায়ে লিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। গাড়ি আবার চলার আগে লিয়া বাসায় ফোন করে বলেছিলো,গাড়ি চলছে।শরীর খা’রাপ লাগছে সেসব আর বলেনি এমনিতেই অনেক রাত হয়ে যাবে।এই নিয়ে বাসার সবাই অনেক টেনশন করছে।তার উপর অসুস্থতার কথা বলা মোটেও সমীচিন হবে না।লিয়া মনে করে।তাই অসুস্থতার কথা বলেনি।
জারিফের গায়ে টিশার্ট।হালকা শীত করছে।তবে সেসবে পাত্তা নেই।জারিফ বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আছে।এমন সময় জারিফের কাঁধের উপর কিছু পড়ে।জারিফের বুঝতে বাকি থাকে না।লিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।আর ঝাঁকুনির ফলে লিয়ার মাথাটা নিজের সিট থেকে সরে জারিফের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।জারিফ লিয়ার ঘুমন্ত ফেসের দিকে তাকিয়ে দেখে। মনে হচ্ছে নিশ্চিতে প্রশান্তিতে বিভোরে ঘুমাচ্ছে।ডাকতে গিয়ে জারিফ থেমে যায়।ভাবে,থাক অসুস্থ যেহেতু কি আছে ডেকে ঘুমটা ভেঙে দেওয়ার।তাইভেবে জারিফ একহাতে আলতোকরে লিয়ার মাথাটা সিটে ঠিক করে দেয়। ঝাঁকুনির দরুন এরকম মাঝে মাঝেই হতে থাকে।আর প্রতিবার লিয়ার মাথাটা সিটে ঠিক করে দেয়। তিন-চার এরকমটা হওয়ার পর।জারিফ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। অবশেষে জারিফ চুপচাপ থাকে।লিয়ার মাথাটা জারিফের কাঁধের উপর থাকে।জারিফের কাঁধে মাথা রেখে লিয়া প্রশান্তিময় ঘুমাচ্ছে।জারিফ যদিও প্রচন্ড বিরক্তবোধ করছে। নেহাত-ই অসুস্থ মানুষ দেখে কিছু বলতেও পারছেনা।আর মেয়েটা তো ঘুমিয়ে আছে।তারও বা দোষ কিসের?দোষ সব তো সিচুয়েশনের।
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]
(আগামী পর্বে বর্তমানে চলবে আসবো। আজকেই চেয়েছিলাম তা হলো না।আর আগামীকালকে আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ)